এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৭

এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৭
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

আকাশে আজ সূর্যের দেখা নেই।ছাই রংয়ের গুটলি পাকানো মেঘের আড়ালে দিনের উজ্জল আলো যেন ছুটি নিয়েছে।প্রকৃতিতে একটা শীতল শীতল ভাব।এত সুন্দর আবহাওয়ার মাঝেও সকাল সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে তোহার।নিজের উপর বেশ বিরক্ত বোধ নিয়ে বারকয়েক চোখ বন্ধ করে ঘুম আনানোর চেষ্টা করলো সে।কিন্তু নাহ্!ঘুম আসার ছিঁটেফোটাও নেই তার টানা টানা চক্ষুজোড়ায়।
অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে গায়ের থেকে কাঁথাটা সরিয়ে বড় একটা হাই তুলে উঠে বসলো তোহা।মাথাটা ভার ভার লাগছে।ব্যাথাও করছে হাল্কা।গতকাল চুড়িগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে রাখতে ঘুমোতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো।সেই রাতের বেলা ঘুমিয়ে আবার এই সকাল সকাল ঘুম ভাঙার ফিলিংটা একেবারেই অসহ্যকর।

কয়েকবার আড়মোড়া দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো তোহা।খোলা জানালার পর্দাটা সরিয়ে বারান্দার দরজাও খুলে দিলো।রাতের ঝোলানো তোয়ালেটা উড়ছে।যেকোনো সময় একেবারের জন্যও উড়ে যেতে পারে।
দ্রুতপায়ে এগিয়ে সেটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো তোহা।যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই দরাজ পুরুশালী কন্ঠের “তিহু” ডাকে থেমে গেল তার পা যুগল।

ঘাড় ফিরিয়ে পাশের বারান্দায় তিহানকে দেখতে পেয়ে একটু জড়োসড়ো হয়ে সে চাঁপা গলায় উওর দিলো,
—“জি?”

ততক্ষনে পুশ-আপ থামিয়ে দিয়েছে তিহান।তোহার সদ্য ঘুম থেকে ফোলা ফোলা তৈলযুক্ত চেহারার দিকে কয়েকমূহুর্ত তাকিয়ে থেকে উঠে দাড়ালো সে।পাশ থেকে টাওয়াল নিয়ে গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
—“কলেজ যাওয়া কি একেবারের মতে বাদ দিয়েছিস?আর পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই?মূর্খই পুরো জীবন কাটিয়ে দিবি?”

তিহানের তিক্ত কথাগুলো কোনরকমে হজম করে নিয়ে তোহা বললো,
—“নিশা আপুর বিয়ের জন্য এ সপ্তাহে যাওয়া হয়নি।”

সাথেসাথেই তিহানের পাল্টা প্রশ্ন,
—“আগের সপ্তাহে কয়দিন গিয়েছিলি?”

শুকনো ফাঁকা একটা ঢোঁক গিললো তোহা।অষ্পষ্ট স্বরে বললো,
—“আসলে…”

—“দুইদিন”।

তিহানের উওরে অপরাধী দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে আবারো চোখ নামিয়ে নিলো তোহা।আগের সপ্তাহে যে বিয়ের কেনাকাটার জন্য যাওয়া হয়নি সেটা বলার আর সাহস হলোনা তার।
তিহান শীতল কন্ঠে বললো,
—“কাল থেকে যেন এক দিনও কলেজ মিস না হয়।ঠিক ঠিক সকাল আটটা বাজে রেডি হয়ে থাকবি।তোকে কলেজে দিয়ে তারপর অফিসে যাবো আমি।…মাথায় ঢুকেছে কথাগুলো?”

তোহা উপর নিচে মাথা নাড়ায়।অর্থ্যাৎ”ঢুকেছে।”

তিহান তোয়ালে রেখে টি-শার্ট নিয়ে পরতে পরতে বলে,
—“রুমে যা।এত তারাতারি উঠেছিস কেনো?”

মুখ লটকায় তোহা।বিরবির করে বলে,
—“আপনার বকা শোনার জন্য উঠেছি।যত্তসব।”

—“কি বললি?”

