মরীচিকার সন্ধানে পর্ব – ৬

মরীচিকার সন্ধানে
পর্ব – ৬

মুনিরা নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে আছে। বসে বসে এমনিই দোয়া পড়ছে। আসলে দোয়া পড়াটা একটা অছিলা মাত্র। ওর মন এখনো সেই মোবাইল ফোনের দিকে। ও সেই ফোনটা বেজে উঠার প্রতীক্ষায় জায়নামাজে বসে আছে। ওর মন বলছে যে এই ফোন কলটার সাথে মায়মুনার কোনো সংযোগ আছে। এমনি এমনি অবশ্য এই ব্যাপারটা ওর মনে হয়নি। যুক্তিযুক্ত কারণেই মনে হয়েছে। এই পুরোনো ফোনটা আগে মায়মুনার ছিল। মায়মুনা হাইস্কুল শুরু করার পর এই ফোনটা আসাদ ওকে কিনে দিয়েছিলো। সেই প্রথম তো মেয়েটা একা একা স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করলো। কোনো দরকার হলে আসাদ বা মুনিরাকে যোগাযোগ করতে পারে সেই কারণেই এই মোবাইলটা ওকে দেওয়া হয়। পুরোনো আমলের নোকিয়া ফোন আর তাতে “পে অ্যজ ইউ গো” সিম ভরা। কিন্তু খুব অল্পকিছুদিন এই মোবাইলটা ব্যবহার করে মায়মুনা। এরপর স্মার্ট ফোন নেবার জন্য অস্থির হয়ে যায়। ক্লাসের সবার নাকি স্মার্ট ফোন, অনেক ডাটা আছে সেই ফোনে, সবাই ইন্টারনেটে যেতে পারে, পড়াশুনার জন্য কোনো কিছু দরকার হলে সাথে সাথে গুগল করতে পারে আর ও শুধু পুরোনো আমলের ধরধরা একটা মোবাইল নিয়ে বসে থাকে। আসাদ আর মুনিরাও খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা। সব বাচ্চাদের হাতেই স্মার্ট ফোন। তাই ওরা আর কথা বাড়ায়নি। আসাদও এরপর ওকে একটা মোটামুটি দেখে স্মার্টফোন কিনে দেয়।

এরপর এই ফোনটা ওরা অন্য সময় কাজে দিতে পারে মনেকরে রেখে দেয়। কাজে দেয়ও। ফাতিমা কখনো কোন বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গেলে ওকে ফোনটা দেওয়া হয় যাতে করে মুনিরা ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারে। মুনিরার বাবা গত সামারে যখন বেড়াতে এসেছিলো, উনি একা একা বাইরে বের হলে এই ফোনটা ব্যবহার করতো। তাই বাড়ির মানুষরা ছাড়া এই ফোনের নাম্বারটা আর কারো জানার কথা না। মায়মুনা নিখোঁজ হবার পর থেকে আসাদের ধারণা ওদের সবার মোবাইল ফোন ট্যাপ করা হয়েছে, ইন্টারনেট অ্যাকটিভিটিও মনিটর করা হয়েছে। মুনিরার মনে হয়েছে এই পে অ্যাজ ইউ গো ফোনটার কথা নিশ্চয়ই কেউ জানেনা। তাছাড়া গত বছর মুনিরার বাবা চলে যাবার পর মোবাইলটা ব্যবহার হয়নি বললেই চলে। মায়মুনা হারিয়ে যাবার পর ফোন ট্যাপিঙের ব্যাপারটা শুনেই মুনিরা এই ফোনটা বের করে চার্জ করে রেখেছে। যদি কোনো সময় কাজে দেয় সেই আশায়। ফোনটা কোনো কাজে দেয়নি। কিন্তু কী আশ্চর্য এই ফোনটাতেই কে যেন রোজ ফোন করছে। এই ফোনের নাম্বার তো ওরা ছাড়া আর কারো জানার কথা না।

