মরীচিকার সন্ধানে
পর্ব – ১৩
মায়মুনা সব মিলিয়ে ইব্রাহিমের সাথে সংসার করেছে মোট চৌত্রিশ দিন। এই চৌত্রিশ দিনের জন্য মায়মুনা সৃষ্টিকর্তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ইব্রাহিমের চলে যাওয়াটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। ইব্রাহিম ওকে অনেক বুঝিয়ে গেছে যে ওরা সব ছেড়েছুড়ে যখন আল্লাহর পথে বের হয়েছে তখন এসব মেনে নিতেই হবে। এইসব নিয়ে হাহুতাশ করা, দুঃখ করা তো দুর্বল ঈমানের লক্ষণ। এতদূর এসে ঈমান দুর্বল করা তো ঠিক না। এই দুনিয়া তো মাত্র দুইদিনের একটা ট্রানজিশন। আসল দুনিয়াতো ওপারে। সেই দুনিয়ার জন্য এই দুনিয়ায় কষ্ট করতেই হবে। মায়মুনা ইব্রাহিমকে কথা দিয়েছিলো যে ও কষ্ট করবে। ও আল্লাহর পথে নিজের জীবন চালনা করবে, খিলাফতের আদেশ নির্দেশ মেনে চলবে, যত কষ্টই হোক না কেন আফসোস করবেনা, কোনো কিছুতে দ্বিধান্বিত হবেনা।
কিন্তু কথা দেওয়া আর সেই কথামতো চলা কি আর এক কথা? মায়মুনার মনেহচ্ছে দিনে দিনে ওর ঈমান দুর্বল হয়ে আসছে। ভীষণ রকম দুর্বল। আল্লাহর পথে বের হবার এই সিদ্ধান্তের জন্য মায়মুনা মোটেও আফসোস করেনা। কিন্তু ও যেই পথে বের হয়েছিল সেই পথ তো শুদ্ধ, পবিত্র হবার কথা। মায়মুনার এই পথ মোটেও সেরকম মনে হচ্ছেনা। এটা কি ওর মনের ভুল? ঈমানের দুর্বলতা। তাই হবে হয়তো। না হলে লীনা কীভাবে এখনো এত ডিভোটেড। লীনা দিন রাত কষ্ট করে ওর দেশের মেয়েদেরকে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই জীবন বেছে নেবার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। লীনারও তো মায়মুনার মতো অবস্থা। ওর বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ পর ওর স্বামী কোয়ালিশন ফোর্সের সাথে এক সংঘর্ষে জীবন হারায়। লীনা এখন এক গেস্টহাউজে বসে খিলাফত প্রচারের কাজ করে চলছে। আর এদিকে মায়মুনা? ও লীনার মতো আরেক গেস্টহাউজে বসে আছে ঠিকই। কিন্তু ভীরু এবং কাপুরুষের মতো নিজের পালানোর রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
তবে এই যে লীনা আর মায়মুনা, ওরাই কিন্তু রাকা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব মানুষদের রিপ্রেজেন্ট করে। পুরুষ হোক বা মহিলা হোক, যোদ্ধা হোক বা বেকার হোক, সধবা হোক বা বিধবা হোক, বয়ষ্ক হোক বা অল্পবয়সী হোক সবার মধ্যেই কেউ না কেউ আছে যে ভীষণ ডিভোটেড ঠিক লীনার মতো। আবার অনেকেই আছে যারা মায়মুনার মতো প্রতি মুহূর্তেই দ্বিধান্বিত। যারা মায়মুনার মতো, তারা সাহস সঞ্চয় করে মুক্তির পথে এক পা আগায় তো সংশয়ে দুইপা পিছিয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসনের ভীষণ অনুরক্ত কিন্তু তারপরও আই সিস বাহিনীর অনেককিছুই তাদের কাছে ন্যায্য মনেহয় না। আবার রাকা শহরের অনেক স্থানীয় লোকজন তো এই বাহিনীর কার্যকলাপের ঘোর বিরোধী। তাদের শান্তির জীবন, সুন্দর শহর এরা এসে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। এদের সাথে আবার লেজুড় হিসেবে যুক্ত হয়েছে সব বিদেশী যোদ্ধা। তবে অনেক স্থানীয় লোকজন কোনো উপায়ান্ত না দেখে আই সিস বাহিনীর বিভিন্ন কার্যকলাপে শেষপর্যন্ত যোগদান করেছে ঠিকই। আর না করে ওদের উপায়ই কী? বাসায় বসে থাকলে তো ওদের না খেয়ে মরতে হবে।
