হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫২.
‘মা? হিমি এই কাজটা করতে চান। অনেকদিন যাবত করছেনও। আমার মনে হয় ওনাকে চাকরিটা করতে দেয়া উচিত।’
তসবি পড়া থামালেন মায়মুনা। ছেলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডানদিকে দাঁড়ানো হিমিকে আড়চোখে দেখলেন।
সকালেই এ বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে হিমির সাথে। অফিস থেকে ফোন আসায় শাশুড়ির থেকে পারমিশন নিতে এসেছিলো হিমি। যদিও এর আগে কখনোই কারো থেকে পারমিশন নিতে হয় নি তাকে তবে বাপের বাড়ি থেকে আসার আগে বড়মা বলছ দিয়েছে যে কাজই করবে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে তবেই করবে। হিমি তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলো যাবে কি না। মায়মুনা স্তম্ভিত গলায় জানতে চেয়েছিলেন কি কাজ করে সে। সরল মনে হিমি জবাব দিয়েছে ম্যানেজমেন্টের কাজ। সাথে সাথেই গর্জে উঠেছেন মায়মুনা। বাড়ির বউ বাইরে গিয়ে কাজ করবে না। কিছুতেই না। হিমি উচ্চবাচ্য করে নি। কথা তো সেখানেই শেষ। তবে এখন আবার ছেলে বউয়ের ওকালতি করতে এসেছে কেনো? ভেবে পান না মায়মুনা।
ছেলেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
‘বাড়ির বউয়ের চাকরি করার প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। তাও আবার ক্যাটেরিং, ডেকোরেটিংএর কাজ!’
মায়মুনার কথায় আশাহত হলো তাহির। শুকনো হেসে বললো,
‘কোনো কাজই তো ছোট নয়। ওনার যা ভালো লেগেছে তাই করছেন। তাতে আমাদের বাঁধা দেয়া উচিত নয়।’
‘অবশ্যই উচিত। বাড়ির বউ যখন তখন অন্যের বিয়ে, জন্মদিন এসব অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা করতে চলে যাবে তা তো আর হয় না। তোমার বউ যদি পড়াশোনা করে ভালো কোনো চাকরি করতো আমি আটকাতাম না। কিন্তু ইন্টার ফেইল মেয়ের আবার কাজ কিসের? নতুন বিয়ে হয়েছে। কোথায় ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ শিখবে তা না। সামান্য চা বানাতেও শিখে নি। কফিও বানাতে চিনে না। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াবে কেনো?’
তাহির হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে হিমির দিকে তাকালো। হিমির গাল দুটো বেলুনের মতো ফুলে আছে। ফর্সা নাকটা লাল টকটকে হয়ে আছে। চোখে বোধ হয় বর্ষণ শুরু হবে। মায়মুনা জামান আবারও তসবি পড়ায় মনোযোগ দিলেন। তাহির বিনাবাক্যে উঠে গেলো। হিমি কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ধপাধপ পা ফেলে উপরে গেলো। মায়মুনা জামান তসবি পড়া অবস্থায় পেছন ফিরে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। এতো জুড়ে হাঁটাচলা করে কেনো এই মেয়ে? ও কি বুঝে না এখন আর সে ছোট নয়। নিজের বাড়িতে নয়। শ্বশুরবাড়িতে আছে। শাশুড়ির সামনের তেজ দেখায় কোন সাহসে? কেউ ওকে শেখায় নি কি করে গুরুজনদের সম্মান করতে হয়?
___________________
হাসপাতালের কাজ শেষে বেডরুমে ঢোকে খাটের মাঝখানে হিমিকে পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো তাহির। দেয়াল ঘড়িতে বারোটা বেজে সাত মিনিট। তাহির দরজা আটকে হিমির মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। হিমির দৃষ্টি শূণ্যে স্থির। হিমিকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষন করেও কিছু ঠাহর করতে পারলো না তাহির। জিজ্ঞাসু গলায় বললো,
‘হিমি?’
