প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৪৭

0
1989

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রাজন শিকদারে কক্ষের বিশাল ছবিটার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রি। প্রতিটি মানুষের প্রতিচ্ছবিকে সে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যেন সবাই তার চক্ষুদর্পনেই দাঁড়িয়ে আছে। রাজন শিকদার হুইল চেয়ারে বসে আছেন। খুটখুট করছে হাসমুলের মুখ। আয়েন্দ্রির এই ঘরে আসাটা তার মোটেও পছন্দ না। রাজন শিকদারকে যে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় তার হেতু কোনো একসময় তিনি নিজের বাক শক্তি হারাবেন। নিষ্প্রাণ চায় না তার অতীত কখনো সবার সামনে আসুক। রাজন শিকদার প্রায়ই উত্তেজনাবশত হাত, পা ছোড়াছুড়ি শুরু করেন। যদিও তা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তার অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিতে আতঙ্কিত হাসমুল সেই ইঞ্জেকশন পুশ করা মাত্রই তিনি শান্ত হয়ে যান। নিষ্প্রাণ বলেছে তার খিঁচুনির জন্য দেওয়া হয় এই মেডিসিন যা সম্পূর্ণ মিথ্যে।

ছবিতে সবাইকে দেখা গেলেও নিষ্প্রাণকে ছবিটার কোথাও নজরে এলো না আয়েন্দ্রির। উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে হাসমুলকে—

“এই ছবিতে প্রাণ নেই কেন?”

হাসমুল নাকের ডগায় বিরক্তি ঝুলিয়ে হেয়ালি গলায় বলল—

“ছোডো সাহেব তহন আছিলে না। ”

আয়েন্দ্রি চুপ করে যায়। সে বুঝতে সক্ষম হয় হয়তো ছবিটা নিষ্প্রাণের জন্মের অনেক আগেই তোলা হয়েছে। নিষ্প্রাণের মাকে বেশ লাগল আয়েন্দ্রির। কী সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে! গা ভর্তি গহনা! মনে হতেই পারে বেশ উচ্চ বংশীয়।
,
,
,
আলমিরা থেকে সিঁদুর লাল রঙের একটা সিল্কের শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি। শাড়ির পাড়ের সাথে ম্যাচ করে সোনালী রঙের ব্লাউজ খুঁজতে খুঁজতে হাপিয়ে উঠেছে সে। অবশেষে পেয়েও গেল তা।

আজ সাজলো আয়েন্দ্রি। গাঢ় লাল রঙা শাড়িতে। গা ভর্তি গহনা জড়িয়েছে। সিঁথি কেটে ঘাড়ের সাথে লাগোয়া খোঁপায় গুঁজেছে কৃত্রিম গাজরা। ঠোঁট রাঙিয়েছে লাল রঙে। কোমরে কোমরবন্ধ। কুচিহীন শাড়ির আঁচলে ভাঁজ তুলেছে পাঁচের অধিক। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই দেখছিল আয়েন্দ্রি।

নিষ্প্রাণ কোনো একটা কাজে নজরুলদের বাড়ি গেছে। সেখান থেকে মাত্রই ফিরেছে সে। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত,বিপণ্ণ শরীর নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। তার উপস্থিতি টের পেতেই আয়নার কাছ থেকে সরে আসে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের শ্রান্ত দেহটার কাছে এসেই ঝরা হাসে। সাথে হেসে ওঠে আয়েন্দ্রির চোখ। ঝুমঝুমিয়ে বলল—

“দেখ, কেমন লাগছে আমাকে?”

নিষ্প্রাণ ভয়াল নিঃশ্বাস ফেলল। চোখ, মুখ বিকৃত করে তাকাতেই আঁতকে ওঠে আয়েন্দ্রি। ভয়চকিত গলায় বলল—

“কী হয়েছে?”

নিষ্প্রাণের শ্বাসে যেন ধরা কাঁপিয়ে দেবে। রণমূর্তি ধারণ করে এক ভয়াল চড় বসিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির গালে। ছিটকে পড়ে আয়েন্দ্রি সমান্তরাল মেঝেতে। ভয়, ব্যথা নিয়ে চোখের পল্লব উঁচুনিচু করে নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই যেন পৃথিবী ঘুরে গেল আয়েন্দ্রির। নিষ্প্রাণ স্রোতের বেগে এসে আয়েন্দ্রির খোঁপাটা মুঠোবন্দি করে রোষিত গলায় বলল—

“তোকে এভাবে সাজতে কে বলেছে? কেন সেজেছিস তুই? এই, এই ! কেন সেজেছিস এভাবে?”

ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছে আয়েন্দ্রির। টলটল করে তার চোখের কলসি উপচে পড়ল নোনা জল। চুলের ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না। নিষ্প্রাণ ক্ষুব্ধ হয়ে আরও এক টান লাগাল আয়েন্দ্রির খোঁপায়। ডুকরে উঠল আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের রাগ বাড়ল দ্বিগুন হারে। সজোরে বসাল আরেক চড়। আয়েন্দ্রি হতভম্ব হয়ে গেল। তার শরীরের সব শক্তি নিষ্প্রাণের চোখের আগুনে গলে গেল। নিষ্প্রাণ চেঁচিয়ে উঠে—

“কেন সেজেছিস এভাবে? কেন মহিলার মতো সেজেছিস? ওই, কী সমস্যা তোর? খোল, খোল এসব। আর কোনোদিন যদি এভাবে সাজতে দেখেছি জানে মেরে ফেলব তোকে আমি।”

