মৃণালিনী পর্ব-২০

0
780

#মৃণালিনী
#পর্ব ২০
সেদিনের ঘটনায় মৃণালিনীর আরও সুবিধা হলো, যে সব কাজ এতদিন সে বড়ো মার অগোচরে লুকিয়ে করছিলো সেগুলো প্রকাশ্যেই করতে লাগলো। আসতে আসতে জমি জমা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য তার নখ দর্পণে চলে এলো। মাঝে মাঝেই সে বড়ো মার বারণ সত্তেও বিভিন্ন প্রয়োজনে আলোকের সঙ্গেও কথা বার্তা বলতে লাগলো। পারুল বালা ক্রমশই তাকে বশে রাখার চেষ্টা ছেড়ে দিতে লাগলেন। কিন্তু সংসার বশে রাখতে গেলে একদম সব কিছু ছেড়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না, তাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে লাগলেন তিনি।

সেদিন ছিলো বুধবার, সকাল থেকেই পুকুরে জাল ফেলা চলছিলো, আবার বিভাকে পাত্র দেখতে আসবে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি পাত্র তাকে দেখে গিয়েছে, আর প্রতিবারই পড়াশুনা না জানার জন্যেই সে সম্বন্ধ ভেস্তে গিয়েছে। শুধু বিভা নয়, এই সমস্যার মুখোমুখি এই গ্রামের বেশ কয়েকটি মেয়েই হয়েছে ইদানিং, সব পাত্র পক্ষই আজকাল শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে দিয়ে চায়।

তবে, এই ছেলেটি কাছকাছি গ্রামের, আশা করা যাচ্ছে, বিভার পড়াশুনা না জানা এক্ষেত্রে খুব বেশি অন্তরায় হয়ে উঠবে না!

মৃণাল দোতলার তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়েই পাত্র কে বিভাদের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখলো, বেরোনোর সময়ে ছেলেটি তার দিকে মুখ তুলে তাকালো, মুখ টি যেনো খুব চেনা লাগলো মৃণালের! কয়েক মুহূর্ত দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে, উচ্ছসিত হয়ে উঠলো মৃণালিনী, সুভাষ! কলেজের সহপাঠী সুভাষ কে এখানে দেখে এতটাই খুশি হলো মৃণাল, যে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেলো এটা তার শ্বশুর বাড়ি এবং পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলা বড়ো মা কিছুতেই মেনে নেবেন না!

দোতলা থেকে ছুটে নেমে এসে বাইরের দরজায় পৌঁছে গেলো মৃণালিনী, কেমন দেখলো সে বিভাকে জানতে চাইলো। সবই ভালো শুধু পড়া শোনা না জানার জন্যেই যে সমস্যা, জানালো সুভাষ।

বিভা কিন্তু খুব ভালো মেয়ে, পড়া শোনা তো যেকোনো সময় শিখে নেওয়া যায় তাইনা? সে তুমি নিজেই বিয়ের পরেও শিখিয়ে নিতে পারো,

বন্ধু মৃণালিনীর কথায় একটু থমকালো সুভাষ,

হ্যাঁ, আমার খারাপ লাগেনি তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। আসলে মেয়েটির বাবা একটু অহংকারী, উনি ওনার অশিক্ষিত মেয়ের বিকল্প হিসেবে আমাকে প্রচুর পণের প্রস্তাব রেখেছেন। তুমি তো জানো আমি এর ঘোর বিরোধী। আমার বাবার এতে আপত্তি নেই, উনি এখনও পুরনো ধ্যান ধারণা গুলোকেই আঁকড়ে আছেন। কিন্তু আপত্তি আমার, যদি উনি বলতেন যে মেয়েকে শিক্ষিত করে নিতে হবে তাতে আমার আপত্তি হতো না। কিন্তু উনি মেয়ের মূল্য নির্ধারণ করেছেন পণ দিয়ে, সেটা আমি চাই না!

সুভাষের কথায় যুক্তি ছিলো, মৃণালিনী চুপ করে রইলো,

তবে তুমি যখন বলেছো ভেবে দেখবো একবার,

মৃণাল কে চুপ করে থাকতে দেখে নিজেই বললো সুভাষ, একটু হলেও শান্তি পেলো মৃণাল, বিভা বাস্তবিকই ভালো মেয়ে!

দুজনের উচ্ছসিত কথার আওয়াজে আশে পাশের বাড়ির লোকজনও বেরিয়ে এলো দেখতে। তাদের দেখেই লজ্জিত হলো মৃণাল, এই খবর এক্ষুনি বাড়িতে পৌঁছে যাবে, এবার দ্রুত সুভাষ কে বিদায় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে এলো সে। কিন্তু ততোক্ষনে যা হবার তাই হয়ে গেছে, বাড়ির মধ্যে দক্ষ যজ্ঞ বাধিয়ে দিলেন পারুল বালা।

সেই ঘটনার রেশ চললো শনিবারও, সৌম্যর শুধু বাড়িতে ঢোকার অপেক্ষা ছিলো, পারুল বালা তার কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বউয়ের অপরাধের ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন।

কোনো লজ্জা সরম নেই গা! অন্য বাড়ির মেয়ে কে দেখতে আসা পর পুরুষের সামনে, ঘোমটা ছাড়াই ছুটে বেরিয়ে গেলো! এই নাকি শিককিত! অমন শিক্কের মুকে আগুন! গোটা পাড়ায় ছি ছি পড়ে গেছে গা! চৌধুরী বাড়ির সম্মান বলতে আর কিছুই রইলো নে!

