মরীচিকার সন্ধানে
পর্ব – ১
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। মায়মুনা এখনো বাসায় ফিরেনি, মোবাইলটাও বন্ধ। মুনিরার ভীষণ অস্থির লাগছে। এমন এক ধরণের অস্থিরতা যা কাউকে বুঝানো সম্ভব না। পনেরো বছরের লন্ডনে বড় হওয়া একটা মেয়ে অবশ্য সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বাইরে থাকতেই পারে। আর এমন না যে ও সন্ধ্যায় কখনো বাইরে থাকেনা। বুধবারে পাঁচটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত ওর কারাটে ক্লাস থাকে। ওদের স্কুলের এক হল ঘরেই কারাটে ক্লাস হয়। সেইদিন স্কুলের ক্লাস শেষ হয়ে গেলে মায়মুনা স্কুলেই থেকে যায়। কারাটে ক্লাস শেষ করে একবারে বাসায় ফিরে। সেই দিনগুলো ওর বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায়ই সাতটা বেজে যায়। তাছাড়া কিছুদিন হলো কাছের মসজিদটাতে “সিস্টারস ফোরাম” বলে ধর্ম আলোচনার এক সেশনে যোগ দিয়েছে মেয়েটা। সেটাও ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত চলে। কিন্তু সেখানে গেলে ও আগে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসে, তারপর খাওয়া দাওয়া করে, কাপড় চোপড় বদলে মুনিরাকে বলেই সেখানে যায়। আজ ওর কারাটে ক্লাস নেই। স্কুল শেষ হয়েছে সেই সাড়ে তিনটার সময়। স্কুল থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে বড়োজোর আধ ঘন্টা লাগে। সাধারণত ও সোয়া চারটা, সারে চারটার দিকে চলে আসে। কদাচিৎ বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে একটু দেরি করে ফেলে। কিন্তু দেরি হলে মুনিরাকে সাধারণত ফোন করে জানিয়ে রাখে। আর ও না জানালেও মুনিরা ফোন করলে সাথে সাথে পেয়ে যায়। মোবাইলটা তো সবসময় মেয়েটার হাতের মুঠোর মধ্যেই থাকে। মুনিরার তো মাঝে মাঝে মনেহয় যে মোবাইল না তো, একেবারে যক্ষের ধন। এক মুহূর্তের জন্য মায়মুনা সেটা হাতছাড়া করেনা।
কিন্তু আজকে ওকে মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছেনা। মোবাইলটা একদম বন্ধ। এরকম কোনোদিনও হয়নি। এই ভাবতে ভাবতে মুনিরা আসাদকে একটা ফোন দিলো। আসাদও ফোন ধরছেনা। আসাদকে মোবাইলে না পেয়ে একটা মেসেজ করে দিয়ে মুনিরা আবার মায়মুনাকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করলো। না, এখনো মোবাইল সুইচড অফ। অগত্যা মুনিরা ছেলেমেয়েদের জন্য রাতের খাবার গরম করায় মন দিলো। কিন্তু ওর মন আপাতত অস্থির। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কী হলো মেয়েটার? আজকাল ভীষণ বেয়াখেয়ালী হয়ে যাচ্ছে মায়মুনা। কয়েকজন প্রাণের বান্ধবী জুটিয়েছে, সারাটাদিন মোবাইলে তাদের সাথে হা হা হি হি আর গুজুর গুজুর চলতে থাকে। নিশ্চয়ই কারো বাসায় গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। হয়তোবা মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বুদ্ধি করে যে অন্য কারো মোবাইল থেকে একটু মা কে জানাবে সেই খেয়ালও নবাবজাদীর হয়নি। আজ বাড়ি ফিরলে ওকে একটু ভালোমতো শাসন করতে হবে। শাসন না করায় মেয়েটা আশকারা পেয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে। আসাদের তো ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথা নাই। সব মুনিরাকেই সামলাতে হয়। এইসব চিন্তা করতে করতে খুব ধীরে ধীরে খাবার গরম করছিলো মুনিরা। ওর চোখ বারবার চলে যাচ্ছে মোবাইলের স্ক্রিনে। যেখানে মায়মুনার কন্টাক্ট ওপেন করে রাখা। মুনিরার মনে হচ্ছে এই বুঝি এই নামটা থেকে একটা কল স্ক্রিনে ভেসে উঠবে।
