#অগত্যা_তুলকালাম
#নাফীছাহ_ইফফাত
পর্ব ১
আগামীকাল আমার এক্সাম। পায়চারী করতে করতে মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। তখনই পাশের রুমে বাবা-মায়ের তুমুল চেঁচামেচি শুরু হয়। ঝগড়া করতে করতে দুজনে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেছে। আমি হালকা আঁড়ি পাতলাম কি বলে শোনার জন্য। যদিও এটা নতুন কোনো ব্যাপার না।
‘তুমি এই মুহুর্তে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।’ বাবার ধমকে চমকে ওঠে মা। বাবার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি আমাকে এটা বলতে পারলে?’
‘হ্যাঁ পারলাম। যাও বেরিয়ে যাও।’
‘ভুলে যেও না এটা আমারও বাড়ি।’ চেঁচিয়ে বলে মা।
‘তোমার বাড়ি? ঠিক আছে তাহলে তুমি থাকো, আমি গেলাম।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ যাও। তোমার দৌঁড় ঐ গেইট পর্যন্তই।’
‘কি বললে তুমি?’
‘এক কথা আমি দু’বার বলি না।’ মুখ ঝামটা মেরে বলে মা।
‘খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’
‘ভালো করতে বেরিয়ে যাচ্ছো না কেন?’
‘আমি কেন বেরুবো তুমি বেরোও।’
এ পর্যায়ে আমি রুমে ঢুকি। ওদের চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে বলি,
‘তোমাদের জন্য কি এই বাড়িতে কাকপক্ষীও বসতে পারবে না?’
দুজনই খানিকটা ভড়কে গিয়ে বললো, ‘বসতে পারবে না কেন?’
‘তোমাদের চেঁচামেচির জন্য থাকা যাচ্ছে? কাকপক্ষী তো ভয়েও এপথে পা মাড়াবে না।’
‘পা মাড়াবে না তো উড়ে উড়ে আসবে।’ বাবার সরল স্বীকারোক্তি।
‘হ্যাঁ ঠিকই তো। আমরা কি কাকপক্ষীকে আসতে নিষেধ করেছি নাকি? আজব ব্যাপার!’ মা-ও সায় মেলালো বাবার সাথে।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে রাগ হজম করলাম। টেবিলে থাবা মেরে বললাম,
‘কাল আমার এক্সাম। ফাইনাল এক্সাম। বোঝো? কত পড়া পড়তে হয়?’
‘হ্যাঁ তো পড়গে যা।’ বাবা বললেন।
‘কি পড়বো হ্যাঁ? কি পড়বো? তোমাদের চেঁচামেচি ছাড়া মাথায় কিছু ঢুকছে?’
‘তোর বাবা আর কি! সবসময় ঝামেলা করে আমার সাথে।’ মা বললেন।
‘কি আমি ঝামেলা করি? ঝামেলা তো তুমি করো।’ বাবা কটমট করে বললেন।
আমি দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা কন্ঠে বললাম,
‘ঝামেলাটা কি নিয়ে হয়েছে শুনি?’
বাবা-মা দুজনই দুটো ফুলের টব হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। দুজনে একসাথে কথা বলে হৈচৈ বাঁধিয়ে ফেলে। আমি আবার চেঁচাই।
‘একজন একজন বলো।’
বাবা বললো, ‘আমি আগে বলবো।’
মা দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলে, ‘আমি আগে বলবো।
তাঁরা আবার বাচ্চাদের মতো ঝগড়া শুরু করে দিলো কে আগে বলবে সেটা নিয়ে।
এবার মা বললো, ‘ঠিক আছে তুমি আগে বলো।’
সাথে সাথে বাবার কড়া জবাব, ‘আমি কেন বলবো? তুমি আগে বলো।’
মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখলি, দেখলি ঝামেলাটা কে বাঁধায় সবসময়? তোর বাবা!’
আমি একবার শান্ত দৃষ্টিতে দুজনকে দেখে নিলাম। তারপর বললাম,
‘তোমরা কি ফুলের টব দুটো আমার জন্য এনেছো?’
