মরীচিকার সন্ধানে পর্ব – ১০

মরীচিকার সন্ধানে
পর্ব – ১০

মুনিরা মসজিদের সেই মেয়েদের নামাজের জায়গায় চুপচাপ বসে আছে। নামাজ দোয়া আপাতত কিছুই ও পড়ছেনা। বসে বসে শুধু একুল ওকুল চিন্তা করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। তবে চিন্তা করাই সার। কুল কিনারা কিছু ও খুঁজে পাচ্ছেনা। মসজিদে বসে আছে ঠিকই কিন্তু কথা বলা যায় এমন কাউকে ও দেখতে পাচ্ছেনা। কাকে যে ও দেখতে চায় তাও মুনিরা ঠিক জানেনা। তারপরও বসে বসে শুধু সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে । নাহ, ওর কাউকে দেখে কিছুই মনে হচ্ছেনা। সবাইকে ওর সাধারণ মানুষই মনে হচ্ছে। ভালো মন্দ মিলিয়ে রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ।

তবে মায়মুনাকে দেখেও তো মুনিরার কখনো অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। মুনিরা অনেক চিন্তা করে দেখেছে। মেয়েটা অবশ্যই ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিলো কিন্তু বয়ঃসন্ধির মেয়েদের যেরকম বদলে যাওয়া সেইরকম। এর বাইরে তো কিছু না। মায়মুনার কাছের দুইজন বান্ধবী ছিল। কাছের মানে একেবারে জানের বান্ধবী ছিল তারা। এই তিনজনকে কিছুতেই আলাদা করা যেতোনা। একটা মেয়ে ছিল পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আর আরেকজন ইংলিশ মেয়ে। পাকিস্তানি মেয়েটার নাম ছিল সানা। মায়মুনার একেবারে ছোট বেলার বান্ধবী। মেয়েটা একেবারে বলা নাই, কওয়া নাই হঠাৎ করেই গতবছরের শুরুর দিকে ক্যান্সারে মারা যায়। একেবারে লাস্ট স্টেজে ধরা পড়েছিল ওর অসুখটা। ডায়াগনোসিসের মাত্র তিনমাসের মধ্যেই জলজ্যান্ত ফুটফুটে মেয়েটা কিভাবে হারিয়ে গেলো। সানা মারা যাবার পর মায়মুনা ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিল। এত আপসেট থাকতো যে বলার না। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছিল সেইসময়। এমনকি ওর সেই ইংলিশ বান্ধবী অলিভিয়ার থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলো। তবে এত কাছের বান্ধবীর এভাবে চলে যাওয়া মেনে না নিতে পারাই তো স্বাভাবিক। মায়মুনা যদি আপসেট না হতো, ভেঙে না পড়তো তাহলেই বরং আরো চিন্তার বিষয় ছিল। মুনিরা তাই এনিয়ে খুব বেশি ঘাটাঘাটি করেনি। ওর মনে হয়েছিল যে সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়েছিলও। কয়েক মাসের মধ্যেই ও আবার শোকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। অল্পকিছু নতুন বন্ধু-বান্ধবী জুটিয়ে সারাটাদিন মোবাইল ফোনে তাদের সাথে গুজুর গুজুর শুরু করে দেয়। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে উঠে। মাঝখান দিয়ে অলিভিয়ার সাথে কেন যেন মায়মুনার একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। বলা যায় সানার মৃত্যু ওদের এতদিনের বন্ধুত্বে একটা ফাটল ধরিয়ে দিয়ে যায়।

মুনিরার অবশ্য ব্যাপারটা সেসময় খুব একটা খারাপ মনে হয়নি। ছোটবেলায় অলিভিয়া খুবই মিষ্টি স্বভাবের একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু একটু বড় হবার পর মুনিরার অলিভিয়াকে একটু উচ্ছৃঙ্খল টাইপের মনে হতো। ওর পোশাক আশাক, সাজগোজ মুনিরার একটুও ভালো লাগতোনা। এই বয়সেই এক বয়ফ্রেন্ডও জোগাড় করে ফেলেছিলো। ওদের ক্লাসেরই এক ছেলে নাকি সেই বয়ফ্রেন্ড। মায়মুনাই একবার ভুল করে মুনিরাকে কথাটা বলে ফেলেছিলো। তখনই মুনিরা মায়মুনাকে ওর সাথে কম মেলামেশা করতে বলেছিলো। মায়মুনা কথা শুনেনি। তবে অলিভিয়া সম্পর্কে ভুল করেও এসব কথা আর মুনিরাকে বলেনি। শেষে যদি মুনিরা ওর সাথে মিশতে না দেয়। কিন্তু সানার মৃত্যুর পর মায়মুনা নিজেই যখন ওর থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো তখন মুনিরা যেন একটু স্বস্তিই বোধ করেছিল।