অনেক শখ করে মুনিরা ওর বড় মেয়ের নাম মায়মুনা রেখেছিলো। ওর বাবার শখ ছিল প্রথম সন্তানের নাম রাখবে ফাতিমা। নবীজির মেয়ের নামে হবে তার মেয়ের নাম। কী অসাধারণ একটা ব্যাপার না? কিন্তু মায়মুনার বাবা আসাদ আবার স্ত্রী অন্তপ্রাণ। তাই মুনিরার শখের কাছে নিজের শখ খুশি মনেই সে বিসর্জন দিয়ে দেয়। তাদের প্রথম সন্তানের নাম রাখা হয় “মায়মুনা”, মানে ব্লেসেড বা সৌভাগ্যশালী। মুনিরা অবশ্য নামের মানে দেখে মেয়ের নাম রাখেনি। না, ওর নিজের নাম মুনিরার সাথে মিল করেও মেয়ের নাম রাখেনি। মুনিরা যখন মায়মুনাকে নিয়ে প্রেগনেন্ট তখন ইস্ট লন্ডনের এক পার্কে ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়েকে খেলতে দেখে। মুনিরা তখন জানতোনা যে ওর নিজের ছেলে হবে না মেয়ে হবে। কিন্তু সেই মেয়েটিকে দেখা মাত্রই ওর কেন যেন মনে হয়েছিলো যে ওরও ঠিক এরকম একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে। পার্কে মুনিরা হাঁটতে গিয়েছিলো। প্রেগনেন্সির সেই সময়টায় ডাক্তার বেশি বেশি হাঁটাচলা করতে বলেছিলো। কিন্তু সেই শিশুটিকে দেখা মাত্র মুনিরা হাঁটার কথা ভুলে গিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এত ফুটফুটে মিষ্টি দেখতে কোনো বাচ্চা হয়? কোন দেশের হবে বাচ্চাটা? সিরিয়ান নিশ্চয়ই, দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। আর এই এলাকায় সম্প্রতি বেশকিছু সিরিয়ান পরিবার এসেছে। সেই মায়েরা দল বেঁধে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এই পার্কে খেলতে নিয়ে আসে।
এরপর শিশুটির মায়ের ডাকে মুনিরার সম্বিৎ ফিরে। “মায়মুনা মায়মুনা” বলে শিশুটিকে ডাক দিয়ে ওর মা হেসে হেসে বেশ উঁচু স্বরেই আরবীতে কী যেন কথা বলে। শিশুটির বয়স বড়োজোর দেড়বছর হবে। মায়ের কথা বুঝার বয়স হয়নি তার। তারপরও মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলের পিচ্চি মেয়েটি হাসতে হাসতে দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে মুগ্ধ নয়নে মায়ের কথা শুনতে থাকে। এমন ভাব যে মায়ের কথা সব বুঝছে সে। মুনিরা ওদের স্বর্গীয় আলাপে একেবারে বুদ্ হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক সেইসময়ই আসাদ ওর পাশে এসে তাড়া দেয়। বলে,
– কী হলো? চলো। এখন না গেলে পরের বাসটা তো আর ধরতে পারবোনা।
মুনিরাও আর কথা না বাড়িয়ে পা চালায়। ও নিজেও বাস মিস করতে চায়না। কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক থেকে থাকে একটা নাম, “মায়মুনা”। মুনিরা সেই মুহূর্তেই ঠিক করে ফেলে যে ওর মেয়ের নাম রাখবে “মায়মুনা”।
সেই রাতে বিছানায় মুনিরা আসাদের হাতটা নিয়ে নিজের বিশাল পেটটার উপর চেপে ধরে। বলে,
– দেখেছো, কী দস্যি একটা মেয়েরে বাবা। সেই কখন থেকে নড়েই যাচ্ছে। থামাথামির কোনো লক্ষণ নাই।
আসাদ হাত দিয়ে অনাগত সন্তানের নড়াচড়া অনুভব করার চেষ্টা করতে করতে বলে,
– দস্যি মেয়ে মনে হলো কেন? ছেলে না কেন?
