আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-৯

0
3098

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -৯

নিকষ কালো আঁধার কাটিয়ে নব এক প্রভাতের সূচনা ঘটেছে। জানালার কার্নিশ ছুঁয়ে সূর্যের প্রথম কিরণ রুমে প্রবেশ করার প্রয়াস চেষ্টায় মত্ত। চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকাল ঝুমু। তুলি বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। শেষ রাতে হালকা গোঙানির আওয়াজ কানে আসতেই ঝুমু হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এসেছিল ঘুমের রাজ্য হতে। তুলির কপালে হাত দিতেই চমকে উঠল সে। জ্বর এসেছে মেয়েটার। সে আঁতকে উঠে আদ্রর রুমের সামনে দৌড়ে এসে উপস্থিত হলেও ডাকল না। সারাদিনের দীর্ঘ জার্নি ও বিয়ের নানা আয়োজনের ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু ঘুমানোর সুযোগ পেল সবাই। তাই আর কাউকে বিরক্ত না করে জেগে থেকে নিজেই জলপট্টি দিল। শরীরের উত্তাপ কিছুটা কমে এসেছে বুঝতেই আবারও ঘুমের রাজ্যে ডুব দিয়েছিল ঝুমু। বিছানা ছাড়ার আগে তুলির কপালে হাত দিয়ে শরীরের তাপ টা পরখ করে নিল সে। আগের চেয়েও কিছুটা স্বাভাবিক। ‘ ঘুম থেকে জাগলে ওষুধ খাইয়ে দিব।’ মৃদু হেসে কথাটা বলে ওয়াশরুমে চলে এল। ফ্রেশ হয়ে রুমের বাহিরে আসতেই দেখতে পেল এখনো সবাই ঘুম থেকে জাগে নি। পা বাড়িয়ে সকালের শুদ্ধ নির্মল হাওয়া উপভোগ করতে ছাদে এসে উপস্থিত হল। কিছুটা এগিয়ে যেতেই ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে এল ঝুমুর। আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে একটা ছেলে। ছেলেটা টের পাওয়ার আগে ঝুমু তড়িঘড়ি করে যেতে নিলেও আটকা পড়ল একটা বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে। স্তম্ভিত হয়ে গেল ঝুমু। পিছন থেকে ছেলেটা তার হাত টা শক্ত করে টেনে ধরে রেখেছে। ঝুমু ভয়ার্ত চোখে সিঁড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হাতে জোরালো টান অনুভব করতেই দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল,

‘ ছাড়ুন আহান স্যার। কেউ দেখলে আপনার কিছু হবে না কিন্তু আমার অনেক কিছু হয়ে যাবে। আপনার মতো একাধিক গার্লফ্রেন্ড,বয়ফ্রেন্ড রাখার সাহস আমার ফ্যামিলি আমাকে দেয় নি। একটা রাখারও অনুমতি নেই। ‘

ঝুমুর তীক্ষ্ণ বানে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল আহান। বিন্দুমাত্র রাগ হচ্ছে না তার বরং চারটি দিন মেয়েটা থেকে দূরে থেকে মরুভূমির ন্যায় প্রখর উত্তপ্ত তার হৃদয়। মেয়েটা কে এক পলক দেখলেই যেন তার সমস্ত পিপাসা মিটবে,পিপাসায় কাতর কন্ঠনালিতে এক ফোঁটা জলের সঞ্চার হবে। ঝুমুর হাত টা টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে এল। আকস্মিকতায় ভড়কে গেল ঝুমু। আহান কে পিছু ফিরে কিছু বলার পূর্বেই তাকে পিছন থেকে কোমরে হাত পেচিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল দুটো হাত। ধরাস করে কেঁপে উঠল ঝুমু। কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ ককক,কি করছেন স্যার?’

‘হুঁশ!’

ঝুমু কে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল আহান। কানের পিঠে নিজের ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে, ফিচেল স্বরে বলে উঠল,

‘ স্যার আমি ভার্সিটিতে, তোমার বাড়িতে নয়। তোমার সাহস হলো কি করে বাড়িতে এসে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার?’

