অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৪৫

0
543

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৪৫

জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে ডায়েরিটায় চোখ পড়লো। ওটা ব্যাগে ঢুকাতে গিয়ে কি ভেবে যেন খুললাম। খুলতেই প্রথম চোখে পড়লো একটা কবিতা।

“তার ডাকের অপেক্ষায়
অলিন্দে চোখ রাখা বন্ধ করেছি,
বন্ধ করেছি স্মৃতির আরশিতে দেখা
প্রেয়সীর মলিন মুখ।

তবুও সন্ধ্যা নামার কালে কিংবা
আচমকা মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে
মনে হয়; কেউ একজন—
প্রিয় নামে আমাকেই ডাকুক।” [১]

আমারও তো তা-ই মনে হয়। আদৌ কি যার মুখে ‘প্রিয়’ ডাক শুনতে চেয়েছিলাম তার মুখে ডাক শোনা হবে? নাহ! আল্লাহ যার মুখে প্রিয় ডাক শোনাতে চান তার মুখেই যেন শুনতে পারি। হে পরওয়ারদিগার! তোমার ইচ্ছে যেন সফল হয়, আমার ভুল ইচ্ছেকে তুমি কবুল করো না। তুমি তো সঠিকটা জানো। আমি যা জানি না তা তুমি জানো। তোমার দৃষ্টিতে যা সঠিক, যা কল্যাণকর তুমি তা-ই রেখো আমার জীবনে। আমার অকল্যাণ, ভুল ইচ্ছে তুমি পূরণ করো না প্রভু। বুক ফুঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রুমের বাইরে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ডায়েরি বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম। সাথে সাথে রুমের দরজা খুলে গেল এবং আমাদের আবার চোখাচোখি হয়ে গেল। আমাকে দেখেই ‘স্যরি, স্যরি‘ বলে সে দরজা আটকে দিলো। আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাথে সাথেই দরজার ওপাশে খালামণির আওয়াজ পেলাম। খালামণি বললেন,
“বাবা! তুই একটু দাঁড়া। ও এক্ষুনি গোছগাছ করে অন্যরুমে শিফট করে যাবে।”
“ইট’স ওকে মা। কাউকে শিফট করতে হবে না৷ অনেক রুম তো আছে। আমি নাহয় অন্য একটা পছন্দমতো রুম বেছে নিবো”
“এতবছর পর এলি নিজের রুমে থাকবি না?”

আমি খানিকটা শিউরে উঠলাম। বেছে নেছে ওর রুমেই থাকছি আমি? বাই দ্যা ওয়ে, ও খালামণিকে মা ডাকলো কেন?
সে বললো, “নো মা, এবার অন্য রুমে থেকে দেখি। প্রয়োজন হলে শিফট করবো।”
বলেই হাঁটা শুরু করলো, বুটের আওয়াজ পাচ্ছি।

খালামণি এসে বললেন, “থাক হৃদি, তোর আর শিফট করতে হবে না। ছেলেটা নিজেই অন্য রুমে চলে গেল।”
“খালামণি, আপনি বারবার ছেলেটা, ছেলেটা বলছেন কেন? কে হয় উনি আপনার?”
“ভাইজানের ছেলে, ফাইয়াজ। তবে আমারও ছেলে। ছোটবেলায় দুধ খাইয়েছি আমি। আমি ওর দুধ মা। বড্ড আদুরে ছেলেটা। নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করে না।”

আমার খালামণি রাফিনের দুধ মা? বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে উঠতে উঠতে বোধহয় আর জায়গা নেই। আর কত অবাক হতে হবে আমায়? আল্লাহর কি সুন্দর নিয়ম! কে কোথাকার বাসিন্দা আমরা আর দেখা হলো কিনা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে, কাশবনে আমাদের শহরে। কতদিনের সম্পর্ক ছিল আমাদের অথচ আমরা যে এত লতানো প্যাঁচানো আত্মীয় জানতামই না। আজ আবার আমরা এক জায়গায়, এক ছাদের নিচে। অথচ এমনটা কখনোই হওয়ার কথা ছিলো না। যদি আমাদের সম্পর্কটা টিকে যেত হয়তো আমাদের সম্পর্কের কথা জানার পর কেউই কখনো মেনে নিতো না। আর আমারও এখানে আসা হতো না। মাঝখান থেকে খালামণির সাথে সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যেত আমাদের। আল্লাহর প্ল্যান বোঝা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। তিনি এমন কিছুই করেন যাতে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

