একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ৬০
“আমার চোখ থেকে জলেদের যে যোজন
যোজন দূরত্ব
বাড়ছে তার দোষের ভার তুমি ছাড়া আর কে
নিবে?”
“ঝিকিমিকি সূর্যটা চন্দ্রের প্রেমে যে
অবিরত পুড়ছে তা
এই আমি ছাড়া আর কে বুঝবে?”
এতটুকু লিখেই কূজন ডায়েরি বন্ধ করে রাখলো।
চোখের চশমাটা খুলে শার্টের কোণা দিয়ে
মুছে পরিষ্কার করলো। কূজনের চোখ বারবার
ঝাপসা হয়ে আসছে। কুহুর কথাটা কানে
বাজছে, বুকেও বিঁধছে। কলরব আর কূজনের
মাঝে আসলেই আকাশ পাতাল পার্থক্য। কূজন
কখনোই কলরবের মতন হতে পারবে না। কূজনের
হঠাৎ মরে যেতে ইচ্ছে হলো। অপমানে আয়নার
সামনে দাঁড়ানোর মতন সাহস খুঁজে পাচ্ছে না।
ভালোবাসার মানুষটার কাছে আজ সে চরম
অপমান হয়েছে। বুকের পাঁজর বেদনা সহ্য করতে
করতে ক্লান্ত হয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে
ইচ্ছে হচ্ছে। কুহুর যে চোখে কূজন ভালোবাসা
খুঁজে বেড়ায় সে চোখজোড়ায় আজ শুধু ঘৃণা।
কূজন তবুও কুহুর পিছু ছাড়বে না। ভালোবাসার
কাছে এই ঘৃণাকে সে পাত্তা দিবে না। আরো
শক্ত হতে হবে তাকে। কুহুকে নিজের করে
পেতেই হবে। এই বুকের খাঁচায় কুহুকে বন্দি
করে রাখবে, ভালোবাসার গান শুনাবে সে।
কুহুর প্রেমের ডাক
শোনার জন্য কূজন আকুল হয়ে আছে। কিন্তু কুহু
কি কখনো বুঝবে? কুহুর মনে কখনো কি কূজন
জায়গা করে নিতে পারবে না? কুহুর ঘৃণা
নিয়েই কি কূজনকে মরতে হবে? আর ভাবতে
পারলো না। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো।
ডায়েরিটা বালিশের নীচে রেখে বালিশে
মুখ গুঁজলো। হঠাৎ করে কূজনের মনে হলো
জীবনটা এমন কেনো? সত্যিকার
ভালোবাসাগুলো কেনো এভাবে হেরে যায়?
বেদনাই কি ভালোবাসা? এ জীবনে
ভালোবাসা বলতে কিছু নেই যা আছে তা
হলো বেদনা। প্রেমিক বলতেও এই ধরায় কেউ
নেই, যারা আছে তারা হলো কষ্টের কুণ্ডলী।
এই পৃথিবীতে কোনো প্রেয়সীও নেই, আছে শুধু
বাধ ভাঙা কান্না। প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছে
কূজনের যা কখনোই বুঝানো সম্ভব না।
দীর্ঘশ্বাস সঙ্গী করে বিছানায় শরীর এলিয়ে
শুয়ে আছে কূজন। ইরিন রুমে উঁকি দিয়ে কূজনকে
শুয়ে থাকতে দেখে রুমের দরজায় নক করলো।
কূজন ঘাড় ঘুরিয়ে ইরিনকে দেখতে পেল। মুখে
হাসি ফুটিয়ে বলল,
– কিছু বলবে সোনার হরিণ?
ইরিন বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
– আঙ্কেল এসেছেন, তোমার সাথে দেখা
করার জন্য।
বাবার কথা শুনে কূজন ধরফরিয়ে উঠলো।
তারপর বলল,
– কখন এসেছে?
– এই মাত্র।
কূজন তাড়াতাড়ি করে হন্তদন্ত হয়ে রুম ছেড়ে
বেরিয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে যেয়ে বাবাকে না
পেয়ে কূজন বেশ অবাক হলো। ইরিন এসে বলল,
– ভাইয়া আঙ্কেল আমার রুমে।
কূজন ইরিনের রুমের দিকে পা বাড়ালো। ঠিক
তখনই হাসনাদ সাহেব রুম ছেড়ে বেরিয়ে
এলেন। বাবাকে দেখেই কূজন জড়িয়ে ধরলো।
হাসনাদ সাহেব বললেন,
– কেমন আছো প্রিন্স?
– ভালো বাবা,তুমি?
