#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৩৬
“রাত যখন গভীর হলো, শহর যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন আমি প্রেয়সীর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বাড়ির সামনে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রেলিং টপকে টপাটপ ওর ব্যলকনিতে উঠে পড়লাম। এ-ই প্রথম লুকিয়ে কারো বাসায় ঢুকেছি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লম্বা দুটো শ্বাস ফেলতেই দেখি ঝাড়ু হাতে কেউ একজন আমার দিকে তেড়ে আসছে। কেউ একজনটা কে বুঝতে বাকি রইলো না। আমি দ্রুত তার হাত ও মুখ চেপে ধরলাম। তার হাত ফসকে ঝাড়ুটা পড়ে গেল। ঝাড়ু পড়তেই আমার কাঁধে ভয়ানক ব্যাথা অনুভব করলাম। মি. শলাবাবু কাঁধ বরাবর লাঠি চালিয়েছে আমাকে চোর ভেবে। আজ থেকে প্রেয়সীর ভাইয়ের নাম শলাবাবু। শলার ঝাড়ু থেকে বেঁচে গিয়ে লাঠির আঘাত। উঁহ! কাঁধে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম। কিছু হলো এটা? প্রথমবার ওর বাড়ি এসে লাঠির আঘাত! খুব গায়ে লাগলো ব্যাপারটা। ও নিজের ভাইকে খুব করে বকে দিলো। এজন্যই অতি রোমান্টিকতা দেখাই না আমি। অতি ঢং করলেই বিপদ। অবশ্য আমি ঢং করে কিংবা রোমান্টিকতার জন্য এখানে আসিনি। এসেছি বিপদ আঁচ করে। আমার যখন ব্যাথায় মরি মরি অবস্থা তখন তিনি ঢং করে আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি এলাম কেন? মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। বললাম,
“হ্যাঁ, ভুল করেছি এসে, মস্ত ভুল। এই যে ঠোঁট কেটে গিয়েছে, কপালে ব্যান্ডেজ করেছো, বিছানায় পড়ে আছো তাই লুকিয়ে দেখতে এসেছিলাম। এসেই তো লাঠির আঘাত খেলাম! আহ! কি ব্যাথা! ভুল হয়ে গেছে আমার। চলে যাচ্ছি।”
কথাটা বলতে দেরী তার ওভারথিঙ্ক করতে দেরী হলো না৷ উনি বসে গেলেন ওনার বিশ্বখ্যাত ভাবনা নিয়ে৷ কি ভাবছে কে জানে৷ আমি রেলিংয়ের কাছে চলে এলাম। ব্যাথার চোটে নামতে পারলাম না। মি. শলাবাবু এসে বললো, “কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”
আমি ব্যাথায় কুঁকড়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে বললাম,
“কেন ভাইয়া, আরেকটা দিবে লাঠির আঘাত?”
কথাটা বলতেই শলাবাবুর রাগ হল না অথচ ওনার রাগ হয়ে গেল। মানে বোকা হলে যা হয় আর কি! সে রেগেমেগে অস্থির হয়ে গেল।”
এতটুকুতে ঠাস করে ডায়েরি বন্ধ করে দিলাম। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, “আমি মোটেও রেগেমেগে অস্থির হইনি। সবসময় বেশি বোঝে।”
পরক্ষনেই সামনে তাকিয়ে চেহারা মলিন করে ভাবলাম,
এত বছর পর কাকে রাগ দেখাচ্ছি? আর কি নিয়েই বা রাগ দেখাচ্ছি? এসব তো কবেই শেষ হয়েছে।
রাত অনেক হয়েছে। ডায়েরি রেখে শুয়ে পড়লাম। খানিক বাদেই আবার তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে হবে। ঘুমাতে গিয়ে আমার মনে ভাবনারা উঁকি দিলো। আচ্ছা, সেদিন কেন আমার একবারও আল্লাহর কথা মনে পড়লো না? কেন মনে হলো না, সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও একজন তো জেগে আছেন। তিনি তো স্বাক্ষী ছিলেন সেই রাতের। আমি কেন তাঁর পাকড়াও-এর কথা ভুলে গেলাম? কিভাবে ভুলে গেলাম? ওহ হ্যাঁ, সেদিন আমার ধারণা ছিল রাফিন আমাকে জাফরের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। অথচ আল্লাহ যদি না চাইতেন রাফিন কি পারতো বাঁচাতে? আমি কেন পুরো ক্রেডিট রাফিনকে দিচ্ছি? ও তো উছিলা মাত্র। আমাকে তো বাঁচিয়েছেন স্বয়ং মহান রব। এতবড় একটা ভুলের মধ্যে ছিলাম আমি? আউজুবিল্লাহ! আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।