মুনিরা ভীষণ অস্থির হয়ে বার বার মোবাইল ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে। গত তিনদিন তো এই সময়ের মধ্যেই ফোনটা এসেছিলো। আজকে কেন কেউ ফোন করছেনা? জায়নামাজে বসে ও বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছে। মায়মুনা যেদিন হারিয়ে গেলো সেইদিন থেকে ও এই যে দোয়া ইউনুস পড়ে যাচ্ছে তো পড়েই যাচ্ছে। কিন্তু দোয়া পড়াই সার। বিপদমুক্তির ও কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেনা। হঠাৎ করেই মুনিরার বুকটা ভার হয়ে আসছে। কী যেন একটা কষ্ট, কী যেন অভিমান গলার কাছে দলা পেকে আটকে যাচ্ছে। মুনিরা দোয়া পড়তে পারছেনা। কিসের কষ্ট, কার উপর অভিমান? আল্লাহর উপর? আল্লাহর কাছে কি মুনিরার অভিমানের কোনো দাম আছে? যদি থাকতো তাহলে কি আল্লাহ ওকে এই কষ্টের মধ্যে ফেলতো? কোনোদিনই না। মুনিরার দুই চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। ও তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেললো। আসাদ আজকাল মুনিরাকে বেশি কান্নাকাটি করতে দেখলে কেন জানি বিরক্ত হয়। মুনিরা আসাদকে ওর চোখের জল দেখতে চায়না।
হঠাৎ করেই ফোনের আওয়াজে মুনিরা চমকে উঠলো। এইতো ফোন ঠিকই এসেছে। মুনিরা একটুও দেরি না করে ফোনটা কানে দিয়েই হ্যালো বলে উঠলো। ওপাশ থেকে যথারীতি কোনো উত্তর নাই। কিন্তু কেউ যে ফোনটা ধরে বসে আছে তা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে। গত তিনদিন মুনিরা হ্যালো ছাড়া আর কিছু বলেনি কিন্তু আজ ও আর চুপ থাকলোনা। কিছু না ভেবেই বলে উঠলো,

– কে? মায়মুনা? আমার মা মায়মুনা? কথা বলো মা। তোমার কোনো ভয় নাই মা। আমি আছি। আমি কী করতে পারি বলো?

মুনিরা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু এইটুকু কথা বলা মাত্রই ওপাশ থেকে ঝট করে ফোনটা কেটে দিলো।

মুনিরা ফোনটা হাতে নিয়ে বসেই থাকলো। ওর বুক ধড়ফড় করছে। হাত কাঁপছে। না জানি কে ওকে ফোনটা করছে? হয়তোবা রং নাম্বারে কেউ ফোন করেছে। আগে তো এই ফোনটা ব্যবহার না হলে এরকম অন করে রাখা হতোনা। অন করে রাখলে হয়তোবা আগেও প্রতিদিন এরকম ফোন আসতো। এখন মুনিরা অকারণে এই কলটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। মোবাইলটা আবার ড্রয়ারে রেখে মুনিরা জায়নামাজ থেকে উঠে গেলো। সেই কখন রান্না চুলায় মাংস চড়িয়ে রেখে এসেছে ও। গিয়ে হয়তোবা দেখা যাবে পাতিলের তলায় লেগে টেগে একেবারে একাকার হয়ে গেছে। আসাদ তো একটু দেখবেও না। মুনিরা উঠে পড়লো। ওর এখনো বুক ধড়ফড় করছে। কে ওকে ফোন করছে প্রতিদিন?

মুনিরা ঠিক করেছে এখন ও উঠে পড়ে মায়মুনার খোঁজ করা শুরু করবে। এতদিন তো তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি। এতদিন পুলিশ, সাংবাদিক, পাবলিক সবাই মুনিরাদের পিছে লেগে ছিল। দিনের চব্বিশটা ঘন্টা ওরা সার্ভেইলেন্সের মধ্যে ছিল। কিন্তু মুনিরা বুঝতে পারছে যে মায়মুনা নিখোঁজ হবার উত্তেজনা এখন থিতিয়ে এসেছে। পুলিশের মায়মুনাকে খুঁজে বের করার কোনো আগ্রহ ছিলোনা। টেরোরিস্ট মেয়ে আবার ফিরিয়ে আনলে নানান ক্যাচাল। আর যেহেতু মায়মুনার ঘটনাটা মিডিয়ায় এত সাড়া জাগিয়েছে সেহেতু এটা তো এখন শুধু আর আইনের ব্যাপার না। এর মধ্যে পলিটিক্স, দেশের ইমেজ, পাবলিক সেন্টিমেন্ট এসব সবকিছু ম্যানেজ করার ব্যাপার চলে এসেছে। এর চেয়ে বরং ও যেখানে গিয়েছে সেখানেই থাকা পুলিশের জন্য ভালো। তবে ওরা যখন বুঝে গিয়েছে যে এর মধ্যে পরিবারের কোনো হাত নেই, তখন আস্তে আস্তে মুনিরাদের থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে।

