#প্রেমমানিশা(৩২)
গোল্ডফিল্ড এভিনিউ,
জন মূর্তিতে ভরে উঠেছে হল। চারদিকে শুধু হাস্যময় রমণীদের কলকলে হাসির শব্দ। ভেসে আসছে মৃদু শব্দে গানের সুর। আবার কোথাও ভাসছে ফুলের ঘ্রাণ। চারদিক মুখরিত হয়েছে ফুলেল সুবাসে। হলের এক পাশে ফুলে সজ্জিত স্টেজে বসে আছে নব দম্পতি।
মিসেস জামান মেহমান এবং আত্মীয় স্বজনদের অ্যাটেন্ড করার মাঝে ফাঁকফোকরে মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের দিকে নজর দিচ্ছেন। মেয়ে টগরকে সুখী করতে চেয়েছিলেন। মেয়ের মুখের হাসি বলে দিচ্ছে উনি উনার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছেন।
মিস্টার কবির আর ফারহান মিস্টার জামানের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। পুরনো সম্পর্ক আবারও ঝালাই করে নিচ্ছে তারা। পুরনো বান্ধবী হিসেবে মিসেস জামান,মিসেস আশা আর মিসেস কায়নাতের মধ্যে ভালই সখ্যতা আছে। আবার তাদের ছেলে মেয়েদের মধ্যেও মোটামুটি যোগাযোগ আছে। টগর সানার সমবয়সী। NSU এর সিএসসি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখার দিক দিয়ে সানার জুনিয়র কারণ মাঝে টাইফয়েডের ভুক্তভোগী হয়ে ক্লাস সেভেনে দুইবার পড়তে হয়েছে।
মিস্টার কবির আর অতসী আগেই চলে এসেছেন। মিসেস কায়নাত,জাপান আর সানাহ্ গেছে বিয়ের উপহার কিনতে। মিসেস কায়নাত মেয়ের বিয়ের কাজের মধ্যে পরে বান্ধবীর মেয়ের বিয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। সেদিন মিসেস জামান ফোন করে মনে করিয়েছিলেন বলেই উপহার কেনার কথা মনে পড়লো।
ফারহান কথার মাঝে বারবার হলের এন্ট্রান্স গেটের দিকে নজর দিচ্ছে। মনটা আনচান করছে এক পলক সানাহ্কে দেখার জন্য। এই প্রথম ফারহান সানাহ্কে একদম ভিন্নভাবে আবিষ্কার করতে চলেছে। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে তারা তাই স্বাভাবিক ভাবেই সানাহ্ অত্যন্ত সেজেগুজে আসবে। আর এই সাজই ফারহান দেখতে চেয়েছিল।
‘ হবু বউকে খুঁজছেন মিস্টার দুলাভাই ? ‘
ফারহান আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সানাহ্কে খুঁজছিল কিন্তু আচমকা ওর পিছন দিয়ে হুট করে এসে অতসী ওর কানের কাছে কথা বলায় চমকে উঠলো। বুকে হাত রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে শূন্যে যেন থু থু ফেললো। অতসী দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওর কান্ড কারখানা দেখছে। ব্যাপারটা ওর হাস্যকর লাগছে। ওর হবু দুলাভাই যে এতটা ভীতু হবে সেটা ওর জানা ছিলনা।
‘ এত অদ্ভুত অদ্ভুত নাম কোথা থেকে খুজে পাও তোমরা ? তুমি ডাকছো মিস্টার দুলাভাই। তোমার বোন ডাকে কবি সাহেব, মিস্টার কবি ব্লা ব্লা ব্লা। এরকম অদ্ভুত নাম আমি বাপের জন্মে শুনিনি কাউকে ডাকতে। ‘ নিজেকে খানিকটা সামলে ভরাট গলায় বললো ফারহান।
‘ বাপের জন্মে শুনেন নি ? তাহলে বউয়ের জন্মে শুনে নিন। অভ্যাস করে নিন। এখন থেকে এসবই শুনতে হবে। আফটার অল উই আর সাইয়ারা সিস্টার্স… ‘ কথাগুলো বলেই ফারহানের দিকে এক গা জ্বালানো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই গুনগুন করতে করতে চলে গেলো অতসী।
অতসী যেতেই ফারহান কিছু একটা বিড়বিড় করে মাথায় হাত রেখে চোখ দুটো খানিকটা বড় করে আবার স্বাভাবিক করলো। বুঝাই যাচ্ছে এদের দুই বোনের কাজে সে হতবাক প্রায়। যাহ বাবা আধা ঘন্টা তো হয়েই গেলো কিন্তু সানাহ্ যে এখনও এলো না। এতক্ষন লাগছে গিফট কিনতে ?
