অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৪৪

0
567

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৪৪

অন্ধকার ঘরে বসে আছি। মা এসে বাতি জ্বালালেন৷ চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“সারাদিন অন্ধকারে কি করিস তুই?”
“কবর তো অন্ধকার হবে। তাই প্র্যাকটিস করছি।”
“ফাজলামি করিস না।”
“আচ্ছা। তুমি কি বলতে এসেছো বলে ফেলো?”
“বলতে এসেছি মানে হলো, বাইরে একটু ঘুরে-টুরে দেখতে তো পারিস৷ এভাবে বন্দী হয়ে থাকবি জানলে তোকে আনতাম না।”
“আমি তো এমনই, না জানার কি ছিল। তাছাড়া আমি তো আসতেই চাইনি তাও এনেছো। তোমায় কিছু কঠিন কথা শোনাই মা৷ আমাদের ধর্মের কিছু মানুষ প্রচন্ড রকমের স্বার্থলোভী, স্বার্থপর। এরা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে তার নিজের মতো সাজিয়ে নেয়। যেমন– তুমি বলছো আমাকে ঘুরতে যেতে। আমি বললাম, গায়রে মাহরামের সামনে যাওয়া ইসলামে হারাম। তুমি বললে, ঘোরাঘুরি করতে তো নিষেধ করেনি ইসলাম। তাই বলে কি ইসলাম বলেছিলো, গায়রে মাহরামের সাথে ঘুরতে? বলো, বলেছিলো?”
বলতে বলতে আমার চোখ জ্বালা শুরু হয়ে লাল হয়ে এলো। মা আমার চোখের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন।

“তোমরা এখানে আসতে বাধ্য করেছো আমায়। আমি আসতে চাইনি। কেন আসতে চাইনি জানো? আমি জানতাম যে, এখানে আসলেই ফেৎনার জালে আটকা পড়বো৷ তোমার ধারণা, আমি সমাজের সবার সাথে মিলে চলতে জানি না। আসলে আমি মিলতে চাইও না। যে সমাজ ইসলাম মানে না সে সমাজের সাথে আমি মিলতে চাইও না৷ খালু আর খালুর ভাই তো তোমারও নন-মাহরাম। ওদের সামনে যাও কেন তুমি? বাবা বারণ করেছে একবারও? না তুমি ইসলামের বিধান মেনেছো, আর না মেনেছে বাবা। বাবা তোমায় বারণ করেনি, তিনি দাইয়্যুসের অন্তর্ভুক্ত হবেন। দাইয়্যুস কারা জানো?”

“আমি তোর খালুর ভাইয়ের সাথে কথা বলি না। একঘরে থাকলে তো একটু-আধটু দেখা হবেই।”
“আমাকে দেখেছে একবারও? হ্যাঁ, দু’একবার দেখেছে তাও তোমাদের দু’বোনের বাড়াবাড়িতে। তোমরা দু’বোন সবার সামনে যেতে বাধ্য করেছো আমায়।”
“তোর মতো ঘরকুণো হয়ে আমরা চলতে পারি না।”
“এজন্যই তো বাবা দাইয়্যুসের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর তোমার জবাব তো তুমিই দিবে আল্লাহর কাছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তিন প্রকার মানুষের দিকে মহান আল্লাহ তা’আলা পুনুরুত্থান দিবসের দিন রহমতের দৃষ্টি দিবেন না। যে মাতা-পিতার অবাধ্য, যেই নারী তাঁর সাজ-সজ্জায় পুরুষের অনুকরণ করে এবং আদ-দাইয়ুস। [১]
আবার অন্যত্র প্রিয় হাবীব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা জান্নাত হারাম করেছেন, যে মদ তৈরী করে, যে মাতা-পিতার নাফরমানী করে এবং ঐ চরিত্রহীন ব্যক্তি (আদ-দাইয়ুস) যে নিজ স্ত্রীকে অশ্লীলতা ও ব্যভিচার করতে সুযোগ দেয়।” [২]

“আমি অশ্লীলতা, ব্যভিচার করছি? আর তের বাবা আমাকে সাহায্য করছে? এতবড় কথাগুলো তুই বলতে পারলি? তুই বাবা-মায়ের অবাধ্য, বেয়াদব সন্তান। তুই জীবনে জান্নাতে যাবি না। বেয়াদব কোথাকার!”

