#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
গোলাপী রঙের বাগানবিন্যাস মৃদু পবনে উড়ছে।সবুজ রঙের পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় থোকায় সাজিয়ে রয়েছে তা।পশ্চিমাদেশ তখন অস্তাভা সূর্যের রক্তিম রঙে রঞ্জিত।থমকে যায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি ভ্রু কুঁচকে বললো–
“দাঁড়ালি কেন?
নিষ্প্রাণ শান্ত গলায় বললো—
“তুই যা,আমি ফিরবো।”
আয়েন্দ্রি কপট রাগ দেখিয়ে বললো—
“ফিরবো কী রে?বাসার সামনে এসে চলে যাবি কেন?
একরকম টেনে হিঁচড়ে নিষ্প্রাণকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে আয়েন্দ্রি।রান্নাঘর থেকে তখন ক্লান্ত মুখে বেরচ্ছিলেন ঝুমা বেগম।তাকে দেখেই অস্থির হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ।প্রাণখোলা হেসে আয়েন্দ্রি বললো–
“মা,ও প্রাণ।আই মিন নিষ্প্রাণ।তোমাকে বলেছিলাম না আমাদের ডিপার্টমেন্টের টপ।”
আলতো হাসলেন ঝুমা বেগম।নিষ্প্রাণ সাধারণ ভঙিতে তাকে সালাম প্রদর্শন করলো।আরিশা একটু দূরে দাঁড়িয়েই নিষ্প্রাণকে দেখছিলো।ফর্সা মুখের শান্তশিষ্ট নিষ্প্রাণকে আরিশার কাছে একটা রোবট মনে হলো।যেনো কেউ নাড়ালেই নড়বে,নাহয় চুপ করে থাকবে।আরিশাকে কাছে ডেকে নেয় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই মিষ্টি হাসে।আরাজ তখন বাইরে।ঝুমা বেগমকে ফটাফট কিছু খেতে দিতে বলে ফ্রেশ হতে যায় আয়েন্দ্রি।চুপচাপ হয়ে বসে আছে নিষ্প্রাণ।তার পা দুটো সমানতালে কাঁপছে।প্রায় পনেরো মিনিট পর এসেও আয়েন্দ্রি দেখতে পায় নিষ্প্রাণকে কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি।মুখটা তিরিক্ষি করে রান্নাঘরে যেতেই দেখে ঝুমা বেগম নীরব দাঁড়িয়ে আছেন।আয়েন্দ্রি খরখরে গলায় বললো—
“ওকে কিছু দাও নি কেন মা?
ঝুমা বেগম সরল গলায় বললেন—
“বাসায় কিছু নেই।আরিশাকে নুডলস আনতে পাঠিয়েছি।এলো বলে।”
সেই মুহূর্তে আরিশা রান্নাঘরের চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে।আয়েন্দ্রি ব্যস্ত গলায় বললো—
“থাক,তুমি যাও।আমি রান্না করছি।তুমি রেস্ট করো।”
ঝুমা বেগম অবিশ্বাস নিয়ে বললেন—
“তুই পারবি?
“আরে পারবো,পারবো।”
মুখ চিপে হেসে ফেলে আরিশা।টগবগে চোখে তাকায় আয়েন্দ্রি।তার চাহনিতে বিলীন হয়ে যায় আরিশার হাসি।
বাটিভর্তি নুডলস নিষ্প্রাণের সামনে রেখে তার পাশেই বসে আয়েন্দ্রি।চকচকে চোখে তাকিয়ে বললো—
“সরি,একটু লেট হয়ে গিয়েছে।খা।”
নিষ্প্রাণ বিনাবাক্য ব্যয়ে নুডলসের বাটি হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে।আয়েন্দ্রি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।আজ অন্তত খাওয়ার মতো রান্না করেছে সে।রান্নাঘর থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই শশব্যস্ত হয়ে সেদিকেই ছুট লাগায় আয়েন্দ্রি।আরিশার সামনেই পড়ে আছে নুডলস সমেত বাটি।অরুণলোচনে চেয়ে রাগী গলায় শাসিয়ে উঠে আয়েন্দ্রি—
“এই,তুই কী বাচ্চা?একটা বাটি সামলাতে পারিস না?
