মরীচিকার সন্ধানে
পর্ব – ৪
পুলিশের সেই দলবল বাসা থেকে চলে যাবার পর মুনিরা আর আসাদ কী করবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। পুরো ব্যাপারটাই এতটা অবিশ্বাস্য যে ওদের মনেহচ্ছে ওরা স্বপ্ন দেখছে। তবে এটা অবশ্যই সত্যি যে মায়মুনা মিসিং। ওদের বড় মেয়ে, ওদের কলিজার টুকরা মায়মুনা আজ বাসায় ফিরেনি। ওদের হাসিখুশি, আহ্লাদী, একটু বেপরোয়া আর একগুঁয়ে গোছের মেয়েটা আজ বাড়ি ফিরেনি। আর এই বাবা মায়ের সেই মেয়েটাকে কোথাও খুঁজে বের করার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। ওরা এত অসহায় বোধ করছে যে অসহায়ত্বের বোঝাটা ভীষণ ভারী বোধ হচ্ছে। সেই বোঝার ভারেই ওরা যেন সেই সোফা থেকে আর নড়তে পারছেনা।
আসাদ বসে বসে এলোপাথাড়ি নানান চিন্তা করে যাচ্ছে। ওরা এখন কী করবে? ওদের এখন কী করা উচিত? পুলিশের কাছ থেকে খবর পাবার অপেক্ষায় বসে থাকবে? নাকি ওদের নিজেদেরই কোথাও খোঁজ খবর করা উচিত? কিন্তু ওরা আর কোথায় খোঁজ খবর করবে? মুনিরা তো ইতিমধ্যে পরিচিত সবাইকে ফোন করে খবর নিয়েছে। কেউ তো মায়মুনার কোনো খবর জানেনা। আর পুলিশ তো ওদের বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করে গেলো। তাহলে কি ও শুধু এভাবে বসে থাকবে?
চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে ওদের জীবনটা একেবারে তছনছ হয়ে গেলো। ওরা দুইজনই নিঃসন্দেহ যে মায়মুনা মহা বিপদে পড়েছে আর সেই বিপদ থেকে ওদের মেয়েকে এই মুহূর্তে উদ্ধার করা দরকার। মায়মুনা কি আসলেই কি টার্কিতে? ও কি আসলেই আইসিস বাহিনীতে জয়েন করতে গেছে? কিভাবে এটা সম্ভব? আর যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে বেশি দেরি হবার আগে এই মুহূর্তেই ওকে ফিরিয়ে আনা দরকার। আর ধরা হোক যে ও স্বেচ্ছায়ই গিয়েছে, পরিকল্পনা করেই গিয়েছে, তারপরও তো ওকে এই মুহূর্তে ফিরিয়ে আনা দরকার। আরএই কাজটা করতে শুধু পুলিশই পারবে। এতক্ষনে ও নিশ্চয়ই টার্কিতে পৌঁছে গেছে? এরপর ও কোথায় যাবে? ওকে কিভাবে আটকানো সম্ভব। মেয়েটা বর্ডার ক্রস করে গেলে যে মহাবিপদ হয়ে যাবে। এরপর কি মেয়েটাকে আর ফেরানো যাবে?