আর কতক্ষন এই মসজিদে বসে থাকবে মুনিরা? এখানে বসে থেকে মুনিরার মনে হচ্ছে শুধু শুধু সময় নষ্ট। মসজিদে কাউকে দেখে ওর মনে হচ্ছে না যে কোনো সাহায্য করতে পারে। বরঞ্চ সেইদিন নাজমা মেয়েটাকে দেখে মুনিরার কেমন যেন অস্থির লেগেছিলো। মুনিরা আশা করেছিল নাজমা ওকে ঠিকই একটা ফোন করবে। ওর ধারণা ভুল ছিল। এর মাঝে প্রায় পাঁচদিন পার হয়ে গেলো। মেয়েটা ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টাই করেনি। আজকে মসজিদে ঢুকার সময় মেয়েটিকে ও মেন্দি লাগাতেও দেখেনি। তাই একটু সময় নিয়ে এখানে বসে আছে। ফেরার পথে আবার দেখে যাবে নাজমা এসেছে কিনা।

মুনিরা আস্তে ধীরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসলো। বাইরে এসে বেশ হতাশই হয়ে গেলো। নাজমা এখনো আসেনি। ও বাসার দিকে রওনা হচ্ছিলো। হঠাৎ কী মনে করে মসজিদের সামনের সেই মাসালা চায়ের স্টলে গিয়ে সেই চা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো,

– আচ্ছা এখানে একটা মেয়ে মেন্দি লাগতো যে ও আর আসেনা?

– নাহ, ও এখন এই কাপড়ের দোকানে কাজ করছে। তুমি মেন্দি লাগাতে চাইলে স্টেশনের কাছে চলে যাও। সেখানে বেশ কয়েকটা স্টল আছে।

– থ্যাংক ইউ। আমাকে এক কাপ মাসালা চা দিবে?

– অবশ্যই।

ভদ্রতা করে মুনিরা চা কিনেনি। এই দারচিনি, এলাচি, বাদাম আর ঘন দুধের চায়ের মো মো গন্ধে ওর আসলেই এক কাপ চা খেতে খুব ইচ্ছা করছে। আগে প্রায় প্রতি ছুটির দিন সকাল বেলায়ই ও নিজে ঘরে জ্বাল দিয়ে শখ করে এই চা বানাতো। মুনিরা অবশ্য ওর মশলা চাতে বাদাম দেয়না। আসাদের ভীষণ পছন্দ এই চা। চা বানিয়ে নিয়ে আসাদ আর ও দুইজন গল্প ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প জুড়ে দিতো। মায়মুনা হারিয়ে যাবার পর থেকে কখনো আর এই চায়ের কথা মনে হয়নি। আসাদও দিনে দিনে কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছে। এরপর কতগুলো ছুটির দিন গেলো। আসাদও কখনো এই চায়ের কথা বলেনি। তবে আজ হঠাৎ করেই এই চায়ের গন্ধটা ভীষণ ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে ছোটোখাটো জিনিসও অনেক বড় ভালো লাগার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুনিরা খুব মন দিয়ে ডিসপোজেবল কাপে সেই চা ঢালার দৃশ্য দেখতে লাগলো। ওর কেন যেন ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে। তারপর কাপটা হাতে নিয়েই ও পাশের কাপড়ের দোকানটায় ঢুকে গেলো।

মেয়েদের সেকশনে গিয়ে কয়েকটা আবায়া ধরে নাড়াচাড়া করতেই ও নাজমার দেখা পেয়ে গেলো। নাজমা ওর কিছু হেল্প লাগবে নাকি তা জানার জন্য মনেহয় এগিয়ে আসছিলো। কিন্তু মুনিরাকে দেখা মাত্রই একেবারে ভুত দেখার মতো চমকে গেলো। চমকে গেলেও খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে ধাতস্ত করে নিয়ে হাসিমুখে বলে উঠলো,

