#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৩৫
নাকীব ফিরে এলো অনেকক্ষণ পর। দুজনই মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি। রান্না শেষে আমরাই খাবার সার্ভ করলাম। সার্ভ করতে করতে নাকীব বললো,
“এতগুলো কাজ মা একা করে? আসলেই মায়ের অনেক কষ্ট হয়।”
“হুম। আমরা বুঝি না সেসব।”
“সন্তানেরা আসলেই অনেক স্বার্থপর হয় আপু।”
“হ্যাঁ।”
এশার নামাজ শেষে সবাই একসাথে খেতে বসলাম। নাকীবকে দিয়ে শান্তি কুঠিরের বাসিন্দাদের জন্য বক্সে করে আগেই খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বাবা-মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে প্রত্যেকটা খাবার। মা বলেই বসলেন,
“এটা যে আমার প্রিয় খাবার তোরা জানলি কি করে?”
“স্মৃতির পাতায় ভর করে জেনে এসেছি।”
সেদিন রাতে বাড়িতেই থেকে গেলাম। পরদিনও শান্তি কুঠিরে গেলাম না। অনেকদিন পর আমরা প্রচুর হাসাহাসি করেছি। অনেকদিন পর পুরো পরিবার একসাথে খুবই সুন্দর সময় কাটালাম। এতদিন নিজেদের ব্যস্ততায় পরিবারকে সময় দিতেই যেন ভুলে গিয়েছি। অথচ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত ব্যস্ততায়ও পরিবারকে সময় দিতে ভুলতেন না। আমরা কবে পারবো বিশ্বসেরা এই মহামানবকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে? আদৌ কখনো পারবো কি?
রাতে শোয়ার আগে ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম। নাকীব শান্তি কুঠিরে যখন খাবার নিয়ে গিয়েছিল তখন ওকে দিয়ে আনিয়েছি এটা।
ডায়েরি খুলে পরের অধ্যায়ে এলাম। এই অধ্যায়ের নাম “না বলা কথাগুলো”।
সে ভাবে আমি তাকে পাত্তা দিই না। তার সঙ্গ উপভোগ করি না, ভালোবাসি না তাকে। কিন্তু সে কি জানে তাকে আমি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি? সে কি জানে তার প্রতিটা পদক্ষেপ আমি অনুসরণ করি? তার মনে কখনো কি প্রশ্ন জেগেছে আমি তার বাড়ি চিনলাম কি করে? কিভাবে রিলেশনের পঞ্চমতম দিনেই আমি তাকে তার বাড়ি থেকে আনতে গেলাম তার মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে? কক্ষনো জাগেনি৷ কারণ মেয়েটা ভীষন বোকা। আমি যে ওর প্রত্যেকটা পদক্ষেপ অনুসরণ করি সেটা ও কখনো টেরও পায়নি। ওর সাথে পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেলে ও ভাবে হয়তো কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু না, ওর সাথে এই জীবনে একবারই আমার কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়েছে। আর সেটা ছিলো আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। এরপর থেকে যতবার দেখা হয়েছে ততবারই আমার ইচ্ছেতেই হয়েছে। এমনও অনেকবার হয়েছে আমি ওকে কাশবনে অপেক্ষা করিয়ে রেখে নিজে আড়ালে থেকেছি। ও ভেবেছে আমি আসিনি। তাও মেয়েটা কখনো রাগ করেনি আমার সাথে। এমনও তো অনেকদিন গেছে, অনেক দিন বললে ভুল হবে, এমন অনেক মাস গেছে ওকে পাশে বসিয়ে রেখে আমি পাবজিতে ডুবেছিলাম। আমি ওর পাশাপাশি থাকতে ভালোবাসি। কিন্তু কথা বললে, কথা শেষ হলেই তো হুট করে চলে যায়। পাবজি খেলার ভান করে ওকে তো ঘন্টার পর ঘন্টা পাশে বসিয়ে রাখা যায়। এটাই আমার কাছে আনন্দের, ওর কাছে হয়তো বিরক্তির।
এটুকু পড়ে একটু মায়া লাগলো আমার। অশ্রুও জমা হতে চাইলো খানিকটা। সেটাকে তুড়ি মেরে সরিয়ে মনে মনে বললাম,
“আমিও সময়টা উপভোগ করতাম। তুমি পাশে আছো এই ভেবে। কিন্তু এখন বড় আফসোস হয়। সেসবই হারাম ছিল। আর তার জন্য আমি তাওবা-ও করে নিয়েছি। এখন সেসব ভেবে চোখের জল ফেলাটাই বরং পাপ। যদি সবটা হালাল হতো! ইস!” পরক্ষণেই আবার মনে হলো, একজন পরপুরুষ এভাবে সবসময় তীক্ষ্ণ নজরে দেখতো আমায়৷ ছি! না জানি কত কি দেখে ফেলেছে। ভাবতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো হৃদয়।
“আজও যথারীতি কাশবনে বসেছিলাম। হঠাৎ গোপন সূত্রে খবর পাই ও বেরিয়েছে। আমি বাইক নিয়ে সোজা ওর বাসায় সামনে চলে এলাম। এমন জায়গায় ওর সাথে গিয়ে সাক্ষাৎ করলাম যাতে ও সন্দেহ করতে না পারে। ওর বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলাম,
“কোথায় যাওয়া হচ্ছে মিস?”