মুনিরা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। আসাদের মুনিরার উপর এখন একটু বিরক্ত লাগছে। সুযোগ পেলেই মুনিরা বলতে থাকে যে সারাটাদিন ও নাকি ছেলেমেয়েদের পিছে ছুটাছুটি করে মরে। ছেলেমেয়েদের দেখভাল করে কাটিয়ে দেয়। এই সেই দেখভালের নমুনা? এভাবে মেয়েটা চলে গেলো আর মুনিরা এব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা করতে পারেনি? আসাদ নিজে তো এই সংসারের জন্য, সবার ভরণপোষণের জন্য দিনরাত খাটাখাটুনি করে মরছে। আর মুনিরা শুধু একটু বাচ্চাগুলোকে দেখে রাখে সেটাও ঠিকমতো পারলো না? কিন্তু আসাদ মুনিরাকে কিছু বললো না। ওর এখন কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা।
তবে আসাদের মনেহলো এভাবে চুপচাপ বসে থাকলেও চলবেনা। ও পুলিশের রেখে যাওয়া কন্টাক্ট নাম্বারটায় ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কল করার সাথে সাথে রিং না বেজেই সোজা ভয়েসমেলে চলে গেলো। সকাল নয়টার আগে নাকি সেই নাম্বারে কাউকে পাওয়া যাবেনা। অগত্যা আবার ৯৯৯ কল করে পুলিশের সাথে আসাদ কথা বলার চেষ্টা করলো। আসাদের কথা ওরা মন দিয়ে সব শুনলো ঠিকই। কিন্তু তারপর জানালো যেহেতু পুলিশ ইতিমধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করছে তাই ইমার্জেন্সি পুলিশের এই মুহূর্তে আর কিছু করার প্রয়োজন নেই। ওরা আসাদকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো। বললো যেই টিম এই কেস নিয়ে কাজ করছে তারা অবশ্যই গুরুত্বের সাথে কাজ করছে। কোনো আপডেট থাকলে বা কোনো দরকার হলে নিশ্চয়ই সেই টিম আসাদের সাথে যোগাযোগ করবে।
পুলিশের কথায় আসাদ একটুও আশ্বস্ত হলোনা। আসাদের সেই পুলিশ টিমের হাবভাব একটুও ভালো লাগেনি। ওরা অনেকটা সময় এই বাসায় আসাদ মুনিরাকে জেরা করে নষ্ট করেছে। ওই সময়টা এতগুলো মানুষ কি মায়মুনাকে খোঁজার জন্য কাজ করতে পারতোনা? ওদের কথাবার্তায় মায়মুনাকে ফিরিয়ে আনার কোনো তাড়া বা আগ্রহ দেখতে পায়নি আসাদ। ওরা টার্কির পুলিশ ফোর্সের সাথে যোগাযোগ করে মায়মুনাকে আটকানোর আদৌ কোনো চেষ্টা করছে কিনা সেব্যাপারে একবারও কিছু বলেনি। আসাদের এখন কেন যেন মনেহচ্ছে যে ওরা মায়মুনাকে ফিরিয়ে আনার কোনো চেষ্টাই করছেনা। ওরা কাজ করছে ওদের ন্যাশনাল থ্রেট নিয়ে। মায়মুনা তো এখন ইউকের বাইরে। তাই ওদের জন্য মায়মুনা আর থ্রেট না। ওদের চিন্তা মায়মুনার সাথে জড়িত যারা যারা ইউকেতে আছে তাদের কিভাবে ধরা যায় সেটা নিয়ে। ওরা কি ভাবছে যে আসাদ আর মুনিরা এই ব্যাপারে জড়িত? যতই এসব নিয়ে ভাবছে ততই আসাদের ভয় লাগছে। এত ভয় লাগছে যে সেই ভয় ওর চিন্তাশক্তিকে গ্রাস করে ফেলছে। ও বুঝতে পারছে যে ওদের মায়মুনা তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছেই আর সাথে করে ওদেরকেও বিপদের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর ওদের এখানে বসে বসে তিলমাত্র কিছু করার কোনো ক্ষমতা নাই।
মুনিরা এখনো মোটামুটি ডিনায়ালের মধ্যে আছে, ও কিছুতেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছেনা। ও শুধু গত কয়েকদিন না, গত কয়েক সপ্তাহ, গত কয়েক মাসের স্মৃতি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখছে। ভেবে দেখছে মায়মুনার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা ও দেখতে পেয়েছিলো নাকি। হ্যাঁ, আজকাল একটু ফোন নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতো, নিজের রুমে অনেকটা সময় কাটাতো, নামাজ কালামে, ধর্ম কর্মেও একটু মন বেশি ছিল। কিন্তু বাড়াবাড়ি কিছু দেখেনি মুনিরা। ওর মনেহচ্ছে এখানে কিছু একটা ভুল হয়েছে, সাংঘাতিক একটা ভুল হয়েছে। পুলিশ অন্যকারো সাথে মায়মুনাকে গুলিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে মায়মুনা এখন কোথায়?