তবে ফারহানকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সানাহ্ এসে হাজির তার জাপান ভাই আর মাকে সঙ্গে করে। আসার সময় ওয়েডিং গিফটকে তার জায়গামতো দিয়ে এসেছে। ফারহানের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে অপরূপ সুন্দরী সানাহ্কে দেখে। সানাহ্ তার ইচ্ছার মান রেখেছে। তার দেওয়া শাড়িটাই পড়েছে।
বাঙ্গি কালারের পাকিস্তানি শিফন জর্জেট বারিশ শাড়ির সঙ্গে পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া লালচে ঘন লম্বা চুল যেন এক অন্যরকমভাবে মানিয়েছে। হাতে সিলভার রোলেক্স ওয়াচ আর কানে গলায় শোভা পাচ্ছে রেড স্টোন বসানো ডায়মন্ড লকেটের সেট। পরনে মিডিয়াম হিলের ব্ল্যাক শূ।
সানাহ্ কোনোকালেই তথাকথিত হাই হিলের স্টিলেটোতে ইন্টারেস্টেড ছিল না। প্রথমত তার হাইট মোটামুটি ভালোই বলে স্টিলেটো পড়লে তাকে অতিরিক্ত লম্বা মনে হবে। দ্বিতীয়ত স্টিলেটো পড়ে নিজের হাইটের চেয়ে লম্বা জাহির করা তার মোটেই পছন্দ না।
হলে এসেই মিসেস কায়নাত মিসেস আশা এবং মিসেস জামানের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বহুদিন পর তিন বান্ধবী এক হয়েছেন। কথা যেন শেষ হতেই চাইছে না। সানাহ্ ওর মাকে তার বান্ধবীদের সঙ্গে এত হেসে হেসে কথা বলতে দেখে খুশি হলো। ওর মামনি চলে যাওয়ার পর থেকে ওর মা যেন হাসতেই ভুলে গেছে। সারাদিন শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। তবে আজ সে অনেকদিন পর মন থেকে হাসছে। শেষবার হেসেছিল যখন ওরা কয়েকদিন আগে রাতেরবেলা ঢাকা শহর ঘুরতে বেরিয়েছিল।
জাপান দেখলো সানাহ্ ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে আর ফারহান সানার সঙ্গে কথা বলার জন্য হাসফাস করছে। জাপান মুচকি হেসে সানাহ্কে বললো ‘ তুই তোর মাকে দেখছিস আর ওইদিকে দেখ তোর হবু বর তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য রীতিমত তড়পাচ্ছে। যা গিয়ে কথা বল ভাইয়ার সঙ্গে। ‘
জাপানের কথার জবাবে সানাহ্ মিষ্টি হেসে ফারহানের দিকে এগিয়ে গেলো। ফারহান ততক্ষনে রুদ্র কল করায় ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। সানাহ্ ফারহানের পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ফারহানের কথা শেষ হওয়ার। ফারহান যখন তার কথাবার্তা শেষ করে ফোন পকেটে গুজলো তখন সানাহ্ গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে ইশারা করে দেখিয়ে চোখে চোখে জিজ্ঞেস করলো ‘ কেমন লাগছে আমাকে ? ‘
ফারহান যেন এই কথার অপেক্ষাতেই ছিল। মুগ্ধ চোখে সানার দিকে তাকিয়ে বললো ‘ বাংলা একাডেমি আপনার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার মতো যথোপযুক্ত শব্দের আবিষ্কার এখনও করতে পারেনি উড বি মিসেস ফারহান। তবে আপনি আমার প্রেমমানিশা। হুম আমার প্রেমমানিশা, আমার অমানিশার মতো অন্ধকার জীবনে এক মুঠো প্রেম আপনি। এবার বুঝে নিন আপনাকে কেমন লাগছে। আমার চোখে তো আপনি সবসময়ই অনন্যা। ‘
