মরীচিকার সন্ধানে পর্ব – ২

মরীচিকার সন্ধানে
পর্ব – ২

ফাতিমা, আমিনা আর মোহাম্মদ তিন ভাই বোন নিঃশব্দে ভাত খেয়ে যাচ্ছে। ছয় বছরের মোহাম্মদ হলো দুষ্টের শিরোমণি। সারাটাদিন মুনিরাকে একেবারে চরকির উপর রাখে। কিন্তু এই মুহূর্তে ও একদম চুপচাপ ভাত খেয়ে যাচ্ছে। ভাত খেতে যে মোহাম্মদের ভালো লাগছে, তা না। অন্যদিন হলে এতক্ষনে মায়ের সাথে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিতো। কিন্তু আজ ও বুঝতে পারছে যে মাকে ডিস্টার্ব করা যাবেনা। মা আপাতত অশান্তিতে আছে। মুনিরা ওদের সাথে খাবার টেবিলেই বসে আছে। বসে ত্রস্ত হাতে মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট ঘেঁটে দেখছে। কিন্তু মায়মুনার কোনো বান্ধবীর নাম্বারই মুনিরার কাছে নাই। কেন যে মেয়েটার বন্ধু-বান্ধবের নাম্বারগুলো রাখার কথা মুনিরার মাথায় আসেনি। আর মাথায় আসলেই কি মায়মুনা সবার নাম্বার দিতো? ঠিকই ঠোঁট উল্টে বলে দিতো যে আমার ফ্রেন্ডের নাম্বার দিয়ে তুমি কী করবে। আসলেই তো, ওর ফ্রেন্ডের নাম্বার দিয়ে মুনিরা কী করবে? কিন্তু এই মুহূর্তে মুনিরার মনেহচ্ছে সবার মোবাইল নাম্বার ওর কাছে থাকা খুবই দরকার ছিল। মুনিরার হঠাৎ মায়মুনার ক্লাসের রাইসার কথা মনে পড়ে গেলো। রাইসা মায়মুনার তো কাছের বান্ধবীই। রাইসার মা মুনিরার পরিচিত। আর উনার ফোন নাম্বারও মুনিরার কাছে আছে। রাইসাকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাক ও মায়মুনার কোনো খবর জানে নাকি। সাথে সাথেই মুনিরা রাইসার মাকে কল দিলো। দুইটা রিং বাজা মাত্রই ওপাশ থেকে রাইসার মায়ের হ্যালো ভেসে উঠলো। মুনিরা সময় নষ্ট না করে নিজেই কথা শুরু করে দিলো,

– আসালামুআলাইকুম ভাবি। চিনতে পারছেন? আমি মায়মুনার মা।

– জ্বি ভাবি, চিনবো না কেন? আপনার নাম্বার তো আমার মোবাইলে সেভ করা আছে। আপনি তো একদমই ফোন টোন করেন না, যোগাযোগ রাখেন না। খবর কী আপনাদের?

– না ভাবি, আসলে বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আপনাকে একটা কাজেই ফোন দিলাম। রাইসা কি কাছে আছে?

– রাইসা? আচ্ছা দাঁড়ান ওকে ডাক দেই। কেন রাইসাকে কোনো দরকার?

মুনিরা আর কিছু বলার সুযোগ পেলোনা। ওপাশ থেকে রাইসার মা মোটামুটি চিৎকার করেই রাইসাকে ডেকে যাচ্ছে। এত জোরে ডাকছে যে মুনিরার নিজের কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। প্রায় এক দুই মিনিট ধরে ডাকাডাকির পর বের হলো রাইসা শাওয়ার নিতে গেছে।
মুনিরা বললো,

– আচ্ছা ভাবি, ও বের হলে আমাকে কষ্ট করে একটু ফোন দিবেন?

– কেন? রাইসা কিছু করেছে নাকি?

