মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ৭

0
348

মেঘের আড়ালে চাঁদ
(৭)

দুঃসংবাদটা নিলয় পেল বেলা এগারোটায়, সাথে সাথেই কল দিয়ে আমায় জানালো, আমি হতবাক, এরা তো খুনি! ভয়ংকর খুনি! একটা সন্তানসম্ভবা মা কেও ছাড়ল না? ফোন করে করে, ভয় দেখিয়ে শারিরীক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ বানিয়ে ফেলে,
নিলয় জানায়,
•অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপ সাথে ঝাপসা দেখা ছিল লক্ষণ, তারপর হাসপাতালে ভর্তি করানোর সাথে সাথেই সিজার করে বাচ্চা বের করা হয়েছিল, কিন্তু মা ওটিতেই মারা যান, বাচ্চা কয়েক ঘন্টা বেচে ছিল!

পোস্টের ফাইনাল ড্রাফট সাজিয়ে ফেলেছি, অনেকগুলো মহিলা লেখিকা ও গ্রুপ এ্যাডমিনদের জানিয়েছি। নিলয় বলেছে, সে বলার সাথে সাথে যেন পোস্ট করি। আর মেঘনা আপার ঘটনা যেন মিজান কে না জানাই। সে আবেগ ধরে রাখতে পারবেনা। একমাত্র বড় বোন, তার উপর সন্তান সম্ভবা ছিল। কিন্তু নিজের ভেতরেই এলোমেলো হয়ে যাই আমি, কিছুক্ষণ একা একা কেঁদে মন হালকা করার চেষ্টা করতে থাকি।
সন্ধ্যায় নিলয়ের ফোন, সে এখুনি রওনা হবে, ভোর নাগাদ পৌঁছে যাবে, খুব সামান্য জরুরি জিনিস প্যাক করে রাতের আধারেই বের হতে হবে, আমার মিজানের, আশুলিয়ার এক রিসোর্টে আপাতত থাকব, জায়গা বদল করতে হবে বারবার, আমাকে নতুন সিম, ফোন, ল্যাপটপ দেয়া হবে, তাতেই যেন আমি সব পোস্ট করি। আমি আমার প্ল্যান জানালাম, নিলয় বলল,
•একাধিক আইডি থেকে সেইম পোস্ট করা হলে, বেশি বেশি শেয়ার হলে অবশ্যই ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া কঠিন হবে। তাও আপনার কোন একাউন্ট হ্যাক করতে দেয়া উচিত হবেনা।
•হুম ঠিক।

আমরা তৈরি, তারিককে কিছু জানানো হয়নি, সে ভোরের আগে তাহাজ্জুদ পড়তে উঠে আমাদের তৈরি দেখে অবাক হয়, কিন্তু কিছু বলেনা, আমি ভালো পরিমাণ বকসিস দেই, তাও তার মুখ ভার হয়েই থাকে, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না, নিলয় এলো আজানের একটু পর, আমরা নামাজ পড়ে নিয়েছি, নিলয় খুব কড়া করে কফি বানাতে বলল, তারিক গেল বানাতে, মিজান শক্ত হয়ে বসে আছে, ঢাকার দিকে যেতে হচ্ছে, তার চোখে মুখে আতংক, তাছাড়া নিলয়কে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলে ও কে একটু ভয় ভয়ই লাগে!

দুই মগ কড়া কফি নিজে নিল, ড্রাইভারকেও দিল, পুরো রাস্তা ভাগ করে চালিয়েছে, ফেরার পথেও তাই করবে। মিজান গাড়িতেও শক্ত ভাবেই বসে আছে, আমাকে নিলয় বলল একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে, আমি সিডেটিভ ছাড়া ঘুমাতে পারিনা এটা নিলয়কে বললে ঝাড়ি খেতে হবে, কানে হেডফোন গুজে মিষ্টি লয়ের গান চালিয়ে, হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু ভালো লাগছে না, অন্ধকারে রাস্তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না, গ্রামের রাস্তা টুকু পার হলেই হাইওয়ে, ভালো রাস্তা, মিজান বাইরে তাকিয়ে, আমি আড়চোখে ও কে দেখছি, আধো আলোয় ও কে কেমন যেন লাগছে, ও তো জানেইনা, আমি কত বড় খবর লুকিয়েছি, জানলে আমাকে ক্ষমা করবে?
ওর পরিবার ওর জন্য অপেক্ষা করে করে, লাশ দাফন করে দিয়েছে সন্ধ্যায়,