বেদনায় আমার বুক ভার হয়ে এলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কুরআনের একটা আয়াত মনে পড়ছে এই মুহুর্তে। আয়াতটা মনে করে বুকের ব্যাথাটা আরও তীব্র হলো। চোখ ফেটে বেরিয়ে এলো অশ্রুর নোনা ঢল।
“এখনো কি সে সময় আসেনি— যখন আল্লাহর কথা শুনে মুমিন বান্দাদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে কেঁপে উঠবে এবং তাতে নম্রতা সৃষ্টি হবে?” [১]
হে আমার রব! সে সময় এসেছে। এসেছে সে সময়। আমি দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে এলাম। দাঁড়িয়ে পড়লাম নামাজে। সিজদায় গিয়ে অবাধ্য অশ্রুদের ছেড়ে দিলাম। এক অতৃপ্ত, অবাধ্য আত্মাকে সঁপে দিলাম মহান রবের সিজদাহয়। একটাই আশা বুকে, সূরা যুমারের ৫৩ নং আয়াত।
“বলে দিন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছো! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ তো সব গুনাহ মাফ করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।” [২]
হে প্রভু, তোমায় ডেকে আমি কভু নিরাশ হইনি। তাই তো শত হতাশায় তোমায় ডাকি। আমি তোমার সৃষ্টির প্রেমে পড়ে তোমায় ভুলতে চাই না। আমি তোমার প্রেমে পড়তে চাই বারংবার। প্রভু, তুমি আমার সহায় হও। এই অবাধ্য আত্মাকে প্রশান্ত করে দাও। প্রতিবার সূরা যুমারের ৫৩ নং আয়াতটা আমার হৃদয়ে আশার সৃষ্টি করে, হতাশা কাটিয়ে দেয়।
কাঁদতে কাঁদতে আর রাতে ঘুম হলো না আমার। একেবারে তাহাজ্জুদ পড়ে, ফজর, ইশরাক, যিকর, দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে সকাল হয়ে গেল। অনেক অনেকদিন পর নিজেকে সতেজ লাগছে। পুরো একটা রাত আল্লাহর ইবাদতে কাটানোটা যে কতটা প্রশান্তির বলে বোঝানো যাবে না।
সকালে আবার রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাবান্না করলাম। সারাটাদিন কিভাবে যেন কেটে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষে সারাদিনটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চারপাশে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। কাজে শত ভুল করলেও মা এসে বকা দেয় না। বাবা-মা এখন আর ঝগড়া করে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে দৃশ্য বোধহয় বাবা-মায়ের অসুস্থতা নিজের চোখে দেখা। বাবা কিংবা মা বিছানায় পড়ে আছে এরচেয়ে করুণ দৃশ্য আর হয় না।
বাড়ির সবাই অসুস্থ হোক কোনো সমস্যা নেই কিন্তু মা কেন? মা অসুস্থ হলে পুরো বাসাটাই মৃত বাড়ির মতো হয়ে যায়৷ মা শুয়ে থাকে রুমে। সারাঘর এলোমেলো হলেও কেউ ডাক দেয় না, পড়তে না বসলে কেউ ডাক দেয় না, টাইমমতো খেতে কেউ ডাকে না, না খেলে বকে না, মোবাইল ধরলেও কেউ চেঁচায় না। বড্ড একঘেয়ে জীবন। মা যতই বকাবকি করুক আমরা তাতেই অভ্যস্ত। বরং না বকাটাই অনিয়ম। যেটা আমাদের হজম হয় না। তাই মায়ের অসুস্থতার এই মুহুর্তে আমার ভীষণ রকমের অস্বস্তি হচ্ছে, অসহ্য লাগছে। কেমন যেন মরা মরা টাইপ একটা ব্যাপার চলে আসে ঘরে। ভালো করে লক্ষ্য করলাম, মায়ের বকার চেয়ে না বকাটাই বরং বেশি প্যারা দেয় আমাদের। এতদিন মায়ের যে কথাগুলোকে বিষ মনে হতো এখন সেগুলোকেই মিস করছি।