ওর একটা হাড়বজ্জাত ফুফু আছে। এরকম শয়তান কোনো ফুফু, স্যরি ফুফু না মানুষ, এরকম শয়তান মানুষ আমি কখনও দেখিনি। কোথায় যাচ্ছে জানতে চাওয়ায় সে প্রথমে বলতে চাইলো না। পরে অনেক জোরাজুরির পর বলতে বাধ্য হলো, এমনকি আমাকে তার সাথে নিতেও বাধ্য হলো। ওর সাথে গিয়ে দেখলাম কেমন যেন জীর্ণশীর্ণ একটা এলাকার দিকে ও এগিয়ে চলেছে। বস্তি টাইপ একটা জায়গায় এসে থামলো। আমি ভেবে পেলাম না এরকম বস্তি এলাকায় ওর ফুফি কেন থাকে? বাড়ির সামনে গিয়ে ও ঢুকে পড়লো আমাকে রেখে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কিছুক্ষণ পর দেখি বাড়ি থেকে ছিটকে উঠানে এসে পড়ে প্রেয়সী। উঠানে পড়েই ও কাশতে থাকে। ওকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার প্রাণভোমরাটা বেরিয়ে আসতে চাইলো। দ্রুত ওর কাছে গিয়ে দেখি ওর চোখ দুটো রক্তলাল হয়ে আছে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে অশ্রুর ঢল। গলায় হাত দিয়ে কিছু একটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। হিজাবটা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছে। ওকে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলাম,
“মহিলাটা তোমায় এভাবে ধাক্কা দিলো কেন?”
সে কিছুতেই বলতে চাইলো না। অনেকক্ষণ পর জানতে পারি যে সেটা ওর ফুফু। জানার পর আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। এমন ফুফুও হয় পৃথিবীতে? সেদিনের পর থেকে আরও বেশ কয়েকবার আমার সে-বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বলা যায়, এরপর থেকে কখনোই ওকে একা ছাড়িনি আমি৷ ওর আবার প্রায়ই ও-বাড়িটায় যেতে হয়। একজন বৃদ্ধা দাদুকে ভালোবেসে সে বারবার ছুটে যায় ওই বাড়িতে৷ মাঝেমাঝে বাচ্চা এবং বৃদ্ধদের প্রতি ওর ভালোবাসা আমাকে বিস্মিত করে তোলে। বৃদ্ধ এবং বাচ্চার প্রতি ওর আলাদা একটা দূর্বলতা আছে।মাঝেমধ্যে আমরা হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় চলে যেতাম। প্রায়ই দেখতাম হুট করে আমার পাশ থেকে ও হাওয়া হয়ে গেছে। পাশে তাকিয়ে দেখতাম, কখনো কোনো বৃদ্ধাকে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছে, কখনো বাচ্চাদের বেলুন কিনে দিচ্ছে আবার কখনো দেখতাম পথশিশুদের খাবার কিনে দিচ্ছে। ওর আরেকটা বিষয় আমায় খুব অবাক করতো। ওর ব্যাগে সবসময় একগাদা চকলেট রাখা থাকে। রাস্তায় কোনো বাচ্চা দেখলেই সে চকলেট দিবে।
সেই ঘটনার পর আজ আবার বহুদিন পর ও আবার ও-বাড়ি যাওয়ার মতলব এঁটেছে। সকালে কি ভেবে যেন কালো টি-শার্টের সাথে হলুদ জ্যাকেট এবং কালো জিন্স পরলাম। সাথে ব্ল্যাক কেডস। আমার এই গেটআপটার প্রতি প্রেয়সীর আলাদা দূর্বলতা আছে জানি আমি। সাইকেল নিয়ে কাশবনে চলে গেলাম। পেলাম ওর দেখা। কড়া রোদে বসে আছে মন খারাপ করে। আমায় দেখামাত্র ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। ওর মন খারাপ দেখে নিজের ভালো লাগাটা উগড়ে দিলাম। মন ভালো করতে বললাম,
“সাইকেল রেস দিবে আমার সাথে?”