অস্ফুট স্বরে খালামণির কথার জবাব দিলাম,
“ওহ আচ্ছা।”
“আচ্ছা, খেতে আয়।”
“নাকীব এসেছে?”
“দেখলাম না তো। তাের মা’রাও তো এলো না। আমি আর ভাইজান চলে আসলাম শুধু। আমি গিয়েছিলাম একটু পাশের পাড়ায়। পুকুরে মাছ উঠেছিলো অনেক। ফাইয়াজের জন্য আনতে গিয়েছিলাম। পথে ভাইজানের সাথে দেখা হয়ে গেল। ভাইজান গিয়েছিলো বাজারে। তারপর দুজনে চলে এলাম।” খালামণির চোখমুখ বেয়ে খুশি উপচে পড়ছে।

“হৃদি, তুই যাবি একটু আমার সাথে? রান্নায় একটু সাহায্য করলি। আমি একা ছেলেটার জন্য রান্না করে সামলাতে পারবো না। আবেগে কান্না ধরে রাখতে পারছি না রে। আমার ঘরের ছেলেটা কতদিন বাদে ঘরে ফিরলো। তুই রান্নাঘরে যা, আমি দেখি ছেলেটা কোথায় গেল।” বলতে বলতে খালামণির চোখে আনন্দাশ্রু টলমল করতে লাগলো।
“আচ্ছা আপনি যান, আমি আসছি।’’
“বাবা গো! কোথায় তুই?” চোখের কোণ মুছতে মুছতে চলে গেলেন খালামণি।

দুপুরে নাকীব দৌড়ে আসে আমার রুমে। নামাজে ছিলাম। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্রায় ভেঙ্গে ফেলার যোগাড়। দরজা খুলতেই হুমড়ি খেয়ে ঢুকলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“আপু, রাফিন ভাইয়া এসেছে দেখেছো?”
“রাফিন? ও এখানে কোত্থেকে আসবে?” স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম।
“তুমিই না দরজা খুললে?” বিস্ফোরিত স্বরে বলে নাকীব।
“জানিস যখন এত হড়বড় করছিস কেন?”
“বাট উনি কিভাবে এখানে জানো?”
“জানি না। আমার অতো জানতে ইচ্ছে করে না।”
“আপু, উনি তানভীর ভাইয়ার কাজিন। ভাবতে পারো?”
“বললাম তো ভাবতে ইচ্ছে করে না। তুই কি এখন ওর গুণগান গাইতে এসেছিস এখানে?”
“নাহ! আমি একটু ঘুমাই।” বলে নাকীব শুয়ে পড়লো।

আমি নামাজ শেষ করলাম। কুরআন পড়লাম। তারপর জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। প্লেনের আওয়াজ আসছে। কোনদিক থেকে আসছে ঠাহর করতে পারলাম না। এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম বিমানটা।
“নাকীব, নাকীব তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। তাড়াতাড়ি, চলে গেল তো…”

নাকীব ধড়ফড় করে উঠে এলো। আমি প্লেন দেখিয়ে অজান্তেই লাফাতে লাগলাম, “ঐ দেখ, ঐ দেখ।”
নাকীব ফিক করে হেসে বললো, “দেখেছি তো। একদম নিচে ছিল।”
“হু, কি সুন্দর!”
“চলো সবাই লাঞ্চ করে ফেলছে বোধহয়।”

আমরা দুজনে রুমের বাইরে এলাম। করিডোর থেকেই ডাইনিং স্পেস দেখা যায়। নিচে ছেলেরা সবাই লাঞ্চ করছে। আমি ও নাকীব উপরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সবার খাওয়া। নাকীবকে বললাম,
“আমি যা দেখছি তুইও কি তাই দেখছিস?”
“হুম।”
“ভাগ্যের খেল দেখলি?”
“সবই তাকদীরের লিখন আপু। আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই হচ্ছে।”
“হু।”