—“ঘুম ভেঙে গেছে।”

তিহান বাঁকা হাসে।বলে,
—“আচ্ছা,যা রুমে যা।আর হ্যাঁ,দরজা আস্তে লাগাবি।ভেঙে যেতে পারে”।

তিহানের কথার মানে বুঝতে কষ্ট হয়না তোহার।কালরাতের কথা বলছে সে।কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রুমে ঢুকে যায় সে।
_______________

সন্ধ্যার দিকে একগাদা বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে তোহা।।প্রায় একঘন্টা যাবত উচ্চতর গণিতের একটা অঙ্ক সল্ভ করার চেষ্টায় অব্যাহত সে।তবে মাথায় ঢুকছেনা কিছুই।বসে বসে কলম কামড়াচ্ছে আর খাতায় চোখ বুলাচ্ছে।

হঠাৎই জানালার বাঁড়ি খাওয়ার শব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় তোহা।আচমকাই তুমুল ঝড়ো বাতাস শুরু হয়েছে।ছুটে গিয়ে জানালা গুলো আটকে দিয়ে পর্দা টেনে দিতেই তোহার মায়ের কন্ঠস্বর শোনা গেলো।

গলা ফাটিয়ে তোহাকে ডাকছে সে।রাগে গজগজ করতে করতে বলছে,
—“তোহা,জলদি ছাদের কাপড় গুলো নিয়ে আয়তো।বাড়িঘর সব ধুলো দিয়ে ভরলো।জানলা গুলো আটকাবে সেই খেয়ালটাও নেই কারো।যত জ্বালা সব একা আমারই।”

দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তোহা।এই সন্ধ্যাবেলা ঝড়ো বাতাসের মধ্য একা একা ছাদে যেতে যথেষ্ট ভয় করছে তার তবুও মাথায় ওড়না টেনে দুতিন সিঁড়ি উপরে উঠতেই বাঁধলো আরেক বিপত্তি।কারেন্টাও চলে গেলো।অন্ধকারে ডুবে গেলো সিঁড়ি।তার উপর বোঝাই যাচ্ছে বাতাসের বেগ ক্রমশ বাড়ছে।ধুমধাম কিছু পরে যাওয়ার শব্দও হচ্ছে।দুরুদুরু কাঁপা মন নিয়ে অন্ধকারের মধ্য উপরের সিঁড়িতে পা রাখতেই একটা শক্ত হাত তার বামহাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল।একমূহুর্তের ব্যবধানে জায়গাটা ফোনের ফ্ল্যাশলাইটের আলোতে আলোকিত হয়ে গেলো।তিহান তোহার হাত টেনে উপরে উঠতে উঠতে ধমকে উঠে বললো,
—“বেশি সাহস হয়ে গেছে তাইনা?একা একা যাচ্ছিলি কেন?”

—“মা বললো,কাপড়গুলো নিয়ে আসতে।”

—“তাই বলে এই ভর সন্ধ্যায় ঢ্যাঙ্ ঢ্যাঙ্ করে একা একাই ছাদে ছুঁটবি?আমাকে ডাকা যেতোনা?”

তোহা উওর দিলোনা।চুপচাপ উপরে উঠতে লাগলো।

ছাদে পা রাখতেই করতেই বুঝতে পারলো বেশ ভালো ঝড় শুরু হয়ে গেছে।বৃষ্টি না নামা পর্যন্ত এ বাতাস থামবেনা।মাথা নিচু করলো তোহা।সামনে এগোতে নিলেই তিহান তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
—“এখানেই দাঁড়া।কাপড় আমি নিয়ে আসছি।বলে একটু সামনে যেয়ে থেমে গিয়ে বললো,”চোখ বন্ধ করে রাখ।ধুলো ঢুকবে।”

দেয়াল ঘেঁষে গুটিশুটি হয়ে দাড়িয়ে রইলো তোহা।তার হাতের মুঠোয় তিহানের ফোন।
তিহান দ্রুত কাপড়গুলো নিয়ে এসে তার হাতে ধরিয়ে দিলো।ফ্লাশলাইটের আলোতে তোহা স্পষ্ট লক্ষ্য করলো তিহানের শার্টের বোতামগুলো উল্টাপাল্টা করে লাগানো।এমনকি শার্টটাও উল্টা।কোনোরকমে সেটা গায়ে জড়িয়েই যে সে এসেছে তা বুঝে আসতেই মনে মনে মিটমিটিয়ে হেসে উঠলো সে।ঝড়ো বাতাসের মতো তার মনটাও তুমুল গতিতে এলোমেলোভাবে ছুটতে লাগলো।


ঘরে এসে কাপড়গুলো রেখে অলস ভঙ্গিতে বই-খাতা গুলো গুছিয়ে রাখলো তোহা।বিছানায় বসতেই খেয়াল হলো তার হাতের মুঠোয় এখনো তিহানের ফোন।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবারো উঠে দাড়ালো সে।
রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো তার মা আতিয়া আর খালামনি আফিয়া মোম জ্বালিয়ে সোফায় বসে রয়েছে।এই অন্ধকারেও খোশগল্পে মেঁতেছে দুই বোন।তূর্য আর বাবা বাসায় নেই।চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।তার বাবার ইদানীং চোখের সমস্যা দেখা গিয়েছে।

