#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ১১
আমি ধীরপায়ে বারান্দার দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখি একটা লম্বা ছায়া জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমে এসে নাকীবকে বললাম, “কাউকে জাগাবি না, কেনো শব্দ করবি না। চুপচাপ কিচেনে গিয়ে ঘর ঝাড়ুটা নিয়ে আয়।”
ও ফিসফিস করে বললো, “ঝাড়ু দিয়ে কি হবে?”
“তোর মুন্ডু হবে। যেটা বললাম সেটা কর, প্রশ্ন করবি না একদম।”
নাকীব ছুটে গিয়ে ঝাড়ু নিয়ে এলো। আমি বললাম,
“তুই দরজার কাছেই থাক, আমি বারান্দায় যাচ্ছি। কিছু ঘটলে তারপর ভেতরে গিয়ে বেদম কেলাবি তুই, ঠিক আছে?”
এরপর নাকীবকে বড়সড় একটা লাঠি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। আমি ভেতরে ঢুকতেই ছায়াটা হালকা নড়ে উঠলো। আমি যে-ই ঝাড়ুটা তুললাম মারবো বলে অমনি ছায়াটা “করছো কি, করছো কি” বলে আমার মুখ চেপে ধরলো। কন্ঠ শুনে আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। আমার হাত ফসকে ঝাড়ুটা পড়ে গিয়ে সামান্য আওয়াজ হলো। নির্জন রাতে সেই আওয়াজ নাকীবের কানে লাগলো ভীষন। ও একলাফে বারান্দায় এসে লাঠি চালালো রাফিনের কাঁধ বরাবর। আমার মুখ বন্ধ থাকায় বাঁধা দেওয়ার সুযোগটাও পেলাম না, তার আগেই রাফিন আর্তনাদ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। নাকীব আরও মারতে যাচ্ছিলো তার আগেই ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম,
“গাধা, বেকুব! তোরে বলছিলাম কিছু ঘটলে তারপর আসবি৷ ঝাড়ু পড়তেই হামলে পড়লি?”
ও ফিসফিস করে বললো, “কে ওটা?”
“তোর দুলাভাই। বের হ তুই। যা!” রেগেমেগে বললাম।
আমি রাফিনের সামনে বসে বললাম, “খুব লাগলো না?”
ও আর্তনাদ করে কাঁধ চেপে ধরে ফ্যাকাশে মুখে বললো, “একদম না। প্রথমবার ফিউচার বউয়ের বাড়িতে দেয়াল টপকে, হাত ছিঁলে, পা ছিঁলে এসে ফিউচার বউয়ের ঝাড়ুর আঘাত, ফিউচার শ্যালকের হাতে ফিউচার লাঠির ধুর লাঠির আঘাত খেয়েছি। আহা! কি মধুর স্বাদ! এই জামাই আদর ভোলা যায়?”
নাকীব কাঁচুমাচু করে বললো, “স্যরি ভাইয়া, আমি বুঝতে পারিনি।”
“তোমার হাতে জোর খুব বেশি, বাচ্চা হলে কি হবে? আহহ!” ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে রাফিন।
নাকীবকে বললাম, “বরফ নিয়ে আয়!”
ও বরফ আনতে চলে গেলে রাফিন বললো,
“এজন্যই অতি রোমান্টিকতা দেখাতে নেই বুঝলে? এবার বুঝতে পারছো তো আমি কেন কাটখোট্টা, আনরোমান্টিক? রোমান্টিক হলেই ঝামেলা। হুহহ!”
আমি আস্তে করে বললাম, “তুমি কেন এসেছো এত রাতে?”