আরিশা নাক ছিঁটকে বললো–
“ছিঃ!
কী রান্না করেছো এইসব?বমি আসতেছে আমার।ইয়াক!
আয়েন্দ্রির মুখটা ক্ষণপলেই পাংশুবর্ণ হয়ে যায়।বসার ঘরে এসে দেখে নিষ্প্রাণ প্রায় শেষ করে ফেলেছে নুডলস।অধৈর্য পায়ে এগিয়ে এসে ছোঁ মেরে তার হাত থেকে বাটি ছিনিয়ে নিয়ে এক চামচ মুখে দিতেই গা গুলিয়ে আসে আয়েন্দ্রির।নাক উঁচু করে বললো–
“পাগল হয়েছিস?কী খাচ্ছিস এগুলো?
নিষ্প্রাণ সতেজ হাসে।মিষ্টি গলায় বললো–
“এর চেয়ে ভালোবাসাপূর্ণ খাবার আমি অনেক দিন খাইনা।আসি।”
দম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে আয়েন্দ্রি।হয়তো নিজের পরিবারকে মিস করছে নিষ্প্রাণ!তাদের ভালোবাসাকে মিস করছে!মায়ের হাতের খাবারকে মিস করছে!আরিশার ফিচেল কন্ঠ—
“হিরোর মতো ছেলেটাকে জিরো বানিয়ে দিলা আপু।বাব্বাহ!নিষ্প্রাণ ভাইয়া গিললো কী করে এইসব!আমি শুনেছি কেউ কাউকে ভালোবাসলে নাকি তার সবকিছুই ভালোলাগে।”
আয়েন্দ্রির হাতটা ঝাঁকিয়ে তুলে আদুরে গলায় পূনরায় বললো আরিশা—
“আপু,তোমার যদি পছন্দ না হয় তাহলে আমাকে দিয়ে দিও নিষ্প্রাণ ভাইয়াকে।আম্মু বলেছে তোমার চেয়ে আমি ভালো রান্না করতে পারি।”
আয়েন্দ্রি খেঁকিয়ে উঠে বললো—-
“মারবো এক ঠাটিয়ে চড়।যা এখান থেকে।”
,
,
,
ক্লাস শুরুর আগেই এক দফা হয়ে যায় আয়েন্দ্রিদের।আজ পেছনের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে আয়েন্দ্রি আর নিষ্প্রান।নিষ্প্রাণের বামদিকে লো বেঞ্চে পা রেখে হাই বেঞ্চে বসে আছে সীমান্ত।তাদের সামনের বেঞ্চ থেকে পেছন দিকে ফিরে বসেছে প্রাবিশ।কুসুম বসেছে পাশের সারির বেঞ্চের কোণায়।
প্রাবিশের গার্লফ্রেন্ড জাহ্নবীকে নিয়ে কথা হচ্ছে।প্রাবিশ থেকে দু’বছরের বড় জাহ্নবী।বর্তমানে একটা কিন্ডার গার্টেনে জব করে।প্রাবিশের বোনের মেয়ে সেই কিন্ডার গার্টেনে পড়ে আর ওকে বাসায় টিউশনও দেয়।সেই সুবাদে বোনের বাড়ির বেড়াতে গিয়ে পরিচয় জাহ্নবীর সাথে প্রাবিশের।সীমান্ত বক্রোক্তি করে বললো—
“মামা,বিয়ার সময় আবার না তোমার বাপ কয় মাইয়া আমার খালার বয়সি।তারে আমার পোলার লগে বিয়া দিমু না।তখন আশেপাশে আমারে খুঁজিস না।আমার আবার বয়স্ক মাইয়া দিয়া চলতো না।কচি,টসাটসা লাগবো।”
প্রাবিশ ধাম করে এক চাপড় বসিয়ে দেয় সীমান্তের কাঁধে।কুসুম খিকখিক করে হেসে বললো—
“আরে প্রাবিশ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।নিজের চেয়ে বয়সে বড় মেয়ে হলে আদরের সাথে শাষনও পাওয়া যায় বুঝলি।তুসসি গ্রেট হো মামা।”
সীমান্ত চরম অবাক হয়ে বললো–
“আরে প্রবেশপত্র এইসব ভাইবা এই কাম করছোস!কস কী?আমি চিন্তা করতাছি বাসর রাইতে তুই বিড়াল মারবি নাকি বৌদিরে দিয়া মারাবি।আই এম কনফিউসড!
