#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৫৫|
আজ খুব সকাল সকাল পদ্ম ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। আর সে ফ্রেশ হয়ে এসেই আদিদ কে ডাকতে লাগে। আদিদের চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছিল। তাও সে কোনো রকমে তাকাল। বললো,
‘কী হয়েছে পদ্ম? এত সকাল সকাল ডাকছেন কেন?’
পদ্ম খুশি খুশি গলায় জবাব দিল,
‘চলুন হাঁটতে বের হই।’
আদিদ চোখ বুজে শুয়ে পড়ে বললো,
‘খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।’
পদ্ম কপাল কুঁচকে বললো,
‘উফফ, প্রতিদিন তো আর যাই না। একদিনই তো। একটু কষ্ট করে উঠুন না, প্লীজ।’
আদিদের কান অবধি পদ্ম’র গলার স্বর পৌঁছালেও মস্তিষ্ক অবধি হয়তো পৌঁছাল না। আদিদের কোনো হেলদোল না দেখে পদ্ম তার কাছে গেল। ঘুমে কাতর মুখখানা দেখে পদ্ম’র বড্ড মায়া হলো। কিন্তু বাইরেও খুব যেতে ইচ্ছে করছে তার। আর সবথেকে বড়ো কথা হলো, এখন বাইরে নিয়ে না যেতে পারলে সারপ্রাইজ টা ও আর দেয়া হবে না। পদ্ম তাই আদিদের বাহুতে হাত রেখে তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
‘উঠুন না, ডাক্তারবাবু।’
আদিদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আবারও ঘুমে তলিয়ে পড়ল। পদ্ম এবার আদিদের কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ডাক্তারবাবুউউউউউ!’
আদিদ ধরফরিয়ে উঠে বসলো। চোখগুলো লাল হয়ে আছে তার। ফোলা ফোলা মুখ টা কুঁচকে বিরক্ত দৃষ্টিতে সে পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম হেসে বললো,
‘সরি, ঘুমটা নষ্ট করার জন্য। কিন্তু বাইরে যাওয়াটা খুব দরকার। চলুন না প্লীজ।’
আদিদ নাক মুখ ফুলিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওয়াশরুমের দিকে যাওয়া ধরে কর্কশ গলায় বললো,
‘আপনার জ্বালায় একটু ঘুমিয়েও শান্তি নেই।’
সকাল ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। এইদিকের রাস্তাটায় খুব একটা মানুষ নেই। অল্প কিছু মিষ্টি রোদের আলো রাস্তার একপাশে জড়ো হয়ে তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। পিচ ঢালা সেই রাস্তার মাঝ দিয়ে হেঁটে চলছে পদ্ম। আদিদ বার বার তাকে সাইডে আসতে বলছে। কিন্তু তার বক্তব্য, এত সকালে এই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি যাবে না। তাই সে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতেই পারে। অনেকটা পথ হাঁটার পর তারা একটা চায়ের দোকান পেল। আর সেটা দেখেই পদ্ম’র আত্মা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল। পদ্ম বলার আগেই আদিদ সেখানে গিয়ে দু কাপ চায়ের অর্ডার দিল। কারণ সে জানে, পদ্ম’র এই চা কত পছন্দ। এই ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাসে দু কাপ গরম গরম চা এই মানুষ দু জন খুব উপভোগ করলো। চায়ের দোকানের টাকা মিটিয়ে আদিদ বললো,
‘চলুন, এবার ফেরা যাক।’
পদ্ম ব্রু উঁচিয়ে বললো,
‘ওমা, এত তাড়াতাড়ি।’
‘আরো হাঁটতে ইচ্ছে করছে আপনার, পায়ে ব্যথা করে না?’
পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘উহু, না তো। চলুন, আরো সামনে যাবো।’
পদ্ম হাঁটা ধরলো। তার পেছন পেছন বাধ্য হয়ে আদিদ কেও ছুটতে হলো। কিছুটা পথ যাওয়ার পর হঠাৎ আদিদের পা থেমে গেল। সে আশ্চর্য চোখে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। প্রথমে বিশ্বাস হলো না কিছু। কিন্ত পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এই সবকিছুই সত্য। তারা যেই জায়গাটাই এসেছে সেখানে আশে পাশে অনেকগুলো সুপারি গাছ। আর সেই সারি সারি গাছগুলোতে আজ অনেকগুলো ব্যানার টানানো। আর সবগুলোই ব্যানারেই ছিল আদিদের ছবি আর নিচে লেখা, “শুভ জন্মদিন, ডাক্তারবাবু।” আদিদ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। মেয়েটা কী ভয়ানক কান্ড করে বসেছে!। সে আপ্লুত চোখে পদ্ম’র দিকে তাকায়। পদ্ম মুচকি হেসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘শুভ জন্মদিন, ডাক্তারবাবু। আপনাকে অনেক ভালোবাসি।’
আদিদ পদ্ম’কে তার কাছে টেনে নিল। কপালে ওষ্ঠ্য জোড়া ছুঁইয়ে বললো,
‘আমিও আমার পদ্মফুল কে অনেক বেশি ভালোবাসি।’
পদ্ম আদিদ কে জড়িয়ে ধরে। আদিদ তাকে নিজের বুকের মাঝে মিশিয়ে নেয়। শীতল কন্ঠে বলে,
‘এসব কী করে বসেছেন, বলুন তো? আর এত কিছু করলেনই বা কখন?’