– আস্সালামুআলাইকুম সিস্টার। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

– ওহ, তুমি এখানে কাজ করছো এখন? তোমাকে তো বাইরে খুঁজছিলাম।

– তাই, কেন? হাতে মেন্দি লাগানোর জন্য।

– হ্যা, কিন্তু আমার জন্য না। আমার দুই মেয়ে তো সেইদিন আমার হাতের মেন্দি দেখে পাগল হয়ে গেছে। আমি ওদের প্রমিজ করেছি যে ওদের হাতেও ঠিক আমার ডিজাইনের মেন্দি লাগানোর ব্যবস্থা করে দিবো। তাই তোমার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছিলাম কখন ওদের নিয়ে আসবো।

– সরি সিস্টার। আমি তো এখন আর মেন্দি লাগানোর কাজ করিনা। আমি এখন এখানেই ফুল টাইম কাজ করছি। আমি পারবোনা। তুমি বরং ওদের স্টেশনের কাছের স্টলগুলোতে নিয়ে যাও।

– ওহ, কিন্তু ওরা যে ঠিক এই ডিজাইনটাই চায়।

– তুমি যেকোনো কারো কাছে গিয়ে তোমার হাতের ডিজাইনটা দেখালে আমার মনেহয় ওরা করে দিতে পারবে। তুমি কি এখানে কোনো কাপড় খুঁজছিলে? তোমাকে কোনো হেল্প করতে পারি?

মুনিরা একটু হতাশ হয়েই হুট করে বলে উঠলো,

– আমার মনেহয় মায়মুনা আমাকে রোজ ফোন করে। কিন্তু সাহস করে কথা বলতে পারছেনা। আমার মেয়েটার হেল্প দরকার। তুমি কি আমাকে হেল্প করতে পারবে?

– সরি সিস্টার। তুমি কিসের কথা বলছো আমি বুঝতে পারছিনা। আমি তোমাকে হেল্প করবো কেমন করে?

মুনিরা আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

– সরি, কিছু মনে করোনা। মায়মুনা হারিয়ে যাবার পর থেকে আমার মাথাটা আসলে ঠিক নাই। কখন কী বলে ফেলি তার কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। তুমি কিছু মনে করোনা। তবে কাজের পর কোনোদিন আমার মেয়েদুইটার হাতে মেন্দি লাগিয়ে দিতে পারলে আমাকে একটু জানিও। আমার নাম্বার তো তোমার কাছে আছেই।

এই বলে মুনিরা জোরে হেঁটে দোকান থেকে বেরিয়ে আসলো।

বাড়িতে ফিরে দেখে আসাদ আর সাথে এক লোক লিভিংরুমে বসে আছে। এই লোক আবার কে? বাসায় তো কাউকে ওরা ঢুকতে দেয়না। ঠিক সেইসময় ওর মনেহলো এই নিশ্চয়ই সেই হিউম্যান রাইটস লইয়ার। ওর তো আজকে আসার কথা। তবে লোকটাকে দেখে মুনিরার একটু বিরক্তই লাগলো। এতদিন তো পুলিশ, সাংবাদিক আর পাবলিকের যন্ত্রনায় জীবন অতিষ্ঠ ছিল। এখন সাথে যুক্ত হলো এই লইয়ার। এই লোক অবশ্য ওদের উপকার করতেই এসেছে। একমাত্র এই মনেহয় মুনিরাদের পক্ষে কাজ করতে এসেছে। আর বাকিরা সবাই তো মুনিরাদের বিপক্ষে।

মুনিরা ঘরে ঢুকতেই আসাদ ওর সাথে মুনিরার পরিচয় করিয়ে দিলো। লইয়ারের নাম মুস্তাফা কামাল। লোকটার বয়স খুব একটা না, মাত্র বত্রিশ। এদেশে বড় হওয়া ছেলে কিন্তু ওর বাবা-মা, আসাদ আর মুনিরার মতো ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্র্যান্ট। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। বুঝাই যায় যে মুস্তাফা কামাল খুবই অ্যাম্বিশাস। নিজে থেকে ও আসাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। এখন ওদের সম্পূর্ণ ফ্রিতে সাহায্য করার প্রস্তাব দিচ্ছে। আসাদ এবং মুনিরা আবার এই নতুন আইনজীবীর ঝামেলায় জড়াবে কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলোনা। বুঝাই যাচ্ছে যে এই হাই প্রোফাইল কেস নিয়ে কাজ করতে পারলে রাতারাতি এই লোক ফেমাস লইয়ার হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু এতে মুনিরাদের আদৌ কোনো উপকার হবে কিনা তা নিয়ে মুনিরা আর আসাদ একটু সন্দিহান।