আয়েন্দ্রিকে সোজা করিয়ে দাড় করায় নিষ্প্রাণ। বেপরোয়া হাতে তার গায়ের সমস্ত গহনা, শাড়ি খুলে ফেলল। রাগে বিহ্বল নিষ্প্রাণের নখ গেঁথে যায় আয়েন্দ্রির নরম শরীরে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। দমিয়ে রাখা রাগের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে আয়েন্দ্রির চোয়াল চেপে ধরে নিষ্প্রাণ।

“আর কোনোদিন যদি ওই মহিলার মত সেজে আমার সামনে আসিছ, সত্যি তোকে মেরে ফেলব আমি। মনে রাখিস।”

গজগজ করে কক্ষ থেকে বের হয় নিষ্প্রাণ। নিচে বসে পড়ে আয়েন্দ্রি। গলা, উদর, বাহুর বিভিন্ন জায়গা লাল আঁচড় ফুলে উঠেছে। ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লহু।

নিষ্প্রাণের পদার্পণ ঘটে রাজন শিকদারের কক্ষে। দেয়ালে থাকা ছবিটার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি তার। নিষ্প্রাণের রাগান্বিত আনন দেখে ভড়কে যায় হাসমুল। ফাঁকা ঢোক গিলে অধর ছড়াতেই নিষ্প্রাণ ফুঁসলে উঠে বলল—

“কোথায় ছিলি তুই?”

“আআমিইই…।”

নিষ্প্রাণ দেওয়ালে টাঙানো ছবিটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। ক্রোশে বশীভূত নিষ্প্রাণ পায়ের নিচে দলিয়ে ফেলে ফ্রেমটাকে। কিচকিচ করে তার কাঁচ ভেঙে বিক্ষিপ্ত হতে থাকে। রাজন শিকদারের কাছে গিয়ে ঝুঁকে গিয়ে দমদমে গলায় বলল—

“ভালো হচ্ছে না দাদু। একদম ভালো হচ্ছে না।”

রাজন শিকদার কম্পিত চোখে চাইলেন। চেয়েই রইলেন।
,
,
,
সেভাবেই মেঝেতে বসে আছে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ কঠিন শান্ত। কক্ষে এসে আয়েন্দ্রিকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসায়। ওয়েন্টমেন্ট নিয়ে আয়েন্দ্রির পাশে বসে। নিখুঁত হাতে আয়েন্দ্রির ক্ষতস্থানগুলোতে সাদা আঠালো জিনিষটির প্রলেপ দিতে থাকে। আয়েন্দ্রি কেঁপে ওঠে। ক্ষত জায়গাগুলো চিনচিন করে উঠছে। আয়েন্দ্রির সিক্ত পল্লব বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আর্দ্র গলায় বলল—

“এমন কেন করলি তুই?”

নিষ্প্রাণ ঠোঁটের কোণে মলম লাগাতেই কঁকিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি।

“তোকে এভাবে সাজতে কে বলেছে?”

“উনি তোর মা নিষ্প্রাণ।”

টুপ করে আয়েন্দ্রির ক্ষত জায়গায় চুমু বসায় নিষ্প্রাণ। নিরুদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে বলল—

“সে আমার মা নয়।”

আয়ন্দ্রি বিস্মিত হয়। কৌতূহলী গলায় বলল—

“কী বলছিস তুই?”

“হুম। আমি আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। আমার মা সুইসাইড করেছে। ওই যে, করিডোর দেখছিস? এখান থেকে লাফ দিয়ে। আমিও ওখানেই ছিলাম। ওই দেয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে আমার মাকে এখান লাফ দিতে দেখেছি।”

আয়েন্দ্রি নির্বাক চোখে চেয়ে থাকে। কী বলছে এই ছেলে! নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির ঠোঁটের কাছ মুখ নিয়ে বলল—

“আমি তোকে এই বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছি। আমার অতীত ঘাটতে না করেছি। তুই আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। এর মাঝে অতীতের কালো ছায়াকে ডাকিস না ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রির নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে। কিছু ভাবার মতো জোর সে তার মস্তিককে দিতে পারছে না। কর্ণরন্ধ্রে ঝড় তোলা নিষ্প্রাণের প্রতিটি শব্ধ অবাস্তব সত্য মনে হলো তার। নিস্পৃহ, নিষ্প্রভ, নিরীহ চাহনি।

নিষ্প্রাণ আলগোছে তার মাথাটা রাখে আয়েন্দ্রির কোলে। লম্বালম্বি শুয়ে নাজুক চোখে চেয়ে বলল—

” কোনো এক রূপকথার জগতে..
তুমি তো এসেছ আমারই হতে…

আয়েন্দ্রির ভেজা আঁখিপুট দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তা পড়ছে নিষ্প্রাণের শুষ্ক, খসখসে, প্রাণহীন ঠোঁটে। ঝাপসা চোখে আয়েন্দ্রি কক্ষের বাইরে তাকায়। তার মনে হলো কেউ একজন তাকে দেখে হাসছে। খুব হাসছে। পাগলের মতো হাসছে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো হাসছে। ফুটে ওটা সদ্য গোলাপের মতো তার হাসি। যেন এ যাবতকালের জন্য বদ্ধ কুঠরি থেকে সে ছাড়া পেয়েছে!

একটু দূরেই একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সে চেয়ে আছে অনিমেষ। সেই কেউজন আচমকা করিডোরের হাফ দেয়ালের উপর উঠে বসে। পরে..খানিক পরেই একটা ঝপাং আওয়াজ। সেই কেউ একজনকে আর দেখল না আয়েন্দ্রি। বাচ্চা ছেলেটি দৌড়ে দেয়ালের কাছে গেল। নতজানু হয়ে চেয়ে রইল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here