– না না। মায়মুনা এখনো স্কুল থেকে বাসায় ফিরেনি। মোবাইলও বন্ধ। মনেহয় মসজিদের সিস্টার্স সার্কেলে গেছে। যোগাযোগ করতে পারছি না তো, তাই একটু চিন্তায় আছি। রাইসা কিছু জানে নাকি জানতে চাচ্ছিলাম।
– ভাবি, আপনি ওকে ঐসব মসজিদের সিস্টার্স সার্কেলে যেতে দেন? একদম দিবেন না। ওসব জায়গায় মেয়েদের ব্রেইনওয়াশ করা হয়। রাইসাও একবার যেতে চেয়েছিলো। আমি বলেছি খবরদার না। ওসব কথা আর যেন মুখেও আনেনা। যতসব গোঁড়াদের আড্ডাখানা। আপনি মায়মুনার দিকে খেয়াল রেখেন।

মুনিরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। বেশিদিন হয়নি মায়মুনা সেই সার্কেলে যোগ দিয়েছে। একবার মুনিরাও মসজিদে গিয়ে দেখে এসেছে। অল্পবয়সী কয়েকজন মেয়ে একসাথে মিলে ধর্ম কর্ম করার চেয়ে হা হা হি হি করছেই বেশি। মুনিরার পরিবেশটা বেশ ভালোই লেগেছে। বাসায় বসে সারাদিন অর্ধ উলঙ্গ ছেলেমেয়েদের ব্যান্ডের নাচ গান দেখা আর মোবাইলে গেম খেলার থেকে অনেক ভালো।

তাছাড়া শান্তা ভাবীর মেয়ে নাবিলা ছোটবেলা থেকে এইধরণের সার্কেলে যুক্ত ছিল। মেয়েটা এখন একজন বিশাল ডাক্তার। নাবিলা হলো মুনিরার দেখা সবচেয়ে আদর্শ মেয়ে। মুনিরার শখ মায়মুনাও নাবিলার মতো হবে। ইংল্যান্ডে বড় হওয়া মেয়ে নাবিলা। কী সুন্দর ওর আচার ব্যবহার, দেশের প্রতিও টান আছে, সুন্দর বাংলা বলে, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে আবার ধর্মের প্রতিও ভীষণ সম্মান। ডাক্তার হবার পর সুযোগ পেলেই ও ছুটি নিয়ে দেশে গিয়ে গরিব বাচ্চাদের চিকিৎসা করে আসে। সবদিক দিয়ে নাবিলা একদম পারফেক্ট। মুনিরার ধারণা এই ধর্ম কর্মের সাথে নাবিলা সবসময় ভীষণভাবে জড়িত ছিল দেখে এত সুন্দরভাবে বড় হয়েছে মেয়েটা।

মুনিরা এব্যাপারে রাইসার মায়ের সাথে আর কথা বাড়ালোনা। বললো,

– আপনি রাইসা বের হলে একটু আমাকে ফোন দিয়েন প্লিজ।

– দাঁড়ান ভাবি। রাইসা মনেহয় বের হচ্ছে। দরজা খোলার শব্দ পেলাম।

মুনিরা ফোন ধরে বসে আছে। ওপাশে ভাবি রাইসার সাথে কথা বলছে। কী বলছে মুনিরা তা কান খাড়া করে শুনার চেষ্টা করছে কিন্তু পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেনা। বেশিক্ষন অপেক্ষা করা লাগলোনা। এক মিনিটের মধ্যেই ভাবি আবার মুনিরার সাথে কথা বলা শুরু করলো,

– ভাবি, রাইসা তো বলছে যে মায়মুনার নাকি জ্বর? আজকে ও স্কুলে যায়নি।

– জ্বর? না তো ভাবি। কে বললো?