রাজি হলো না সে। তার সাথে রেস দিতে হলে নাকি আমার এই গেটআপ চেঞ্জ করতে হবে। নাহয় নির্ঘাত সে হেরে যাবে। হাহাহা! পাগলী একটা। এরপর সে আবার ঐ বাড়িতে যেতে চাইলো। আমার মেজাজ খারাপ হলো খুব। তবুও তার মন ভালো করতে যেতে রাজি হলাম।
গিয়ে যথারীতি ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো। ও দাদুর সাথে কথা বলছিলো ঘরের ভেতর আর আমি ছিলাম বাইরে। হঠাৎ একটা ছেলে এসে ঢুকলো ঘরে। আজেবাজে কথা বলতে লাগলো। বিপদ আঁচ করে ঝটপট ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন ফুফু। শয়তানটার ওপর রাগ আমার বহুদিনের। এক ঝটকায় দূরে ছুঁড়ে ফেললাম। সেদিন ঠিক যেভাবে আমারই চোখের সামনে আমার প্রেয়সীকে ছুঁড়ে ফেলেছিলো। আমি যেতে যেতে দেখি শয়তান ফুফুর ছেলে আমার সযত্নে রাখা ফুলটা ছুঁয়ে দিলো৷ নাহ! ছুঁয়ে দেয়নি। আমি যথাসময়ে হাজির হয়েছি। আমার মেজাজ তখন তুঙ্গে। মারতে মারতে ছেলেটার বেহাল দশা করে ছেড়েছি। তারপর প্রিয়তমার হাত ধরে বেরিয়ে আসি। ওকে নিয়ে কাশবনে অনেকক্ষণ বসে থাকি। বসে থাকতে থাকতে আমার মাথায় ঝট করে আইডিয়া আসে। ওকে আমার অনুমতি ছাড়া বাইরে বেরুতে মানা করলাম। এরপর ওকে সাবধানে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে গেলাম থানার দিকে। থানায় জিডি করলাম। পুলিশ আসার আগে আমি নিজেই চলে গেলাম জাফর নামক শয়তানটার বাড়ি। তখন সন্ধ্যা নামছে। সে বাড়ির পেছনে স্মোক করছিলো। পেছন থেকে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে মাটিতে ফেলে ইচ্ছেমতো পেঁদিয়ে ফেলে রাখলাম। যে হাত ও আমার প্রেয়সীর দিকে বাড়িয়েছিলো সেই হাত ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছি।”
এটা পড়ে আমি আঁৎকে উঠলাম। জাফরের হাত ভেঙ্গেছে আগে তো জানতাম না। ও এত কান্ড ঘটিয়েছে সেটাই তো আমি জানতাম না। দ্রুত পরের পৃষ্ঠায় গেলাম।
পুলিশ এলো, ওকে ধরে নিয়ে গেল ঐ অবস্থাতেই। পরে আমাকে আবার থানায় ডেকে পাঠালো। আইন কেন নিজ হাতে তুলে নিয়েছি জিজ্ঞেস করতেই বললাম,
“ওকে যে আমি মেরেছি তার কোনো প্রুভ আছে? যদি ওকে মারারই হতো তাহলে তো আর আপনাদের জানাতাম না।”
কোনো প্রুভ না পেয়ে পুলিশ আমাকে আর ঘাঁটাতে সাহস পেলো না। চলে এলাম। ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই খবর পেলাম জাফর পালিয়েছে। বুঝলাম, পুলিশেরই হাত ছিল এতে। যাইহোক, আমার যা করার আমি করে ফেলেছি।
সেই রাতে প্রথম আমি আমার প্রেয়সীর বাড়িতে গেলাম।আমার ভয় হচ্ছিল যদি জাফর ওর কোনো ক্ষতি করে বসে? এরমধ্যেই ওর শয়তান ফুফুটা ওকে মেরে আহত করেছে শুনলাম। তাই রাতের আঁধারে ছুটে গেলাম ওর বাড়িতে।
#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀
[ বি.দ্র: কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। ]