#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫০
.
সারাদিন রূপের বলা কথাগুলোই ভাবছিলাম। কী বলতে চাইছিলেন উনি? কী এমন আছে যেটা আমার জানা দরকার? আমার কী একবার ওনার কথা শোনা উচিত? কিন্তু আদ্রিয়ান? ও তো রূপকে পছন্দই করেনা। রূপ যেচে আমার সাথে একটু কথা বললেও রেগে যায়, সেখানে যদি আমি নিজে ওর সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে যাই নিশ্চিতভাবে ও ভীষণ রেগে যাবে। কী করবো সেটাই বুঝতে পারছিনা। আমি আগেই বলেছি আমার মন বরাবরই কৌতূহলী, আর রূপ কী বলতে চাইছিলেন সেটা জানার জন্যে আমার মন ছটফট করছে। যতক্ষণ না শুনব আমার মনের এই অস্হিরতা কিছুতেই কাটবেনা। আমার কী করা উচিত? হঠাৎ আমার গায়ে আলতো করে চাদর জরিয়ে দিয়ে চাদরের ওপর দিয়েই কেউ আমায় জড়িয়ে ধরল। এটা যে আদ্রিয়ান সেটা বুঝতে একটুও সময় লাগেনি আমার। আদ্রিয়ান আমার কাধে থুতনি রেখে বলল,
— ” একা একা দাঁড়িয়ে কী ভাবছো হুম?”
আমি ওর হাতের ওপর হাত রেখে মুচকি হেসে বললাম,
— ” তেমন কিছু না তুমি কখন এলে?”
— ” এইতো কিছুক্ষণ হলো, এতো রাত হয়ে গেল এখনও ঘুমাতে যাও নি কেন?”
— ” তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
ও আমার কাধে হালকা করে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বলল,
— ” দাঁড়িয়ে আমার কথাই ভাবছিলে বুঝি।”
আমি নিজের কুনুই দিয়ে ওর পেটে একটা খোঁচা মেরে বললাম,
— ” হুহ, বয়েই গেছে আমার।”
ও ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললেন,
— ” আচ্ছা?”
আমি ওকে ছাড়িয়ে ওর দিকে ঘুরে বললাম,
— ” জি হ্যাঁ। ফ্রেশ হয়েছেন?”
— ” হ্যাঁ ম্যাম। আপনি আপনাকে ভাবনাতে এতই মসগুল ছিলেন যে খেয়ালই করেননি আমি কখন চলে এসছি।”
— ” অ্ আচ্ছা এবার চলো আমি বিছানা করে দিচ্ছি ঘুমাবে তো? টায়ার্ড নিশ্চয়ই?”
ও আমার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। আমি খুব বেশি চমকালাম না। ওর এসব হুটহাট অদ্ভুত কাজে আমি অভ্যস্ত। ও আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে আমার চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিতে দিতে বলল,
— ” টায়ার্ড তো অবশ্যই। কিন্তু ঘুম না অন্য কিছু লাগবে।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
— ” কী লাগবে ?”
ও আমার কানের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ” তোমাকে।”
ওর অমন ধীর কন্ঠে আমার অবস্থা করুণ হয়ে গেছে। আমি লজ্জা পেয়ে ওকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে যেতে নিলাম, কিন্তু ও পেছন থেকে আমার হাত ধরে আবার নিজের কাছে টেনে কোলে তুলে নিলো আমাকে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ওর এরকম কান্ডে। আমি কিছু বলার আগেই ও ওর সেই নেশা ধরানো কন্ঠে বলল,
— ” তুমি নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দিয়েছিলে জানপাখি। এখন এতো পালাই পালাই করলে তো হবেনা? আর পালাতে চাইলেও আমি পালাতে দেবোনা।”
আমি লজ্জা পেয়ে সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিয়ে ওর টিশার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললাম। সবসময় এই কথাটাই বলে। অসভ্য ছেলে একটা। ও আমায় কোলে করে ভেতরে নিয়ে গেল।
___________________
পরের দিন দুপুরে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেটের কাছে এসে দেখি আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুশির সাথে অবাকও হলাম। অবাক হয়ে দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে বললাম,
— ” বাহ্বা। তুমি আজ আমায় নিতে এলে যে? বিশেষ কোন কারণ আছে নাকি।”
আদ্রিয়ান গাড়ির ডোর খুলে দিতে দিতে বলল,
— ” বাড়ি গেলেই দেখতে পাবে সুইটহার্ট আগে চলো তো?”