রাকায় মেয়েরাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গেস্ট হাউজের তত্বাবধায়ন এমনকি পুলিশ ফোর্সেও মেয়েরা কাজ করছে। এসব জায়গায় তো ছেলেদের সাথে সাথে মেয়েদেরও দেখভাল আর পরিচালনা করতে হয়। আর মেয়েদের পরিচালনা করার জন্য তো মেয়েদের প্রয়োজন। সেকারণে মেয়েরাও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তবে সেখানেও ডেডিকেটেড মহিলারা যেমন আছে, দ্বিধান্বিত মহিলারাও তেমন আছে। বিশেষ করে পুলিশ ফোর্সে। মেয়েরা ধর্মীয় অনুশাসন অনুসারে পোশাক ঠিকমতো পরছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা মেয়ে পুলিশ বাহিনীর একটা বড় কাজ। আর সেই পোশাকে কোনো গরমিল দেখলে শাস্তির ব্যবস্থাও ভীষণ কঠোর। পুলিশ বাহিনীর অনেকের মধ্যে পোশাকের অনুশাসনে কোনো সন্দেহ না থাকলেও শাস্তির ব্যাপারে অনেকসময়ই সন্দেহ জাগে। একটু চুল বের করে রাখার জন্য বেত্রাঘাত অনেকের মেনে নিতে কষ্ট হয়। তখনই শুরু হয়ে যায় মনের সাথে যুদ্ধ, তখনই শুরু হয়ে যায় সংশয় এবং দ্বিধা।
আর এই সংশয় আর দ্বিধার দোলাচালে সমস্ত রাকাবাসীর মধ্যে সার্বক্ষণিক এক ধরণের ভয়, ভীতি এবং অবিশ্বাস কাজ করে চলছে। কে সত্যি আই সিস আর কে দ্বিধান্বিত আই সিস তা বুঝে উঠা কারো পক্ষে সম্ভব না। সবাই একে অপরকে নিত্য সন্দেহের চোখে দেখে, কেউ কারো সাথে মন খুলে কথা বলেনা। সবাই যে যার মতো অস্থির সারাটাক্ষন। আর এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবচেয়ে কঠোর পন্থা অবলন্বন করা হয়। আই সিস বাহিনীতে কোনো বিশ্বাসঘাতকের স্থান নাই। বিশ্বাসঘাতকতার কোনো গন্ধ পেলেই তাদের একেবারে সাথে সাথেই নিঃশেষ করে ফেলা হয়। এই ব্যাপারে কোনো ছাড় নাই।
কিন্তু এরপরও প্রতিনিয়ত মানুষজন পালাচ্ছে। অনেকে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আবার অনেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে মারা পড়ছে। তারপরও অনেকেই এই ঝুঁকি নিতে পিছপা হয়না। কেননা এখানে থাকলে যুদ্ধে এমনিতেই মারা পড়বে। এর চেয়ে বরং পালানোর চেষ্টা করে মারা যাওয়া ভালো। অনেকে আবার এই জীবন না পারছে ফেলতে আবার না পারছে গিলতে। এই জীবন থেকে মুক্তি চাইলে নিজেকে যে অবিশ্বাসী প্রমান করা হবে। তারা তো আল্লাহ ভক্ত মানুষ, অবিশ্বাসী হতে চায়না।
মায়মুনার গেস্টহাউজেও ঠিক একই অবস্থা। কার মনের ভাব যে কী তা ঠিক বুঝে উঠা মুশকিল। সবাই সবসময় তটস্ত থাকে। এর উপর আবার গোলাগুলি আর বম্বিংয়ের ভয় তো আছেই। তবে কেমন করে যেন রাকার বিভিন্ন খবর এই মেয়েগুলোর কাছে ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে। তার মানে অনেকেরই এই গেস্ট হাউজের বাইরে অনেকের সাথে যোগাযোগ আছে। কিন্তু কার যোগাযোগ আছে, কীভাবে যোগাযোগ আছে তা কেউ বুঝতে পারেনা। কেউ নিয়মের বাইরে কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে তাদের নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড।
তারপরও সাহস করে মায়মুনা এই ফোনটা ব্যবহার করছে। ইব্রাহিম মায়মুনাকে ভালোবেসে শেষ উপহার হিসেবে এই মোবাইল ফোনটা দিয়ে যায়। তবে এই ফোন হাতে পাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার ছিলোনা। মিশনে বের হবার পর শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিমের কাছে ফোনটা রাখতে হয়েছিল। সেই ফোনের মাধ্যমেই তো সবার সাথে যোগাযোগ করতে হয়েছিল ওর। সবার ধারণা ইব্রাহিমের সাথে ফোনটাও ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ইব্রাহিম মায়মুনাকে বলে গিয়েছিলো যে বড় হাসপাতালের সামনে এক গাছের তলায় মাটির নিচে একটা প্যাকেটে এই