#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ২৫
কয়েকদিনের মধ্যেই ঝিলিসহ সবাই আমাদের মনে জায়গা করে নিলো। বাচ্চাগুলো আসলে খুবই ভালো। শুধু যত্নের অভাবে আর অবহেলায় রাস্তাঘাটে যা পায় তাই খেয়ে বড় হচ্ছিলো। ক্ষুধার জ্বালায় হয়তো চুরিও করেছে। বুয়া ওদের সবাইকে সুন্দর করে গোসল করিয়ে ব্রাশ করিয়ে দিলো। তারপর নতুন পোশাক পরার পর ওদেরকে দেখে চিনতেই পারছিলাম না আমি। কি যে সুন্দর আর ফুটফুটে দেখাচ্ছিলো ওদেরকে। কোনো ধনী বাড়িতে জন্ম হলে হয়তো সবসময় ওরা এমনই থাকতো।
বিকেলে ওদের সাথে বসে নাস্তা করছিলাম। একপর্যায়ে বললাম,
“আচ্ছা, তোমরা কখনো চুরি করেছো?”
“অনেকবার করছি।”
“অনেকবার? কি বলো? কেন করেছিলে?”
“আমরা যে বস্তিতে থাকতাম ওখানে কুলসুম আপা আর মাহফুজ ভাই মিইল্যা একমাস সময় নিয়া সুন্দর করে একটা ঘর বানাইছিলো। যেদিন বানানো হইলো তার ফরদিন নেতার দলবল আইসা ভাঙচুর করে গেলোগা। এরপর আর ঘর বানাইনাই। ঝুপড়ি বানাইয়া আছিলাম। সারাদিন কাগজ টোকাইতে থাকতাম কিন্তু বেচতে পারতাম না৷ না খাইয়া থাওন লাগতো। ফুটপাতের দোকান থেইকা মাঝেমধ্যে কিছু দিলে খাইতাম নইলে উপোস তাকতাম। তহন সুযোগ পাইলে চুরি কইরা খাইতাম।” আবির বললো।
আহারে! বাচ্চাগুলোর কত নির্মম জীবন। এদিকে আমরা একটার ওপর পাঁচটা খাবার খাচ্ছি। না খেলে বাবা-মা জোর করে খাওয়াচ্ছে। কত খাবার আবার ফেলেও দিচ্ছি। আর ওরা খেতেই পায় না।
আমি বললাম, “তোমরা অনেক কষ্ট করেছো। জানো রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও দরিদ্র ছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন বিশ্বজাহানের নেতা। তারপরও তিনি অত্যন্ত দরিদ্রের সাথে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি নিজের সব সম্পদ অনায়াসে বিলিয়ে দিতেন। যদি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একটি কেজুর থাকতো, তবে কেউ যদি সেটাও চাইতো তিনি দিয়ে দিতেন। এতই দয়ালু ছিলেন। তিনি কখনো ভরপেটে খাবার খেতেন না। আর জানো, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খানা খাশ তার ঐ পেট আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাত্র। [১] তোমরাও এতদিন অজান্তেই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করেছো। দারিদ্র্যের জীবন কাটিয়েছো৷ জানো, দরিদ্ররা ধনীদের বহু বছর আগেই জান্নাতে যাবে।”
“জান্নাত কি?” ঝিলি বললো।
“দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর ইবাদত করলে, রাসূলের অনুসরণ করলে আল্লাহ শেষ বিচারের দিন যে চিরস্থায়ী সুখের ঠিকানা পুরস্কার হিসেবে দিবেন তাই হলো জান্নাত।”
“আমরাও যাবো?” আবরার বলে।
“হুম। যদি ভালো কাজ করো, আল্লাহকে স্মরণ করো, রাসূলকে অনুসরণ করো তবেই…”
সবাই বেশ মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলো। ওদেরকে মাগরিবের আযান না হওয়া পর্যন্ত জান্নাত- জাহান্নাম নিয়ে গল্প শোনালাম, সত্য গল্প।
পরদিন আমাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে ওদের জন্য সুন্দর একটা আধপাকা বাড়ি কিনে দিলেন বাবা। আমিও অনলাইনে বিজনেস শুরু করেছি। এখনও তেমন চলছে না৷ তবে যেটুকু আয় হচ্ছে তা দিয়েই আমি ছোট্ট কুঠিরটা সাজাচ্ছি। প্রথম উপার্জন দিয়ে আমি বানালাম বাড়িটার জন্য একটা নেমপ্লেট। নেমপ্লেটে লেখা “শান্তি কুঠির”। আসতে-যেতে সেই নামটা দেখে কি যে শান্তি লাগে আমার। বারবার মনে হয়, ইস! আমার প্রথম উপার্জন।