সৌম্য চুপ করে থাকলো, সে যথেষ্টই প্রগতিশীল, এইসব ব্যাপারে বউয়ের বিচার করার কোনো ইচ্ছেই তার ছিলো না। সেও তো নিজেই একসময় মৃণালিনী কে দেখার জন্যেই স্যারের বাড়িতে প্রতিদিন যেতো! সেখানে স্যারের যত ছাত্র আসতো তারা সবাই তো কোনো না কোনো অজুহাতে মৃণালের সঙ্গেই কথা বলতে চাইতো, সেও তো বিভিন্ন অজুহাতে কম কথা বলেনি তখন। সেই সময় পুরুষের সাথে কথা বলায় যদি আপত্তি না থেকে থাকে, তাহলে এখন সহপাঠীর ক্ষেত্রে থাকবে কেনো!

এতো কথা বলা সত্বেও সৌম্যর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে, রেগে আগুন হলেন পারুল বালা, এবার তাঁর সব রাগ দেওর পো র উপরেই পড়লো!

বলি, তোমাকে কি এসব কতা আমি গল্প কওয়ার জন্যে কয়েছি বাছা! আর কতো কাল বউ এর আঁচল ধরা হয়ে থাকবে! শিক্কিত হয়ে যে তোমার বউ ধরা কে সরা জ্ঞান করছেন! এর কিছু একটা ব্যবস্তা আজ তোমায় করতেই হবে, এই কয়ে দিলুম।

বড়ো মা! একসঙ্গে কলেজে পড়াশুনা করেছে, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে তো কথা বলবেই, তাই না! এতে এতো হৈ চৈ করারই বা কি আছে? তুমি সব সময় বড্ড রাগ দেখিয়ে ফেলো!

বিরক্ত গলায় বললো সৌম্য। এই প্রথম বার পারুল বালার কথার বিরুদ্ধে কথা বললো সৌম্য সুন্দর, দেওর পো র এই ধৃষ্টতায় অবাক হয়ে গেলেন পারুল বালা। প্রথম রাতেই বিড়াল বধ করতে হবে, না হলেই সংসার তাঁর হাতের মুঠোর বাইরে বেরিয়ে যাবে বুঝেই, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি, ঘোষণা করলেন বউ এর শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি জল টুকুও মুখে তুলবেন না।

অসহায় সৌম্য চুপ করে বসে রইলো, বউ এর শাস্তির ব্যবস্থা করা কোনো মতেই সম্ভব ছিল না তার পক্ষে, এই তুচ্ছ ব্যাপারে মৃণাল কে কিছু বলার ইচ্ছে, একটুও তার ছিলো না। রাত বাড়ছিলো, পারুল বালা খান নি বলে বাড়িতে সবাই না খেয়েই বসে ছিলো, শেষ পর্যন্ত মৃণালিনী নিজেই তাঁর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো।

আমায় কি শাস্তি দিতে চান বলুন? বাড়িতে সবাই আপনার জন্যে না খেয়ে বসে রয়েছে, যা শাস্তি দেবার তাড়াতাড়ি দিন, সবার খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে!

দয়া করে শাস্তি নিতে এয়েচো! যাও বাছা, তোমাকে মুক্তি দিলেম! আর কোনো দিনও তোমার কতায় কতা কইতে যাবনে! এবার থেকে তুমি নিজের ইচ্ছেতেই চলবে। পারুল বালা কারুর দয়ার পাত্রী নয়! কেউ আমাকে দয়া করবে এ আমি বেঁচে থাকতে সহ্য করতে পারবো নে!

শেষের কথাগুলো একটু যেনো অন্য রকম শোনালো, কেমন যেনো অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো তাঁর গলায়। পারুল বালা তার পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কোনো কথা আর না বলেই খেতে বসলেন, মৃণালের দিকে ফিরেও তাকালেন না আর। কুমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকেও হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। অত মানুষ এক সঙ্গে খেতে বসা সত্বেও ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো।

রাতে ঘরে শুয়ে মৃণালিনীর ঘুম আসছিলো না, বড়ো মার কথাগুলো যেনো মনের ভেতরে তোলপাড় করছিলো। সে কি অনিচ্ছাকৃত ভাবেই খুব আঘাত সত্যিই দিয়ে ফেললো বড়ো মা কে! তার কথার মধ্যে কি সত্যিই দয়া দেখানো প্রকাশ পাচ্ছিলো? দাপুটে বড়ো মা কে যেনো অনেক অসহায় লাগলো আজ!