ফোনটা পুঁতে রাখা হবে। কেমন দেখতে গাছ, হাসপাতালের ঠিক কোন জায়গায় সব কিছু ও ভালো মতো বুঝিয়ে দিয়েছিলো। এই ফোনটা নিয়ে মায়মুনা যাতে মাঝে মাঝে ওর মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পারে সেইকারণে এই উপহার। মায়মুনা ইব্রাহিমকে কথা দিয়েছিলো যে মায়ের গলার আওয়াজ শুনা ছাড়া আর কোনো কাজে ও ফোনটা ব্যবহার করবেনা। তবে মিশনের শেষ মুহূর্তে কার কাছে ও ফোনটা দিয়েছিলো আর সেই বা কেন ওর কথামতো ফোনটাকে হাসপাতালের গাছের নিচে পুঁতে রেখেছিলো তা মায়মুনা জানেনা। কিন্তু মায়মুনা এইটুকু বুঝেছে অনেকেই মায়মুনার মতো চিন্তা করছে। অনেকেই একজন আরেকজনকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য তৈরি আছে। কিন্তু সেই অনেকে কারা সেটাই মায়মুনা বুঝতে পারছিলোনা।
ইব্রাহিম মায়মুনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার দুইদিন পর মায়মুনাদের ফ্ল্যাটে দুইজন পুরুষ এবং একজন মহিলা এসে হাজির হয়। মায়মুনা তাদের অপেক্ষায়ই বসে ছিল। তারা যে আসবে সেটা তো ও জানতোই। যথারীতি মায়মুনাকে দেখে এক ব্রাদার বলে উঠেছিল,
– কংগ্রাচুলেশন সিস্টার। তুমি এখন একজন শহীদের স্ত্রী। ব্রাদার ইব্রাহিম সাহসিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উই আর অল ভেরি প্রাউড অব হিম।
কী সাহসিকতা, কী দৃষ্টান্ত এইসব বৃত্তান্ত শুনার কোনো আগ্রহই মায়মুনার ছিলোনা। ও শুধু কথাটা শুনেই ওর পেটটা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছিলো। ওরা ভেবেছিলো যে মায়মুনা বোধহয় দুঃখে, কষ্টে ভেঙে পড়েছে। ওকে শান্তনা দিয়ে বলেছিলো যে এটাতো দুঃখের সময় না, আনন্দের সময়। কিন্তু মায়মুনা পেট চেপে ধরে রেখে বুঝিয়েছিল যে ওর আসলে ভীষণ পেটে ব্যাথা।
মায়মুনার এই অবস্থা দেখে ওরা সাথে সাথেই বাসার অদূরের সেই বড় হাসপাতালে মায়মুনাকে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে মহিলাদের কক্ষে অপেক্ষা করার সময় মায়মুনা টয়লেটে যাবার নাম করে ঠিক ইব্রাহিমের কথামতো টয়লেটের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে বের হতেই সামনে বড় গাছটা দেখতে পায়। কোনোরকমে কাছে গিয়ে সেই গাছের গোড়ার দিকে তাকানো মাত্রই দেখতে পায় কেউ নতুন মাটি স্তুপ করে রেখে গিয়েছে। সেই মাটির ভিতর হাত ঢুকাতেই পেয়ে যায় সেই মোবাইলের প্যাকেট। একেবারে নিশ্বাস বন্ধ করে তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা ওর ব্যাগে ভরে আবার সেই মহিলাকক্ষে ফিরে আসে মায়মুনা। ডাক্তার অবশ্য মায়মুনার পেটে কোনো সমস্যা খুঁজে পায়নি। হয়তোবা শক থেকে এরকম হয়েছে বলে দুইটা পেইনকিলার দিয়েই ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই তিনজন মিলেই মায়মুনাকে এই নতুন গেস্ট হাউজে নামিয়ে দিয়ে যায়।
এখানে আসার পর মায়মুনাকে গেস্টহাউজের কিছু কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব মানে দক্ষিণের রুমগুলো পরিষ্কার করে রাখার দায়িত্ব ওর। কারণ মায়মুনার তো কমপক্ষে চারমাস দশদিন এখানে থাকার কথা। এই সময়টা তো বিধবাদের জন্য ইদ্দতকাল। এর আগে তো ওর আরেকটা বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবেনা। যেইসব মেয়ে বা মহিলারা এরকম দীর্ঘ সময়ের সময়ের জন্য গেস্টহাউজে থাকে তাদেরকে এরকম কাজ ভাগ করে দেয়। বেশ বড় একটা গ্ৰুপ রান্নার কাজে থাকে। মায়মুনারা চার পাঁচজন মিলে পুরো গেস্টহাউজ পরিষ্কারের দায়িত্বে আছে। মায়মুনার এই গেস্টহাউজ পরিষ্কারের কাজ একেবারে অসহ্য লাগে। প্রতিদিন উঠে এই এক রুটিন, এক কাজ, একটু মন খুলে কথা বলার কেউ নাই, সবাই কেমন ভীত। সব মিলিয়ে একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। মায়মুনার মনে হতো এ কেমন ইসলামিক স্টেইট? এখানে কোথায় আল্লাহ, কোথায় শান্তি, কোথায় খিলাফত? এখানে বসে থেকে পৃথিবীর কার উপকারে আসবে ও? এই সেই সত্যের জীবন যার জন্য ও মা বাবা ভাই বোন ছেড়ে এসেছে। তারপরও মায়মুনা এই জীবনে মানিয়ে নিতে চেয়েছিলো।দমবন্ধ এই পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে বাইরে কোথাও কাজ করতে চেয়েছিলো মায়মুনা। এই যেমন হাসপাতাল অথবা মসজিদে। কিন্তু ওকে সেই পারমিশন দেওয়া হয়নি।
তবে মায়মুনার মনেহয়েছিলো যে আরেকটা বিয়ের চেয়ে এই গেস্টহাউজ অনেক ভালো। আর কাউকে বিয়ে করার কথা মায়মুনা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারেনা। আরেকজন পুরুষমানুষের কথা ভাবলেই ওর গা একেবারে রিরি করে উঠে। আপাতত ওর লক্ষ্য হলো বিয়ে না করে এখানে থাকার একটা উপায় বের করা। মায়মুনা ভেবেছিলো যে এই কয়মাসের মধ্যে একটা উপায় নিশ্চয়ই বের হয়েই যাবে। কিন্তু এই কয়মাস কোথায়? মাত্র কয়েকদিন থাকার পরই গেস্টহাউজের সিস্টার পেরভিন ওর বিয়ের পরিকল্পনা করা শুরু করে দিয়েছে। সেই সৌদি লোকের সাথে।
সিস্টার পেরভিন মায়মুনাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলো,
– তুমি তো ভীষণ ভাগ্যবতী মায়মুনা। তোমার আর অপেক্ষা করা লাগবেনা। ব্রাদার জালাল এখুনি তোমাকে বিয়ে করতে চায়। ব্রাদার জালালের কথা তো তোমার মনে আছে। সে কিন্তু তুমি রাকাতে আসার পরপরই তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। হি ইজ অ্যা গুড ম্যান। হি ইজ অ্যা ভেরি রিচ ম্যান। তুমি তো খুবই লাকি মায়মুনা।
এই কথা শুনে মায়মুনাতো একেবারে আকাশ থেকে পড়েছিল। বলেছিলো,
– এখুনি মানে?
– হ্যাঁ এখুনি। এই কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা হচ্ছে।
– কিন্তু আমি তো এখন বিয়ে করতে পারবোনা। এই বিয়ে তো হবেনা।
– কেন হবেনা?
– ইসলাম ধর্মমতে আমাকে চারমাস দশদিন অপেক্ষা করতে হবে।
– ওসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা। তুমি তো ধর্মের কিছুই জানোনা। ব্রাদার জালাল খুবই ধার্মিক। সে বুঝে শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
– ব্রাদার জালাল বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিলে তো হবেনা। এটা আমার বিয়ে। আমাকেও বুঝতে হবে।
– মায়মুনা, তুমি অকারণে ঝামেলা করছো। এখানে থাকার চেয়ে ব্রাদার জালালের ফ্ল্যাটে থাকা অনেক ভালো। বোকারাও নিজের ভালো বুঝে। তুমি ছোট, তুমি বুঝতে পারছোনা।
– না আমি ছোট না। আমি ধর্মমতে চলার জন্য এখানে এসেছি। তোমরা আমাকে অধর্ম করতে বলতে পারোনা।
– ঠিক আছে দেখা যাবে। ইউ মে লিভ নাও।
সিস্টার পেরভিনের আচরণে মায়মুনা হতভম্ব হয়ে যায়। গেস্ট হাউজের কয়েকজন সিস্টারকেও মায়মুনা ইদ্দতকালের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল। সবাই বলেছে যে এটা পালন করতে হবে। একজন অবশ্য বলেছে,
– পালন করতে হলেই কি আর সবাই পালন করে নাকি। পাওয়ারফুল ব্রাদারদের জন্য সাতখুন মাফ। তা না হলে এই শহরেই মেয়েরা রেপড হয় কেমন করে।
মায়মুনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
– এখানেও রেপড হয়?