‘হুম।’ বাবা বললো।
মা বললো, ‘গতকাল একটা ভাঙলি না টব? ঐ যে আমাদের ঝগড়া থামাতে গিয়ে…’
‘হুম, এজন্য তোমরা দুজনে টবগুলো কিনেছো তাই তো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তোর বাবা বলছে ওর টবটা রাখবে, আমারটা নাকি রাখবে না। এটা কোনো কথা তুই বল?’
‘না বাবা, এটা ঠিক না। এত ঝগড়া করার তো কোনো দরকার নেই। তোমরা যতবার ঝগড়া করো ততবারই তো আমি কিছু না কিছু ভাঙ্গি। তোমারটা সকালে সাজালে বিকেলে তো ওটা আর থাকবে না, আমিই ভেঙ্গে ফেলবো। তখন মায়েরটা বসাবে। তাই না?’
দুজনই এবার চুপ করে গেল। আমি শান্তভঙ্গিতে দুজনের হাত থেকে টব দুটো নিলাম। দুজনের চেহারার ভাব বোঝার চেষ্টা করলাম। ওরা আমাকে পরখ করতে ব্যস্ত। কারণ দুজনই জানে এখন গুরুতর কিছু ঘটবে। গুরুতর কিছু ঘটানোর আগে আমি হুট করে শান্ত হয়ে যাই।
দুজনের দিকে একপলক তাকিয়ে সজোরে টব দুটো ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেললাম আমি। বাবা-মা দুজনই ছিটকে সরে গেল দূরে। আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,
‘কারো আওয়াজ যেন আমার রুম অব্দি না যায়। পরীক্ষা আমার, পড়বো সারারাত।’
বলে হনহন করে রুমে এসে ধড়াস করে দরজা আটকে দিলাম।
পড়ায় আর মন বসছে না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর নাকীব আসে আমার রুমে। নাকীব আমার ছোট ভাই। ক্লাস এইটে পড়ে। ও এসে আমার পাশে বসলো। আমি আঁড়চোখে তাকিয়ে বললাম,
‘কিরে কিছু বলবি?’
‘আচ্ছা আপু, বাবা-মা এত ঝগড়া করে কেন?
ওর কথায় খানিকক্ষণ চুপ করে থাকি। নাকীব ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে বাবা-মায়ের ঝগড়া। ও ঝগড়া একদম সইতে পারে না। ওর ন্যাঁদাকালে যখন বাবা-মা ঝগড়া করতো ও তখন চেঁচিয়ে কান্না শুরু করতো। কি বিশাল আওয়াজ তার কান্নার। বাবা-মায়ের উঁচু আওয়াজ ছাপিয়ে ওর কান্নার আওয়াজ ভাসতো। বাবা-মা তখন ঝগড়া থামিয়ে ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। ওর বয়স যখন চার, ও একটু একটু বুঝতে শিখেছে তখন থেকে ও বুদ্ধি দিয়ে ঝগড়া আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে। বাবা-মা ঝগড়া করলেই মাকে ধরে অন্য রুমে নিয়ে আসে। তারপরও চেঁচালে দুজনকে দুই রুমে নিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেয়। ওইটুকু বাচ্চার বুদ্ধি দেখে সবাই ভারী অবাক হতো। সবচেয়ে বেশি অবাক হতাম আমি। আমি ছোটবেলা থেকে শুধু ঝগড়া দেখেই এসেছি। কখনো আটকানোর চেষ্টা করিনি। ওদের ঝগড়া থামাতে গিয়ে বরাবরই শুধু হাতের কাছে যা পাই তাই ভেঙ্গে চলে আসি। তারপর ওরা সেই জিনিসটা নিয়ে আবার ঝগড়া শুরু করে। কিন্তু নাকীব ব্যাপারটা পুরোপুরি অন্যভাবে হ্যান্ডেল করে। কিন্তু এতদিন পর আজকে হঠাৎ ওর প্রশ্ন শুনে খানিক অবাকই হলাম।
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘ওদের হয়তো ঝগড়া লগ্নে বিয়ে হয়েছিল।’
‘আপু, ফাজলামো করো না। আমি সত্যিই জানতে চাই। আমি এগুলো আর নিতে পারছি না। সারাক্ষণ চেঁচামেচি। অসহ্য!’