লাশ!
এই কদিন আগেও ফোনে কথা হয়েছিল ,খুব অনুরোধ করেছিল মিজান কে যেন দেখে রাখি! খুব আদরের ভাই! বাচ্চার নাম নাকি মিজান ঠিক করবে, ছোট বাচ্চা নাকি ও খুব ভালোবাসে……
ঐ কয় মিনিটেই মিজানের অনেক গল্প শুনেছি, ও ক্লাস ফোরে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে, কিন্তু তাও গাছে সে উঠবেই, ডাব গাছেও উঠতে পারে, মা আর মেঘনা ,মোহনা দোয়া দরুদ পড়তে থাকত, আর ও ডাব পাড়ত…
আমি হেডফোন খুলে নিলাম।,দোয়া পড়তে শুরু করি, মিজান একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার বাইরে তাকালো,

দোয়া পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানিনা, তার চেয়ে অস্বস্তিকর হল, আমি মিজানের কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি, সে ও পরম যত্নে আমার মাথা আগলে রেখেছে! গাড়ি থামল, আমি উঠে সলজ্জ হেসে ধন্যবাদ দিলাম মিজানকে। মিজান জবাবে ফ্যাকাসে হাসি দিল। ছেলেটা এত ভালো কেন? আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, একটা সাধারণ হাইওয়ে লাগোয়া হোটেলে থামা হল, সম্ভবত সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে বাঁচার জন্য।

ফ্রেস হয়ে, চা নিয়ে বসলাম, মিজান কোন কথাই বলেনি সন্ধ্যা থেকে,
নিলয় একটু দূরে দাঁড়িয়ে স্মোকিং করছে, ড্রাইভার কে কি কি যেন নির্দেশ দিল।
সিগারেট কয় টান দিয়ে ফেলে পায়ে পিশে টেবিলে এসে বসল, মিজানকে বলল,
•যান আপনি টেনে আসুন।
•জি?
•সিগারেট!
•নাহ! আমি একা খাইনা। বন্ধুরা জোর করলে…. একটু আধটু!
•আচ্ছা! মেয়েরা কিন্তু স্মোকার ভালোবাসে!
•একদম ভুল! আমি চেঁচিয়ে বললাম।
•নিলয় বলল, আহ আপু তুমি অন্যরকম! শিশির ভাই ভয়ংকর লাকি ছিল।
•মিজানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিলয়, শিশিরের নামে একটু নড়েচড়ে বসল মিজান
•কি রকম মেয়ে পছন্দ?
•জি?
•শুনেছি আশরাফুন্নেসা সুন্দরী ছিল।
•ও মোহনার বান্ধবী ছিল
•পূর্ব পরিচিত?
•হ্যা, আমার গ্রামের
•দেখে রাখতে পারলেন না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে নিলয়
•আপু ভারী কিছু খান, রিসোর্টে আপাতত কোন কুক থাকবেনা, কোন খবর লিক করার চান্স নিব না।
আমি একটু অবাক হলাম, মিজান এভাবে থাকাটা পছন্দ করবেনা, কিন্তু ওর পছন্দ, অপছন্দ অনুযায়ী চলার সুযোগ নেই আমাদের। আশুলিয়া পৌছালাম সকাল আটটায়, এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব ভাবিনি, বেশ ভিতরে রিসোর্ট টা , গাড়ি থেকে নেমে হাত পায়ের রক্ত চলাচল ঠিক করে নিচ্ছিলাম, গেটের পাশের পুরো দেয়াল জুড়ে ঝুলোনো টবে ফার্ন জাতীয় গাছ, পুরো দেয়াল সবুজ করে দিয়েছে, বেশ বড় পার্কিং, তারপর ডুপ্লেক্স বাড়ি, পিছনে বিশাল সুইমিং পুল, নিলয় তালা খুলে আমাদের ডাকল, নিচতলায় একটা মাত্র বেডরুম, পুরোটাই ড্রইং, ডাইনিং, উপরে চারটা বেডরুম।
•একটু এ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে। নিলয় বলে
•কি বল? এতো রাজার হালে থাকব। কার বাড়ি এটা?
•সব জানবেন।
•কিছু নিয়ম বলে দেই, দিনের বেলা যাই করুন সন্ধ্যার পর বেশি আলো জ্বালাবেন না। আমি দূরের জংলা মতন জায়গায় গিয়ে লক্ষ্য করেছি, পরিস্কার অবয়ব বোঝা যায়, বাজার সদাই করাই আছে, সব রেডি টু কুক ফুড আশাকরি সমস্যা হবে না, আমি আইটি ডিপার্টমেন্ট এ কথা বলে আপনাকে পোস্ট করার টাইম জানাবো, যেভাবে সাজিয়েছি, সেভাবে দেবেন, মিজানের লাইভ যাবে, শাহবাগে মোমবাতি জ্বলবে, নির্ভয়ার কেসের মতো সাজাতেই হবে, পাবলিক ইমোশন আমরা কম পাবো, কারণ আশরাফুন্নেসা মৃত, যাই হোক, হোপ ফর দ্যা বেস্ট। এরপরের ঠিকানা ও রেডি করে ফেলছি….
•তোমার ফ্যামিলি?
•আপাতত ইন্দোনেশিয়া ট্যুরে আছে
•যাক,
•ফেরার পর ওদের নিয়ে চিন্তা করব।
•কি যাযাবর জীবন
•ওরা মেনে নিয়েছে, কোন বিচার হলে তাহিয়া তোহফা, এত খুশি হয়।
•তোমার মতো অফিসার আরো দরকার।
•আমি আজ আসি, আপনারা রেস্ট করুন।