আপাতত বাচ্চাগুলোর আর্থিক দায়িত্ব নিয়েছেন বাবা আর খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন মা। আর ওদের খেলার সাথী হয়েছে নাকীব। মাঝখান থেকে আমি বাদ পড়ে গেছি। আমি ও নাকীব অবশ্য সারাদিনই শান্তি কুঠিরেই থাকি। ওখানে আমার একটা রুম আছে৷ বইয়ের একটা সেলফ রাখা হয়েছে, সেলফে যদিও তেমন বই নেই এখনো। সেলফের সামনে চেয়ার টেবিল। তার পাশেই নামাজের সরঞ্জাম।
পুরো বাড়িতে চারটা বেডরুম। আহামরি কোনো রুম নয় সেগুলো। ঘরটা আধপাকা। মাথার ওপরে টিনের চাল। যখন বৃষ্টি পড়ে কি যে মধুর লাগে সেই ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির ছন্দময় শব্দ শুনতে। প্রায় রাতে তো আমি ওখানেই থেকে যাই বাচ্চাগুলোর সাথে। মাঝেমধ্যে নাকীবও থাকে। ইদানীং আমার আসল বাড়ি হয়ে উঠেছে শান্তি নীড়।
ওদেরকে পেয়ে আমি অন্যকিছু পুরোপুরি ভুলে গেলাম। এতসব কিছুর মাঝেও মাঝেমধ্যে রাফিনকে এত মনে পড়ে যে নিজেকে সামলানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। প্রায়ই রাতে বেশি মনে পড়ে ওর কথা। তখন আমি নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। সত্যি বলতে, নামাজ পড়ার পর নিজেকে এত হালকা লাগে মনে হয় আল্লাহকে পেলে দুনিয়া তো কিছুই না। রাফিন তো কোন ছাড়।
এর মাঝে হঠাৎ একদিন রাফিন আমাকে ফোন দেয়। দু’বার কল দেওয়ার পর রিসিভ করি। ও সালাম দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলে,
“কি খবর তোমার?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
তারপর দুজনই চুপ। ও বললো,
“আমি ভেবেছিলাম তুমি ফোন রিসিভ করবে না।”
আমিও স্বাভাবিকভাবেই বললাম,
“কোনো দরকার ভেবে রিসিভ করেছি।”
এরপর ও মাদরাসার কথা বললো, ওর অসুস্থতার কথা বললো, আরও কত কি বললো। কোনো কথাই আমার কানে ভালোভাবে পৌঁছালো না। কারণ তখন আমি আল্লাহর ভয়ে কাঁপছিলাম। আবার পরপুরুষের সাথে কথা বলছি৷ আমি তো তওবা করেছিলাম। রাফিন অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেই চলেছে। ওর সুখ-দুঃখের সব কথা। আমি বারবার ফোন রাখার পায়তারা করছিলাম। ও বুঝতে না পেরে কথা বাড়িয়েই চলেছে। এত কথা রিলেশনে থাকাকালীন ও কখনোই বলেনি। তাহলে কি মিস করছে আমাকে? একপর্যায়ে আমি বললাম,
“এখন রাখছি আমি। নামাজ পড়বো।”
“ওহ শিউর শিউর। আগে বলবে না?” বলে ও নিজেই রেখে দিলো।
আমি আবার তওবার নামাজ পড়লাম। এরপর আমার আবার খারাপ লাগা শুরু হয়।
সেদিন সন্ধ্যায় ঝুম বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি নামার আগমুহূর্তে ফেসবুকে হঠাৎ একটা কবিতা খুঁজে পাই। এমন একটা কবিতা যেটা পুরোপুরি আমার সাথে মিলে যায়৷ ওটা পড়ার পর প্রায় দু’ঘন্টা আমি থ মেরে বসেছিলাম। বারবার শুধু কবিতাটা পড়েছি। পড়তে পড়তে মূখস্ত হয়ে গেছে আমার। কবিতার নাম “হারাম সম্পর্কে ইতি”। লিখেছেন, মারদিয়া রুহিন মারজুখা”।
আজও আমি বাচ্চাদের কুটিরেই ছিলাম। বৃষ্টি নামতেই দাওয়ায় গিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করলাম কবিতাটা।
আমার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি
তোমার কলিজা পোড়া ঘ্রাণ,
নিষিদ্ধ আবেগে টেনেছি সীমানা
রব্বের কাছে সঁপেছি এই প্রাণ।
ফাগুনের আগুনে হারিয়ে ছিলাম
ভয়ংকর রাতের অতল অন্ধকারে,
খুঁজে ফিরেছি সুখের আঙিনা
ছেড়ে রব্বের গোলামী বারেবারে।
তুমি অভয় দিয়ে বলেছিলে
এ হাত ছাড়বে না কভু,
বোকা হেসে আমিও সম্মতি দিয়েছি
আসুক না শত বাধাবিপত্তি তবু।
দিন বদলেছে, সময় ফুরিয়েছে
বোধদয় হয়েছে আজ,
কুঁকড়ে মরছে হৃদয় জমিন
তাড়িয়ে ফিরছে লাজ।
সীমালঙ্ঘন তো অনেক হয়েছে
