প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৫২

0
2188

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

একজন সুস্থ মানুষ তার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনায় রিয়েক্ট করবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যখন একটি শিশু তার শৈশবে ঘটা কোনো ঘটনায় কোনো ধরনের রিয়েক্ট করতে পারে না তখন তার মধ্যে সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীকালে রাগের জন্ম দেয়। এই রাগ একসময় তার আওতার বাইরে চলে যায়। তখন সে রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে বিভিন্ন অযাচিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তার সামনে করা কোনো অপরাধের জন্য অপরাধিকে ক্ষমা করতে নারাজ সে। একে আনফরগিভনেস হুপ বলে। এর ফলে উক্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে তার সামনের মানুষটিকে ক্ষমা করার মহৎ গুণ হারিয়ে ফেলে।

হাঁটু ভাঁজ করে হাতের বাঁধনে জড়িয়ে ধরে বসে আছে নিষ্প্রাণ। তার শিড়দাঁড়া ঠেসে আছে রাজন শিকদারের হুইল চেয়ারের সাথে। নিষ্প্রাণের নিমগ্ন দৃষ্টিত মেঝেতে। ক্লান্তিহীন গলায় বলল—

“আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা আমার ভুল হয়েছে। আপনার কারণে আজ আমাকে ধ্রুবতারার গায়ে হাত তুলতে হলো। আপনি ইচ্ছে করলেই সব থামাতে পারতেন। কিন্তু করেননি। আপনার কারণে তারাকে হারিয়েছি আমি। আমার মাকে হারিয়েছি আমি। আজ আপনার কারনেই আমি আমার ধ্রুবতারার প্রাণটাও কেড়ে নিতে চেয়েছি।”

সক্রোধে উন্মাদ নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়ায়। এক লাথি বসায় হুইল চেয়ারে। তা গিয়ে ঠেকে দেয়ালে। রাজন শিকদার হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝেতে। তার চোয়াল আঘাতপ্রাপ্ত হলো। চকিতে দাঁতের সাথে গালের নরম জায়গা লেখে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। কপালের একপাশ মেঝের শক্ত পাটাতনে লেগে ফেটে যায়। গলগলিয়ে শোণিতে মাখামাখি হলো সফেদ মেঝে। রাজন শিকদার কাতরাতে থাকল। তাকে বিছানায় শোয়াল নিষ্প্রাণ। নিভুনিভু, ফ্যাকাশে দৃষ্টি। নিষ্প্রাণ নির্বিকার গলায় বলল—

“যদি ধ্রুবতারার কিছু হয় তাহলে আপনাদের কাউকে আমি ছাড়ব না। মনে রাখবেন। হাসমুল! হাসমুল!”

রাজন শিকদারের ভয়ে থমকে যাওয়া দুই চোখ দিয়ে জলস্রোত বইছে। কপাল কেটে ঝরছে রক্তস্রোত। নিষ্প্রাণের চিৎকারে ছুটে এলো হাসমুল। তাকে দেখেই কঠোর গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দাও। তার আগে ডাক্তার ডেকে ড্রেসিং করিয়ে নিয়ো। ”

“জে ছোডো সাহেব।”