সাংবাদিকদের উত্তেজনাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। পনেরো বছরের কিশোরী মেয়ের সিরিয়ায় গিয়ে জিহাদী ব্রাইড হবার রগরগে খবর প্রচার করে করে আপাতত তারা এখন ক্লান্ত। একই খবর আর কতদিন জমবে? নতুন কোনো রগরগে ব্যাপার বের না হওয়া পর্যন্ত ওরাও আর ঝামেলা করবেনা। আর হুজুগে পাবলিকও লাফালাফি করে এখন কিছুটা ক্ষান্ত হয়েছে। এই গতরাতের পচা ডিম ছুড়ে মারার ব্যাপারটা বাদ দিলে গত কয়েকদিন মোটামুটি কিছুটা নির্জঞ্ঝাটই কেটেছে। এখনই সময়, এখনই মুনিরাকে উঠে পড়ে নামতে হবে। আর বেশি দেরি করা যাবেনা। প্রতিদিন সিরিয়াতে বোম্বিংয়ের খবর আসছে। প্রতিটা খবর পাওয়া মাত্রই মুনিরার বুকটা একেবারে কেঁপে উঠে। কখন না মেয়েটার কী হয়ে যায়। তার আগে কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু মুনিরা কী করবে?

মুশকিল হলো আসাদও এব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেনা। মায়মুনার ব্যাপারে ও এত কষ্ট পেয়েছে, এত ভেঙে পড়েছে যে ওর নামটা পর্যন্ত মুখে আনতে চায়না। হঠাৎ করেই ও যেন বাকি তিন ছেলেমেয়ে একেবারে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে । আগে তো ছেলেমেয়েদের কোনো খেয়ালই রাখতোনা। এখন সারাটাদিন ওদের নিয়েই থাকে। মুনিরা বুঝে যে এটা আসাদের এক ধরণের কষ্ট চেপে রাখার তরিকা। মায়মুনাকে ভুলে যেতে ও বাকিদের বেশি বেশি আঁকড়ে ধরছে। এই মুহূর্তে মুনিরা আসাদের কাছ থেকে তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পাবে বলে ওর মনে হচ্ছেনা। যা করার ওর নিজেরই করতে হবে। আজ দুপুরের পর ও ঠিক করেছে যে সেই মসজিদে গিয়ে ঘুরে আসবে। যেখানে মায়মুনা সিস্টারস ফোরামে যেত। যদিও সেই ফোরাম আর এখন নাই। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের পর সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও তেমন কিছু বের করতে পারেনি কিন্তু পুলিশের ধারণা সেখানেই মায়মুনাকে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে। তবে সিস্টারস ফোরাম আর না থাকলে কী হবে, নিশ্চয়ই এমন কেউ মসজিদে থাকবে যে সেই ফোরাম সম্পর্কে জানে।

দুপুরে খাবারের পর মুনিরা ওর বোরকা আর নিকাবটা পরে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো। মুনিরা বোরকা কেন, হিজাবও পরেনা। কিন্তু মায়মুনার এই ঘটনার পর ওর এক বান্ধবী এগুলো দিয়ে গেছে। নাহ, পর্দা করার জন্য না। কোনো দরকারে মুনিরার বাইরে যেতে হলে যাতে করে কেউ ওকে চিনতে না পারে, হেনস্তা না করতে পারে, সেই কারণে। তবে মুনিরা এর মধ্যে আর বের হবার সাহস করেনি। বাজার টাজার সব অন-লাইনেই করেছে। আজ এই প্রথম বের হলো। বের হবার সময় ও আসাদকে বলেছে যে এই কয়দিন দেশি মাছ, শাক, সবজি কিছু কিনতে পারেনি তাই আজ একটু কাছের দেশি দোকানটা থেকে বাজার করে আনতে যাচ্ছে।

