হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬৮.
সকাল সাতটায় ঘুম ভেঙে নিজেকে তাহিরের বাহুডোরে পেলো হিমি। হিমির মাথা বুকের সাথে জাপটে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাহির। হিমি মাথা তুলার সর্বস্ব চেষ্টা করেও পারলো না। দমবন্ধ লাগছে তার। হাত দিয়ে ঠেলে তাহিরের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে তাকে ডাকলো হিমি।
‘শুনছেন? ছাড়ুন না! দমবন্ধ লাগছে।’
তাহির শান্ত শীতল গলায় বললো,
‘ছাড়বো না।’
হিমি অবাক হওয়া গলায় বললো,
‘আপনি জেগে আছেন?’
‘না। ইচ্ছে করে জাগি নি। ঘুম ভেঙে গেছে।’
‘তাহলে উঠুন। হাসপাতালেও তো যেতে হবে!’
‘সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার এখন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। এখন আপাতত এক ঘন্টা ঘুমাবো।’
‘আপনার ঘুমাতে ইচ্ছে করলে আপনি ঘুমান। আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। আমি উঠবো। ছাড়ুন আমায়।’
তাহিরের দৃঢ় গলার স্পষ্ট জবাব,
‘সরি। ছাড়তে পারলাম না। অনেকদিন পর কাছে পেয়েছি। এখন ছাড়াছাড়ি যাচ্ছে না। আমায় একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিন তো। ছটফট করে সময় নষ্ট করবেন না। চুপ করে আমার বুকে ঘুমান। আমার ভালো লাগছে।’
হিমি আবারও হাত দিয়ে ঠেললো তাহিরকে। তাহিরের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। মুখে কিছু বললো না সে। হিমি হার স্বীকার করলো। ক্লান্ত হয়ে পরে রইলো তাহিরের বুকেই। তাহির তখনও জেগে। ঘুমানো তো বাহানা মাত্র। হিমিকে কাছে রাখার বাহানা।
দীর্ঘদিন বাপের বাড়ি কাটিয়ে গত রাতে বাড়ি ফিরেছে হিমি। একদিন তাকে ছাড়া বাড়িটা ভীষন ফাঁকা লাগছিলো তাহিরের কাছে। সব কেমন শূণ্য। রঙহীন। আজ থেকে আবারও সবকিছুতে আনন্দ পাচ্ছে তাহির।
রাদিবা আজকাল বেশ খাতির যত্ন করছেন মিশ্মির। বহু বছর পর আবারও বংশে সন্তান আসতে চলেছে। প্রথম বারের মতো দাদি হওয়ার সুখ আকাশচুম্বি। যদিও এই অনাকাঙ্খিত ঘটনায় নিহান কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পরেছে। মিশ্মির মনের ভাবটাও বুঝা যাচ্ছে না ঠিক। তবে পরিবারের বড়দের খুশির মাত্রা ছাড়াচ্ছে। নিহান মিশ্মি হয়তো এতো তাড়াতাড়ি বাবা মায়ের ভুমিকা পালন করতে চায় নি। হুট করে পরিকল্পনা বিহীন ব্যাপারটা ঘটে গেছে। পরিবারের সবার দিকে তাকিয়ে সে কথা আর কাউকে বলা হয় নি তাদের। নিজেদের মধ্যে বিচার বিবেচনা করে মেনে নিয়েছে সব। আল্লাহর নেয়ামত বলে কথা। ওনার ইচ্ছাতেই সব হয়। আল্লাহর ইচ্ছার উপর কথা বলার সাধ্য কার আছে? যখন থেকে এসব ভেবেছে তখন থেকেই লাজুক হাসছে মিশ্মি নিহান। শরীরে কম্পন ধরছে। শির শির করছে বুকের ভেতর। ভাবতেই অবাক লাগছে আট মাস পর তাদের বাচ্চা তাদের কোলে থাকবে। মিশ্মি ক্ষণিক পর পরই তার পেটের দিকে তাকাচ্ছে। এতো ছোট পেটে একটা বাচ্চা? কি করে সম্ভব? আচ্ছা, বাচ্চাটা কি মিশ্মির কথা শুনতে পাবে? নড়বে? পেট বড় হবে কবে? এতো ছোট জায়গায় থাকতে বাচ্চার কষ্ট হবে না? অদ্ভুত সব কথার বেড়াজালে নিজেই হাসিতে