রাফিন কটমট করে তাকালো আমার দিকে।
“হ্যাঁ, ভুল করেছি এসে, মস্ত ভুল। এই যে ঠোঁট কেটে গিয়েছে, (আমার ঠোঁটের দিকে নির্দেশ করে ) কপালে ব্যান্ডেজ করেছো, বিছানায় পড়ে আছো তাই লুকিয়ে দেখতে এসেছিলাম। এসেই তো লাঠির আঘাত খেলাম! আহ! কি ব্যাথা! ভুল হয়ে গেছে আমার। চলে যাচ্ছি।”
বলতে বলতে কাঁধ ধরে উঠে দাঁড়ালো রাফিন। আমার মুখে আপনাআপনি মুচকি হাসি চলে এলো। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে এসেছিলো আমাকে? এটাও কি সম্ভব রাফিনের দ্বারা? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।
নাকীবের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি।
“আপু, বরফ নাও। আরে ভাইয়া আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
রাফিন রেগে আমার দিকে তাকালো। অথচ নাকীবকে শান্তস্বরে বললো, “কেন ভাইয়া, আরেকটা দিবে লাঠির আঘাত?”
নাকীব মাথা নিচু করে বললো, “ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া। স্যরি!” বলে বরফের ঢাকনাটা নিচে রেখে চলে গেল।
আমি খানিকটা রেগে বললাম, “তুমি ওকে এভাবে বললা কেন? ও কষ্ট পেয়েছে না?”
“আমি কষ্ট পাইনি? তাছাড়া আমি স্বাভাবিকভাবেই বলেছি। ও বুঝেছে তুমি বোঝনি।”
“কি বুঝিনি আমি?”
“কিছু না।”
এরপর বিড়বিড় করে বললো, “তুমি একটা গাধী এটা বোঝনি।
আমি চেঁচিয়ে বললাম, “কিহ?”
“আস্তে কথা বলো। বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জাগিয়ে তুলবে নাকি?”
আমি চুপ করে গেলাম। রাফিন রেলিংয়ের হাতলে হাত রেখে পার হতে গিয়ে পারলো না। ওর ডান হাতে প্রচুর ব্যাথা। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলাম। ধরবো না আমিও, আমাকে গাধী বলা? ওকে ধরতে ঠ্যাকা পড়েছে আমার।
রাফিন রেলিং থেকে সরে এসে বললো,
“যাও, ঘুমাতে যাও।”
“যাবো না, এটা আমার রুম, আমার বারান্দা। আমি যেখানে খুশি থাকবো।”
“কি বললা? একটা থাপ্পড় দিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো একদম।”
আমি রাগী চেহারায় ওর দিকে তাকাতেই বললো,
“আমাকে ভয় দেখাতে এসো না। রুমে যেতে বলেছি, রুমে যাও।”
“যাবো না বলেছি মানে যাবোই না।”
“যাবে না তো?”
“না।” দু’হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে ভেংচি দিয়ে বললাম।
“ওকে ফাইন, আমিও সারারাত এখানে বসে থাকবো।”
রাফিন সত্যি সত্যি ফ্লোরে বসে পড়লো।
আমিও তেজ দেখিয়ে ওর অন্যপাশে ফ্লোরে বসে পড়লাম। বললাম, “আমিও যাবো না।”
বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর রাফিন হালকা সরে এসে আমার পাশে বসলো। আমি নড়লাম না একটুও।
আরও খানিক চুপ থাকার পর বললো,
“আরোহী, জানো আমার বুকের ভেতর খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব। তোমাকে যখন জাফর ছুঁয়ে দিতে যাচ্ছিলো তখন আমার মনে হয়েছে আমার পৃথিবীটা কেউ দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিচ্ছে। আমার যত্নে রাখা কাঁচের দেওয়ালের ওপারে পরিষ্কার দামী ডায়মন্ডটা কেউ তার নোংরা হাতে ছুঁয়ে অপবিত্র করে দিচ্ছে। আমি যদি শেষমুহুর্তে ওকে কাবু করতে না পারতাম আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারতাম না। যেই তোমার হাতটা পর্যন্ত অকারণে কখনো আমি ধরিনি, যেই তোমার কাছ থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি, বারবার দেখতে ইচ্ছে করা সত্ত্বেও ফিরে তাকাইনি শুধুমাত্র অবৈধ, পাপ হবে বলে সেই তোমাকে কিনা নোংরা শয়তানটা…ছি!”