কিন্তু দুইদিন আগের ঘটনাটার কারণেই এই হিউম্যান রাইটস লইয়ারের একটু প্রয়োজন বোধ করছে মুনিরা আর আসাদ। বেশকিছুদিন ধরে গণ যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মায়মুনার ব্যাপারে একটু ঝিমিয়ে ছিল। এতে করে মুনিরা আর আসাদও একটু স্বস্তি বোধ করছিলো। কিন্তু দুইদিন আগে সবকিছু আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই “দ্য মুন” নামের এক ট্যাবলয়েড খবরের কাগজ তাদের প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন করেছে আসাদ আর মায়মুনাকে নিয়ে।

পাঁচ বছর আগে ইস্ট লন্ডনের বাদশাহী মসজিদে জুম্মার নামাজের পর মসজিদের কিছু মুসুল্লি আর এক চরম ডানপন্থী সাদা গ্ৰুপের মধ্যে রায়ট বেঁধেছিলো। সেই রায়টে নাকি উভয় পক্ষেরই দোষ ছিল। মসজিদের সেসময়কার ইমামও নাকি ছিল চরমপন্থী। পরবর্তীতে তাকে এক্সট্রিম এবং মৌলবাদী ভিউ প্রচারের জন্য গ্রেপ্তারও করা হয়। সেই জুম্মার দিন খুতবার সময় সেই ডানপন্থী সাদা গ্ৰুপনাকি ঝামেলা করার চেষ্টা করে। সেই ইমামের নেতৃত্বেও তো এইদিকে চরম্পন্থীর অভাব ছিলোনা। সাথে সাথে শুরু হয়ে দুইদলের হাতাহাতি মারামারি। সেই ঘটনা নিয়ে সেসময় লন্ডনে একেবারে হুলস্থুল বেঁধে গিয়েছিলো। দৈবচক্রে আসাদ সেইদিন সেই মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিলো। মারামারি শুরু হবার পর কোনোরকমে পালিয়ে ও বের হয়ে আসে। কিন্তু সেসময় কারো মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ভিডিওতে ভিড়ের মধ্যে আসাদকেও দেখা যায়। এতদিন পর আবার “দ্য মুন” পত্রিকা ভিডিও থেকে আসাদের ছবি এনলার্জ করে ফ্রন্ট পেইজে বড় করে সেই ছবি দিয়ে হেডলাইন প্রচার করেছে। পেইজের আরেকপাশে আবার মায়মুনার ছবিও আছে। খবরের হেডলাইন করেছে, মায়মুনার চরমপন্থী শিক্ষাগুরু: ওর বাবা আসাদ

ব্যস এরপর থেকে আবার ওদের বাড়িতে সাংবাদিকদের ঢল নেমে গেছে। আসাদ বা মুনিরা এখন পর্যন্ত কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। কথা বলে কী হবে? কেউ ওদের কথা শুনবে নাকি? বরং ওদের সাধারণ কথারও উল্টা মানে বানিয়ে তিলকে তাল করে আবার ভিন্নভাবে পরেরদিন খবর হিসেবে প্রচার করা হবে। কিন্তু এত বড় মিথ্যা তো চুপচাপ মেনে নেওয়াও যায়না। আসাদ তো সেইদিনের রায়টের সাথে কোনো ভাবেই জড়িত ছিলোনা। ওরা কী করবে যখন কোনো কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলোনা, তখন এই মুস্তাফা কামাল আসাদের সাথে যোগাযোগ করে। ও নাকি এখন থেকে মুনিরা আসাদের হয়ে সবার সাথে কম্যুনিকেট করবে আর এতদিন ওদের সাথে যা যা অবিচার হয়েছে তা হিউম্যান রাইট আইনের আওতায় এনে কোনো কিছু করা যায় নাকি তা দেখবে। প্রথমে আসাদ লোকটাকে পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু গতরাতে মুনিরা আর আসাদ অনেক চিন্তা করে দেখেছে যে ওরা নিজেরা আর এতকিছু সামলাতে পারছেনা। সবকিছু ওদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ওদের কারো সাহায্য দরকার। সেকারণেই মুস্তাফাকে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আজকে আসাদ বাসায় আসতে বলেছে।