‘করেছি, আমি আর রাণী মিলে। আহামরি কিছু করতে পারবো না বলে এই ছোট্ট সারপ্রাইজ। তবে আপনার জন্য আরো একটা সারপ্রাইজ আছে, ডাক্তারবাবু।’
‘আরো সারপ্রাইজ?’
অবাক হয় আদিদ। পদ্ম বলে,
‘হ্যাঁ, তবে সেটা বাসায়। এখন চলুন আমরা ঐ দিকটাই বসি। আজ আপনার সাথে সুন্দর একটা সকাল কাটাবো।’
আদিদ আলতো হাসে। পদ্ম তাকে ছাড়তেই সে হুট করে পদ্ম কে কোলে তুলে নেয়। বলে,
‘চলুন, সুন্দর একটা সকাল আপনার আমার অপেক্ষা করছে।’
আটটার দিকে আদিদ আর পদ্ম বাড়ি ফিরলো। তখনও বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে। জেগে ছিল কেবল রাণী। পদ্ম বাসায় ফিরতেই রাণী তার প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসে। পদ্ম তার সব প্রশ্নের একে একে জবাব দেয়। এক এক করে সকল প্রশ্নের জবাব পেয়ে তবেই রাণী ক্ষান্ত হয়। পদ্ম কে বলে,
‘আর ঐ কথা টা?’
পদ্ম ফিসফিসিয়ে বলে,
‘রাতে কেক কাটার পর বলবো। তুই কিন্তু আগে থেকে কিছু বলিস না।’
রাণী দু গালে দুবার হাত লাগিয়ে বলে,
‘তওবা তওবা, আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না।’
সকালের নাস্তা খেয়ে আদিদ তার হসপিটালে চলে যায়। পদ্ম তখনও নাস্তা খায়নি। আদিদ অনেকবার তাকে জোর করেছিল খাওয়ার জন্য। কিন্তু সে তখন খায়নি, রাণীর সাথে পরে খাবে বলে আদিদ কে বুঝিয়েছে।
রাণী আর রুবি হোসেন খেতে বসেছেন। পদ্মও বসেছে। তবে সে খাচ্ছে না। রুবি হোসেন ব্যাপার টা খেয়াল করে বললেন,
‘কী হলো, পদ্ম? তুমি কিছু খাচ্ছো না কেন?’
পদ্ম ছোট্ট করে একটা রুটির টুকরা মুখে দিয়ে বললো,
‘এই তো খাচ্ছি মা।’
রুবি হোসেন তখন পদ্ম’র দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘আজকাল তোমার শরীর টা ভালো যাচ্ছে না, তাই না?’
পদ্ম হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘না না মা, তেমন কিছু না। শুধু খাবার খেতে গেলে একটু কষ্ট হয়।’
‘বমি বমি পায়?’
পদ্ম রাণীর দিকে তাকায়। রাণীও খাবার ফেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার জবাব শোনার জন্য। পদ্ম তখন আমতা আমতা করে বললো,
‘হালকা একটু বমি বমি লাগে।’
রুবি হোসেন মুচকি মুচকি হেসে বললেন,
‘বিয়ে হয়েছে এক বছর হতে চললো, এখন তো একটু আধটু বমি বমি পাবেই। সময় তো হয়েছে, তাই না?’
রুবি হোসেনের কথায় পদ্ম লজ্জা পেল। সে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘আমি পরে খেয়ে নিব মা। আপনারা খান।’
রুবি হোসেন আর রাণী ঠোঁট চেপে হাসে। পদ্ম তার রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। নিশ্বাস বাড়ছে তার। ডান হাত টা পেটের উপর রাখতেই অদ্ভুত এক শান্তি পায় মনে। সে ভেবে পায় না এই কথাটা আদিকে কে কীভাবে বলবে। লজ্জায় তো ম*রে যাবে তখন। উফফ, কী ভয়ানক অবস্থা!