কাছে যেয়ে দাঁড়ালো সে।মিনমিনে কন্ঠে তিহানের ফোনটা দেখিয়ে বললো,
—“আমি একটু খালামনিদের বাসায় যাচ্ছি মা।তিহান ভাইয়ের ফোনটা আমার কাছেতো।উনাকে দিয়ে আসি।

আতিয়া মৃদু ধমকের স্বরে বললো,
—“তোর কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই?সারাটাদিন খালি ছেলেটার ফোনটা নিয়ে রাখিস।তোর মতো বেকারতো না ও।ফোনে কতো জরুরি কাজ থাকে।তুই তো দিবি সব নষ্ট করে।”

আতিয়ার কথার মাঝেই আফিয়া খালামনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
—“আহা!এত কথা বলিস কেনো তিয়া?নিশ্চয় কোনো কাজেই এনেছে।তোহা যাতো তুই দিয়ে আয় ওর ফোন।কলিংবেলতো বাঁজবে না।এই নে ফ্ল্যাটের চাবি।”

চাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলো তোহা।লক খুলে গুটিগুটি পায়ে তিহানের দরজায় ধাক্কা দিতেই তা খুলে গেলো।সে গলা বাড়িয়ে একবার ডাকলো,
—“তিহান ভাই?”

কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা।আবারো ডাকলো,
—“তিহান ভাই?কোথায় আপনি?রুমে আছেন?”

এবারো কোনো শব্দ পাওয়া গেলোনা।তোহা এদিকওদিক তাকিয়ে বারান্দার কাছাকাছি যেতেই দেখলো একটা সুঠাম দেহী অবয়ব বারান্দার রেলিংয়ে দুহাত রেখে দাড়িয়ে আছে।তার দৃষ্টি আকাশের দিকে।ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে।লোকটা কি ভিজে যাচ্ছেনা?
ধীরপায়ে তার পেছনে গিয়ে দাড়ালো তোহা।বললো,
—“তিহান ভাই,আপনার ফোন…।”

তিহান ফিরে তাকালোনা।হাত বাড়াতেই তার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলো তোহা।সেটা পকেটে ঢুকিয়ে আবারো একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলো সে।কিছুসময় সব চুপচাপ।নিরবতা ভেঙে তিহানের বাহুর শার্ট টেনে ধরলো তোহা।বললো,
—“ভিজে যাচ্ছেনতো।ঘরে চলুন।”

—“ভিজতেই চাচ্ছি।”তিহানের ছোট্ট উওর।

ফের কিছুক্ষণ সব চুপ।এবার নিরবতা কাটলো তিহানের কন্ঠে।আকাশের দিকে তাকিয়েই সে বললো,

—“তোমার বৃষ্টি পছন্দ?”

পুনরায় সেই “তুমি” সম্মোধন।ঠান্ডা হাওয়ায় মাঝেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো তোহার।আমতাআমতা করেও কিছু বলতে পারলোনা।কথাগুলো যেন গলাতেই আটকে গেছে।কন্ঠনালির ঠি ক মাঝখানটায়।

হুট করেই তাকে কাছে টেনে নিলো তিহান।পেছন দিয়ে একহাতে বাহু জড়িয়ে ধরে ধীরস্হির কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

—“এই বৃষ্টিতে কি মন ভিজানো যায়?”

তোহা এবারো চুপ।তার জানা পুরো শব্দভান্ডার খুঁজেও এ প্রশ্নের কোনো উওর খুঁজে পেলোনা সে।অগত্যা উওর না দিয়ে মৌন মুখে দাড়িয়ে রইলো সে।

তিহান বললো,
—“এই বৃষ্টিতে মন ভিজে না,বুঝলে?মন ভেজানোর জন্য প্রেমের বৃষ্টির প্রয়োজন।তৃষ্ণার্থ প্রেমিকের ধু ধু ফাঁকা হৃদয়টাকে শুধুমাত্র এক পশলা প্রেমের বৃষ্টিই স্বস্তি দিতে পারবে।কবে হবে প্রেমের বৃষ্টি?বলতে পারো?”

তিহানের ভারি ভারি কথাগুলো কানে গেলেও এদের অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হলোনা তোহার পক্ষে।সে চুপটি করে তিহানের বুকের সাথে লেপ্টে ঠাঁয় দাড়িয়ে রইলো।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here