মুনিরা কিছুক্ষন মুস্তাফার সাথে কথা বলে চা বানানোর অজুহাতে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। এই মুহূর্তে ওর একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা। এটা সেই ফোন আসার সময়। এখন ওকে মোবাইলটার কাছে থাকতে হবে। কতদিন ধরে ফোনটা আসছে কিন্তু এখনো কেউ ওপাশ থেকে কথা বলে উঠেনি। তবে মুনিরা এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে এটা মায়মুনার ফোন। মুনিরার বিশ্বাস ও শুধু মায়ের গলা শুনার জন্য ফোনটা করে। আর কিছু ও চায়না। ইতিমধ্যে মুনিরা অন-লাইনে সিরিয়ার রাকা শহরের ম্যাপ ঘেটে অনেক কিছু ধারণা করার চেষ্টা করেছে। পুলিশ আর খবরের মাধ্যমগুলোর ভাষ্যমতে মায়মুনার তো এখন রাকা শহরে থাকার কথা। কিন্তু মায়মুনার কথা বলতে হবে। না হলে মুনিরা কিছু করতে পারবেনা।

যথাসময়ে ফোনটা বেজে উঠলো। মুনিরা ফোনটা ধরে যথারীতি সময় নষ্ট না করেই হড়হড় করে কথা বলা শুরু করে দিলো,

– মায়মুনা আমি সেই মেন্দি মেয়ে নাজমার সাথে দেখা করেছি। ও কি কিছু জানে? আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনতে পারবো। তোমাকে কথা বলতে হবে। তোমাকে হেল্প করতে হবে। তাছাড়া আমি যে কিছুই করতে পারবোনা। কথা বলো মা। আমার তোমার উপর কোনো রাগ নাই। আমি শুধু তোমাকে ফিরিয়ে আনতে চাই। তোমার বাবা, ফাতিমা, আমিনা, মোহাম্মদ সবাই শুধু তোমাকে দেখতে চায়। আমরা আর কিছু চাইনা।

– মা, আমি সরি। আমি অনেক সরি। আমি বেশি কথা বলতে পারবোনা মা। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। নাজমা বলতে পারবে আমি ঠিক কোথায়। আমি নিজেই জানিনা মা। আমাকে হেল্প করো মা প্লিজ। হয় ওরা আমাকে মারবে নাহয় বম্বিংয়ে আমি মরে যাবো। প্লিজ মা।

এই বলে হুট করে ফোনটা রেখে দিলো মায়মুনা। মুনিরা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। ও এখন কী করবে? পুলিশকে বলবে কোনোভাবে এই ফোনটা ট্র্যাক করা যায় কিনা? তারপর? ট্র্যাক করতে পারলেও ওরা কি আদৌ কিছু করবে নাকি মায়মুনাকে আরো বিপদে ফেলে দিবে? মায়মুনা “ওরা” “ওরা” করছে যে “ওরা” আসলে কারা? আসাদের সাথে এই মুহূর্তে কথা বলা দরকার। আসাদের সাহায্য ছাড়া মুনিরা আর এখন কিছু একা করতে পারবেনা। আর সবচেয়ে যার সাহায্য দরকার, সে হলো নাজমা। ওই অপ্সরারূপী শয়তান মেয়েটা কিছু করবে বলে তো মুনিরার মনেহয় না। মেয়েটাতো একেবারে সাক্ষাৎ শয়তান। ওই নিশ্চয়ই মায়মুনার মাথা নষ্ট করেছে। নাহ, মুনিরাকে এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এই লইয়ার আসার আর সময় পেলোনা। ও অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে সেই লইয়ার চলে যাবার অপেক্ষায় থাকলো। ওর আসাদের সাথে এই মুহূর্তে কথা বলা দরকার।

(চলবে)
©আমিনা তাবাস্সুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here