আসাদের ব্যাপারটা একটুও পছন্দ হয়নি। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলেছে যে একটু দেশি মাছ সবজি না খেলে এমন কী সমস্যা যে এরমধ্যে এখন বাজারে যেতে হবে। মুনিরা বলেছে যে বাসায় থেকে থেকে ওর একেবারে দমবন্ধ হয়ে আসছে। ও একটু বাইরে যেতে চায়। অগত্যা আসাদ সাথে আসতে চেয়েছিলো। মুনিরা দেয়নি। বাচ্চাদের একা বাড়িতে রেখে ওদের দুইজনেরই বের হওয়া এখন ঠিক হবেনা। আসাদ মুনিরাকে আর কিছু বলেনি। মুনিরা জানে যে আসাদ বেশ বিরক্ত হয়েছে কিন্তু ও পাত্তা না দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে।

প্রথম পাঁচমিনিট মুনিরা একটু ভয়ে ভয়ে হাঁটছিলো। তারপর হঠাৎ করেই ওর ভয়টা কেটে গিয়ে মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যায়। সোজা মসজিদে মেয়েদের নামাজের জায়গায় চলে যায় ও। সেখানে গিয়ে দুইরাকাত নফল নামাজ পড়ে নেয়, চারিদিক দেখতে দেখতে অনেক্ষন ধরে দোয়া পড়ে, মোনাজাত করে। এখন কোনো জামাতের সময় না। তাই বেশি কেউ নাই মসজিদে। কয়েকজন মেয়ে এসে জলদি করে নামাজ পড়ে চলে গেলো। কয়েকজন মহিলা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দল ধরে বসে উঁচু স্বরে আরবীতে গল্পগুজব করছে আর হাসাহাসি করছে। আর বাচ্চাগুলো এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে। এখানে মুনিরা কী খুঁজছে? মুনিরা নিজেই জানেনা। অনেক্ষন ধরে বসে থেকে মুনিরা একটু হতাশ হয়েই উঠে পড়লো।

মসজিদের লাগোয়া দুটো দোকান আছে। একটা ইসলামিক বই, জায়নামাজ, তসবি, আতর, পেইন্টিং, ক্যালিগ্রাফি এসবের দোকান আর আরেকটা কাপড়ের দোকান। সেটাতে হিজাব, আবায়া, নিকাব, পাঞ্জাবি, টুপি এসব পাওয়া যায়। তার সামনেই আবার রাস্তার উপর একটা ট্রলির মতো স্টলে মাসালা চায়ে বিক্রি করা হচ্ছে আর তার পাশেই একটা মেয়ে দুটো মোড়া আর একটা ছোট টেবিল পেতে হাতে মেন্দি লাগানোর স্টল দিয়ে বসেছে। এখানে তো আর মেন্দি বলেনা, মেহেদি বা হেনা বলেই সবাই জানে। সেই মেন্দি লাগানো দেখেই হঠাৎ মুনিরার বুকটা কেন জানি ছ্যাৎ করে উঠলো। মায়মুনার সেই সিস্টারস ফোরামের একটা বড় আকর্ষণ ছিল হাতে মেন্দি লাগানো। তিনচারবার এমন হয়েছে যে সিস্টারস ফোরাম থেকে বাসায় ফিরেছে হাত ভরে মেন্দি লাগিয়ে। মুনিরা খেয়াল করলো যে সেই মেন্দি লাগানোর মেয়েটা এখন একা একা উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে। ওর সামনে কোনো মেন্দি লাগানোর কাস্টমার নাই। কিছু চিন্তা না করেই হুট করে মুনিরা ওর সামনে বসে পড়লো। বসেই বা হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো ,

– আস্সালামুআলাইকুম। এই হাতে কি আমি হেনা লাগাতে পারি?