আসাদ আর মুনিরা কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলছেনা। অনেক্ষন ধরে টানা কান্নাকাটি করার পর মুনিরা যেন একটু ধাতস্ত হলো। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। মুনিরা আসাদকে জিজ্ঞেস করলো,
– টার্কিতে এখন কয়টা বাজে?
– আমাদের থেকে দুইঘন্টার পার্থক্য। রাত আড়াইটা হবে।
– ওরা কি বলেছে মায়মুনা কোন ফ্লাইট ধরেছে? সেই প্লেন কয়টার সময় ইস্তানবুলে ল্যান্ড করেছে?
– না বলেনি। তুমি তো সাথেই ছিলে। যা যা বলেছে তা তো শুনেছই। আবার শুধু শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন? আমি কি আকাশ থেকে এসব খবর পাবো নাকি?
আসাদ রীতিমতো বিরক্ত হয়ে কথাগুলো বলে উঠলো। আসাদের এরকম ব্যবহারে মুনিরার আবার কান্না চলে আসলো। ও আলোচনা করে দেখতে চেয়েছিলো যে আসাদ টার্কিতে কাউকে চেনে নাকি যে এয়ারপোর্টে গিয়ে মায়মুনার খোঁজ করতে পারবে। তবে, মুনিরা এর উত্তর জানে। আসাদ কাউকে চিনেনা। চিনলে মুনিরা তা অবশ্যই জানতো। আসাদ খুবই অন্তর্মুখী মানুষ। ওর তেমন কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। নিজের ব্যবসা আর পরিবার নিয়েই ওর জীবন। মুনিরাই মোটামুটি সবার সাথে যোগাযোগ রাখে। মুনিরা আর কথা বাড়ালোনা। শুধু বললো,
– তুমি খাবে না?
হঠাৎ করে এরকম রেগে যাওয়ার জন্য আসাদের এখন খারাপ লাগছে। ও এখন একটু ঠান্ডা হয়ে বললো,
– তুমি রাতে খেয়েছো?
মুনিরা রাতে খায়নি। কিন্তু এখন সেটা আসাদকে বললে ও খাওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করে দিবে। মুনিরার একটুও ভালো লাগছেনা। তাই বললো,
– হ্যাঁ, বাচ্চাদের সাথে খেয়ে নিয়েছি।
– ওহ, আমি আমার তো খেয়ে নিবো তাহলে। তুমি বরং ঘুমাতে যাও। এখন বসে থেকে আমরা কিছুই করতে পারবোনা।
মুনিরা কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উঠে গেলো। যাবার সময় জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার পরিচিত কেউ টার্কিতে আছে?
– না তো। কেন?
– না, কেউ যদি এয়ারপোর্টে একটু খোঁজ নিতো?
– আমি তো কাউকে চিনিনা। তুমি চিনো?