এবার তবে নীড়ে ফেরা হোক,
হৃদয় আরশীতে শত ব্যথা সয়েও
অনুভব হয়না আর কোনো শোক।
রব্বের পথে চলতে চাই সদা
ফিরতে চাই না অতীতে,
জানি! আসবে অনেক ঝড়ঝাপটা
তবু চলবো নিজ গতিতে।
কবিতাটা বিড়বিড় করে বারবার পড়লাম। সেদিন রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো আমার৷ বাবা এসে বাসায় নিয়ে গেলেন আমাকে।
জ্বর হলে আমার আর হুঁশ থাকে না। সারাক্ষণ মায়ের পাশ ঘেঁষে শুয়ে থাকি, মাকে বিছানা থেকে এক মিনিটের জন্যও দূরে সরতে দিই না। দুনিয়ার কোনোকিছুর প্রতি আমার আর খেয়াল থাকে না। সেরকম দূর্বিষহ মুহুর্তে আমার রাফিনকে মনে পড়তে লাগলো। বারবার হারাম ভুলে গিয়ে ওকে টেক্সট করতে ইচ্ছে করছিলো। ঐ যে বলে না, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। সারাদিন শুয়ে-বসে অলস সময় কাটানোয় শয়তান ওয়াসওয়াসা দিচ্ছিলো আমাকে।
আমার মন বলছে, রাফিন যদি আমার জন্য ওয়েট না করে? যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়? একটা ফোন করে বা টেক্সট করে কি বলবো, আমার জন্য ওয়েট করতে? আমাকে ছাড়া যেন কাউকে বিয়ে না করে সেই কথা কি বলে রাখবো?
আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়, ওকে একটা কিছু গিফট পাঠাই। যেমন; কুরআনুল কারিম, তাফসীর কিংবা কোনো ইসলামিক বই। নিজের মনকে বোঝাই, এগুলো দেওয়া তো গুনাহের না। এগুলো দিলে বরং সওয়াব৷ আচ্ছা, আমি নাহয় নিজের নাম প্রকাশ করবো না।
আবার যখন খানিক সময়ের জন্য জ্বর নেমে যায় তখন ভাবি, আমি যদি রাফিনকে বলেও রাখি আমার জন্য অপেক্ষা করতে, আল্লাহ যদি না চান তাহলে কি কখনো আমাদের বিয়ে সম্ভব? এই ভেবে নিজেকে আগের অবৈধ ভাবনার জন্য ধিক্কার দিই৷ আবার গিফটের ব্যাপারটা ভাবি এইভাবে, কুরআন গিফট দেওয়া সওয়াবের কাজ, তবে এমন কাউকে নয় যাকে দিলে মনে অন্যকিছুর উদ্ভব হবে। যেমন; আমি রাফিনকে কুরআন গিফট দেওয়ার কথা ভাবলেও মনের ভেতরে একটা সুপ্ত বাসনা কাজ করছিলো। মন বলছিলো, যদি গিফট পাঠাই ও তো একটাবার আমার সাথে কথা বলবে। সেটা যে কারণেই হোক না কেন? গিফট কে পাঠিয়েছে সেটা শিউর হতেও তো ও আমাকে ফোন করতে পারে। এই অবৈধ চিন্তার কারণে হুঁশ আসার পর আবার নিজেকে ধিক্কার জানালাম। শয়তান যখন মানুষকে কোনোভাবেই দমাতে না পারে তখন সে হারামকে হালালভাবে উপস্থাপন করে। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। আসতাগফিরুল্লাহ পড়তে থাকলাম। কিন্তু দিনশেষে জ্বরের ঘােরে আবার সেই অবৈধ চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো।
বাকি সময় বাচ্চাদেরকে নিয়ে থাকলেও জ্বরের ঘোরে আবার রাফিনের ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শত চেষ্টা করেও ভুলে থাকতে পারি না। ওর কথা ভাবলেই বুক-পেট মুচড়ে ওঠে। পেট মুচড়ে উঠে পেট খারাপ হয়। মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। একপর্যায়ে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন অসুস্থতা কাটাতে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবেন। ছোটফুফি বললেন, ফুফির শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যেতে। ফুফির বাড়ির আশেপাশে অগণিত পাহাড়। পাহাড় আমার খুবই ভালো লাগে। তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম যেতে। ফুফির বাড়িতে ফুফি, ফুফা এবং ফুফির শ্বাশুড়ি ছাড়া আর কেউ নেই। খুব অল্প মানুষ। তাই আমরা সবাই ঝিলিদেরকে সহ নিয়ে পরদিনই ফুফির বাড়ি চলে গেলাম।
#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️