রাজন শিকদার অসাঢ় হয়ে পড়ে রইলেন। নিষ্প্রাণ বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। করিডোর দিয়ে নরম পায়ে হেঁটে এসে নিজের কক্ষে প্রবিষ্ট হয় সে। আয়েন্দ্রি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ডাক্তার তাকে অল্প মাত্রার ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। আপাতত মাথার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য তার ঘুম প্রয়োজন। নিষ্প্রাণ ধীর পায়ে এসে বিছানার সাথে লেগে মেঝেতে বসে। তার প্রগাঢ় দৃষ্টি আয়েন্দ্রির ঘুমন্ত মুখে। কপালে দুটো সেলাই লেগেছে। ঠোঁটের কোণে লাগিয়েছে মলম। নীল হয়ে গেছে জায়গাটা। লাল তিল ঢেকে গেছে কালচেভাবে। তবুও তা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিচ্ছে নিষ্প্রাণের চোখে। নিষ্প্রাণের এক দুর্দমনীয়, কৌতূহলী, তূরন্ত টান আয়েন্দ্রির কোমল ওষ্ঠাধরে। যারা মোহ সে কাটাতে পারে না। বিছানার কার্ণিশে দুই হাতের ভরে উঁচু হয় নিষ্প্রাণ। ঝুঁকে পড়ে গভীর আশ্লেষে আয়েন্দ্রির অধরসুধায় নিজের অশান্ত, অতৃপ্ত সত্ত্বার মৃত্যু ঘটায় সে। আয়েন্দ্রির ঘুমন্তভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। ফিচেল হাসে নিষ্প্রাণ। এই ঠোঁটের মায়া সে এই জন্মে কাটাতে পারবে না। পকেট ভর্তি বেলীফুলের পাঁপড়ি। তা নিয়ে ছড়াতে থাকে আয়েন্দ্রির সারা অঙ্গে। মুচকি হাসি নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির কাঁধের কাছে আঁচলের সম্মুখভাগ নিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরে।

এত ভালোবাসা গো জান রাখিও আঁচলে…..

“ধ্রুবতারা! ব্যাথা পেয়েছিস তুই? কী করব বল। তুই কেন আমার কথা শুনিস না? কতবার না করলাম ওই বাড়িতে যাস না। কিন্তু তুই…।”

বুকপাঁজরে জমে থাকা চাপা শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। কাতর গলায় বলল—

“আরেকটু হলেই তো সব শেষ হয়ে যেতো। এই হাতে আমি আমার অস্তিত্বকে শেষ করে দিতাম। কেন বলিসনি তুই আমাকে, তুই মা হতে চলেছিস?”

নিষ্প্রাণ বিছানার কার্ণিশের উঁচু বর্ডারে চিবুক রাখে। তার মুখটা একদম আয়েন্দ্রির বুকের কাছে। যেন হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে নিষ্প্রাণ।
বাচ্চাদের মতো অস্পষ্ট গলায় বলল—

“আমার সন্তানকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলি তুই? এতটা পাষাণ কী করে হলি?”

আয়েন্দ্রির চুলে হাত গলায় নিষ্প্রাণ। মেয়েটার এই শান্ত রূপ বুকে ব্যাথা বাড়ায় নিষ্প্রাণের। কপালের সেলাইয়ে সযত্নে অধর ছোঁয়াল, চোখের পাতায় ছুঁয়ে দিলো নিরভিমান মায়া। নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়াল। দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে জ্বালিয়ে দিলো সবুজাভ ক্ষীণ আলোক বাতি। জানালা পর্দা উড়িয়ে সুধানিধির জগৎ মোহনীয় জ্যোৎস্না হুরহুর করে ঢুকে পড়ছে। নিষ্প্রাণ পর্দা টেনে নেয়। নিঃশব্দে এসে তার ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির পাশে। দেহের উচাটন কমাতে মাথাটা রাখে আয়েন্দ্রির বুকের উপর। আলতো হাত রাখে আয়েন্দ্রির নরম উদরে। নিষ্প্রাণ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার চোখের সামনে হাজারো প্রতিচ্ছবির সমাবেশ ঘটেছে। আয়েন্দ্রির বক্ষস্থল ভিজতে লাগল নিষ্প্রাণের নিমেষহীন চাহনির ক্লান্ত, নিরবধি,নোনতা স্বচ্ছ জলের নহরে।
,
,
,
দুই দিনে অনেকটা সুস্থ হয়েছে আয়েন্দ্রি। কিন্তু মৌনতা যেন এখন তার নিত্যসঙ্গি। ঘরের মধ্যে বিড়াল ছানার মতো গুঁজে থাকে। নীরবতায় এক প্রশান্তি খুঁজে নিয়েছে সে।

আয়েন্দ্রির মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে নিষ্প্রাণ। চকিতে নজরুল ডেকে ওঠে।

“ছোডো সাহেব, নিচে ক্যাডায় আইছে আফনের লগে দেহা করতে।”

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য শেষ করে নজরুল। নিষ্প্রাণ প্রশস্ত গলায় বলল—

“তুমি যাও, আমি আসছি।”

আয়েন্দ্রি ভীত, নরম দৃষ্টিতে তাকাল। গহন হাসল নিষ্প্রাণ। চোখের ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করে বলল—

“তুই থাক, আমি আসছি।”

আয়েন্দ্রি কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। অচঞ্চল সে।
,
,
,
“কেমন আছেন মি. মিশকাত?”