আমি গাড়িতে বসে পরলাম। ওও গাড়িতে বসে আমার সিটবেল্ট আর নিজেরটা বেঁধে নিলো। সারারাস্তা আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি ব্যপারটা কী কিন্তু মহাশয় বললেনই না। কিন্তু ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো ও ভীষণ খুশি। মেডিক্যাল থেকে ফিরে আমি টোটালি শকড। বাড়ির সবাই আজ এই দুপুরবেলা বাড়িতে? আপি সোফায় বসে আছে মুখে একরাশ লজ্জা নিয়ে। ইফাজ ভাইয়ার চোখেমুখেও ভীষণ খুশির ছাপ। এরপর মামনী যেটা বলল তাতে আমি শকড। আপি প্রেগনেন্ট! আমি এটা শুনে খুশিতে সবার সামনেই চিৎকার করে উঠলাম। আপিকে গিয়ে টাইটলি হাগ করলাম। বাড়ির সবাই নতুন অতিথি আশার খবরে ভীষণ খুশি হয়েছে। সারাদিনই সেলিব্রেশনেই কাটলো। আদ্রিয়ানের চোখে মুখেও চাচু হওয়ার আলাদারকম খুশি দেখছি আমি। সারাবাড়ি মাথায় করছে। মিষ্টি খাওয়ানো, ইফাজ ভাইয়াকে টিচ করা, আপিকে খোঁচা মারা। আচ্ছা যে চাচু হবে শুনে এতো খুশি হতে পারে সে যেদিন নিজের বাবা হওয়ার খবর পাবে কতটা খুশি হবে? আদ্রিয়ানের সেই খুশিগুলো কল্পনা করতে পারি আমি। দাদী হেসে বলল,
— ” এইযে ছোট বুড়ি। বড় বুড়ি কিন্তু সুখবর দিয়ে দিয়েছে। এবার তোমারটা কবে শোনাবে তা বলো?”
আমি বরাবরের মতই লজ্জায় কুকড়ে দাঁড়িয়ে আছি, বলার মত তো কিছুই নেই। কিন্তু আদ্রিয়ান বলল,
— ” দাদী? ভুলে গেলে কী বলেছিলাম? ক্রিকেট টিম?”
বলেই চোখ মারল। দাদীসহ সবাই মুখ টিপে হাসছে আমি লজ্জা পেয়ে ওপরে চলে গেলাম। সবগুলোই অসভ্যের হাড্ডি। আমি বেচারি মাঝখানে ফেসে যাই।
__________________
দেখতে দেখতে আরও দুটো দিন কেটে গেল। এই দুইদিনে অনেক চেষ্টার করেও রূপের বলা কথাগুলো মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলে দিতে পারছিনা আমি। আমার অধিক কৌতূহলী মনটাই আমায় ঐ কথাগুলোর দিকে আরও বেশি করে টানছে। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা আমি। আমি সকালে শাওয়ার নিয়ে চুল ঝাড়তে ঝড়তে এসব ভাবছি। আজ শুক্রবার তাই কোন তাড়া নেই। আদ্রিয়ান ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এসে চুল মুছতে মুছতে বলল,
— ” কী ব্যাপার বলোতো? দু-দিন যাবত দেখছি কিছু একটা নিয়ে ভেবেই চলেছো? এতো ভাবুক হলে কবে? কবি সাহিত্যিক হওয়ার প্লান করছো নাকি?”
ওর কথায় নিজের ভাবনা থামিয়ে মেকি হেসে বললাম,
— ” না আসলে এমনি..”
বলে টাওয়েলটা রেখে পাশ কাটাতে গেলেই আদ্রিয়ান আমার হাত ধরে নিলো। আমি তাকাতেই ও ওর সেই বিখ্যাত স্টাইলে মানে আড়াআড়ি ভাবে ভ্রু বাঁকিয়ে একপলক তাকালো আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” অনি এমন কিছু কী আছে যেটা তুমি আমায় বলনি বা বলতে চাও কিন্তু বলতে পারছোনা?”
আমি একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম। আমি তো ওর কাছে দুটো জিনিসই এখনও বলতে পারিনি। ঐ টেরোরিস্টদের ব্যপারটা আর রূপের ঐসব কথা। কিন্তু রূপ তো রিকোয়েস্ট করল আদ্রিয়ানকে কিছু না বলতে আমার কী ঠিক হবে বলাটা? আচ্ছা রূপের কথা নাইবা বললাম। কিন্তু টেরোরিস্ট দের ব্যপারটা তো ওকে আমি খুলে বলতেই পারি। অন্তত একটা জিনিসতো ওকে জানানো হবে তাইনা? আদ্রিয়ান আমার সামনে তুরি বাজাতেই আমার হুস এল। ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— ” কী ভাবছো?”
আমি কিছু বলার আগেই দরজায় আপির নক পরল। আদ্রিয়ান কে আছে জিজ্ঞেস করতে, দরজার ওপাশ থেকে আপি বলল,
— ” আমি, খাবার সার্ভ হয়ে গেছে। খেতে যাবেতো নিচে? চলো?”
আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান ইশারা করে বলল নিচে যেতে। খাওয়ার জন্যে নিচে নেমে আমি আর আদ্রিয়ান দুজনেই চরম মাত্রায় অবাক হলাম। আদ্রিয়ান আর আমি অবাক দৃষ্টিতে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে আবার ডায়নিং টেবিলে তাকালাম। কারণ টেবিলে একটা চেয়ারে রূপ বসে আছে। ও এই বাড়িতে কীকরে এলো? হ্যাঁ ও ওর বাবার বন্ধুর ছেলে তাই বলে হঠাৎ এখানে? আদ্রিয়ান এর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ও অনেকটাই রেগে গেছে। আমরা দুজনেই টেবিলে বসলাম। বাবা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আদ্রিয়ান রূপ এর ফ্যামিলি লন্ডন গেছে ওর পার্সোনাল একটা কাজে। ওর কাজ আছে তাই এখানে আছে। ছেলেটা ও বাড়িতে একা থাকবে তাই ভাবলাম এই এক সপ্তাহ আমাদের বাড়িতেই থাকুন।”
আদ্রিয়ান শক্ত হয়ে বসে আছে। আমি জানি ও রূপের এই বাড়িতে থাকাটা মোটেও ভালোভাবে নিচ্ছেনা। কিন্তু বাবার মুখের ওপরে কিছু বলতেও পারছেনা। আমারও ব্যপারটা ভালো লাগছেনা কিন্তু কী করবো? আমি রূপের দিকে তাকাতেই ও আমার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যতার হাসি দিলো। আমিও উত্তরে তাই করলাম। আদ্রিয়ানও সৌজন্যতার খাতিরেই দু-একটা কথা বলল। আদ্রিয়ান কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে ওপরে চলে গেল। তাই আমিও ঠিকভাবে খেতে পারলাম না। ওর সাথে ওর রুমে চলে গেলাম। রুমে যেতেই ও বলল,
— ” রূপের থেকে দূরে দূরে থাকবে। খুব বেশিই দরকার না পরলে কথাই বলবে না। গট ইট?”
আমি উত্তরে শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়েছি। যা রেগে আছে, এখন কথা বাড়ালেই ধমক মারবে পাক্কা। আদ্রিয়ান গম্ভীর মুখ করে বেডে বসে আছে। আমি ওর পাশে গিয় বসতেই ও হুট করে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। জেনো ছেড়ে দিলেই আমি কোথাও একটা হারিয়ে যাবো। হঠাৎ এরকম কেন করছে ও? আমিও কীসব ভাবছি আমি কোনোদিন ওর কোন কাজ বা কথার মানে বুঝতে পেরেছি যে আজ বুঝবো? সব ইঞ্জিনিয়ার গুলোই এরকম হয়? ম্যাথস এর মতো জটিল আর কঠিন কিন্তু একবার বুঝে গেলে ভীষণ মজার। নাকি ও একাই এরকম সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হয় আমার।
__________________
তিনটা দিন কেটে গেছে রুপ এই বাড়িতে আছে। ও যদিও নিজেই আমার সাথে কথা বলতে চায় কিন্তু আমিই যথেষ্ট এবোয়েট করি ওকে। আদ্রিয়ান এমনিতে ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণই করে কিন্তু মনে মনে যে বিরক্ত হয় সেটা খুব ভালোকরেই বুঝতে পারি। কিন্তু বাড়ির বাকি সবাই রূপকে বেশ পছন্দ করে কারণ তিনদিনেই মিষ্টি মিষ্টি কথা আর মিশুক আচরণ দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছে। কাল থেকে আবারও আমায় সেই কথা বলতে চাইছে ও কিন্তু আমি এভোয়েট করে গেছি। আদ্রিয়ান জানলে ব্যপারটা ভালো হবেনা। আমি মেডিকেল থেকে বাড়িতে এসে দেখি আজ বাড়িতে কেউই নেই। আমি বেশ অবাক হলাম। এইসময় সব কোথায় গেল? মামনী, বড় আম্মু, আর আপির তো অন্তত থাকার কথা।বাড়ির এরকম নিরবতা খুব বেশি অস্বাভাবিক লাগছে। আমি ওপরে ঊঠে করিডর দিয়ে নিজের রুমে যেতে নেবো তখনই কেউ আমার হাত টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল আর তাড়াতাড়ি দরজা লক করে দিল। ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটলো যে অবাক হওয়ার মত পর্যাপ্ত সময়টাও পেলাম না। তবে ভয় যথেষ্ট পেয়েছি। তাকিয়ে দেখি রূপ।
#চলবে…
[ এতোদিন পরে দেওয়ার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু হঠাৎই অসুস্থতা নামক বাধায় বাধাগ্রস্ত হয়ে গল্প লিখতে বসতে পারিনি। এই প্রথম হয়তো এতোদিন পর গল্প দিলাম। তাইনা? যাই হোক গল্পের শেষ অধ্যায়ে চলে আসছি আস্তে আস্তে। এখন কালকে থেকে পরবর্তী পর্বগুলোতে যাই হবে সেটার জন্যে কর্তিপক্ষ থুরি লেখিকা দায়ী নয় 😑😅।
যাই হোক, হ্যাপি রিডিং]