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। সকলে গ্রুপে গ্রুপে যে যার যার পরিবারের সঙ্গে খেতে বসছে। ফারহানদের পরিবারও নিজেদের হবু বেয়াই পরিবার নিয়ে খেতে বসেছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে আরেক জায়গায়। সবার জায়গা হলেও জায়গা হয়নি ফারহান আর সানার।
গোল টেবিলে জনপ্রতি পাঁচজন করে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই হিসেবে মিসেস আশা,মিসেস কায়নাত,মিস্টার কবির,অতসী আর জাপানের বসার জায়গা হলেও সানাহ্ আর ফারহানের হয়নি। সানাহ্ বেশ চিন্তিত এ নিয়ে। ফারহান উপায়ান্তর না পেয়ে বললো ‘ আন্টি আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি সানাহ্কে নিয়ে অন্য টেবিলে বসতে পারি। আর কোনো উপায় তো দেখছি না। সব ফুল হয়ে গেছে। ‘
‘ আরে না না কিছু মনে করার কি আছে। তুমি ওকে তোমার সঙ্গে নিয়েই আলাদা বসাও। বাবা তুমি একটু দেখতো ও ঠিকমত খায় কিনা। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তো সে অনেক গড়িমসি করে। তুমি একটু দেখেশুনে খাইয়ে দিও। ‘ মিসেস কায়নাত ফারহানকে অভয় দিয়ে বললেন।
নিজের মায়ের কথায় বিরক্ত হলো সানাহ্। কি দরকার ছিল ফারহানের সামনে এভাবে বলার ? না জানি ফারহান ওকে নিয়ে কি কি ভাবছে। ওই দেখো ওর জল্লাদ মায়ের কথা শুনে ব্যাটা বজ্জাত হাসছে। সানাহ্ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দাত কিরমির করলো। ফারহান মিসেস কায়নাতের কথা শুনে সায় দিয়ে বললো ‘ না না আন্টি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে দেখেশুনেই রাখবো। ‘
ফারহান আর সানাহ্ বসেছে হলের একান্ত নিরিবিলি জায়গায়। এইদিকে মানুষের আনাগোনা কম। খাবার দাবারের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন লোক আছেন যিনি খাবারের দিকটা তদারকি করছেন। একটু পরপর হাকডাক করে সব খাবার হাজির করছেন লোক দিয়ে।
সানাহ্ গেছে বর বউয়ের ছবি তুলতে। এসব ব্যাপারে সে অনেক এক্সপার্ট। বিভিন্ন ওয়েডিং এর ফটোগ্রাফি করা তার হবি। সে বিয়ের ছবি জমাতে পছন্দ করে। তার ঘরের একটা অংশ জুড়ে আছে নানান লোকের নানান বিয়ের ছবি যাদের বিয়েতে হয় সে তার মা বাবার সূত্রে গেছে নয় বোনের সূত্রে গেছে। এই ব্যাপারটা ফারহান যখন লক্ষ্য করেছিল তখন অবাক ওয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ‘ এগুলো কাদের ছবি ? এত জোড়া কাপলের ছবি তোমার রুমে কেন ? ‘
সানাহ্ উত্তর দিয়েছিল ওয়েডিং ফাংশনের থিম ফটোগ্রাফি কালেক্ট করা আমার হবি। আই লাইক ইট। ফারহান সেদিন অবাক হয়েছিল কিন্তু সানার পছন্দকে সম্মান করেছি। এই অপার্থিব পৃথিবীতে অনেকেরই উদ্ভট পছন্দ থাকে। সানাহ্ও তাদের মধ্যে একজন।
