মরীচিকার সন্ধানে
পর্ব – ১৫
আসাদের মনের মধ্যে সারাটাক্ষন অশান্তি। যত দিন যাচ্ছে অশান্তি যেন বেড়েই চলছে। মায়মুনা চলে যাবার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পায়নি ও। আসাদের আগে খুব একটা ধর্মকর্মে মন ছিলোনা। কিন্তু আজকাল ও বেশ নামাজ কালামে মন দেবার চেষ্টা করছে। এতেকরে যদি মনটা একটু শান্ত হয়। কিন্তু আসাদের মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছেনা।
যত কষ্টই হোক না কেন আসাদ মায়মুনাকে ভুলে যেতে চেয়েছিল। মায়মুনার উপর ওর পাহাড় পরিমান অভিমান। এত সহজ পথভ্রষ্ট হওয়া? এত সহজ বাবা, মা, ভাই, বোনকে ত্যাগ করা? কারো হৃদয় পাষান না হলে তো সম্ভব না। কিন্তু ভুলে যেতে চাইলেও ও ভুলতে পারছেনা। নিজের সন্তানকে ভুলে যাওয়া এত সহজ? অথচ মুনিরার ধারণা আসাদ একজন পাষান বাবা। মেয়েটা চলে যাবার পর থেকে আসাদ নাকি উঠে পড়ে লেগেছে মায়মুনাকে ওদের জীবন থেকে মুছে ফেলার। মায়মুনাকে জীবন থেকে মুছে ফেলে আবার সুখে শান্তিতে বসবাস করার পরিকল্পনায় আসাদ নাকি দিনরাত ব্যস্ত। আসলেই কি তাই? মুনিরার হাবভাব দেখলে আসাদের অশান্তির সাথে সাথে বুকের মধ্যে এক ধরণের চাপ ব্যথা অনুভূত হয়। আসাদের মনেহয় এত বছর একসাথে সংসার করার পরও মুনিরা ওকে ঠিক বুঝতে পারেনি। ওদের মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান, বিশাল ফারাক থেকে গেছে। এতদিন নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ছিল, কোনো বিশাল বিপদ আপদ হয়নি দেখে ব্যাপারটা বুঝা যায়নি। আসাদের সবসময় মনেহত ওদের দুইজনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং বেশ ভালো। একে অপরকে শুধু ভালোবাসে না, বুঝতেও পারে। কিন্তু এখন দিনে দিনে আসাদ টের পাচ্ছে যে সব ভুল, সব মিথ্যা। আজকাল আসাদের সব ছেড়েছুড়ে মায়মুনার মতো কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। শুধুমাত্র বাকি তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু করতে পারেনা ও। সব কষ্ট, অবসাদ ঝেড়ে ফেলে উঠে দাড়াতে হয়। জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। আসাদ সবই করছে কিন্তু বুকের মধ্যেকার এই অশান্তি, এই চাপ ব্যথাটা আর নিতে পারছেনা।
আসাদ কিচেনে দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে তিন কাপ চা বানাচ্ছে। ওদিকে লিভিংরুমে মুনিরা আর সেই হিউম্যান রাইটস লইয়ার মুস্তাফা কামাল চায়ের অপেক্ষায় বসে আছে। আসাদ জানে যে ওরা এই মুহূর্তে অধীর আগ্রহে আসাদের জন্য বসে আছে। আসাদ ওখানে গেলেই সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করে দিবে। আর সেকারণেই মনেহয় আসাদের বুকের চাপ ব্যথাটা ভীষণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যথাটা কমানোর জন্য ও ইচ্ছা করেই যত ধীরে সম্ভব চা বানানোর কাজটা করছে। কিন্তু তারপরও আসাদের মনে হচ্ছে যে যত ধীরে ও চা বানানোর চেষ্টা করছে, তত তাড়াতাড়িই যেন কাজটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আসাদ একটা ছোট ট্রেতে করে তিন মগ চা নিয়ে লিভিংরুমে ফিরে এলো।
আসাদকে দেখা মাত্রই মুনিরা বলে উঠলো,
– শুধু চা এনেছো? মুস্তাফার জন্য ওই নতুন বিস্কুটের প্যাকেটটা আনতে?