– ওয়ালাইকুমআসসালাম সিস্টার। শিওর। কোন ডিজাইনটা তুমি চাও?

এই বলে মেন্দির বিভিন্ন ডিজাইনের একটা লিফলেট ওর হাতে ধরিয়ে দিলো মেয়েটা। মুনিরা সেটা ভালোমতো না দেখেই সবচেয়ে প্রথমটা দেখিয়ে দিলো।

মেয়েটা হেসে বলল,

– গুড চয়েজ সিস্টার। ফাইভ পাউনড ফর ওয়ান হ্যান্ড। ওকে?

– ওকে।

মেয়েটার কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে যে মেয়েটা এদেশে বড় হওয়া মেয়ে না। সম্ভবত সিলেটি হবে। মেয়েটার ইংরেজি বলার ধরণ দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। মেয়েটা গভীর মনোযোগ দিয়ে পারদর্শিতার সাথে মুনিরার হাতে অপূর্ব করে মেন্দি লাগিয়ে দিচ্ছে। আর মুনিরা গভীর মনোযোগের সাথে মেয়েটাকে দেখে যাচ্ছে। কত বয়স হবে মেয়েটার, বিশ? বাইশ? বড়োজোর পঁচিশ। এর বেশি হবেনা। মেয়েটা একটা কালো আবায়া পরে আছে আর মাথায় কালো হিজাব। মুখে কোনো প্রসাধন নেই। কিন্তু এতেই মেয়েটাকে স্বর্গের অপ্সরা মনে হচ্ছে। এত সুন্দর মেয়েটা যে মুনিরা ঠিক চোখ সরাতে পারছেনা। মুনিরা হঠাৎ বলে উঠলো,

– বাহ্, তুমি তো দারুন মেন্দি লাগাতে পারো।

মেয়েটা কিছু না বলে শুধু একটু হাসলো। মুনিরা আবারো বলে উঠলো,

– মসজিদের সামনে তো তোমাকে আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছেনা। এখানে কি নতুন?

– নাহ, ঠিক নতুন না। প্রায় পাঁচ মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই আমি এখানে এই হেনার স্টল দিয়ে বসি।

– তাই নাকি? আমার মেয়ের খুব হেনা পছন্দ। তার মানে ও এখানে তোমার কাছ থেকেই কয়বার হেনা লাগিয়েছে।

– তাই? কী নাম তোমার মেয়ের?

মুনিরা একটু ইতস্তত করলো প্রথমে। নামটা বলা ঠিক হবে কি হবেনা বুঝতে পারছেনা। তারপর মেয়েটার ঠিক চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

– মায়মুনা।

মেয়েটার হাতটা সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো। হাত কেঁপে উঠার কারণে মেন্দির একটা জায়গায় একটু লেপ্টে গেলো। মেয়েটা সরি সরি বলতে বলতে লেপ্টে যাওয়া জায়গাটা মুছে নিয়ে আবার মেন্দি দেওয়া শুরু করে দিলো। এবার বেশ তাড়াহুড়ো করে মেন্দি লাগাচ্ছে মেয়েটা। এমন ভাব যে কাজটা শেষ করে তাড়াতাড়ি আপদ বিদায় করলেই হয়। মেয়েটার মায়মুনাকে না চেনার কোনো কারণ নাই। মায়মুনার কারণে এই মসজিদের কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মায়মুনার মা শুনে যে কেউ এরকম কেঁপে উঠতে পারে, তাড়াতাড়ি আপদ বিদায় করতে চাইতে পারে। কিন্তু মুনিরার মনেহলো এই মেয়েটা অন্য কোনো কারণে কেঁপে উঠছে। টেরোরিস্টের মায়ের ভয়ে কেঁপে উঠেনি।

মেয়েটা খুব জলদি মেন্দি লাগিয়ে যাচ্ছে। মুনিরা খুবই মনোযোগ দিয়ে মেয়েটাকে দেখছে। মায়মুনার নাম শুনে কিছু বললো না দেখে মুনিরা নিজেই আবার কথা শুরু করলো,

– কোন মায়মুনা তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছ? ও তোমার কাছে হেনা লাগায়নি?