মিশকাত নড়েচড়ে বসল। তার কৌতূহলী দুই চোখ আয়েন্দ্রিকে খুঁজে চলছে। গত দুই দিনে আয়েন্দ্রির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ সে। তাই বাড়িতে আসতে হলো তাকে। কণ্ঠে ঠাঁট রেখে প্রত্যুক্তি করে মিশকাত—

“জি ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো। তা কী মনে করে এসেছেন?”

মিশকাত চোখ বুলালো সিঁড়ির দিকে। তার চোখের দর্পণে ধরা দিলো না আয়েন্দ্রি। সরল গলায় বলল—

“আয়েন্দ্রি কোথায়? অনেকদিন ওর সাথে দেখা হয় না। তাই ভাবলাব দেখা করে যাই।”

নিষ্প্রাণ চমৎকার হাসল। তার হাসিতে মিশকাতের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো। কিন্তু মিশকাত তা প্রকাশ করল না। তার অধরে দীপ্ত হাসির মাতম খেলিয়ে বলল—

“ওর সাথে দেখা করা যাবে?”

নিষ্প্রাণ আগ্রহের সাথে বলল—

“শিওর। হোয়াই নট? আসুন আমার সাথে। দাদুর সাথেও দেখা করে নেবেন। অবশ্য আমার জানা মতে দাদু ঘুমোচ্ছে এখন। তবুও দেখা করে যান। কখন কী হয়ে যায় আবার!”

মিশকাত মৃদু চমকাল। নিষ্প্রাণের ব্যক্ত কথার অর্থোদ্বারের প্রয়াসে সে তাকাল নিষ্প্রাণের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উঠছে নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণের বিষয়ে এত কিছু শোনার পর তার আচরণে অবাক না হয়ে পারে না মিশকাত। এত কিছু করেও এত স্বাভাবিক থাকে কী করে মানুষ?

রাজন শিকদারের কক্ষে প্রবেশ করেই গা ছমছম করে ওঠে মিশকাতের। তিনি ঘুমোচ্ছেন। পাশেই বসে আছে হাসমুল। নিজের গরজেই নিষ্প্রাণ বলল—

“হাসমুল সবসময় দাদুর আশেপাশেই থাকে। তার সার্বক্ষণিকের সঙ্গি। আসুন।”

মিশকাত পুরো ঘরে চোখ বুলায়। সবকিছু কেমন শান্ত, সমাহিত। গা শিউরে ওঠে তার।

আয়েন্দ্রি সেভাবে বসে রয়েছে। মিশকাতকে দেখে কোনো ভাবাবেশ হলো না তার। কপালের উপরে চুল থাকায় সেলাইয়ের দাগ অস্পষ্ট। আয়েন্দ্রির থেকে বেশ দূরত্বে বসে মিশকাত। নিষ্প্রাণের চোখ এড়িয়ে কোনো কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। নিষ্প্রাণ সচল চোখে চেয়ে আছে। আয়েন্দ্রি মৌনতার সাগরে ডুবন্ত। তার ফ্যাকাশে আনন, ক্লান্ত চোখ আর চকিতে সেলাইয়ের দাগ চোখে পড়তেই অধৈর্য হয়ে ওঠে মিশকাত। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে চেয়ে রয় সে। নিষ্প্রাণের মোবাইল বেজে উঠতেই সে বাইরে চলে আসে। আয়েন্দ্রি হুটোপুটি করে ওঠে দাঁড়ায়। বালিশের তলা থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে তা ব্যস্ত হাতে মিশকাতের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল—

“প্লিজ আপনি চলে যান, চলে যান এখান থেকে। ”

“আয়েন্দ্রি তোমার এই অবস্থা হলো কী করে? এসবের মানে কী?”