আপাতত আর কোনো কাজ নেই দেখে ডায়েরি নিয়ে বসলাম। আজকাল তেমন বই পড়া হচ্ছে না। হবেই বা কিভাবে? বই পড়তে নিলেই তো মনে হয় এতক্ষণে ডায়েরিটা পড়লে হয়তো আরও আগেই ডায়েরিটা পড়া হয়ে যেত। তাই আমি ঠিক করেছি দ্রুত ডায়েরিটা পড়া শেষ করে তারপর বই পড়া শুরু করবো। এখন যেহেতু রাফিনের প্রতি আগের মতো ফিলিংস নেই তাই ডায়েরিটা পড়েও আমার অনুভূতিরা চাঙ্গা হচ্ছে না। এটা একটা ভালো দিক। শুধু রাফিন সামনে এলেই আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। অন্য সবসময় আমি ঠিক আছি। তবে গতরাতের পর মনে হচ্ছে ও সামনে এলেও এবার আমি নিজেকে ঠিক সামলাতে পারবো। অবৈধ একটা সম্পর্কের জন্য আমি কিছুতেই এলোমেলো হবো না। কিছুতেই না। ডায়েরিটা জাস্ট পেয়েছি তাই পড়া। একজন পরপুরুষ আমার দিকে ঠিক কোন দৃষ্টিতে তাকায় সেটা জানতে পড়া।
ডায়েরির বাকি অংশ খুলে পড়া শুরু করলাম। হয়তো আজকের অধ্যায়ে অনেককিছু জানার আছে। একটা স্মৃতি আমার ঝাপসা মনে আছে। সে-রাতে রাফিন আমায় কিছু একটা বলতে গিয়েও বলেনি। হয়তো ডায়েরিতে সেই কথাটাও লেখা থাকবে।
“সাধারণত বোকাকে বোকা বললে সে রেগে যায়৷ এই বোকার বেলায়ও তাই হলো। তাকে বোকা বলতেই সে রেগে গেল। বললাম ভেতরে যেতে। তাও গেল না। উল্টো রাগ দেখিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। আজব মেয়ে তো! তবে আমার ভালোই লাগছিলো ওর রাগ দেখতে। ও কখনো আমাকে রাগ দেখায় না। আমার কথার উল্টোপিঠে কিছু বলে না। কিন্তু আমি তো চাই ও আমার কথার পিঠে কথা বলুক। কিন্তু ও কিছুতেই ঝগড়া করতে চায় না। বলা যায়, আমিই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করি। সম্পর্কে যদি একটু ঝাল না থাকে সম্পর্কে তেঁতো ভাব চলে আসে। অথচ পাগলীটা চায় সবসময় ঝগড়া এড়িয়ে যেতে। যাকগে, আমিও ওর পাশে বসলাম।
সেই রাত! সেই রাতটা আমার জীবনে ভয়াবহ পরিবর্তন এনে দিলো। এতদিনকার লুকায়িত ভালোবাসার গল্প আমি ওর কাছে প্রকাশ করে দিলাম। রাত সময়টা খুব খারাপ একটা সময়। এসময়টায় কোনোভাবেই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমিও যথারীতি আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না৷ এতদিনের তিলতিল করে জমানো সব কথা হড়বড় করে ওকে বলে দিলাম। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে আমি থমকে গেলাম। কথাটা ওকে বলতে গিয়েও বলিনি৷ আজকের এই আবেগঘন মুহুর্তে যদি ওকে ছেড়ে যাওয়ার কথাটা আমি বলি নিশ্চিত ও সেটা মানতে পারবে না। হু হু করে কাঁদবে সে৷
আমার মাদরাসা থেকে নোটিশ এসেছে। আমাকে ফিরতে হবে হোস্টেলে। হোস্টেল জীবন খুবই ভয়াবহ। মোবাইল এলাউড না। মোবাইল ছাড়া আমাদের যোগাযোগও সম্ভব না। আমার সাথে কথা না বলে যে একটা দিন কাটাতে পারে না হুট করে যোগাযোগ বন্ধ হলে সে কি করে থাকবে দু’দুটো বছর? আমি ভেবে পেলাম না। সে-কথা বাদ দিয়ে বাকিসব বলে সেদিন ফজরের মৃদু আলোয় বাড়ি ফিরেছিলাম। ভোরের মৃদু আলোয় সেদিন ওকে ভারী মায়াবী লাগছিলো। রেলিংয়ে হাত রেখে ও আমার যাওয়ার পানে তাকিয়েছিলো। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, “আমাদের বিয়ের পর রোজ আমরা একসাথে ভোর হওয়া দেখবো। প্রিয়তমা, তুমি দেখবে ভোর হওয়া আর আমি দেখবো তোমায়৷ ততদিন একটু অপেক্ষা করো। আমায় ছাড়া ভোর দেখো না প্লিজ।”
বক্রহাসি হেসে বললাম, “অথচ আমি আজও একাই ভোর দেখেছি। অবশ্য একা না, আমায় সঙ্গ দিয়েছেন আমার মহান প্রভু। আমি তো রবের নামে যিকর করতে করতেই ভোরের সব দৃশ্য অবলোকন করছিলাম।”
পরবর্তী অধ্যায় “বিভীষিকাময় স্বপ্ন” এবং পাশে ডেট লিখা।
Date: 13.11.2020
আজ আমি ভীষন খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, ওর কারো সাথে অ্যাফেয়ার্স চলছে, যেটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। হয়তো সেই কেউটা ছিল আমার কাজিন শামীম। শামীমকে আমার একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না ওর পাশে। (কারণ শামীমের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে যেটা আমি ডায়েরীতে উল্লেখ করবো না।) শামীমকে পেয়ে ও আমার কোনো কথাই শুনছিলো না। শেষমেশ আমাদের সম্পর্কটাই শেষ হয়ে গেল।