আমার হঠাৎ করেই রাফিনের ওপর থেকে সারাজীবনের সমস্ত রাগ, অভিমান উঠে যেতে লাগলো। ওর কাটখোট্টা আচরণের এই তাহলে কারণ? যেখানে সমাজে চলছে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের দোহাই দিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা সেখানে রাফিন…? ও এত ভালো কেন?
রাফিন আবার বলতে শুরু করলো,
“আমি জানি তুমি মনে মনে আমাকে কি ভাবো। ভাবো আমি এমন রোবটের মতো কেন, কোনো ফিলিংস নেই কেন আমার মাঝে? সবসময় রেগে থাকি তোমার ওপর। কথায় কথায় রেগে যাই, তোমার সাথে কথা বলি না, ঠিকমতো দেখা করি না, কেয়ার করি না তোমার। এককথায় আমাদের সম্পর্কটা অন্য সম্পর্কগুলোর মতো না কেন এটাই তো তোমার আফসোস তাই না? তুমি কি জানো, আমার এই রাগটা শুধুমাত্র তোমার ওপর? আমি পৃথিবীর আর কারও ওপর রাগ দেখাই না। শুধু তুমি আর মায়ের ওপর খুব বেশি রাগ দেখাই আমি। কারণ আমি যাদেরকে ভালোবাসি তাদের ওপর রাগ দেখানোর অধিকারবোধটা নিজ থেকেই জন্ম দিই। রাগ দেখাই বলে তোমার খুব আফসোস হয় তাই না?”
আমি মনে মনে বললাম, “আমার কোনো আফসোস নেই। তুমি যেমন তেমনই ভালোবাসি আমি।”
রাফিন জবাবের অপেক্ষা না করে বললো,
“আজ সব খুলেই বলি। তোমাকে দেখার খুব লোভ আমার জানো? তোমার সুন্দর ঘন কালো চোখ, তোমার মিষ্টি মুখ আর সবচেয়ে বেশি লোভ তোমার কালো চুলের ওপর। এত লোভ থাকা সত্ত্বেও কখনো ভালোভাবে দেখিনি জানো? সে-ই প্রথমদিন একবার শুধু তোমার চোখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়েছিলাম, চুল তো তুমি সবসময় হিজাবের আড়ালেই রাখো। তাই কখনো নজর দেইনি। আমার মনে হতো যদি তুমি আমার না হও তখন কি হবে? আমার না হলে তো আল্লাহর কাছে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে, কেন আমি অন্যের হকের দিকে নজর দিয়েছি? আর আমি যদি তোমার সাথে অন্যদের মতো সারাক্ষণ ফোনালাপ, চ্যাটিং করতাম তুমি আমার কাছে আরও বেশি কিছু এক্সপেক্ট করতে। কারন মানুষ যত পায় তত চায়। এন্ড মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিং ইজ, আমাদের সম্পর্কটা অন্যদের মতো হলে আমরা আজ এত রাতে এত দূরে দূরে বসে থাকতাম না আরোহী। তুমি কি বুঝতে পারছো, হোয়াট আই মিন?”