মা আমার গালে এমন থাপ্পড় দিলেন যে আমি কিছুক্ষণ কানেই শুনতে পেলাম না৷ মিনিট কয়েকের জন্য গাল পুরো অবশ হয়ে গেল৷ গর্জাতে গর্জাতে মা চলে গেলেন৷ যতটা না শরীরে আঘাত লেগেছে তারচেয়ে বেশি আঘাত লেগেছে মনে, মায়ের কথায়। মা আমাকে রীতিমতো বদদোয়া করে গেলেন। আমার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো মায়ের বলা কথাটা, “তুই জীবনে জান্নাতে যাবি না।” আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। যদি জান্নাতেই না যেতে পারি তাহলে এই জীবনের মানে কি? বেঁচে থাকারই বা কি মানে? ব্যর্থ জীবন। বাবা-মায়ের দোয়া সর্বাবস্থায় ফলে যায়। এখন আমার কি হবে?

আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা তখনও রাগে রি রি করে কাঁপছেন। আমি মায়ের পায়ের কাছ বসে বললাম,
“মা, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি একদমই তোমাকে সেসব বলিনি। আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছি। ও মা!”

মা অন্যদিকে ফিরে গেলেন। বাবা খাটে শুয়েছিলেন। সেখান থেকে উঠে এসে আমাকে তুলে দাঁড় করালেন।
“কি হয়েছে মা?”
“বাবা, আমি মাকে শুধু বোঝাতে চেয়েছি যে গায়রে মাহরামদের সামনে যাওয়ার শাস্তি কতটা ভয়াবহ। মা আমাকে ভুল বুঝে অভিশাপ দিয়ে দিলেন।”
বাবা ক্রোধান্বিত হয়ে মায়ের দিকে তাকালেন।
“কি অভিশাপ দিয়েছো তুমি?”
“বাবা, আমি মায়ের নামে বিচার দিতে আসিনি। আমি শুধু বলতে এসেছি, মা যেন অভিশাপটা তুলে নেয়। নাহয় আমার দুই জীবনই ব্যর্থ হয়ে যাবে। মা বলেছে, আমি কখনো জান্নাতে যাবো না।”

মায়ের রাগ গলে গেল। আচমকা আমার সামনে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন,
“ওসব তো রাগের কথা। রাগের কথা ফলে না।”
“রাগের কথাই সবচেয়ে বেশি ফলে মা। বাবা-মা রেগে বা খুশি হয়ে যা-ই বলুক না কেন সবই কবুল হয়ে যায়।”
“আচ্ছা আমি দোয়া করে দিলাম, তুই যেন সপরিবারে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে স্থান পাস।”

“এই দোয়াটা তুমি দোয়া কবুলের মুহুর্তে করবে আমার জন্য।”
“মা-বাবার দোয়া তো প্রতিমুহুর্তেই কবুল হয়।”
“তাও। যেমন; ধরো, বৃষ্টি পড়ার মুহুর্তে, তাহাজ্জুদের নামাজে, সিজদাহয়, আযান ও ইকামতের মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়গুলোয় বেশি দোয়া করবে। এসময়ে করা দোয়াগুলো ফেরানো হয় না। সরাসরি আরশে আযীমে গিয়ে লাগে। তাছাড়া দু’হাত তুলে দোয়া করলে আল্লাহ তায়া’লা সেই হাত খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।”
“আচ্ছা দোয়া করে দিবো ভালোমতো। যা এখন।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে এলাম রুমে। এই রুমটায় এলে আমার অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে, হয়তো জানালাগুলোর জন্য৷ আমার বাসার রুমে মাত্র একটা জানালা। সেই জানালা দিয়ে রাস্তা দেখা যায় শুধু। অথচ এখানকার তিন জানালা দিয়ে তিনরকম প্রকৃতি উপভোগ করা যায়। খেয়েদেয়ে আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে উঠে নাস্তা করার পর সবাই বেরিয়ে গেল। বাসায় আমি আর কাজের আন্টি। সকাল দশটা নাগাদ চাশতের নামাজ পড়ে রুমে শুয়ে আছি। কানো কলিংবেলের শব্দ বাজছে অনর্গল। আশ্চর্য! কেউ খুলছে না কেন দরজা? আমি রুমের বাইরে গেলাম। কলিংবেলটা ঠিক আমার রুমের সামনে করিডোরের রেলিংয়ের একটু নিচে লাগানো। কলিংবেল বলতে এটা মূলত পুরোনো আমলের কড়া নাড়ার মতো মরচেপড়া লোহার একটা বেল। দরজার বাইরে চাকার মতো লোহার একটা রিং আছে। কেউ ওটা ধরে ঘোরালেই মোটা শেকলে টান পড়ে। আর টান এসে লাগে ঘরের ভেতরে দোতলার উপরে রাখা বিশাল লোহার বেলটাতে। বেলটা তখন বিকট আওয়াজে ক্যাটক্যাট করে।

রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখি বুয়া নেই। আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে। বড় হিজাব পরে আছি। হিজাবের সামনের দিকের কিছু অংশ নিয়ে নিকাব করে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলে দেখলাম একজন পুরুষ হাত ঘড়িতে টাইম দেখছেন ভীষণ বিরক্তি নিয়ে। দরজা খুলতেই তাকালেন আমার দিকে। সেই তাকানোতেই আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো থরথর করে। সামনের মানুষটাও তখন বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে। তার হাত থেকে ব্যাগ ছুটে গেল আর আমার হাত থেকে পড়ে গেল তালা। বিচ্ছিরি একটা শব্দ হলো। বুয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। আমি আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে উপরে উঠতে লাগলাম। জানি, পেছনের মানুষটা তখনও বিস্ময় নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। কারণ সে বুয়ার একটা কথারও জবাব দিচ্ছিলো না। আমি রুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা আটকে দিলাম। আল্লাহ তায়া’লা এ কোন পরীক্ষায় ফেললো আমাকে? আমি কিভাবে উত্তীর্ণ হবো এই পরীক্ষায়?

মিনিট বিশেক পর খালামণি এলেন আমার ঘরে। দরজায় করাঘাত করার অনেকক্ষণ পর খুলে দিলাম। আমি বিধ্বস্ত, হতবিহ্বল হয়ে খালামণির দিকে তাকালাম। খালামণি বললেন,
“হৃদি, তুই নাকি দরজা খুলেছিস? আহ! কতদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম ছেলেটার। আজ এত বছর পর এলো। আমি নিজে দরজা খুলে তাকে রিসিভ করতে পারলাম না। স্টেশনে একটু আনতেও যেতে পারলাম না। যাক, আমি খুশি হয়েছি দরজাটা তুই খুলেছিস।”
আমি কিছু বললাম না।
“আচ্ছা শোন না, এই রুমটা না ছেলেটার। ও অনেক বছর আসে না তাই তোকে এখানে থাকতে বলেছিলাম। ও আসবে জানলে কত গোছগাছ করে রাখতাম। ও আগেও অনেকবার আসবে বলে আসেনি। ভেবেছিলাম এবারও আসবে না। কিন্তু আমাদেরকে চমকে আমার বাপটা চলে এলো। তুই কি কষ্ট করে অন্য ঘরে চলে যাবি?” খালামণির চোখেমুখে আনন্দ।
“আমি পারবো না খালামণি। আমি তোমাদের বাড়িতে মেহমান হয়ে এসেছি। তোমরা এখানে থাকতে দিয়েছো আমি এখানেই থাকবো। কারো জন্য আমি একচুল পরিমাণও নড়তে পারবো না।”

কিন্তু নাহ! কথাটা মনে মনে বলেছি। মুখে বললাম,
“আচ্ছা আমি গোছগাছ করে বেরিয়ে যাচ্ছি।”

[১] [সুনানে আন-নাসা’ঈঃ অধ্যায় ২৩, হাদীস ২৫৬৩]
[২] [মুসনাদে আহমাদঃ হাদীস ৫৮৩৯। সহীহুল জামে’ আস সাগীরঃ হাদীস ৩০৪৭]

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here