– আমিও ভালো। হঠাৎ তোমার সাথে দেখা
করতে ইচ্ছে হলো তাই চলে এলাম।
কূজন খুশি হয়ে বলল,
– বেশ করেছো বাবা।
হাসনাদ সাহেব কূজনের কাঁধে হাত রেখে
বললেন,
– চলো তো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
– চলো বাবা।
হাসনাদ সাহেব আর কূজন বাইরে বেরিয়ে
গাড়িতে এসে বসেছে। হাসনাদ সাহেব
ড্রাইভার শামসুকে বাইরে যেয়ে দাঁড়াতে
বললেন।শামসু চলে যেতেই নরম সুরে বললেন,
– কূজন তুমি কি জানো তুমি যে তোমার মায়ের
চোখের মণি, আমার আদরের একমাত্র প্রিন্স?
কূজন কিছু বলল না চুপ করে রইল। হাসনাদ
সাহেব একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন,
– শুনো তুমি কুহুর পিছন পিছন ঘুরা বন্ধ করে
দাও।
বাবার কথা শুনে কূজন স্তব্ধ হয়ে গেল। কি
বলছে কি বাবা? কূজন ভেবেছিল ওর বাবা
নিশ্চই এতে খুশি হবে কিন্তু এমন কেনো বলল
মিলাতে পারলো না। কূজনকে স্তব্ধ হয়ে
থাকতে দেখে হাসনাদ সাহেব বললেন,
– কূজন তুমি কোথায় থাকো,কি করো না করো
সব আমার জানা আছে। যেদিন থেকে কুহু
কলরবের বিয়ে ঠিক হয়েছে সেদিন থেকেই
আমি তোমাকে নজরে নজরে রাখছি। কেনো
করছো এমন? কুহুর চোখের ঘৃণার বাণ তোমাকে
তিলে তিলে মেরে ফেলবে।
কূজন শান্ত স্বরে বলল,
– বাবা আমি যেকোনো মূল্যে কুহুকে বিয়ে
করতে চাই।
হাসনাদ সাহেব ভরসা দিয়ে বললেন,
– এক সপ্তাহ সময় দাও বাবা কুহু তোমারি হবে।
শুধু শুধু ওর কাছে তুমি নিজে খারাপ সেজো
না। তাহলে কোনোদিনও ভালোবাসা পাবে
না। কুহুকে পাইয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার উপর
ছেড়ে দাও।
– না বাবা কুহুকে আমি নিজের ভালোবাসার
জোরে পেতে চাই।
– এটাকে কি ভালোবাসা বলে কূজন? তুমি
কয়েকদিন ধরে যা করছো তাকে জোর
খাটানো বলে, ভালোবাসা না। জোর করে
যেহেতু কুহুকে পেতে হবে তাহলে সে জোরটা
তুমি না করে আমি করি। দেখো কূজন মেয়েরা
পাগলের মতন যেমন করে ভালোবাসতে জানে
তেমনি পাগলের মতন ঘৃণাও করতে জানে। তুমি
কি চাও, কুহু তোমাকে ঘৃণা করুক? আমি বলি কি
কুহুর তোমার প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও
চলবে তবে ঘৃণা থাকলে চলবে না। সংসার
ভালোবাসা ছাড়াও করা যায় কিন্তু ঘৃণাকে
সঙ্গী করে কখনো সংসার করা যায় না।
আমাকে আর তোমার মাকেই দেখো। আমরা
খুবই সুখী দাম্পত্যজীবন কাটাচ্ছি অথচ
আমাদের মাঝে ভালোবাসা ছিল না। আমি
কথা দিচ্ছি কুহুর বিয়ে তোমার সাথেই হবে।
তবে তুমি কুহুর সাথে জুরাজুরি করা বন্ধ করে
দাও নয়তো বিয়ের পরও কুহু কোনোদিন
তোমাকে মেনে নিবে না।
কূজন বাবার সব কথা শুনে বলল,
– বাবা আমার বিশ্বাস আছে আমি কুহুকে জয়
করতে পারবো সো তুমি প্লিজ এসবের মধ্যে
এসো না। ইটস আর্নেস্ট রিকুয়েস্ট।
হাসনাদ সাহেব কিছু বললেন না। কূজন বাবার
জবাবের অপেক্ষা করে জবাব না পেয়ে বলল,
– বাবা আমি আসছি, পরে কথা হবে। তবে বলে
রাখছি কুহু আর আমার মাঝে আমি কোনো
ইন্টারফেয়ার চাই না।
হাসনাদ সাহেব ছেলের কথা শুনে চমকে
ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
…
কুহু রান্নাঘরে রুটি বেলছিল। পিহু দৌড়ে এসে
ফোন দিয়ে বলল তোর ব্যাংক আর আমার
এটিএম কার্ড ফোন দিয়েছে।
কুহু বলল,
– তাড়াতাড়ি ধরে আমার কানের সাথে চেপে
ধর।
পিহু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
– ইশ্ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি?
– প্লিজ পিহুন প্লিজ। দেখছিস না রুটি বেলছি,
এখন রুটি বেলা বাদ দিয়ে কথায় লাগলে আম্মু
এসে বকবক করবে।
– আমার পড়া আছে।
– প্লিজ পিহুন তুই এতো পাথর কেনো?