প্রাবিশ অসহনীয় গলায় বললো—
“শালা তুই চুপ করবি।
“লাভ নাই মামা।আমার কোনো বোন নাই।তোর কপাল খারাপ।”
সকলের কথার মাঝখানেই অদ্ভুত কথা বলে ফেলে নিষ্প্রাণ।
“তোর বেলী ফুল পছন্দ?
আচমকা নিষ্প্রাণের এই প্রশ্ন দ্বিধান্বিত হয় আয়েন্দ্রি।সরস গলায় বললো—
“হ্যাঁ।তুই কী করে জানলি।”
নিষ্প্রাণ ভাবাবেগ ছাড়াই বললো—
“এমনি।”
সীমান্ত পেয়ে যায় আরেক চান্স।সন্দিহান গলায় বললো—
“নিষ্প্রাইন্নার তোর মতলব তো ভালা না।আন্দির উপর কালা জাদু করছোস?তুই জানোস কেমনে আন্দির বেলি ফুল পছন্দ?
সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি।আয়েন্দ্রির উৎসুকতা তরতর করে বাড়ছে।সে তো কখনো তার পছন্দ,অপছন্দের কথা নিষ্প্রাণকে বলেনি।তাহলে?
নিষ্প্রাণ হালকা করে মাথাটা হেলিয়ে আয়েন্দ্রির কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো—
“তোর গায়ের ঘ্রাণ বেলি ফুলের মতো।”
নিষ্প্রাণের এই শান্ত,শীতল কথায় জমাট বেঁধে যায় আয়েন্দ্রি।অক্ষিপল্লব প্রশ্বস্ত করে নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই রহস্য হাসে নিষ্প্রান।তখন ক্লাসে প্রবেশ করে কমলক্রান্তি।সবাই যার যার জায়গায় চলে যায়।আয়েন্দ্রি উঠতে নিলেই নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় বললো—
“এখানেই বস।”
“উঁহু।পেছনে বসতে আমার ভালো লাগে না।”
চোখে হাসে নিষ্প্রাণ।আবেশিত গলায় বললো—
“তাহলে চল,আজ তোর সাথেই বসবো।”
নিষ্প্রাণ উঠে গিয়ে সামনের বেঞ্চে আয়েন্দ্রির পাশে বসে।স্যারের দিকে নয়,আয়েন্দ্রির পূর্ণ মনোযোগ নিষ্প্রাণের দিকে।কী বললো তখন সে?
আয়েন্দ্রির দিকে একটা স্কেচ এগিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ।তারই স্কেচ।আয়েন্দ্রি অবাক হয় তার ঠোঁটের সেই লাল তিলকে হাইলাইট করা হয়েছে।পাশে সুন্দর করে লেখা ‘ধ্রুবতারা’।আয়েন্দ্রির নিষ্কম্প ব্যাকুল চাহনি।চোখটা স্যারেই দিকেই আবদ্ধ রেখে মাথা কিঞ্চিৎ হেলিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির দিকে নিষ্প্রাণ।আলতো গলায় বললো—
“আমি যদি তোর প্রাণ হই তাহলে তুই আমার ধ্রুবতারা।যে তারা তার জায়গা পরিবর্তন করে না।স্থির থাকে।আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য তুই।যার স্থান কখনো পরিবর্তন হবে না।তাই তুই আমার ধ্রুবতারা।”
অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে নিষ্প্রাণের প্রতিটি শব্দ শ্রবণ করে আয়েন্দ্রি।
চলবে,,,