আসাদ কিছু বলার আগেই মুস্তাফা বলে উঠলো,
– না না আমি শুধু চা খাবো। বিস্কুট খেতে চাইনা। আপনারা বসেন। আমরা আলোচনাটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি। রাকা শহরের অবস্থা ভালোনা। যা করার আমাদের খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।
মুনিরা ওর কথা না শুনে রীতিমতো দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে বিস্কুটের প্যাকেটটা নিয়ে এসে মুস্তাফার সামনে রাখলো। মুনিরা আর আসাদ দুজনেরই এখন মায়মুনার সাথে প্রায়ই কথা হচ্ছে। মায়মুনা শুধুমাত্র ওদেরকে ওর গেস্টহাউজের নাম ঠিকানা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। মায়মুনা জানিয়েছে যে রাকা শহরে অনেকেই আছে যারা সবাইকে সিরিয়া থেকে বের হতে সাহায্য করে। কিন্তু সেই “অনেকে” কারা, তাদের কোথায় খোঁজ পাওয়া যাবে সেই সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনি। মুনিরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে সেই শয়তান নাজমার কাছ থেকে এক ডাক্তার মহিলার কন্টাক্ট ডিটেইলস পেয়েছে। সেটা পাওয়া মাত্র মুনিরা উত্তেজিত হয়ে তাকে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো। আসাদ কোনোরকমে মুনিরাকে থামিয়েছে। নাজমার কোনো কিছু বিশ্বাস করা ঠিক না। তাছাড়া মুনিরা আসাদ তো নিজেরা এখানে কম অশান্তিতে নাই। একবার পুলিশ ওদের সন্দেহ করে তো আরেকবার মিডিয়া ওদের সন্দেহ করে। আর এতে করে শুধু ওদের জীবন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে না, সাথে সাথে ওদের বাকি তিন বাচ্চাও যারপরনাই সাফার করছে। আসাদ তাই একটু ভালোভাবে চিন্তা করে আগাতে চাচ্ছিলো।
আসাদ প্রথমে ভেবেছিলো পুলিশকে আরেকবার একটু বলে দেখবে নাকি। এখন তো ওরা জানে যে মায়মুনা ঠিক কোথায় আছে আর ও ফেরত আসতে চায়। পুলিশ কি একটু চেষ্টা করলে পারবেনা মেয়েটাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে। কিন্তু পর মুহূর্তেই ও বুঝতে পেরেছে যে এটা কখনোই সম্ভব না। এখন পর্যন্ত যারা ওখান থেকে ফিরে এসেছে সবাই নিজেদের ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে। ব্রিটেনের পুলিশের কী ঠ্যাকা পড়েছে যে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টেরোরিস্টদের উদ্ধার করার। পুলিশ যেটা করেছে সেটা হলো যারা যারা ফেরত এসেছে, তারা পৌঁছানো মাত্রই তাদের অ্যারেস্ট করে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই আইনের চোখে তো এরা দোষী এবং দেশের জন্য রিস্ক। পুলিশ এদের না ধরে নিশ্চয়ই ফুলের মালা দিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানাবেনা।