– আমি এমনি।
– প্লিজ প্লিজ বেশিক্ষণ না পাঁচ মিনিট
তারপর রেখে দিব। কাজ শেষ করে আবার কথা
বলবো।
– স্পিকার দেই তাহলেই হলো।
– ধুর গাধী!
পিহু হতাশ হয়ে বলল,
– গাধী আবার অন্যকে গাধী বলতে আসে।
– তাহলে ইয়ার ফোনটা এনে দে।
– দিচ্ছি! এটা ভালো আইডিয়া। প্রেমে পড়ে
তোর উন্নতি হচ্ছে।
কুহু বিরক্ত হয়ে বলল,
– এখন তোর পড়া নষ্ট হয় না?
তাড়াতাড়ি যা!
পিহু ইয়ার ফোন কুহুর কানে গুঁজে দিয়ে চলে
গেল। কুহু হ্যালো বলতেই কলরব বলল,
– ফুলটুশী সরি! সরি! সরি! সরি! সরি! সরি!…
এতোবার সরি শুনে কুহু হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর
বলল,
– কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
– শুনো না অফিস থেকে না খুব বেশি চাপ তাই
আসতে পারছি না। তুমি প্লিজ রাগ করো না।
অনেক ট্রাই করেছি কিন্তু ম্যানেজ করতে
পারছি না। তারপরো তুমি বললে চাকুরী ছেড়ে
চলে আসবো।
কুহু বিরক্তির আওয়াজ করে বলল,
– চাকুরী ছাড়বেন কেনো? আশ্চর্য তো! পরে
খাওয়াবেন কি আমায়? আর কুহুরব,
কিচিরমিচির ওদের পালবেন কি করে?
কথাটা বলেই কুহু জ্বিহ্ব কাটলো। কি বলে
ফেললো সে। এখন কলরব প্রতিনিয়ত এটা নিয়ে
মজা করবে। ধুর ছাই!
কলরব কুহুর কথা শুনে হাসতে লাগলো। কলরবের
হাসি শুনে কুহুর আজ ভালো লাগছে না বরং
মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এভাবে হাসার কি
আছে? কিন্তু কলরবকে কিছু বলল না। একটু সময়
নিয়ে ভাবলো কলরবের উপর এই হাসির ঝালটা
মিটাতে হবে কিন্তু হাসা নিয়ে কিছু বলা
যাবে না। কিছু বললে আরো বেশি করে হাসবে
তারচেয়ে অন্য কথা বলে রাগ দেখাবে। আসতে
পারলো না এ নিয়ে অবশ্য কথা শুনাতেই পারে
কিন্তু এটা নিয়ে কিছু বলা উচিত হবে না।
বেচারা কতোবার সরি বলল। সরির কথা মনে
হতেই কুহু মনে মনে হাসলো। তারপর ভাব ধরে
বলল,
– আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে এতোবার সরি
বললেন?আপনার কান্ড দেখে মনে হয় আমি
আপনাকে টর্চার করি।
কলরব গগনবিহারী হাসি হাসতে হাসতেই বলল,
– ফুলটুশী বাঘিনী হবে আর ভাল্লুক এর ফিমেল
ভার্শন…
কলরবের কথা শেষ না হতেই কুহু রেগে বলল,
– আপনি আমাকে নিয়ে এমন ইয়ার্কি মশকারা
করেন কেনো? যা বলি তাতেই হাসাহাসি।
এসব একদম ভালো লাগো না। আমাকে আর
কোনোদিন ফোন দিবেন না। যদি আমার
নাম্বারে আপনার কল আসে তাহলে ছাদ
থেকে ধাক্কা দিয়ে আপনাকে ফেলে দিব।
কুহুর বলা শেষ হতেই কলরব বলল,
– ফুলটুশী মিসডকল আসলে হবে তো?
কুহু আরো বেশি রেগে বলল,
– একদম ফাজলামি করবেন না, ফাজিল
কোথাকার।
– ফাজিল বলছো আবার ফাজলামি করতে
নিষেধ করছো এটা কেমন হলো না? ফাজিল
যদি ফাজলামি না করে তাহলে….
কলরব পুরো কথা শেষ করবার আগেই কুহু কল
কেটে দিয়েছে। কুহু কল কেটে দিয়ে
বিশ্বজয়ীর হাসি হেসে বলল,
– এবার মিস্টার ইবনাত কলরব কাজে লেগে
যাও। ফুলটুশীর রাগ ভাঙাও এখন। হুহ! এবার বুঝো
কতো হাসিতে কতো প্যারা!
কলরব অলরেডি মিশনে নেমেও পড়েছে। একের
পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে আর কুহু তা দেখে
গুণগুণ করে গাইছে,
” রাগ করো না করো না ওগো ঝরনা বিবি…. ”
চলবে…