হিমি নিশ্চুপ। তাহির আবারও ডাকলো তাকে। এবার চোখ ঘুরিয়ে তাহিরকে দেখলো সে। তাহির কিছু বলতে নিতেই হিমি বলে উঠলো,
‘আপনার ঘুম পাচ্ছে? ঘুমান। আমি সরে যাচ্ছি।’
কথাটা বলেই ঝট করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো হিমি। তাহির ভড়কে গেলো। হিমির কন্ঠ শোনে মনে হচ্ছে ভীষন রেগে আছে সে। কিন্তু কার উপর রেগেছে? তাহিরের উপর? না কি তাহিরের মায়ের উপর? বিষয়টা বুঝা যাচ্ছে না ঠিক। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে টাউজারের পকেটে হাত গুজে বললো,
‘আমার ঘুম পায় নি। আপনি চাইলে আগের মতোই খাটের মাঝখানে বসে থাকতে পারেন।’
হিমি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো। রাগে কটমট করতে করতে খাটের কোনায় বসে পরলো। কিছুক্ষন নিরব থেকে হুট করেই বলে উঠলো,
‘আপনার মা এমন কেনো?’
‘কেমন?’
‘নিজের ছাড়া অন্যের কথা, অনুভুতি কিছুই বুঝার চেষ্টা করেন না। কে কি চাইলো, কার কি ইচ্ছে, কার কি পছন্দ এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই কেনো ওনার?’
‘মা এমনই হিমি। কেনো এমন সেটা জানি না। তবে ছোটবেলা থেকেই ওনাকে এমন ব্যবহার করতে দেখে আসছি।’
‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন বাচ্চা ডাক্তার। আমার এখন আপনার বাবার জন্যই মায়া হচ্ছে।’
তাহির হাসলো। এগিয়ে গিয়ে হিমির পাশে বসলো। শান্ত গলায় বললো,
‘মা আপনাকে কিছু বলেছেন?’
‘যেদিন থেকে এবাড়িতে এসেছি খালি তো উনিই বলে যাচ্ছেন।’
‘মায়ের কথার জবাব দিতে না পারায় ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পরছেন?’
‘হতে পারে। তবে আপনার মায়ের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। এই যে আমাকে একের পর এক আদেশ, নিষেধ, অপমান করছেন তাতে আমার খারাপ লাগছে, রাগ হচ্ছে এসব উনি বুঝতে পারার পরও থামছেন না।’
তাহির শুকনো হাসলো। হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি মাকে রাজি করাবো। কিছুদিন সময় দিন আমায়। কাজ ছাড়তে হবে না আপনাকে। শুধু কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে নিন। মা রাজি হয়ে গেলেই আবার জয়েন করবেন।’
হিমি মাথা নেড়ে বললো,
‘আমি কাজ ছেড়ে দিতে হবে বলে রেগে নেই বাচ্চা ডাক্তার।’
কপালে চিন্তার ভাজ পরলো তাহিরের। চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলছে।
‘কাজ করাটা আমার জন্য ইম্পোর্টেন্ট নয়। তখন ছিলো। নিজের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিলো বলে নয় বরং নিজেকে ব্যস্ত রাখার তাগিদে। এখন সে ইচ্ছাটা নেই। কাজটা বোরিং লাগে আমার কাছে।’
‘তাহলে?’