আমি সজোরে উপর-নীচ মাথা নাড়ালাম। ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “নিজেকে আরও অনেক বেশি শক্ত করো আরোহী। আমি ছাড়াও তোমার জীবনে আরও মানুষ আছে। আমাকে পাওয়াটাই তোমার এইম না, আমি না থাকলেও যাতে জীবনটা নির্বিঘ্নে কাটাতে পারো সেভাবেই তৈরী করো নিজেকে। আমি চাই না কেউ আমার জন্য কষ্ট পাক। একফোটা চোখের জল ফেলুক।”
“তুমি যেমন আমি তোমাকে তেমনই ভালোবাসি।”
“আমি জানি। বারবার ভালোবাসি কথাটা বলে ভালোবাসা প্রমাণ করতে হবে না। কারো বিহেভিয়ার দেখে বোঝা যায়। তুমি জানো, আমার লাইফে আরও কত্ত মেয়ে এসেছিলো?…”
“কত্ত মেয়ে?” চোখ বড় করে বললাম আমি।
“অনেক মেয়ে। ওদের কাউকে আমি বলিনি আমার লাইফে আসতে, বলিনি থাকতে, যেতেও বলিনি। এত কথাও বলিনি কাউকে। আমার কাটখোট্টা বিহেইভ দেখে দু’তিন মাসেই ওরা চলে যেত। অথচ তোমাকে কি দেখে আমার ভালো লেগেছিলো আজও জানি না। বরাবরের মতো আমার চয়েজটাই সেরা ছিলো। যারা আমাকে চুজ করেছে তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেল অথচ আমি যাকে চুজ করলাম তার সাথে সেইম বিহেভিয়ার করা সত্ত্বেও সে রয়ে গেল।” একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে রাফিন।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, “ওদের কাউকে প্রপোজ করেছিলে?”
“না, বললাম তো ওরা আমাকে চুজ করেছে, আমি না। এখন এটা নিয়ে ভাবতে বসো না যেন। তোমাকে ওদের চেয়ে আলাদা ভাবি বলেই কিন্তু এত কথা শোনাই, এত রাগ দেখাই আর এত অধিকার ফলাই।”
“আচ্ছা, ভাববো না।”
“আরেকটা কথা…”
“কি?” আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম।
“নাহ থাক। আগে নিজেকে শক্ত করে গড়ে তোলো তারপর বলবো। এখন বললে সইতে পারবে না।”
“আচ্ছা।”
“ভোর হতে চললো। আমি গেলাম। সাবধানে থেকো, টেক কেয়ার। আল্লাহ হাফেজ।” রাফিন রেলিং বেয়ে নেমে গেল।
রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়ে আসছে। ভোরের মৃদু আলো এবং ল্যাম্পপোস্টের আবছা হলুদ আলোয় দেখলাম রাফিন হেঁটে গিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। সাথে সাথে টেক্সট করলাম ওকে, “ফজরের নামাজ পড়ো কিন্তু।”
ও ফোন বের করে টেক্সট পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর হাত নেড়ে চলে গেল।
ফজরের নামাজ পড়ে শুয়েছি। চোখ লেগে এসেছে সবেমাত্র তখনই নাকীব এসে হাজির। ‘আপু, আপু’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে আমার কোলবালিশটা টেনে নিয়ে ঘোরাতে লাগলো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে ওর নাচ দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম,
“কি হয়েছে?”
“ছোটফুফি, ছোটফুফি এসেছে।”
আমার ঘুম সাথে সাথে উধাও। “কিহ?” বলে লাফিয়ে ছুটে গেলাম লিভিংরুমে। ছোটফুফি সবেমাত্র এসেছে, বোরকা খুলছে। বোরকা খোলার সময় দিলাম না আমি তার আগেই ‘ছোটফুফি’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফুফি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“আস্তে, আস্তে!”
“আসসালামু আলাইকুম।” উত্তেজিত গলায়ই বললাম।
“ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস?”
“ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“আঙ্কেল আসেনি?”
“না, নিতে আসবে পরে। এখন তুই কি আমাকে বোরকা খুলতে দিবি নাকি এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।” বলে আমি চট করে সরে দাঁড়ালাম।
দুপুরে খেয়েদেয়ে ছোটফুফি আমাকে ডেকে বললেন,
“দেখি সমস্ত ঘটনা খুলে বল।”
আমিও বিস্তারিত বলা শুরু করলাম। সব শুনে ছোটফুফি বললেন,
“তুই নিজেও পুরোপুরি নির্দোষ না। বরং তোর দোষ সবার আগে।”
আমি অবাক হয়ে শুধু বললাম, “আমার দোষ?”
#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️