বড়ো মা একটু কড়া কথা বলেন, সেতো তুমি এতদিনে জেনে গেছো মৃণাল! এখনও কেনো ভাবছো সে সব নিয়ে!

অসহায় গলায় বললো সৌম্য,বউ কে চুপ করে থাকতে দেখে মনে মনেই নিজের অসহায়তার জন্যে লজ্জিত হচ্ছিলো সে। বড়ো মার এই সব প্রাচীন ধ্যান ধারণা কে সে একটুও সমর্থন করে না, কিন্তু সামান্য প্রতিবাদ করার পরই বড়ো মা যে এতোটা প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সে সেটা একটুও ভাবে নি। বউ বড়ো মার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে, এটা অন্তত আজকের দিনে সে একটুও চায় নি। তারপরেও নিজের ইচ্ছেই মৃণালিনী গিয়েছে, এখন তার শুকনো মুখ তাকে কষ্ট দিচ্ছিলো।

আচমকাই স্বামী কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো মৃণালিনী, তার আসল কারণটা বোঝা সৌম্যর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সে বউয়ের অপমানের কথা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছিলো, কিন্তু মৃণালের কষ্টের কারণ অন্য ছিলো। দাপুটে বড়ো মার বলা শেষের কথাগুলো তাকে পীড়া দিচ্ছিলো। একজন মাতৃসমা মানুষ কে নিজের অজান্তে অপমান করে ফেলে তার মনের ভেতরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো। তার শিক্ষা, তার রুচি এই অন্যায্য কাজটা করে ফেলার জন্য মনে মনে তাকেই দায়ী করছিলো প্রতিক্ষনে আর নিজের কাছে নিজেই ছোটো হয়ে যাচ্ছিলো সে।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বড়ো মার ঘরের দরজায় উপস্থিত হলো মৃণালিনী,

আমি কাল খুব খারাপ ভাবে আপনার সঙ্গে কথা বলে ফেলেছি বড়ো মা, আমাকে ক্ষমা করে দিন!

পারুল বালা জপ করছিলেন, হাতের মালা ঘোরাতে ঘোরাতে তাকে ঘর থেকে চলে যেতে ইশারা করলেও ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো মৃণালিনী, জপ শেষে তাকালেন পারুল বালা,

মাফ আমি তোমায় কালই করেচি বাছা! আর নতুন করে কোনো কতা কবার নেই!

না, বড়ো মা, এ আপনার রাগের কথা! অন্যায় করলে নিশ্চয়ই বকবেন, কিন্তু এভাবে দূরে সরিয়ে দেবেন না!

অন্যায় করেচো যে মানো তালে!

মৃণাল ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, বড়ো মা, মানি! সুভাষের সঙ্গে কথা বলেছি বলে অন্যায় করেছি, এটা মানিনা, তবে আপনার সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলা আমার উচিত হয়নি, এটা মানি! তাই সারারাত ঘুমোতে পারিনি, সকালেই আপনার কাছে ছুটে এলাম।

গিন্নী হতে চাও? আমার সংসারের দখল নিতে চাও?

না, বড় মা, সংসার আপনারই, তার দখল নিতে চাই না, আমি শুধু আমার অধিকারটুকুর কথা বলতে চাই। আপনিও এ বাড়ির বউ, আমিও তাই, আপনি বাইরের কারোর সঙ্গে কথা বললে দোষ যদি না হয়, তাহলে আমার ক্ষেত্রে হবে কেনো? আমি জানি আপনিও মনে মনেই সেটা মানেন, হয়ত মুখে বলেন না। ছোটো থেকে আমার মা ছিলোনা তাই আপনাদের নিজের মায়ের জায়গাই দিয়ে এসেছি সব সময়। আপনার বকুনি তে আমি রাগ করি না বড় মা, কিন্তু অন্যায় না করেও বকুনি খেলে কষ্ট পাই। আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই তো বাইরের লোকের সমালোচনা সহ্য করেন না। সুভাষের সাথে কথা বলেছি বলে যদি পাড়ায় সমালোচনা হয় তবে যে আপনিই সবার আগে প্রতিবাদ করবেন সেটাও জানি। তাই আপনাকে কোনো সময় ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করতে চাইনি, তবু কালকের আমার করা ব্যবহারে আপনি কষ্ট পেয়েছেন সেটা আমাকেও খুব কষ্ট দিয়েছে বড়ো মা।

এই প্রথম কোনো কথা না বলেই মৃণালের মুখের দিকে, পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন পারুল বালা, তাঁর বজ্র কঠিন, অজস্র আঁকিবুকি কাটা মুখ আস্তে আস্তে নরম হয়ে এলো। খাটের নিচে রাখা ফুলের সাজি হাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মৃণালিনী, ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার পর থেকেই, বুকের ভেতরের জমে থাকা চাপ ব্যথাটা একটু একটু করে হালকা হয়ে যাচ্ছিলো।
ক্রমশ
(আজকের পর্ব টা অন্য গুলোর থেকে কিছুটা আলাদা, তাই একটু বড়ো করেই লিখতে চেষ্টা করেছি, আপনাদের মতামতের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here