‘দু বাড়িতেই গাড়ি ছিলো। যে যখন যেখানে যেতে চাইতো নিজেদের গাড়িতে বসে যেতে পারতো। পারতাম না শুধু আমি। দাদু নিহান আর আমার মধ্যে ভয়াবহ পার্থক্য তৈরি করেছিলেন। ফলে নিহান বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেলেও গাড়ি চড়ে যেতো আর আমি কোচিংএ যাওয়ার সময় অটোয় করে যেতাম। কেউ দাদুকে আটকায় নি। বুঝায় নি সঠিক বেঠিকের পার্থক্য। ও বাড়িতে আবার মামানির আদেশ! হিমিকে গাড়িতে বসতে দেয়া হবে না। পড়ালেখা নেই যাচ্ছে তাই করে বেড়াবে, দরকারের সময় গাড়ি পাওয়া যাবে না। হিমি যা করার একা একা করবে। একা একা চলাফেরা করবে। মামু তাই জেদ করেই আমায় বাইক কিনে দেয়। ড্রাইভিং শেখায়। বাইক পাওয়ার পর থেকে কখনোই আর হিংসে করি নি কাউকে। আগে একটু একটু করতাম। তবে বাইক পেয়ে নিজেকে সবচেয়ে বেশি লাকি মনে হতে লাগলো। যখন তখন যেকোনো জায়গায় সাই করে বেড়িয়ে গেছি। সারাক্ষন বাইকে করেই ঘুরেছি। বিয়ে হয়েছে বলে কি বাইক চালানো যাবে না? আপনার মায়ের জন্য আমি আমার এতোদিনের কম্ফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে কুর্তি পরছি। কাজ ছেড়ে দিচ্ছি। সারাদিন ঘরে থাকছি। আপনার মা আমার কথা ভেবে শুধু একটা পারমিশন দিতে পারবেন না? বাইক চালানোর পারমিশন? আমি তো আর এখন ওনাকে না বলে ছাদেও যাই না। প্রমিজ করছি বাইরেও ঘুরবো না বেশি। শুধু মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবো। বাইকে চড়ে হাওয়া খেতে যাবো। আমি এই কাপড় পরেই যাবো। তবু আপনার মা মানছেন না। এ বাড়িতে বাইক আনা এলাউড না বলছেন।’
তাহির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হিমির চোখে আকুতি। তাহির এক হাত বাড়িয়ে হিমির হাতের উপর রাখলো। অপরাধী গলায় বললো,
‘আমি মাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে পারি হিমি। তবে আশ্বস্ত করতে পারছি না যে মা মেনে নিবেন। আমার মা ভীষন জেদী। যা উনি চান তাই করতে হয়। যা বলেন তা কখনো পরিবর্তন হয় না। ওনার অমতে কিছুই করাও সম্ভব নয় এ বাড়িতে। চাকরি করা আর বাইক চালানো দুটো আলাদা বিষয়। চাকরি করলে আপনি আর্ন করতে পারবেন বলেই হয়তো মাকে মানানো সহজ হতো। কিন্তু বাইক চালানো!’
হিমি ঠোঁট উল্টে মুখ ঘুরালো। তাহির চেয়েও কিছু করতে পারলো না। দু এক মিনিট ঘরময় নিরবতা ছেয়ে ছিলো। তারপরই হিমি তাহিরকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পরে বললো,
‘ঘুমাবো আমি। যান আপনিও ঘুমান।’
দুচোখ বুজে আছে হিমি। তাহির বুঝতে পারছে হিমির ঘুম পায় নি। শুধু আর কথা বাড়াতে চায় না বলেই ঘুমানোর অভিনয় করছে সে। তাহির কিছু বললো না তবুও। ডিম লাইট জ্বালিয়ে চোখের চশমা খোলে রাখলো বেড সাইড টেবিলে। বালিশে মাথা রাখতেই খসখসে গলায় বলে উঠলো হিমি,
‘কাল কিন্তু আমি আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবো।’
চলবে,,,,,,
[ছোট করে দিলাম বলে দুঃখিত। গল্পের তাল হারিয়ে ফেলেছি। কিছুই মাথায় আসে না। মন চায় এক্ষুনি শেষ করে দেই😑 কিন্তু প্লট ভিন্ন হওয়ার এগিয়ে নিতে হচ্ছে। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।]