মেঘদিঘির পাড়ে পর্ব – ২৯

0
471

মেঘদিঘির পাড়ে – ২৯
মালিহা খান

সরফরাজ রুপালি চাঁদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। ইউসুফ চোখ বুজেছে। বিভার কন্ঠটা কানে বাজছে বারংবার। হঠাৎ নিষ্প্রাণ হওয়া রমণী যেনো এখনো হিমঠান্ডা বুকে মাথা রেখে বিরবির করে বলছে,”বিশ্বাস করেন, আপনাকে আমি বেশি ভালোবাসি। আমার মতো করে আপনি কখনো ভালোবাসতে পারবেন না। কোনোদিন পারবেননা। কক্ষনো না।” সত্যিই তো বলে আধপাগলটা। নিশ্চিত সত্যি!

-“বিয়ে কবে করবি সেটা বল।”

ইউসুফের চোখ খুলে যায়। নীরসনয়নে সরফরাজের দিকে তাকায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

-“বোনের সাথে সাথে তোর মাথাও গিয়েছে?”

-“আমার বোনের মাথা গিয়েছে তোকে কে বললো?”

ইউসুফ মুখ ফিরিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাস টানে। শ্বাস ফেলে আবার তাকায়। মৃতপ্রায় গলায় বলে,

-“তুই জানিসনা চাচা-চাচীর কথা? তাও ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস কেনো সরফরাজ? ও বুঝেনা, ছোট। তোর বুঝ নেই?”

সরফরাজ নির্বিকার গলায় বলে,
-“অত অতীত ঘেঁটে আমার লাভ নেই। বিভা যা চায় তা যদি অন্যায় কিছু না হয় তবে সেটা ওর সামনে হাজির করতে আমি বিন্দুমাত্র ভাববোনা। তোর আত্মসম্মান অত্যাধিক বেশি আমি জানি। কথা বলিস মেপে মেপে। নিজের মর্জি ছাড়া একপাও নড়িসনা। কিন্তু আমার বোন তোকে পছন্দ করেছে মানে তুই নির্ধারিত হয়ে গেছিস। তুই যাই কর আর নাই কর, বিয়ে তোকে ওকেই করতে হবে।”

ইউসুফ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বিভার দরজায় তাকালো। দিব্যি ঘুমাচ্ছে হয়তো। চাঁদের আলো সোজা পড়ছে সরফরাজের চোখেমুখে। ইউসুফ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সরফরাজের স্বভাব সে জানে। এইতো কয়েকমাস আগেই। ইভার সাথে চরম অসভ্যতামির শাস্তি হিসেবে রাতবিরাতে গ্রামের এক ছেলেকে আটকে কি মারলো। শেষমেষ তো মারাই গেলো। বোনদের ব্যাপারে অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা তার বরাবরই। অবাক হলোনা ইউসুফ। হাঁফ ছেড়ে বললো,”বেশ!”

সরফরাজ দু’বার চাপড় দিলো তার কাঁধে। পরিবেশ সহজ করতে গলা কেঁশে বললো,

-“ওইদিন রাতে মিথ্যে বলেছিলি তাহলে, বিভা ঘুমিয়ে ছিলো না।”

ইউসুফ কিছু বলবে তার আগেই গহীন নিশার সুক্ষ্ম নিস্তব্ধতা ভেঙে ঝনঝন ধ্বনিতে স্টিলের কিছু পড়ে যাবার শব্দ এলো। সরফরাজের ঘর থেকে। সরফরাজ চকিতে সেদিকে ফিরে তাকালো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,

-“আমি দেখছি। তোর ভাবি পানির গ্লাস ফেলে দিয়েছে হয়তো।”

সরফরাজ দ্রুত ঘরে গেলো। ধারণা সঠিক। তন্দ্রা হাত থেকে পানি ফেলে দিয়েছে। মেঝেতে পানি ছড়িয়ে গ্লাসটা দূরে পড়ে আছে। সরফরাজ সুইচ চেপে বাতি জ্বালালো। তন্দ্রা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকালো। নিচু গলায় শুধালো,”পড়ে গেলো কিভাবে যেনো, পানির গ্লাসটা এতো ভারি লাগলো কেনো সরফরাজ?”

সরফরাজের কপালে গাঢ় ভাঁজ। এগিয়ে গিয়ে গ্লাসটা তুলে নিলো। জগ থেকে আরেক গ্লাস পানি ঢেলে তন্দ্রার মুখের সামনে ধরলো। উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“তোমার দূর্বল লাগছে তনু? গ্লাস পড়ে গেলো যে!”

তন্দ্রা পানি খেতে খেতেই এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো। পানি খেয়ে সে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। ইউসুফ একবার এসে জিজ্ঞেস করলো,”ভাবি ঠিক আছে?”

সরফরাজ “ঠিক আছে” উওর দিলেও সারারাত ধরে মনের মধ্য উশখুশ তার রয়েই গেলো।

৬২.
গেরুয়া রঙের ফুলে বাড়ি মৌ মৌ করছে। গাঁদা ফুলগুলো তাঁজা। ভোরসকালে বাজার থেকে আনানো হয়েছে। ইভার শাড়ি ঠিক করে জাহানারা উঠে দাড়ালেন। চুলে চিরুনি লাগালেন। মেয়েটার চুল এতো ঘন। মোটা দাঁতের চিরুনি না হলে চিরুনির দাঁত ভেঙে ভেঙে আসে।
তন্দ্রার মেজাজ চটে আছে। বোনের বিয়ে অথচ লোকটার নাকি এখনো কাজের অজুহাত। রাগে গমগম করতে করতেই সে ইভার ঘরে ঢুকলো। জাহানারা একনজর তার চেহারার দিকে চেয়ে বললেন,

-“তোর কি হয়েছে? মেজাজ খারাপ কেনো?”

তন্দ্রা বিরক্তি নিয়ে বললো,”আপনি জানেন উনি কি বলছেন চাচি? ইভাকে হলুদ ছুঁইয়েই নাকি সে চলে যাবে। আসবে কাল। এত ব্যস্ত একটা দিনে উনি কিকরে বাড়ি থেকে যেতে পারে? কি এত জরুরি কাজ বলেন?”

ইভা ঠোঁট গোল করে বললো,”ভাইজান থাকবেননা?”

তন্দ্রার নীরব চোখে রাগ ঝরে পড়ছে। জাহানারা আস্তে করে বললেন,”খুব জরুরি বলেই হয়তো যাচ্ছে বউমা। রাগ করোনা।”

কাজের ফাঁকে একঝলক জাহানারাকে ডেকে নিলো সরফরাজ। অতিব দূরে বসে থাকা অর্ধাঙ্গিনীর দিকে চেয়ে বললো,

-“আমি গেলে ওর একটু খেয়াল রেখো চাচি, শরীরটা খারাপ। মেহমানদের মাঝে বেশি দৌড়োদৌড়ি করতে দিওনা। তুমি কিছু বলে বুঝিয়ে ঘরেই রেখো। কথা শুনতে চায়না তো।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here