– আমি জানি মেয়ে।
মুনিরার চোখে মুখে রহস্যময় এক হাসি। আসাদ জানে মুনিরা রহস্যময়তা পছন্দ করে। এরকম অনেককিছু সে জানে মনে করে ভেবে বসে থাকে। কখনো সেগুলো ঠিক হয় কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই ঠিক হয়না। তাই আসাদ আর কথা না বাড়িয়ে বাচ্চাটার হাত পা ছুড়াছুড়িতেই মনোনিবেশ করে। আসলেই তো, অনবরত নড়ে যাচ্ছে। কী চঞ্চল বাচ্চারে বাবা!
– আমি ঠিক করেছি আমার মেয়ের নাম “মায়মুনা” রাখবো।
হঠাৎ মুনিরার এই কথা শুনে আসাদ একটু অবাকই হয়। ওরা তো বাচ্চার নাম আগেই ঠিক করে রেখেছে। অনেক চিন্তা-ভাবনা, আলোচনা-পর্যালোচনা, ঝগড়া-ঝাটি করে ঠিক করেছে। ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা মুনিরা আগে থেকে ইচ্ছা করেই জানতে চায়নি। আসাদের অবশ্য একটু জানার ইচ্ছা ছিল কিন্তু মুনিরা যখন জানতে চায়না তখন আর সে কিছু বলেনি। ঠিক হয়েছে মেয়ে হলে নাম রাখবে ফাতিমা আর ছেলে হলে নাম রাখবে মোহাম্মদ, স্বয়ং নবীজির নামেই নাম। তাই একটু অবাক হয়েই আসাদ বলে,
– আবার নতুন নাম আসলো কোথা থেকে? আমরা তো নাম ঠিকই করে রেখেছি।
– হ্যা, কিন্তু এখন আমি মত পাল্টেছি। আমার মেয়ের নাম রাখবো আমি মায়মুনা। এটাই ফাইনাল।
আসাদ আর কথা বাড়ায়নি। আগে মেয়ে তো হোক, তারপর দেখা যাবে। আর এরমধ্যে মুনিরা যে আর কতবার মত পাল্টাবে তার কি কোনো ঠিক আছে নাকি।
মুনিরা অবশ্য আর মত পাল্টায়নি। এর দেড়মাস পর ঠিকই ওদের একটা ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। শ্যামবর্ণ, কোঁকড়া চুল আর চোখের তারার গভীরতা মিলিয়ে ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। মুনিরার মনে হয়েছিল ঠিক যেন সেই পার্কে দেখা সিরিয়ান শিশুটির মতো। শুধু গায়ের রংটা একটু চাপা। মায়মুনা হবার সময় মুনিরার এত কষ্ট হয়েছিল যে আসাদ ওর কষ্ট দেখে ঠিক করে ফেলে যে মেয়ের নাম মায়মুনাই হোক। মুনিরার যখন এত শখ।