রাতে আদিদের জন্মদিন উপলক্ষে অভির পরিবার আর তার কাজিন অনিক এলো। আর অনিক আসার পর থেকেই রাণী বার বার এটা ওটার বাহানা দিয়ে ড্রয়িং রুমে যাচ্ছে। পদ্ম আরো আগ থেকেই কিছু একটা সন্দেহ করছিল তবে আজ যেন তার সন্দেহ টা আরো গাঢ় হচ্ছে। রাণী আজ অনেক বেশি সেজেছে। অযথাই আজ সে শাড়ি পরেছে। একটু খাটো হওয়ায় সাজুগুজু করার পর তাকে দেখতে কেমন যেন পুতুল পুতুল লাগে। যেন ব্যাটারি চালিত একটা পুতুল সারাক্ষণ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে।
পদ্ম আজ সারাদিন রান্না করেছে আর ওয়াশরুমে দৌড়া দৌড়’ই করেছে। বেশিক্ষণ রান্না ঘরে থাকলেই তার বমি চলে আসতো। খুব কষ্টে আজ সে রান্না করছে। রাণী অবশ্য তাকে সাহায্য করেছিল। তবে আদিদের জন্মদিন বলে সে নিজেই সবটা করার চেষ্টা করেছে।
কেক কাটা হলো। আদিদ সবাই কে কেক খাইয়ে দিল। রাণী সেখান থেকে এক পিস এক নিয়ে অনিকের কাছে গিয়ে বললো,
‘নিন।’
অনিক কেক টা হাতে নিতে চাইলে রাণী আবার বললো,
‘আমি খাইয়ে দেই।’
অনিক আলতো হেসে বললো,
‘ঠিক আছে।’
রাণী তাকে খাইয়ে দিল। অনিকও তাকে কেক খাওয়ালো। আর বললো,
‘বাচ্চা মেয়েদের শাড়ি পরতে নেই। কারণ তাদের শাড়ি পরলে ছোট্ট পুতুল মনে হয়।’
অনিকের সেই কথায় রাণী প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে পদ্ম’র পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর রাতের খাওয়া দাওয়া হলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই গল্প করতে বসলো। সেখানে তখন সবার সামনেই অনিক বললো,
‘আমার কিছু কথা বলার আছে।’
সবাই আগ্রহ সহকারে তার দিকে তাকাল। অভি বললো,
‘কী কথা, অনিক?’
অনিক রাণীর দিকে এক পলক তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। বললো,
‘আমি আর রাণী এক জন অন্য জনকে ভালোবাসি। আমরা বিয়ে করতে চাই।’
অদ্ভুত ভাবে কেউই সেখানে অবাক হলো না। সবাই উল্টো বলে উঠল, “আলহামদুলিল্লাহ।”
রাণী তো পারছে না সেখানেই নাচতে আরম্ভ করবে। খুশিতে যেন প্রাণপাখি উড়ে যাচ্ছে তার। সেখানে বসেই রাণী আর অনিকের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আগামী সপ্তাহে অনিকের মা বাবা আসলেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু করা হবে। আহা, রাণীর খুশি দেখে কে। সে তো জেগে জেগে এখন থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে।
বারোটার দিকে সকলে চলে যায়। সব কাজ সেরে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পদ্ম রুমে ফিরে। আদিদ তখন মাত্র ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। তাকে দেখা মাত্রই পদ্ম’র ধুকধুকানি বেড়ে যায়। এখন তো কথাটা বলতেই হবে। আর দেরি করা যাবে না। পদ্ম আস্তে আস্তে আদিদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আদিদ তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘খুব ক্লান্ত নাকি? চোখ মুখ যেন কেমন হয়ে আছে।’
পদ্ম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। বললো,
‘একটা কথা বলার ছিল।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
পদ্ম হাঁসফাঁস করছে। কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। কিছুটা সময় নিয়ে সে আস্তে আস্তে বললো,
‘আপনি বাবা হতে চলছেন, ডাক্তারবাবু।’
আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘শুনিনি। আরেকবার বলুন।’
পদ্ম তার দিকে তাকাল। ধীর গলায় বললো,
‘আপনি বাবা হতে চলছেন।’
আদিদ কথা বলছে না। চোখের পলকও ফেলছে না। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
‘সত্যি!’
পদ্ম উপর নিচ মাথা নাড়াল। আদিদ চোখ বুজে ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিল। জড়িয়ে ধরলো পদ্ম কে। বললো,
‘এই দিন টা দেখার জন্যই হয়তো, সুজানার মারা যাওয়ার পরও আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আজ মনে হচ্ছে, সত্যিই আমার বেঁচে থাকাটা স্বার্থক হয়েছে। পদ্ম জানেন, এই এত এত ঝামেলার পরও আপনি আমার জীবনের সাথে জুড়ে গিয়েছিলেন বলেই আজ আমি এতটা সুখী হতে পেরেছি। আমাকে এতটা সুখ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পদ্ম। অনেক ভালোবাসি আপনাকে, পদ্মফুল’
চলবে…