একটু হতাশ হয়ে মুনিরা মাথা নেড়ে না বলে সেই লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।
আসাদও আর বসে থাকলোনা। মিনিট দুই পরেই উঠে মায়মুনার রুমে গিয়ে ওর ডেস্কটপ কম্পিউটারটা ছেড়ে বসলো। আজকে গ্যাটউইক থেকে কয়টা ফ্লাইট ইস্তানবুলে গিয়েছে, ফ্লাইটগুলোর টাইমিং, কোন কোন বর্ডার দিয়ে টার্কি থেকে সিরিয়ায় যাওয়া যায়, এয়ারপোর্ট থেকে সেই বর্ডারগুলো কতদূর, কিভাবে যাওয়া যায়, কত সময় লাগে, সেই বর্ডার ক্রস করা কত সহজ, ইউকে থেকে আর কারা এরকম আগে বর্ডার ক্রস করেছে, তারা এখন কোথায় এরকম নানান তথ্য ও ইন্টারনেট ঘেটে বের করার চেষ্টা করছে। এইসব তথ্য দিয়ে কী করবে আসাদ তা জানেনা। কিন্তু আসাদকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই এইসব তথ্যগুলো আসাদের ভীষণ প্রয়োজন। এই মুহূর্তেই ওর সবকিছু খুঁজে বের করতে হবে।
অপরদিকে মুনিরা বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নিজের ঘরে এসে একটু বসলো। মুনিরা ঘরে এসে দেখে যে ফাতিমা, আমিনা আর মোহাম্মদ তিনজনই ক্লান্ত হয়ে মুনিরার বিছানার এককোনেই জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেচারা বাচ্চাগুলোও ভীষণ ভয় পেয়েছে। মুনিরা আর ওদের উঠালোনা। থাক ওরা আজ মুনিরার বিছানায়ই ঘুমাক। মুনিরার মনেহলো সকালে ফাতিমার সাথে সবার আগে কথা বলতে হবে। মায়মুনা ওর সাথে কিছু শেয়ার করেছে নাকি। অথবা ও মায়মুনার কোনো বন্ধু বান্ধবকে চিনে নাকি যে মায়মুনার ব্যাপারে কিছু জানতে পারে।
মুনিরা নিঃশব্দে কিছুক্ষন ঘুমন্ত ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কী নিষ্পাপ, কী পবিত্র এই মুখগুলো। মুনিরা জানে ওর মায়মুনাও নিষ্পাপ আর পবিত্র। ওর পেটের মেয়ে মায়মুনা। বাবা মায়ের সবচেয়ে আদরের মেয়ে মায়মুনা। সেই মেয়েটা এখন মহাবিপদের মধ্যে আছে আর মুনিরা কিছুই করতে পারছেনা।
মুনিরা জানে ও কী করতে পারবে। ও আর সময় নষ্ট না করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করে দিলো।
“লা-ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমীন”
“তুমি ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই; তুমি পুতঃপবিত্র, নিশ্চয় আমি জালিমদের দলভুক্ত”
মুনিরা ওর মনের সর্বস্ব দিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলো। ওর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। একমাত্র আল্লাহই পারে এই বিপদ থেকে মায়মুনাকে উদ্ধার করতে। একমাত্র আল্লাহই পারে এই বিপদ থেকে ওদের উদ্ধার করতে। আল্লাহ কি করবেনা? অবশ্যই করবে। মুনিরার দোয়া পড়তে ভালো লাগছে। ওর ধীরে ধীরে বিশ্বাস হচ্ছে যে আল্লাহ এই বিপদ থেকে ওদের উদ্ধার করে দিবে। খুব শীঘ্রই উদ্ধার করবে। কিভাবে করবে মুনিরা জানেনা। ওর জানার দরকার নাই। ও সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলো। সব ক্ষমতা আল্লাহর। ও শুধু সর্বস্ব দিয়ে দোয়া পড়তে লাগলো।
দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তেই একসময় ক্লান্ত হয়ে মুনিরা সেই জায়নামাজের উপরই ঘুমিয়ে পড়লো। কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিল মুনিরা জানেনা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠা মাত্র ও লিভিংরুম থেকে কিসের যেন আওয়াজ শুনতে পেলো। জায়নামাজের উপর এভাবে ঘুম থেকে উঠে ওর কিছুক্ষন লেগে গেল গতকালের সব ঘটনা মনে করতে। তারপর হুড়মুড় করে উঠে লিভিংরুমে এসে দেখে আসাদ আর বাচ্চারা সবাই সোফায় আছে। বাইরে ঝকঝকে আলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা দশটা বেজে গেছে।
আসাদ আর বাচ্চাদের চোখ টেলিভিশনের স্ক্রিনে। ঘুম থেকে উঠে মুনিরা সেই টেলিভিশনের আওয়াজই শুনতে পেয়েছিলো। সেখানে বিবিসির খবর চলছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখে স্ক্রীনজুড়ে মায়মুনার ছবি। খবরে কী বলছে ও যেন শুনতে পাচ্ছেনা। ওর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে।
©আমিনা তাবাস্সুম
(চলবে)