লুটোপুটি খায় মিশ্মি। রাদিবা আর আমিনা বেগমের মধ্যে ভাব হয় নি এখনো। বরঞ্চ এখন অহংকার করছেন রাদিবা। ছেলের সন্তান হবে। এই সুখটা তো আমিনা পাবেন না। কখনোই পাবেন না। প্রথমবারের মতো গর্ব করছেন রাদিবা। আমিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তিনি। দয়ার চোখে দেখেন আমিনা বেগমকে। আমিনা বেগমের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। বাড়ির বউয়ের দেখভাল করায় দুজনেই উঠে পরে লেগেছেন।
চেম্বারে রোগী দেখার মাঝখানে ঘড়ির দিকে চোখ যায় তাহিরের। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরুতে গিয়ে মায়ের কাছে শুনেছিলো মিশ্মির প্রেগন্যান্সির খবর শুনে পুরো পরিবার তাকে দেখতে যাচ্ছে। তিনিও যাবেন। অর্থাৎ হিমিও যাবে। তাহিরের আর জিজ্ঞেস করা হয় নি হিমি থাকবে কি না। তবে সে জানে একবার ও বাড়ি গেলে হিমি নিশ্চয় আরো কদিন থেকে আসবে। কোনো মানে হয়? এই না সেদিন ফিরলো? এখন আবার যেতে হবে কেনো? মিশ্মি সবে প্রেগন্যান্ট! বাচ্চা হয় নি এখনো। তাহলে কি দেখতে যাবে? ফোনে কথা বললে হয় না? দেখতে হলে যাক, কিন্তু থাকতে হবে কেনো? বিয়ের পর ঘন ঘন বাপের বাড়ি যাওয়া তো ভালো নয়। স্বামী সংসার থাকতে ও বাড়ি কেনো থাকতে হবে? বাড়ির বউয়ের বাড়ির প্রতি কোনো দায় দায়িত্ব নেই? কবে বুঝবে এসব হিমি? তাহিরের রাগ বিরক্ততে পৌঁছে যায়। মনে মনে ঠিক করে যাই হয়ে যাক হিমিকে বাপের বাড়ি, মামার বাড়ি কোনো বাড়িতেই থাকবে না সে। হাসপাতাল থেকে সোজা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে হিমিকে নিয়ে আসবে। ওবাড়িতে সবাইকে বলবে মা বলে পাঠিয়েছে হিমিকে নিয়ে যেতে। আর হিমিকেও বলে দেবে মায়ের এসব পছন্দ নয়। তাহিরের কথার তো কোনো দামই নেই তার কাছে। শাশুড়ির কথার আছে।
হাসপাতালের ডিউটি শেষ হয়েছে রাত এগারোটায়। এতো রাতে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া উচিত হবে কি না সেসব এক মুহুর্তের জন্যেও মাথায় আসে নি তাহিরের। কাউকে কিছু না জানিয়ে হিমিকে আনতে চলে গেছে সে। তার ধারনা হিমি ওখানেই আছে। আজ রাত থাকবেও। অথচ তাহিরকে একটাবার জানালোও না। কিছুটা অভিমান জায়গা করে নেয় তার মনে।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে খাওয়া ছেড়েই উঠে আসেন আমিনা বেগম। দরজা খুলে তাহিরকে দেখে ভড়কে যান তিনি। হিমির কিছু হয়েছে কি না সেসব ভেবে মুখ কালো হয়ে যায় ওনার। উদ্বিগ্ন গলায় বলেন,
‘এতো রাতে? কিছু হয়েছে?’
তাহির সালাম জানিয়ে বললো,
‘হিমিকে নিতে এসেছি। কোথায় উনি?’
ভ্রু কুঁচকান আমিনা বেগম। ততক্ষনে বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন মোজাম্মেল রহমান আর মুহিব রহমান। তাহিরকে ভেতরে আসতে বলায় সে ভেতরে ঢোকে হিমির ঘরের দিকে উঁকি দেয়। বলে,
‘হিমি কি ঘুমাচ্ছেন? ডেকে দিলে ভালো হতো। আজ থাকবো না। উনাকে নিয়েই ফিরবো।’
ওনারা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। মোজাম্মেল সাহেব ভরাট গলায় বললেন,
‘হিমিকে নিয়ে ফিরবে মানে? ও তো এখানে নেই।’
‘নেই? কখন ফিরলেন?’