– আচ্ছা, আপনি রাইসার সাথে কথা বলেন। রাইসা তো বলছে যে আজ ও স্কুলেই যায়নি। আজকে ম্যাথস টেস্ট ছিল নাকি। মায়মুনা মিস করেছে। আপনি রাইসার সাথে কথা বলেন।

মুনিরার হৃদস্পন্দন মনেহয় ক্ষনিকের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। রাইসা কী বলছে? নিশ্চয়ই মায়মুনা স্কুলে ছিল। ও খেয়াল করেনি। মুনিরা কিছু বলার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে রাইসার গলা শুনা গেলো। এদেশে বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের মতো ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে টেনে টেনে বাংলা বলছে। অ্যাকসেন্ট থাকলে কী হবে, পরিষ্কার বাংলা ওর, খুব একটা ইংরেজি শব্দের ব্যবহারও নাই। রাইসা পরিষ্কারভাবে জানালো যে মায়মুনা আজ স্কুলে ছিলোনা। রাইসা নাকি ম্যাথস টেস্টের আগে ওকে খুঁজেছেও। টিচার বলেছে যে ওর জ্বর তাই ও আসতে পারেনি। বাসায় ফিরেই রাইসা ভেবেছিলো মায়মুনা কেমন আছে তা জানার জন্য ওকে একটা মেসেজ করবে। কিন্তু এখনো করা হয়নি।

মুনিরা আর কোনো কথা না বলেই ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটা ছেড়েই ও প্রথমে আসাদকে কল করলো। নাহ, আসাদ এখনো ফোন ধরছেনা। এরপর লাইনটা কেটে দিয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ৯৯৯ নাম্বারে ডায়াল করলো।
ওপাশ থেকে সাথে সাথে একজন বলে উঠলো,

Which emergency service you need?

মুনিরা আগে কখনো ৯৯৯ কল করেনি। এর মানে কী? কী বলতে হবে মুনিরাকে? ও তো ঠিক জানেনা। মুনিরার গলা কাঁপছে। ওর হাত পা কাঁপছে। মুনিরাকে চুপ দেখে আবার বলে উঠলো,

Which emergency service you need? Police, ambulance or fire?

মুনিরা এতবছর এদেশে থেকেও ইংরেজিটা পুরোপুরি রপ্ত করে উঠতে পারেনি। কিন্তু আবার একেবারে যে কিছু বলতে পারেনা তা না। কাজ চালানোর মতো ইংরেজি সে জানে। তাছাড়া বাচ্চারা তো বাসায় নিজেদের মধ্যে বেশিরভাগ সময় ইংরেজিতেই কথা বলে। তাই বুঝতে ওর কোনো অসুবিধা হয়না। কিন্তু এখন কেন যেন ওর মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছেনা। কয়েক সেকেন্ড নিজেকে একটু ধাতস্ত করে নিয়ে বললো,

– পুলিশ প্লিজ। মাই ডটার ইজ মিসিং। ও স্কুল থেকে বাসায় ফিরেনি। ওর এক বান্ধবী জানালো যে আজ নাকি ও স্কুলেই ছিলোনা। আমার মনেহয় সকাল বেলা স্কুলে যাবার পথে ওর কোনো ক্ষতি বা একসিডেন্ট হয়েছে। আমার মেয়েকে তোমরা এখুনি খুঁজে বের করো।

কাঁপা কাঁপা গলায় ভাঙা ইংরেজিতে মুনিরা কোনোরকমে কথাগুলো বলে উঠলো। মুনিরা আশা করেছিল এই মুহূর্তেই ওরা পুলিশ পাঠিয়ে মায়মুনাকে খোঁজা শুরু করে দিবে। কিন্তু মোটেও তা না। পুলিশ নানান প্রশ্ন করা শুরু করে দিলো। মায়মুনার নাম, বয়স, স্কুলের ডিটেইলস থেকে শুরু করে আজকের সকালের ঘটনা, ওর প্রতিদিনের রুটিন, কখনো ও এরকম দেরি করে নাকি, কাদের সাথে মিশে এরকম প্রশ্নের কোনো শেষ নাই। প্রশ্নগুলো বুঝলেও উত্তরগুলো মুনিরা ঠিকমতো গুছিয়ে বলে উঠতে পারলোনা।

পুলিশ কী বুঝলো কে জানে কিন্তু মুনিরাকে আশ্বস্ত করলো যে ওরা কাউকে বাসায় পাঠাচ্ছে যাতে করে ওরা সাহায্য করতে পারে। মুনিরা পুলিশের কথায় কোনো ভরসা পেলোনা। একটু অস্থির হয়ে বললো,

– বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে কী হবে? এই মুহূর্তে মায়মুনাকে খুঁজে বের করে দরকার।

– অবশ্যই। সেকারণেই তো তোমাদের সাহায্য লাগবে। তা না হলে আমরা তো জায়গামতো ওকে খুঁজতে পারবেনা। তোমার হাসবেন্ড কি বাসায় আছে? তার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো।

– না, সে কাজে। কিন্তু আমি তাকে ফোন করে এখুনি বাসায় আসতে বলে দিচ্ছি। একটু তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করো।

– আমরা চেষ্টা করবো তাড়াতাড়ি পাঠাতে কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারছিনা। তবে এক থেকে দুই ঘন্টা লেগে যেতে পারে।

এই শুনে হঠাৎ করে মুনিরা আরো অস্থির হয়ে গেলো। বেশ আঁকুতি মিনতি করেই বলে উঠলো,

– আমার মেয়েটার নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে আর তোমরা একঘন্টার আগে কিছু করতে পারবেনা?

– আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাউকে পাঠাচ্ছি আর এর মধ্যে সিরিয়াস কোনো খবর পেলে অবশ্যই ৯৯৯ এ কল করবে। মুনিরাকে ওরা একটা কেইস রেফারেন্স নাম্বার দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলো।

মুনিরা ফোন ছেড়ে দিয়ে আসাদকে সাথে সাথে কল করলো। যাক, এইবার আসাদ ফোনটা ধরলো। এতক্ষন মুনিরা কষ্ট করে নিজেকে শক্ত রেখেছিলো। কিন্তু আসাদের গলা শুনা মাত্র চিৎকার করে করে কাঁদতে কাঁদতে কোনোরকমে মায়মুনার কথা বলে উঠতে পারলো।

আসাদ শুধু বললো,

– তুমি ফোন রাখো। আমি এখুনি বাসায় আসছি।

মিনিট বিশেকের মধ্যেই আসাদ বাসায় এসে হাজির। মুনিরা এই সময়ের মধ্যে পরিচিত যারা আছে যেখানে মায়মুনার যাবার ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকতে পারে সবার কাছে ফোন করে খবর নেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু মায়মুনার কোনো হদিস বের করা গেলোনা।

আসাদ ফেরার কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসায় প্রায় ছয় সাতজন মানুষ এসে হাজির। দুইজন মহিলা আর বাকি সবাই পুরুষ। তাদের মধ্যে দুইজন শুধু পুলিশের পোশাকে আর বাকিরা একেবারে স্যুট টাই পরা কেতাদুরস্ত সাজসজ্জায়। মুনিরা বুঝতে পারছেনা এরা সবাই পুলিশ নাকি? ওর মাথা ঠিক কাজ করেছেনা। তাদের মধ্যে মধ্যবয়স্ক সাদা এক লোক আইডি দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে এমনভাবে ঘরে ঢুকে গেলো যে মুনিরার মনেহলো ওরা মায়মুনাকে খুঁজতে না, মুনিরার পুরো পরিবারকেই অ্যারেস্ট করতে এসেছে। ঘরে ঢুকেই সেই মধ্যবয়স্ক লোকটা আর আরেকজন মুনিরা আর আসাদকে ওদের পরিচয় জানালো। একজন মেট্রোপলিটন পুলিশের অফিসার আর আরেকজন বললো সে কাউন্টার টেরোরিজম ব্রাঞ্চের অফিসার। “কাউন্টার টেরোরিজম” কথাটা শুনা মাত্রই আসাদের বুকের ভিতর একেবারে ধক করে উঠলো। কাউন্টার টেরোরিজম ব্রাঞ্চের অফিসার এখানে কী করে?

©আমিনা তাবাস্সুম

(চলবে)

পর্ব ১ – https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1259058571275834
পর্ব ২ – https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1259763221205369
পর্ব ৩ – https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1260389041142787
পর্ব ৪ – https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1261082907740067
পর্ব ৫ – https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1262397227608635

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here