আসাদ নিজেও মায়মুনার সাথে কথা বলার পর থেকে ওকে ফেরত আনার জন্য অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু ওর বারবার শুধু মনে হচ্ছে তারপর কী হবে? মায়মুনাকে নিয়ে পৃথিবী তোলপাড় হয়ে গেছে। ওকে কি এত সহজে ছেড়ে দেওয়া হবে? আর ধরা যাক পুলিশ ওকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু জনগণের চোখে তো ও ক্রিমিনাল। আইনের বিচারে মায়মুনার মুক্তি হলেও, জনগণের বিচারে মায়মুনার কোনো মুক্তি নাই। আসাদের মনেহয় আইন মায়মুনাকে দোষী প্রমান না করতে পারলেও, পাবলিক সেন্টিমেন্টের কথা চিন্তা করে মায়মুনাকে ছাড়া হবেনা। আর মায়মুনা এদেশে না থাকা অবস্থায়ই ওদের জীবন তছনছ করে দিচ্ছে সবাই। মায়মুনা ফিরে আসার পর যে কী হবে সেটা আসাদ ভাবতেই পারছেনা। তারপরও আসাদ চায় মেয়েটা সুস্থভাবে ফিরে আসুক, ওর বিচার হোক। মায়মুনার দোষ ও এক টেরোরিস্ট সংস্থার সাথে সম্পৃক্ততা করেছে কিন্তু ও তো কাউকে মারেনি, কারও ক্ষতি করেনি, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, কারও ক্ষতি করার কোনো পরিকল্পনাও করেনি। তাছাড়া আইনের চোখে ও তো এখনো একজন শিশু। সুষ্ঠু বিচার করার পর মায়মুনাকে যদি অল্প কিছুদিনের জন্য জেল খাটতেও হয় তাও ভালো। মেয়েটার সারাটা জীবন তো সামনে পড়ে আছে। এরপর তো স্বাভাবিক একটা জীবন পেতে পারে মেয়েটা। আর ওখানে থাকলে তো ওর কোনো ভবিষ্যৎ নাই। কিন্তু মায়মুনার সুষ্ঠু বিচার আদৌ হবে নাকি সেটা নিয়েই আসাদ চিন্তিত। সেকারণেই পুলিশের সাথে কথা না বলে মুস্তাফার সাথে কথা বলা।
মুস্তাফার সাথে কথা বলার বুদ্ধি অবশ্য মুনিরার। আসাদ এত অশান্তিতে আছে যে ওর ঠিক কী করা উচিত তা বুঝে পাচ্ছেনা। মুনিরা আপাতত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে নারাজ। ওর কথা একটাই। মায়মুনাকে সেই নরক থেকে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে। এরপর যা হবার হবে। সেটা নিয়ে চিন্তা করে দেরি করা যাবেনা। কিছুতেই মায়মুনাকে এই বিপদের মধ্যে ফেলে রাখা যাবেনা। তবে মুনিরাও সেই নাজমা মেয়েটাকে একেবারে বিশ্বাস করেনা। সেই মেয়েটা হলো সবচেয়ে বড় শয়তান। ইবলিশ শয়তানও ওর কাছে মনেহয় হার মানবে। তাই আসাদ যখন ওর দেওয়া কন্টাক্টের সাথে যোগাযোগ করতে একটু অস্বস্তিবোধ করেছিলো তখন মুনিরা আর জোরাজুরি না করে মুস্তাফার সাথে আগে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়।
সিদ্ধান্ত মুনিরার খুবই ভালো ছিল। মুস্তাফা তো আপাতত এরকম সিরিয়া ফেরত ক্লায়েন্টদেরই ডিল করছে। ও শুধু মায়মুনা ফিরে আসলে ওর কেসের ব্যাপারে সাহায্যই করতে পারবেনা, ও মায়মুনাকে ফেরত আনার ব্যাপারেও সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। ওর ক্লায়েন্টদেরকে যারা সিরিয়া থেকে পালানোর ব্যাপারে সাহায্য করেছে তাদের অনেকের কন্টাক্ট জোগাড় করে ওদের সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মুশকিল হলো গিয়ে মুস্তাফার সব ক্লায়েন্টরা ছেলে। ওদের যেহেতু একা একা চলাফেরায় কোনো রেস্ট্রিকশন ছিলোনা, সেহেতু ওদের পালানোর ব্যাপারটা কিছুটা সহজ ছিল। মায়মুনার তো ওর সেই গেস্ট হাউজ থেকে বের হওয়াই নিষেধ। সেখানে ও কড়া পাহারায় থাকে। পালাতে হলে তো ওকে প্রথমে গেস্ট হাউজ থেকে বের হতে হবে। তারপরই কেউ ওকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারবে।