সে তো গেলো পনেরো বছর আগের কথা। মায়মুনার জন্মের পর পাঁচ বছর পর্যন্ত মুনিরার জগৎ ছিল শুধু মায়মুনাকেই নিয়ে। এরপর পর পর ওদের আরো তিনটি সন্তান হয়েছে। আরো দুটি মেয়ে আর সবশেষে এক ছেলে। অন্য দুই মেয়ে ফাতিমার বয়স দশ আর আমিনার বয়স আট। আর একমাত্র ছেলে মোহাম্মদের বয়স ছয়। মুনিরার এখন আর আসাদের সাথে রহস্য, আহ্লাদ করার সুযোগ বা সময় কোনোটাই হয়না। প্রবাসের সংসার আর চার সন্তান নিয়ে ওর একেবারে নাস্তানাবুদ অবস্থা। আর আসাদ এতদিন বাংলাদেশি এক রেস্টুরেন্টে দিন রাত কামলা খেটে সংসার চালাতো। বহুদিন ধরে এই কষ্টার্জিত অর্থ একটু একটু করে জমিয়ে আর সাথে কিছু ব্যাংক লোন নিয়ে সম্প্রতি নিজেই একটা ছোটোখাটো টেকঅ্যাওয়ে রেস্টুরেন্ট দিয়েছে। নতুন ব্যবসা দাড়া করতে তো একটু সময়ের প্রয়োজন। তাই দিনরাত সেই ব্যবসার পিছনেই সময় কাটাচ্ছে সে। সংসারের কোনো ব্যাপারে আসাদের কোনো দৃকপাতই নেই, সবকিছু মুনিরাই করে। সেই সংসার চালাতে গিয়ে মুনিরার একদণ্ড বিশ্রাম নেবার ফুরসৎ মিলেনা। কিন্তু তারপরও তো নিজের সংসার, নিজের সন্তান, নিজের জীবন। এটাই মুনিরার জগৎ। এই জীবন যেমন কষ্টের, তেমন আনন্দেরও।
চুলা থেকে মুরগির মাংস ছেলের প্লেটে বেড়ে দিচ্ছিলো মুনিরা। হঠাৎ মোবাইলের আওয়াজে চমকে উঠে ও। হাত ছলকে অনেকখানি মুরগীর ঝোল নিজের হালকা নীল কামিজের উপর পড়ে গিয়ে মাখামাখি হয়ে যায়। সেদিকে খেয়াল না করে ও ছুটে গিয়ে ফোনটা ধরার চেষ্টা করে। নিশ্চয়ই মায়মুনার ফোন। নাহ, “নো কলার আইডি” থেকে একটা ফোন বাজছে। নানান মার্কেটিং কোম্পানি থেকে স্প্যাম কল প্রায়ই আসে, মুনিরা কখনো ধরেনা। কিন্তু মুনিরার এখন মনে হচ্ছে যে ফোনটা ধরা উচিত। যদি মায়মুনার ফোন হয়।
ফোনটা ধরেই হতাশ হয়ে গেলো মুনিরা। মায়মুনার ফোন না। ওপাশ থেকে মিষ্টি গলার একটা মেয়ে ব্রিটিশ ইংলিশে হড়হড় করে কথা বলে যাচ্ছে। তাদের কোম্পানির গাড়ির ইন্সুরেন্স নাকি ইংল্যান্ডের বেস্ট ইন্সুরেন্স। শুনেই মুনিরার বিরক্ত লাগলো। ওর কি এখন এইসব ছাইপাশ কথা শুনার অবস্থা আছে? ওর চোখ সামনের দেওয়ালের ঘড়ির কাটায় গিয়ে স্থির হয়ে গেলো। রাত প্রায় আটটা বাজে। মায়মুনা এখনো বাসায় ফিরেনি। এরকম কোনোদিনও হয়নি। কোনোদিনও না। লন্ডনে এখন ডিসেম্বর মাস। বছরের এই সময়টায় সন্ধ্যা নামে সেই চারটার দিকে। সেই হিসেবে এখন বেশ গভীর রাত। মুনিরা কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে ইন্সুরেন্স কোম্পানির কলটা কেটে দিলো। ওর হাত পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে আসছে।
©আমিনা তাবাস্সুম
(চলবে)