“প্লিজ আপনি চলে যান। আমি যা বলার এখানে লিখে দিয়েছি। আপনি এখন চলে যান।”

গলা কাঁপছে মিশকাতের সাথে থরথরিয়ে ওঠল শরীর।

“ওকে, ওকে। যাচ্ছি আমি। নিজের খেয়াল রেখো।”

বাইরে বেরিয়ে আসে মিশকাত। দেখল, করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ অবাক গলায় বলল—

“আরে চলে যাচ্ছেন যে?”

মিশকাত রয়ে সয়ে বলল—

“একটা জরুরি কল এসেছে তাই। আসি আবার দেখা হবে।”

“ওকে।”

দ্রুত পা চালায় মিশকাত। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে বাইকে বসে। ভাইব্রেট করে ওঠে তার মুঠোফোন। রিসিভ করতেই ওপাশের ব্যক্তির তটস্থ গলার প্রশ্ন—

“আয়েন্দ্রি কেমন আছে?”

মিশকাত মর্মভেদী গলায় বলল—

“ভালো নেই। নিষ্প্রাণ নির্ঘাত আয়েন্দ্রির গায়ে হাত তুলেছে।”

“তুমি ওকে এরেস্ট করছ না কেন?”

মিশকাত হেয়ালি গলায় বলল—

“বললেই এরেস্ট করা যায় না কি? প্রুভ পাবো কোথায়? ওয়েট, আয়েন্দ্রি কিছু একটা দিয়েছে আমায়।”

মিশকাত কল হোল্ডে রেখে আয়েন্দ্রির দেওয়া কাগজটা খুলে দেখে। গোটা গোটা অক্ষরে সেখানে লেখা, ” আমার মোবাইল নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের কিছু করতে হবে না। আমি ঠিক আছি। যতক্ষণ না আমি কিছু বলছি আপনারা প্লিজ নিষ্প্রাণ থেকে দূরে থাকুন।”

“শুধু এতটুকুই?”

মিশকাত ঘটনার সত্যতার স্বীকারোক্তিতে বলল—

“হ্যাঁ। এতটুকুই।”

সারক হতাশ গলায় বলল—

“আমার সত্যিই এখন আয়েন্দ্রির জন্য ভয় হচ্ছে।”

করিডোর থেকে বাইকে বসা মিশকাতকে দেখছে নিষ্প্রাণ। তার সব কথা শুনতেও পারছে। বক্র হাসি তার অধরে। নজরুল বাধ্য ভৃত্যের মতো বলল—

“আফনে যেভাবে কইছেন তেমনেই লাগাইয়া দিছি তার সিডের লগে।”

“গুড। ড্রাইভিং কত দূর তোমার?”

“জে ভালো।”

“মনোযোগ দিয়ে শেখো। লাইসেন্সের ব্যবস্থা আমি করে দেবো। এখন যাও। মায়ের খেয়াল রেখো।”

“জে ছোডো সাহেব।”

কক্ষে আসে নিষ্প্রাণ। বিছানায় বসে সে। আয়েন্দ্রি এখনো মোমের মূর্তির মতো বসে আছে। আয়েন্দ্রির কাছে এগিয়ে গেল নিষ্প্রাণ। মখমলে গলায় বলল—

“তুই আর ঝামেলা করিস না ধ্রুবতারা। ওদের আমি ক্ষমা করে দিলাম। ”

আয়েন্দ্রির বুকের কাছে মাথা রাখে নিষ্প্রাণ। আদুরে গলায় বলল—

“তোর হৃদস্পন্দন শুনতে পাই আমি। তুই কেন আমার প্রাণস্পন্দন শুনতে পাস না?”

চলবে,,,

(বি.দ্র:
আর মাত্র কয়েকটা পর্বই আছে। এত কার্পণ্য কেন মন্তব্য করতে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here