‘ আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে। আমাকে আপনার কি প্রয়োজন?’–কঠোর প্রতিবাদী স্বর ঝুমুর।

‘ বউ আর গার্লফ্রেন্ড কি এক?যদি এক নাহয়, তবে আমার বউ প্রয়োজন। ‘

আহানের বেসামাল কথা কর্ণধার হতেই আগ্নেয়গিরির তো জ্বলে উঠল ঝুমু। নিজের পেটে বিচরণ করা আহানের ফর্সা হাত দু’টো তে নখ বিঁধিয়ে দিল প্রচন্ড জোরে। ব্যাথা ককিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই ক্ষীণ হাসির রেখা প্রতীয়মান হল ঠোঁটের কোণে। ঝুমুর কানের পাতায় কামড় বসিয়ে ক্ষান্ত হল সে। সাথে সাথেই ঝুমু চিল্লিয়ে বলল,

‘ ছাড়ুন কুমিল্লার রাক্ষস। ছাড়ুন আমার কান।’

আহান দুষ্টমির সুরে বলল,

‘ আমি কুমিল্লার রাক্ষস হলে,তুমি কি বান্দরবানের পাহাড়ি পেত্নী? ‘

আহানের হাত দু’টো ছাড়িয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে আহানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল ঝুমু। তেলে ভাজা বেগুনের মতো জ্বলে উঠার আগেই আহান কোমড় আকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। নির্মল স্বরে বলল,

‘ শুনো পেত্নী,,!’

‘কি?’- চোখ পাকিয়ে।

‘ আনিসা আমার গার্লফ্রেন্ড নয় বরং তোমাকে রাগানোর জন্যই মিথ্যে বলেছে সে। ও শুধু কলেজ লাইফের বান্ধবী।’

‘ বিশ্বাস করি না।’–মুখ বাঁকিয়ে বললো ঝুমু।

‘ বিশ্বাস না করলেও আমি তোমায় ছাড়তে পারব না।’

ঝুমুর নাকে নাক ঘষতে ঘষতে কটাক্ষ করল আহান। আলতো করে একটা চুমু খেল ঝুমুর লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠা গালে।

আহান রাজশাহীর একটা ভার্সিটির টিচার। সেই ইউনিভার্সিটিতেই দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ঝুমু। স্টুডেন্ট হিসেবে আহানের সাথে পরিচয়,তারপর আত্মীয়তার সূত্রে যোগাযোগ, অতঃপর প্রণয়। আজ চারদিন হয়েছে বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে এসেছে সে। আহান কে বলে আসে নি। বাড়িতে আসার পর থেকে তার মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তীব্র অভিমান ছিল তার আহানের উপর। বিয়ে,অভিমান সব মিলিয়ে আহানের সাথে যোগাযোগ করে নি সে।কিন্তু তার তো ধারণা ছিল আহান এখানে আসবেই। কারণ তুলির খালাতো ভাই যে আহান তা সে জানে। সকল অভিমান ভুলে গিয়ে আহান কে ঝাপটে ধরল ঝুমু। সকালের স্নিগ্ধতায় নীল গগনে অভিমানগুলো এক ঝাঁক পাখির ন্যায় উড়ে গেল মহা আনন্দে।
________

গোধূলি লগ্ন ছাড়িয়ে রাতের ঘন কালো আঁধারে ডুবে গেছে প্রকৃতির সজীব রূপ। চারদিকে ব্যস্ত সবাই রেডি হতে। আজ সারাটাদিন সবার ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে গেছে। বোনের হলুদের আয়োজনে মগ্ন আদ্র কে এক পলকও দেখার সাধ্যি হয় নি তুলির আজ। মনে অজস্র কষ্টের দানা বেঁধেছে তার। আদ্র কে না দেখতে পেয়ে বারবার শ্বাস টা ভারি হয়ে আসছে। দু’দিনের সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিগুলোর প্রখর এতোই বেশি যে তুলির মন টা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। আদ্র কে দেখতে না পারার বিতৃষ্ণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সামান্য কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে। এই নিয়ে বারো বার নিচে গিয়েছে কিন্তু প্রতিবার দেখার তৃষ্ণা মিটানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। আমরিন কালোর মধ্যে লাল পাড়ের একটা শাড়ি নিয়ে বড় বড় পা ফেলে তুলির রুমে এল। কিন্তু তুলির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। শাড়ি টা ধপ করে পাশে রাখল আমরিন। তুলির অনিচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে শাড়িটা পড়িয়ে দিল। তারপর নিজেও লাল একটা শাড়ি পড়ে রেডি হলো। অলরেডি সবাই প্রস্তুত হয়ে ইনশিতা কে নিয়ে স্টেজের কাছে চলে গেছে। আমরিন তুলি কে নিয়ে উঠতে গেলে তুলি আকুতি ভরা ব্যাকুল কন্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ আদ্র ভাইয়া কোথায়?’