আমি উপরতলা, আর মিজান নিচতলার বেডরুম বেছে নিলাম, ঝামেলা হল ওয়াসরুম। এমন একটা ওয়াসরুম ঠিক করে গেছে নিলয় যার আলো রাতেও দূর থেকে দেখা যাবেনা। অতএব আমাকে নিচে নিচে এসে ব্যবহার করতে হবে। দিনের বেলা সমস্যা নেই, আমি ফ্রেস হয়ে একটা ঘুম দিলাম, ঘুম ভাঙল বিকেলে, মিজানের ডাকে, ও চা নাস্তা বানিয়ে ডাকছে,
•বাহ! কি এটা?
•আলু ভাজা!
•হাহা! ফ্রেঞ্চ ফ্রাই!
•আলু দেশি, তেল মসলাও দেশি নামটা অহেতুক বিলাতি রাখার মানে কি!
•তুমি আলু পেলে কোথায়?
•আলু নেই, রেডি টু কুক ফুডে ছিল,
•আচ্ছা!
•আলু থাকলে, ভর্তা করে, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়ে ভরপেট ভাত খাওয়া যেত।
•আমি নিলয়কে বলব।
•না না, আমার জন্য অনেক করছেন আপনারা…
•আরে কটা আলু, পিয়াজ, ডালই তো! দিলই নাহয়।
•হুম…. বাসায় কথা বলা মানা, মেঘনা আপার জন্য দুইদিন হল খুব খারাপ লাগছে…..টানা দুঃস্বপ্ন দেখছি।
•আমি থমকে গেলাম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের কামড় নিয়ে, বাকিটা হাতে রয়ে গেল,
•মিজান বলল, প্লিজ কিছু লুকাবেন না। আমি আর নিতে পারছি না। আমার প্রেগন্যান্ট বোনটা…..
•মিজান….. কি বলব তোমাকে? আসলে আপুর বিপি একটু বেশি থাকে।
•বাবু ভালো আছে?
•হ….হ্যা…! এমন নির্জলা মিথ্যে আমি জীবনে কোনদিন বলিনি।
•ওর মুখটা দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হল
•নিজেকে প্রতারক লাগছে, কিন্তু ওর মনোবল ভেঙে গেলে, এই পর্যায়ে এসে….

দুই দিন পর,
একযোগে আমার আইডি, বিভিন্ন মহিলা লেখিকাদের গ্রুপ থেকে তথ্য প্রমাণ সহকারে পোস্ট দেয়া হল। বিপুল সাড়া পাওয়া গেল, অনেকগুলো অনলাইন সংস্করণে সাক্ষাৎকার চাইছে মিজানের, নিলয় বলল, সময় হয়নি,লাইভটা হোক। তার আগে আমাদের নতুন সেফ হাউস দরকার। সেখানেই লাইভ হবে। আমার আইডিতে ব্যপক রিপোর্ট হল, পটেনশিয়াল রেপিস্ট তো দেশে কম নেই। নিলয় মন শক্ত করে কাজ চালিয়ে যেতে বলল। কেস রিওপেন করা হয়েছে। সাক্ষী দিতে যেতেই হবে মিজানকে। যতটুকু নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব…..নিলয় সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে জানালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here