সেই ব্যবস্থা করার জন্য মুস্তাফা নিজে নাজমার দেওয়া সেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছে। তার ডিটেইলসও ভেরিফাই করেছে। মায়মুনাকে গেস্ট হাউজ থেকে বের করে আনার ব্যাপারে সাহায্য করতে রাজি করিয়েছে। সিস্টার রাবেয়া শুরুতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলোনা। ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন মেয়েদের পালাতে সাহায্য করায় তিনি আইসিস বাহিনীর নজরবন্দী। তবে সিস্টার রাবেয়া যে সাহায্য করেছে তার কোনো প্রমান ওদের কাছে নেই। ওরা শুধু সন্দেহই করেছে। প্রমান পেলে উনাকে ওরা আস্ত রাখতোনা। তাই সিস্টার রাবেয়া এসবের মধ্যে আর জড়াতে চায়না। চুপচাপ উনি অসহায় মেয়েদের চিকিৎসা করে যেতে চায়। কিন্তু মুনিরা আর মুস্তাফার আকুতি মিনতির কাছে শেষ পর্যন্ত উনি হার মেনেছে। শেষ বারের মতো মায়মুনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে পরিকল্পনা অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছে মুস্তাফা। মুনিরা যেন এতদিন পর একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। মুনিরার মনে হচ্ছে ওর এতদিনের দোয়া বিফলে যায়নি। আল্লাহ কেমন করে জানি ওদের কাছে মুস্তাফাকে পাঠিয়েছে। এই ছেলেটা না থাকলে তো ওরা কিছুই করে উঠতে পারতোনা।
মুস্তাফা বিস্কুট খাবেনা বলেও প্যাকেটটা থেকে তিন চারটা বিস্কুট নিয়ে খেয়ে ফেললো। মুনিরার দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ছেলেটার নিশ্চয়ই খিদা লেগেছে। বাসায় কিছু রান্না করা নাই যে খেতে দিবে এখন। মুস্তাফা বিস্কুট শেষ করে চায়ের মগটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে আসাদ আর মুনিরার কাছে পরিকল্পনাটা আবার ঝালাই করে নিলো।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে সবার সাথে ভালোমতো যোগাযোগ করে মুস্তাফা মায়মুনাকে সেই নরক থেকে বের করে আনার একটা প্ল্যান দাড়া করেছে। প্রথমে সবার সুবিধা অনুসারে একটা দিন তারিখ ঠিক করা হবে। মায়মুনা নির্ধারিত দিনের দুই তিন দিন আগে থেকে পেট ব্যাথার কমপ্লেইন করা শুরু করবে। গেস্টহাউজের সবাইকে পেটে ব্যাথার কথা বলবে কিন্তু এমন ভাব করবে যে ব্যথা সহ্য করা যাচ্ছে। নির্ধারিত দিনে সকাল থেকে ওর ব্যাথাটা বাড়তে থাকবে। তারপর সন্ধ্যার দিকে মায়মুনার ব্যথাটা অসহ্যকর পর্যায়ে চলে যাবে। মায়মুনার স্বামী ইব্রাহিম মারা যাবার পর যেদিন প্রথম ও এই গেস্ট হাউজে উঠে এসেছিলো সেদিনও তো পেট ব্যাথার নাম করে হাসপাতালে গিয়ে ওর মোবাইল ফোনটা আনতে পেরেছে। তাই মায়মুনার বিশ্বাস এবারও ও ঠিকঠাকমতো হাসপাতালে পৌঁছে যেতে পারবে। তাছাড়া মায়মুনার ইতিমধ্যে গেস্টহাউজের তত্বাবধায়নে যেই সব সিস্টার আছে সবাইকে ভালোমতো চেনা হয়ে গেছে। ও ঠিক জানে কার মন নরম, কার মন কঠিন। কাকে ওর পেট ব্যাথার কথা বললে ওকে ছুটোছুটি করে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করে দিবে সেটা মায়মুনা ভালোমতোই জানে। সেই মোতাবেক ও সব করবে। মায়মুনা সবাইকে আশ্বস্ত করেছে যে সময় তারিখ জানালে সেইমতো ও হাসপাতালে পৌঁছে যাবে। সেটা নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবেনা।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পরের দায়িত্ব সিস্টার রাবেয়ার। ডাক্তার রাবেয়া ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে আছেন। সুতরাং মায়মুনা হাসপাতালে পৌঁছালে উনার কাছেই নেওয়া হবে। আর সেইদিন মায়মুনার জন্য উনি বিশেষভাবে সচেতন থাকবেন। সিস্টার রাবেয়া মায়মুনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিবেন। এমনভাবে ভর্তি করবেন যাতে করে গেস্টহাউজের সিস্টার ওকে রেখে চলে যায় কিন্তু মায়মুনা হাসপাতালের স্টাফদের বেশি নজরে না পড়ে। এরপর রাত একটু বাড়লে মায়মুনাকে উনি হাসপাতালের পিছনের এক দরজা দিয়ে বের করে দিবে। সেখানে মুস্তাফার ঠিক করে দেওয়া লোকরা অপেক্ষায় থাকবে। ওরা গাড়িতে করে মায়মুনাকে তুলে নিয়ে যাবে। রাকা শহর থেকে টারকির কিলি বর্ডারে যেতে ওদের চার থেকে পাঁচ ঘন্টার মতো সময় লাগবে। তাই সকাল বেলা যখন সবার খেয়াল হবে যে মায়মুনা উধাও, ততক্ষনে মায়মুনা বর্ডার ক্রস করে টারকি পৌঁছে যাবে। ওরা ব্যাপারটা সিস্টার রাবেয়াকে কনফার্ম করলেই উনি হাসপাতালে মায়মুনার খোঁজ করা শুরু করবে। উনার চেষ্টা থাকবে তার আগে যাতে কেউ ব্যাপারটা খেয়াল না করে। আর সিস্টার রাবেয়া যাতে বিপদে না পড়ে সেকারণে তিনি অন্যান্য রুগীদের নিয়ে সারা রাত যথাসম্ভব ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করবে। যাতে করে সবার মনেহয় মায়মুনা নিজে নিজেই পালিয়ে গেছে।
রাকা থেকে টারকির বর্ডার, সেখান থেকে ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট আর তারপর সোজা হিথরো এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মুস্তাফার ঠিক করে দেওয়া লোকজনই মায়মুনাকে হেল্প করবে। এরা এসব কাজে বিশ্বস্ত এবং প্রফেশনাল। প্রতিনিয়ত সিরিয়া থেকে এই ধরণের ছেলেমেয়েদের বের করে আনছে। কিন্তু এর জন্য আসাদের কম পাউন্ড খরচ হচ্ছেনা। প্রত্যেকটা পদে পদে ওরা চার্জ করছে। আসাদ আর মুনিরার এছাড়া তো আর কোনো উপায় নাই। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে মুস্তাফার উপর আস্থা রেখে জলের মতো টাকা ঢালছে ওরা। আল্লাহ আল্লাহ করে মেয়েটাকে ওরা সহি সালামতে বের করে আনতে পারলে হয়। তবে সিস্টার রাবেয়া কোনো টাকা পয়সা নিতে রাজি হয়নি। মুস্তাফা অফার করেছিল। টাকা অফার করায় উনি বেশ অফেন্ডেড হয়েছিল। তাই ওরা আর কথা বাড়ায়নি।
পরিকল্পনাটা আবার ভালোমতো আসাদ আর মুনিরাকে বুঝিয়ে দিলো মুস্তাফা। তারপর বললো,
– পুরো পরিকল্পনাটা কিন্তু বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে অনেকে বেরিয়ে আসতে পারে আর অনেকেই পারেনা। অনেকেই ধরা পড়ে যায়। আর ধরা পড়ে গেলে এর পরিনাম তো আপনাদের জানা আছে। এরপরও কি আপনারা ব্যাপারটা আগাতে চান?