কিয়ৎপরিমাণ চমকাল আমরিন। নিজের বিচক্ষণ দৃষ্টি তাক করতেই আন্দাজ করে নিল কিশোরী তুলির মনের অবস্থা। আলতো হেসে ভ্রু নাচিয়ে জবাব দিল আমরিন,

‘ ভাইয়া মাত্র রুমে গেল। কেনো বলতো?’

আমরিনের কথার জবাব দেওয়ার পিছনে সময় ব্যয় করে নিজের চোখের তৃষ্ণা আর বাড়াতে চাইল না তুলি। তড়িৎ গতিতে পা বাড়াতে বাড়াতে শাড়ির আঁচল টা কোমরে গুঁজে ছুটে যেতে লাগল আদ্রর কাছে। কাউকে পরোয়া করার সময় তার নেই । এই মুহুর্তে সে কেবলই একজন তৃষ্ণার্ত আবেগী কন্যা। যার তৃষ্ণা নিবারণের সাধ্যি একমাত্র ‘আদ্র’ নামক মানুষটার। কিন্তু তুলির মনে সূর্যের প্রবল উত্তাপে সৃষ্ট মাটিতে ফাটলের ন্যায় ফাটল সৃষ্টি হবে তা কি সে আদৌও জানত!জানত না। জানলে হয়ত উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসত না। অজানা আশঙ্কায় অন্তর টা মোচড় দিয়ে উঠল তুলির। চোখ দুটো তাকে ধোঁকা দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে দিতে লাগল অশ্রু। আদ্রর রুমের দরজার থেকে ছুটে আসল রুমে। দরজা লাগিয়ে পা দুটো ভেঙে ফ্লোরে নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়ল । শাড়ির আঁচল টা ছুটে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। তুলি পাথরের মতো স্থির, নিস্তেজ। বাহ্যিক নিস্তেজ হলেও অভ্যন্তর টা?তুলির অভ্যন্তর টা ভালোবাসা না পাওয়ার আকুলতায় আর্তনাদ করছে। সেই দৃশ্য তাকে উপলব্ধি করিয়েছে ভালোবেসে ফেলেছে সে। ভালোবেসে ফেলেছে তার ডাক্তার সাহেব কে। নেত্রযুগল থেকে অবাধ্য জল অবলীলায় ভিজিয়ে যাচ্ছে গাল। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে তুলি চিল্লিয়ে বলে উঠল,

‘ আপনাকে পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই তবু্ও আমি কেন আপনাকে চাই আদ্র,কেন চাই?আপনার জীবনে যদি আমিই না থাকি তবে কেন আমার মনে ভালোবাসার সৃষ্ট হলো আপনার প্রতি?’

তুলির প্রশ্নগুলো চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ রইল। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে এক রাশ চাঁদের আলোয় তুলির চোখের পানি চিকচিক করে উঠল। তুলি আনমনে ভাবতে লাগল,’ কাছের মানুষ গুলোর অভিনয় খুবই নিখুঁত হয়। নয়তো সামনে থেকে বুকে আগলে নিয়ে পিঠে কিভাবে ছুরি গাঁথে! নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে তার। আদ্র তো কখনও তাকে বলে নি ভালোবাসে,কারণ আদ্রর জীবনে পারফেক্ট কাউকে মানায় তার মতো গ্রাম্য মেয়েকে নয়।’

#চলবে,,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

পিক ক্রেডিট ঃ Rubi Rubi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here