– অনেক মেয়েই তো আমার কাছে প্রতিদিন হেনা লাগাতে আসে। মায়মুনাও নিশ্চয়ই এসেছিলো। কিন্তু ওকে আলাদা করে আমার মনে নাই।

– তাই?

মেয়েটা মুনিরার দিকে তাকাচ্ছে না। এই কথার জবাবও দিলোনা। মন দিয়ে মেন্দি শেষ করার কাজ করছে। ওকে চুপ দেখে মুনিরা আবার বলে উঠলো,

– আমার মনে হয় আমার মেয়েটা কোনো বিপদে পড়ে এই কাজ করেছে। ও ভালো একটা মেয়ে। তোমার আমাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নাই।

মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো। তারপর বললো,

– আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছিনা তো। তোমার মেয়ের জন্য তোমার নিশ্চয়ই অনেক খারাপ লাগছে। দোয়া করছি তোমার মেয়ে যাতে সেইফ থাকে।

মুনিরা একটু চুপ থেকে আবার কথা বলে উঠলো,

– আমার মায়মুনার সাথে যোগাযোগ করা দরকার। খুবই দরকার। আমার মনেহয় ও অনেক বিপদে আছে। তুমি কি জানো কে আমাকে এব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে?

মেয়েটা উত্তর দিতে বেশ সময় নিলো। তারপর বললো,

– আমি কেমন করে জানবো?

– ওহ, তাইতো। আসলে জানো, আমি কাউকে জানিনা যে আমার মেয়েটার কী হয়েছিল, ও এখন কোথায় এসব বলতে পারবে। অনেক আশাকরে এসেছিলাম যে হয়তোবা এই মসজিদে কেউ কিছু বলতে পারবে। কিন্তু আমি তো কাউকে চিনিনা যাকে জিজ্ঞেস করবো। তাই তোমাকে দেখে ইমোশনাল হয়ে তোমাকেই বলে ফেললাম। তুমি কিছু মনে করোনা।

– না সিস্টার। কিছু মনে করবো কেন। মে আল্লাহ হেল্প ইউ। মে আল্লাহ হেল্প ইওর ডটার।

– থ্যাংক ইউ। তোমার নাম কী?

মেয়েটা এবারও উত্তর দিতে একটু সময় নিলো। তারপর বললো,

– নাজমা।

মেন্দি লাগানো শেষ। মুনিরা পাঁচ পাউন্ড বের করে নাজমাকে দিতে দিতে বললো,

– নাজমা, তোমার সাথে কি আমি মাঝে মাঝে একটু কথা বলতে পারি? তোমাকে দেখে আমার খুব মায়মুনার কথা মনে পড়ছে। মায়মুনার আসলে কোনো দোষ নাই। ও ভীষণ ভাল একটা মেয়ে।

নাজমা নিরুত্তর। নিরুত্তর হওয়াই স্বাভাবিক। মায়মুনার মায়ের সাথে কেউ নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে কথা বলতে রাজি হবেনা। তারপরও মুনিরা ব্যাগ থেকে একটা কাগজ কলম বের করে সেখানে সেই পুরোনো মোবাইলের নাম্বারটা লিখে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

– এটা আমার মোবাইল নাম্বার। এটা পুরোনো নাম্বার। এই ফোনটা মনেহয় কেউ ট্যাপ করেনি। তোমার কোনোদিন একটা অসহায় মাকে সাহায্য করতে ইচ্ছা হলে আমাকে ফোন করতে পারো।

একহাতে মেন্দি নিয়ে কাগজ কলম বের করে লেখার সময় অনেকটা জায়গা লেপ্টে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেলো। সেদিকে মুনিরার দৃকপাত নেই।

নাজমা এখনো নিরুত্তর। কিন্তু ঠিকই হাতটা বাড়িয়ে মুনিরার কাছ থেকে কাগজটা নিলো। মুনিরা খেয়াল করলো যে নাজমার হাতটা একেবারে থরথর করে কাঁপছে।

©আমিনা তাবাস্সুম
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here