আসাদ চুপ করে থাকলো। ওর বুকের ব্যথাটা বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু মুনিরা সাথে সাথে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। মুনিরার মনে হয়েছে এছাড়া ওদের আর কোনো উপায় নেই । ওখানে থাকলে তো মেয়েটা নির্ঘাত মারা পড়বে। হয় আজ নয় কাল। এর চেয়ে কি পালানোর চেষ্টা করা ভালোনা? আর পুরো ব্যাপারটায় মায়মুনাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে মুনিরার। ওর বিশ্বাস মায়মুনা আর সবাই মিলে সবকিছু ঠিকঠাকমতো করতে পারবে। মুনিরা তো এর জন্য দিনরাত দোয়া পড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ কি ওর দোয়া কবুল করবেনা?
মুনিরার সম্মতি পেয়ে মুস্তাফা বললো,
– তাহলে একটু তাড়াতাড়ি মায়মুনাকে পাসপোর্টের ব্যাপারটা দেখতে বলেন। রাকা শহর একটুও নিরাপদ না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
সব পরিকল্পনা মোটামুটি ঠিক। এখন শুধু একটা কারণে ব্যাপারটা ঝুলে আছে। সেটা হলো মায়মুনার পাসপোর্ট। মায়মুনার কাছে ওর পাসপোর্ট নাই। ওদের গেস্ট হাউজে ম্যানেজার টাইপের এক সিস্টার আছে। সে সবার পাসপোর্ট নিয়ে রেখে দিয়েছে। সিরিয়া থেকে বের হয়ে টারকিতে আসতে যা যা কাগজপত্র লাগবে তা সব মুস্তাফার লোকরা রেডি করে রাখবে। কিন্তু অতপরও মায়মুনার পাসপোর্ট লাগবে। তাছাড়া সেই পাসপোর্ট ছাড়া তো ও ইস্তানবুল থেকে প্লেনে উঠতে পারবেনা। মায়মুনা জানে গেস্ট হাউজের কোন আলমারিতে সব পাসপোর্ট রাখা। সেই আলমারির চাবি আবার রিসেপশন ডেস্কের ড্রয়ারে থাকে। তবে যেই রুমে আলমারি, সেই রুম, রিসেপশন ডেস্ক, এই সব পরিষ্কার করার দায়িত্ব মায়মুনার।
মায়মুনার এখন একটাই দায়িত্ব। কোনোরকমে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রিসেপশনের ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে সেই আলমারি থেকে পাসপোর্ট বের করে আবার কেউ টের পাবার আগেই চাবিটা জায়মতো রেখে দেওয়া। মায়মুনা বলেছে যেভাবেই হোক ও কাজটা করার চেষ্টা করবে। পাসপোর্টটা হাতে পেয়েই মায়মুনা মুনিরা আর আসাদকে জানাবে। আর সেটা জানা মাত্রই মুস্তাফা সাথে সাথে দিন তারিখ ঠিক করে ফেলবে।
আজকেও মায়মুনা পাসপোর্টের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। ও যতক্ষণ ঘরদোর পরিষ্কার করছিলো, এক মুহূর্তের জন্যও রিসেপশন ডেস্ক বা সেই আলমারির রুম খালি পায়নি ও। তবে মায়মুনা বলেছে যে প্রায় সময়ই সেই ডেস্ক বা রুমে কেউ থাকেনা। কেন যেন এই কয়দিন ও সুযোগ পাচ্ছেনা।
মুনিরার ভীষণ অস্থির লাগছে। ওর মনে হচ্ছে দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? প্রতিদিন রাকা শহরের ভয়ঙ্কর সব খবর আসছে। প্রতিদিন ওর বুকটা কেঁপে উঠছে। একটা পাসপোর্ট বের করতে এত সময় লাগছে কেন মায়মুনার?
(চলবে)
©আমিনা তাবাস্সুম
(আগামী পর্ব শনিবার, আর না পারলে রবিবারে পোস্ট করবো ইনশাল্লাহ)