– ওমা, হবেনা কেন? হরদম হয়। মেয়েরা এদিক ওদিক করলেই তাদেরকে পথভ্রষ্ট বানিয়ে রেপ করা জায়েজ হয়ে যায়। অবশ্য শুধু ক্ষমতাবানদের জন্য। কেউ যদি ফকির হয়ে রেপ করে তাহলে তার পাথরের আঘাতে মারা পড়ার সম্ভাবনা আছে।
মায়মুনার অবাক দৃষ্টি দেখে সেই সিস্টার বলেছিলো,
– বুঝলে মায়মুনা। ক্ষমতাবান মানুষরা যা ইচ্ছা তাই করে পার পেয়ে যেতে পারে। তখন আল্লাহর বিধান জানালা দিয়ে উড়ে যায়। ব্রাদার জালাল ক্ষমতাবান মানুষ। এখানে পচে মরার থেকে তার গলায় ঝুলে যাও। তোমারি উপকার হবে। আর আমি তোমাকে যে এত কথা বললাম সেটা আবার কাউকে বলে ফেলোনা।
সেই মুহূর্তেই মায়মুনা বুঝে যায় যে ওকে কিছু একটা করতে হবে। কী করতে হবে ও জানেনা কিন্তু কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে। এর মধ্যে ও বুঝতে পেরেছিলো যে উপরমহলের অনেকেই ব্রাদার জালালের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। তাদের কথা কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেই না হয় বিয়ে করুক। অকারণ এই বিষয় নিয়ে ব্রাদারদের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করার দরকার কী। এই ঘটনার পর আরো অনেকেই সেই একই কাজ করা শুরু করে দিবে। আরেকপক্ষ ব্রাদার জালালের পক্ষে। তাদের কথা আল্লাহ এই বিধান দিয়েছেন যাতে করে বিধবা বা ডিভোর্স মেয়েদের বিয়ের আগে পরিষ্কারভাবে জেনে নেওয়া যায় যে তারা প্রেগন্যান্ট না। সেটাই এই বিধানের মূল উদ্দেশ্য। এখন তো টেস্ট করেই ব্যাপারটা জানা যায়। তাহলে শুধু শুধু অপেক্ষা করে জানার প্রয়োজনীয়তা কী। এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে উপরমহলে নাকি ঢিঢি পড়ে গেছে।
এই ব্যাপারটা যদিও তুচ্ছ কিন্তু পুরো সিস্টেমটাই এরকম গড়বড়ে। পদে পদে এরকম তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে প্রতিনিয়ত। এই গেস্টহাউজের মেয়েদের মধ্যেও তো ধর্মের ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে প্রতিদিন লেগেই আছে। এইদিকে মায়মুনার মনে হচ্ছে সময় খুবই অল্প। খুব তাড়াতাড়ি ওকে কিছু একটা করতে হবে। ও এই জীবন থেকে মুক্তি চায়। চারদিকে অনেক মানুষ আছে যারা হয়তোবা মায়মুনাকে সাহায্য করতে পারে। কত মানুষ এর ওর সাহায্য নিয়ে প্রতিদিন এই বিষাক্ত নগরী থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কাছে তো সাহায্য চাইতে হবে। এখানে বন্দি থেকে কীভাবে ও কারো সাহায্য চাইবে। নাজমা আর ওর মাকে যা যা তথ্য জানানোর দরকার ইতিমধ্যে সব জানিয়ে দিয়েছে মায়মুনা। ওরা কি পারবেনা কোনোভাবে মায়মুনার মুক্তির ব্যবস্থা করতে? নিশ্চয়ই পারবে। ওদের পারতেই হবে।
(চলবে)
©আমিনা তাবাস্সুম