সানাহ্ তার শখের ফটোগ্রাফি করে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। ফারহান তাকে বসিয়ে প্লেট উল্টে প্লেটটা হালকা লেবু পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নাপকিন দিয়ে মুছে তাতে পোলাও বাড়লো। সঙ্গে একটু কাবাব আর চিকেন রোস্ট দিলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে সানাহ্কে খেতে বলার উদ্দেশ্যে ওর দিকে ফিরতেই দেখলো সানাহ্ অলরেডি খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে সারাদিনের ধকলে সে ক্ষুধার্থ। ফারহান মুচকি হেসে নিজের পাতে খাবার বেড়ে খেতে বসল।
খুদার প্রকোপে প্রথমে খাবারের দিকে তেমন নজর না দিলেও ক্রমেই এসব তেলতেলে খাবার খেয়ে সানার শরীর খারাপ করছে। পরের টাকায় কেনা রসদ পেয়ে বাবুর্চি মন প্রাণ দিয়ে সব রান্নায় ঢেলে দিয়েছে। যার ফলপ্রসূ খাবার এখন তেলতেলে অখাদ্য ছাড়া কিছুই না। অথচ এই খাবারই শত লোকে কত তৃপ্তি নিয়ে ভোগ করছে। সানার ভাবতে অবাক লাগছে চিন্তাধারা আর রুচি একজন মানুষকে কতটা আলাদা করে দেয়।
‘ খারাপ লাগছে সানাহ্ ? খেতে পারছো না ? ‘
খেতে ব্যস্ত ছিল ফারহান। কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতে সানার দিকে ঘুরে বসলো। দেখলো সানাহ্ না খেয়ে আনমনা হয়ে বসে আছে। ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ বললো ‘ খেতে পারছি না। বিবমিষা হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে এখনই পেটের নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে। সারাদিনের টায়ার্ডনেসের পর এসব অয়লি ফুডে মাথা চক্কর দিচ্ছে। এমনিতেই অয়লী ফুড আমার সহজে হজম হয় না। ‘
ফারহান এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। সানার প্লেট দেখে মনে হচ্ছে বড়জোর কয়েক লোকমা খেয়েছে। এখন বাড়ি ফিরেই ঘুমোবে। সারারাত থাকবে খালি পেটে। না খেয়ে খালি পেটে থাকাটা ঠিক না। কিন্তু খাবে কি করে ? খাবারের যে অবস্থা। ফারহানের নিজেরও খেতে ইচ্ছা করছে না।
‘ আচ্ছা থাক জোর করে খেতে হবে না। আমারও ভালো লাগছে না খেতে। সেন্টারে অনেক গরম লাগছে। চলো দুজনে বাইরে গিয়ে আইস্ক্রিম খেয়ে আসি। বাড়িতে ভাত আর সবজি আছে। দুজনে মিলে বাড়ি ফিরে খেয়ে নিবো। ‘ ফারহান প্লেটটা ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বললো।
‘ পাগল হয়ে গেলেন ? আমি আপনাদের বাড়ি কি করে যাবো ? কাল না আমাদের এনগেজমেন্ট ? মা যেতে দিবে নাকি ? ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। ফারহানের কথায় অবাক সে। বিয়ের আর মাত্র দুই দিন বাকি। এখন কি করে ওই বাড়ি যাবে।
‘ আচ্ছা যেতে হবে না। এখন তুমি বাইরে চলো। নিচে একটা শপ আছে। ওখান থেকে কোণ আইস্ক্রিম কিনে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে খাবো। হালকা শীতের আমেজে বরফ গলা আইস্ক্রিম খাওয়ার এক আলাদা মজা আছে। ‘ ফারহান বললো।
এবার আর ফারহানের কথায় আপত্তি করলো না সানাহ্। এমনিতেও তার কমিউনিটি সেন্টারের পরিবেশে ভীষণ মাথা ধরা ঝিমঝিম ব্যাথা করছে। বোধ হয় সে এখন দম বন্ধ করে মারাই যাবে। ফারহান সার্ভ করা লোকটার হাতে বকশিশের টাকা ধরিয়ে দিয়ে সানাহ্কে নিয়ে সকলের অগোচরে বেরিয়ে পড়লো রাত্রিবিলাস করতে।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….