মুহিব রহমান জানালেন হিমি এ বাড়িতে আসে নি আজ। ফোন কলেই মিশ্মি নিহান আর বাড়ির সকালের সাথে কথা বলেছে। মায়মুনা জামান এসেছিলেন। আধঘন্টার বেশি বসেন নি। হৃদিকে নিয়েই এসেছিলেন। টুকটাক কথা বলে দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। হিমির এখানে আসার কথা ছিলো না। ও বাড়িতেই আছে। তাহির ভীষন লজ্জা পেলো। বউকে নিতে মাঝরাতে শ্বশুরবাড়ি চলে আসায় সবাই তাকে কি ভাবছে কে জানে! মোজাম্মেল সাহেব মিটিমিটি হাসছেন তার দিকে তাকিয়ে। নিহান তো বলেই বসলো,
‘তাহির ভাই তো দেখি হিমিকে চোখে হারান।’
সকলের চোখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা ছিলো না তাহিরের। মুচকি হাসি আটকে পকেটে হাত গুজে ‘অনেক রাত হয়ে গেছে’ এই দোহাই দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সে। কাউকে কিছু বলার সুযোগও দেয় নি।
…………………………
শোবার ঘরে নীল রঙা ডিম লাইট জ্বলছে। ব্যালকনিতে ফর্সা আলো। তাহির ঘরে ঢোকে হিমিকে খুঁজলো। শোবার ঘরের ডিম লাইট বন্ধ করে রড লাইট জ্বালালো। এক ঝাঁক ফর্সা আলোয় ঘরের আবছা অন্ধকার ভাব কেটে গেলো। ঘরে হিমি নেই। কি ভেবে তাহির ব্যালকনির দিকে অগ্রসর হলো। যেমনটা ভেবেছিলো ঠিক তাই! ব্যালকনির দরজার কোণায় হাত পা গুটিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বসে আছে হিমি। তাহিরের পায়ের আওয়াজ কাছে আসতেই উঠে দাঁড়ালো সে। চটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে চমকে দিলো তাহিরকে। তাহির গোল গোল চোখে হিমিকে দেখছে। প্রথমবারের মতো শাড়ি পরেছে হিমি। কমলা রঙের শাড়ি। কোঁকড়ানো লম্বা চুল বাঁধনহারা। দুহাতে মুঠো ভর্তি চুড়ি। কানে স্বর্ণের দুলের পরিবর্তে কমলা রঙের ছোট ঝুমকো। চোখে কি কাজল? হ্যা, তাই তো! হিমি কাজল পরেছে। মোটা করে নয়, খুব সুক্ষ ভাবে। ঠোঁটে বোধ হয় লিপস্টিক তার। সর্বদা গোলাপী থাকা ঠোঁটে লিপস্টিক পরলে বুঝা যায় না ঠিক। মনে হয় আলোর তারতম্যের কারনে ঠোঁটটা রঙিন। হিমির ঠোঁটে লিপস্টিকের পাশাপাশি আরো একটা জিনিস ছিলো। হাসি। মিষ্টি স্বচ্ছ হাসি। কোনো এক আবদারের হাসি। তাহির হয়তো সে হাসির পেছনের কারন উন্মোচন করতে সক্ষম হলো। এক দৃষ্টে মায়াময় মেয়েটাকে দেখে ধীর গতিতে পা বাড়ালো তার দিকে। হিমি ঘাবড়াচ্ছে। তাহির তা ঠাহর করতে পেরে মৃদু হাসলো। হিমির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্মিত গলায় বললো,
‘হঠাৎ সাজগোজ?’
‘নিরামিষ!’
হিমির কথায় ফিক করে হেসে ফেললো তাহির। হাত বাড়িয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো হিমিকে। চোখ বুজে লম্বা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
‘অসুখটা ভীষন জটিল হিমি। তোমার ভালোবাসার অসুখে আমি পিষ্ট। নিঃশ্বাস নিতেও আজকাল তোমাকে চাই। রোজ রোজ অসুখটা বেড়ে চলেছে। তুমি আবার জর্জরিত করছো। মায়া হয় না? মায়াবতীর চোখ, ঠোঁটে যতোটা মায়া হৃদয়ে কি তার চেয়ে কম? দেখো না আমাকে রুগ্ন হতে? অসুখটা না বাড়ালেই কি নয়?’
হিমি মুচকি হাসে। ফিসফিস কন্ঠে বলে,
‘অসুখটা ছোঁয়াছে। আমারও তো অসুখ করেছে। বাচ্চা ডাক্তারের কাছে বুঝি ঔষধ নেই? ঔষধ থাকলে অবশ্য অসুখকে অসুখ বলে বোধ হয় না।’
‘অসুখ তো আমার আগে হয়েছে হিমি। আগে আমায় সুস্থ করুন। পরে নাহয় আপনাকে ঔষধ দেবো!’
খিলখিল করে হেসে উঠে হিমি। তাহিরের বুক থেকে মাথা তুলে তাকায় তার দিকে। তাহির দেখে হিমির চোখের কোনে একটু খানি জল জমা হয়েছে। বুড়ো আঙুলে খুব সাবধানে জলটুকু মুছে দেয় তাহির। ঠোঁট ছুঁয়ায় কপালে। চাঁদের সম্পূর্ণ আলো বুঝি তাদের গায়ে এসে পরলো! অসুখটা ভালোই কাবু করেছে দুজনকে। একে অপরকে ছাড়া আর কিছুই নজরে পরলো না তাদের। প্রেম ভালোবাসার প্রতি ধাপে সুখ খুঁজতে লাগলো তারা। অসুখটা হয়তো কমবে কিছু। তবে পুরোপুরি যাবে না। এ অসুখ যায় না। যার একবার হয় তার আজীবন থেকে যায়। আমৃত্যু থেকে যায়। অসুখ বয়েই বেড়াতে হয় জীবন। সুখের অসুখ বলে কথা, ছাড়ানো তো অসম্ভব হবেই!
চলবে,,,,,,,,,,
[খুব শিঘ্রই শেষ হবে গল্পটা। আর অপেক্ষা করাবো না। পরিবারে আমি ছাড়া বাকি সবাই অসুস্থ। লিখার মন মানসিকতা নেই। তবুও লিখলাম। ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন।]