এই স্বপ্নটা আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখেছি। সচরাচর স্বপ্ন এতটা দীর্ঘ হয় না। এটা দেখার পর রাগে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছে। ঘুমের মধ্যেই কেঁদে ফেলেছি আমি। আমি কিছুতেই ওকে অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারছিলাম না, কিছুতেই না। এরপর হুট করে ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। সাথে সাথে উঠে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। যাক! স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে এতটাই ঘেঁটে দিলো যে, এরপর আমি আর ঘুমাতে পারিনি। এমনকি সারাদিন আমি ওর সাথে একটাও কথা বলিনি। ও অনেকগুলো টেক্সট করেছে, কল করেছে। আমার ইচ্ছে হয়নি রিপ্লাই দিতে বা ফোন ধরতে। ওকে অসহ্য লাগছিলো আমার। অবচেতন মন বলছিলো, এত জঘন্য কাজ ও কিভাবে করলো?
এদিকে স্বপ্ন দেখে রেগে বোম হয়ে আছি আমি, ঐদিকে আমার প্রেয়সী আমার হঠাৎ ওকে ইগনোর করার চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে একেবারে। ওর অস্থিরতা কাটাতে এবং নিজেও সবটা ওর সাথে শেয়ার করে স্বস্তি পেতে অবশেষে বিকেলবেলা ওকে ফোন দিয়ে বললাম সবটা। সব শুনে বেচারী হা। শুধু বললো, “এটা তো স্রেফ স্বপ্ন ছিল। আমার দোষ কোথায় এতে? সকাল থেকে এজন্য আমাকে এত টেনশনে রেখেছো?”
আমি অপরাধীর সুরে বললাম, “ভোররাতে স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আমার মুড অফ ছিল। এমন কারো সাথে তোমাকে দেখেছি যেটা আমি সহ্যই করতে পারছিলাম না।”
একথা শুনে ও আবেগী হয়ে পড়লো। বললো, “আমি এমন জঘন্য কাজ কখনোই করবো না। আই সোয়্যার! আই লাভ ইউ!”
জবাবে আমি চুপ করে রইলাম। ওকে আমার ‘লাভ ইউ’ বলতে ইচ্ছে করে না৷ লাভ ইউ বললে মনে হয় কম ভালোবাসছি, আমি তো মন উজাড় করে ওকে ভালোবাসি। তাহলে লাভ ইউ বলে মুখে ফেনা তুলতে যাবো কোন দুঃখে?
ও বুঝতে পেরে জবাবের অপেক্ষা না করে বললো,
“আর কিছু কি দেখেছো?”
আমি ওর কথাটার জবাব দিতে পারলাম না। তার আগেই বড় আপ্পি চলে এলো ছাদে। “রাখছি” বলে কথা অসম্পূর্ণ রেখে ফোন রেখে দিলাম। চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ হলো।
বড় আপ্পি কিছুক্ষণ মেয়েকে নিয়ে খেলেধূলে চলে গেল। আমি আবার ফোন দিয়ে বললাম, ”বড়আপ্পি এসেছিলো।” হয়তো বিরক্তিটা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিলো।
ও বললো, “এত বিরক্ত হচ্ছো কেন? আসতেই পারে।”
“কথা বলার মাঝে কেউ ডিস্টার্ব করলে আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়।”
এরপর ও জবাব দেওয়ার আগেই মা এলো। আমার মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো।
“মা এসেছে, রাখো তো!” বলে ফোনটা রেখে দিলাম। আর কল ব্যাকই করলাম না।
আমি জানি ফোনের ওপাশে ও খুব মন খারাপ করেছে। ও চায় সারাক্ষণ আমার সাথে কথা বলতে। কিন্তু সেই সুযোগ ওকে কখনোই দিই না আমি৷ এতে যে মেয়েটা একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। এমনিতেই দিনরাত আমায় নিয়ে ভাবে। বেশি কল করলে হয়তো আরও বেশি ভাববে। না ঘুমিয়ে, না খেয়ে আমার কথা ভাববে। তাই ফোন করি খুবই কম। এই খুবই কম করার মধ্যেও যখন সম্পূর্ণ কথা হয় না তখন মন খারাপ হওয়ারই কথা।
রাতে আবার টেক্সট করলাম ওকে। ও তো অবাক।
“অসময়ে টেক্সট করলে যে?”