‘আমি কি করবো বল? আমার তো কিছু করার নেই।’
‘কিছু করার নেই বললে হবে না আপু। কিছু একটা করতেই হবে।’
‘কি করবো তুই বল?’
‘উফ আপু! তুমি আমার চেয়ে কত্ত বড়। তাও আমার কাছে বুদ্ধি চাইছো?’ বিরক্তি নিয়ে বলে নাকীব।
‘বড়রা সবকিছু জানে নাকি? সবসময় সব বুদ্ধি যে বড়দের কাছ থেকেই আসবে তা তো না, তাই না? কিছু কিছু সময় বড়দের চেয়ে ছোটরাই বেশি বুদ্ধি বাতলে দিতে পারে। ছোটদের কাছেও বড়দের অনেককিছু শেখার আছে।’
‘বাট এটা তো সবাই মানে না।’
‘যার যার মেন্টালিটির ব্যাপার। বড় বলে সে দুনিয়ার সবকিছু শিখে বসে থাকেনি। ছোটরাও হয়তো তারচেয়ে বেশি কিছু জানে। যেমন বাবা-মাকে দেখ। ওরা তো আমাদের চেয়ে অনেক বড়। তাও ওদের সেন্সে এটা নেই যে, ছোটদের সামনে ঝগড়া করা যাবে না। এতে বাচ্চারাও ঐটাই শিখবে। এখন আবার আমাদেরকে দেখ। আমরা ওদের ঝগড়া মিটমাট করার জন্য বসে বসে প্ল্যান করছি। ওরা ঐদিকে ঝগড়া করছে। অথচ ব্যাপারটা হওয়ার দরকার ছিলো উল্টো।’
নাকীব দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে আমার কথা শুনছিলো। কথা শেষ হতেই হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘ইউরেকা!’
আমি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকাই। নাকীবের মাথায় অসম্ভব বুদ্ধি। সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি। ও হয়তো এমন কিছু পেয়েছে যার জন্য চেঁচিয়েছে। নিশ্চয়ই জোশ কোনো প্ল্যান বের করেছে।
‘আপু, চলো আমরাও ঝগড়া করতে শুরু করি।’
‘হোয়াট?’ নাকীবের কথা শুনে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলাম।
‘কি হলো?’
‘বাবা-মায়ের ঝগড়ার চোটে থাকতে পারছি না আবার তুই বলছিস আমরা ঝগড়া করবো? পাড়া-পড়শীরা আমাদের এলাকায় থাকতে দিবে ভাই?’
‘আরে আপু, ব্যাপারটা বুঝলে না? বাবা-মা তো সারাক্ষণ নিজেদের ঝগড়া নিয়ে ব্যস্ত। ঝগড়া করে ওরা মজা পায়। ওরা তো জানে না ঝগড়া দেখতে বা শুনতে আসলে কতটা বিরক্ত লাগে। আর আমরাও কখনো ঝগড়া করি না। ওদের আর কষ্ট করে আমাদেরকে সামলানো লাগে না। নির্বিঘ্নে তাই ওরা ঝগড়া করে।’
‘তারমানে তুই বলছিস আমরা অকারণে ঝগড়া করবো?’
‘হ্যাঁ তো। রোজ রোজ কারণে অকারণে এমন ঝগড়া করবো বাবা-মা নিজেদের ঝগড়া ফেলে আমাদেরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। হি! হি! মজা না?’
‘যদি ঝগড়ার অভিনয় করতে করতে আমরাও ঝগড়ুটে হয়ে যাই তখন কি হবে?’
‘আমরা তো অনেক ভালো, তাই না? আমরা সত্যি সত্যি কখনো ঝগড়া করবো না আপু।’ নাকীব এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমি ওর পিঠে হাত রেখে হতাশ গলায় বিড়বিড় করে বললাম,
‘অগত্যা তুলকালাম।’
#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️