“ঐ যে, বিকেলবেলা সম্পূর্ণ কথা হয়নি তাই।”
“তাই বলে… তুমি সেটা মনেও রেখেছো? আমি তো ভেবেছিলাম ভুলেই যাবে।”
“অতটাও ভুলোমনা না।”
“তো অসম্পূর্ণ ফোন কলের বদলা কি টেক্সট দিয়ে হয়?”
বুঝতে পারছিলাম, কথা বলার ইচ্ছেটা তখনও শেষ হয়নি ওর। হবেও না কখনো। সুযোগ পেলেই যে আমাকে নিয়ে পড়ে থাকতে চায়। আমিও না বোঝার ভান করে বললাম,
“কি দিয়ে হয়?”
“ফোনের বদলা ফোন দিয়ে হয়।”
“ওহ আচ্ছা।”
“তো এখন করি না?”
“কি করবো?”
“ফোন?”
“এখন কিভাবে? এখন তো একদমই সম্ভব না। আপ্পিরা সবাই আছে।”
“তো শুধু শুধু টেক্সট করলে কেন?”
“না করতে বলছো?”
“না, না সেটা একদমই বলছি না। তবে..”
“তবে..?”
“কিছু না।”
“রাগ করলে নাকি?”
“রাগ করি কখনো?”
“গুড গার্ল! এবার খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট!”
“অকে, গুড নাইট!”
ব্যস! সেই দিনটা এভাবেই শেষ হলো। খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দিয়ে দিনের শুরু হলেও শেষটা খুব সুন্দরভাবেই হয়েছে। কিন্তু পরের দিনটা আবার খুবই জঘন্য কাটলো। বিকেলে ওর সাথে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু মাকে নিয়ে আপ্পির বাসায় যেতে হয়েছিলো বলে ওর সাথে দেখা করতে পারিনি। অবাক হলাম এই ভেবে যে, মিট না করার পরও সে কোনোরকম ফোন কল, টেক্সট করলো না। এমনকি কোনোরকম রিয়্যাক্টই করলো না। তাকে ফোন করে একথা বলতেই বললো, সে নাকি আমার সাথে দেখা করেছে। আমি বারবার বললাম দেখা করিনি তবুও বলছে দেখা হয়েছে আমাদের। প্রুভও দিলাম। এরপরও সে বলতেই থাকলো, সে নাকি দেখা করেছে। এরপর আবার বলতে লাগলো,
আমার মতো কাকে যেন দেখেছে। অথচ আমার মতো দেখতে তো ঐ একজনই আছে। তাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে কখনো বলিনি৷ আজও ঝগড়া করেছি ভীষণ। তাকে ভুল প্রমাণ করেছি। পাগলীটা বিশ্বাসও করে নিয়েছে। কথা বাড়ায়নি আর। কিন্তু কে দেখা করেছে সেটা নিয়ে ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেলাম আমি। এত সাহস বেড়েছে যে ও আমার প্রিয়তমার সাথে গিয়ে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করে ফেলেছে? প্রেয়সীর সাথে রাগারাগি হলো খুব। ও নিজেই রাগ করে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। পরপর দুদিন কোনো যোগাযোগ করলো না আমার সাথে। দুদিন যোগাযোগ না হওয়ায় আমার মেজাজ আরও খিটখিটে হলো। স্বপন্টা দেখার পরপরই এমন বাজে ঘটনার মুখোমুখি হওয়ায় স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আশঙ্কা আমার মনে জেঁকে বসলো। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমাতে গিয়েছি। ঘুমের মধ্যেও আমাকে ভাবনারা ছেড়ে দেয়নি। স্বপ্নেও তাড়া করে ফিরে ওকে হারানোর বেদনা। আমি তখনও জানি না আমার জন্য পরবর্তী দিনগুলো কি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে চলেছে। তখনও আমার অজান্তে আমারই প্রেয়সী ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে অন্য এক ছন্দের তালে।”
রেফারেন্স:
১. সূরা আল হাদীদ, আয়াত- ১৬
২. সূরা যুমার, আয়াত- ৫৩
#Be_continued_In_sha_Allah ❣️