রাফিন খেতে খেতে হুট করে উপরে তাকালো। আমি সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম। নাকীবকে ইশারায় ডাকলো খেতে যেতে। নাকীব স্মিত হেসে হাত নেড়ে বোঝালো, আসছি।
“আপু, সবাই খেয়ে নিচ্ছে। আমি যাই।”
“আচ্ছা।”

ছেলেদের খাওয়া হলে আমরা খেতে বসলাম। খেতে বসে মূলত সবাই রাফিনের গুণগানই গাইলো শুধু। আমিই চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়লাম। খাওয়া শেষে মা রান্নাঘরে ডাকলেন ফ্রুটস কেটে দিতে। কাটার পর নাকীব এসে নিয়ে গেল সেগুলো। নাকীব যাওয়ার পর আমিও হাত ধুয়ে বের হয়ে আসি রান্নাঘর থেকে।

রাফিন সোফায় বসেছিলো বাবার সাথে। রান্নাঘর থেকে বেরুতেই অনিচ্ছায় চোখাচোখি হয়ে গেল। ওকে দেখামাত্র বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাকে রান্নাঘর থেকে বেরুতে দেখে বাবা বললেন,
“হৃদি, আমার পাঞ্জাবিটা একটু আইরন করিয়ে দে না।”
“আচ্ছা বাবা, দিও আমাকে।”

বাবার দিকে না ঘুরেই বলে চলে আসছিলাম। বাবা রাফিনকে বললেন,
“বুঝলে বাবা, মেয়েটাকে ছোটবেলায় আইরন করা শিখিয়েছিলাম। সেই থেকে ও আমার সব পোশাক সবসময় আইরন করে দেয়। আমার নিজের আইরনও আর ভালো লাগে না।”
“এবার আমি করে দিবো আঙ্কেল? সামথিং নিউ…” রাফিন হাসলো৷
বাবা সাথে সাথেই আমাকে পিছু ডাকলেন। আমি না ফিরেই বললাম, “বলো বাবা।”
“পাঞ্জাবীটা নাকীবকে দিয়ে পাঠিয়ে দিস৷ ফাইয়াজ আইরন করে দিবে।”
“আচ্ছা।”

কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে এলাম। রুমে এসে পুরোনো স্মৃতি মনে পড়লো৷ একবার রাফিন আমার সাথে কথা বলতে বলতে ইস্ত্রি করছিলো। তখন ও বলেছিলো, ওর ইস্ত্রি করার হাত এত ভালো যে বাসার সবাই ওকে ইস্ত্রি করাতে দেয়। তখন আমিও বলেছিলাম, “আমারও ইস্ত্রি করার হাত খুব ভালো। বাবা ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন সেই কৌশল। তারপর থেকে আমিই ইস্ত্রি করি। তোমার বাসায় গেলে তখন তুমি সবারগুলো করবে আর আমি শুধু তোমারটা করবো।”
ও বলেছিলো, “বাট আমার তো অন্যের হাতের আইরন করা পছন্দ না।”
“তাহলে করবো না।” অভিমানী কন্ঠে বলেছিলাম। রাফিনও বলেছিলো, “করো না।”
খুব রাগ হয়েছিল সেদিন। রাফিনেরও হয়তো এখন সেই ঘটনাটা মনে পড়ছে। হয়তো পড়ছে না!

ইস্ত্রি করা শেষে পাঞ্জাবি রাখতে নাকীব এলো আমার ঘরে। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“বাবার পাঞ্জাবি আমার ঘরে আনলি কেন?”

পাঞ্জাবিটা খাটে বিছিয়ে রেখে সে আবার শুরু করলো তার দুষ্টামি। বললো, “এটা তোমার ঘর নাকি? বাহ! জানতাম না তো।”
“তো কার ঘর? এসে থেকে তো এখানেই থাকছি।”
“কারো ঘরে তুমি থাকলেই ঘরটা তোমার হয়ে যাবে? তুমি রাফিন ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড থাকা অবস্থায় যদি তার জীবনে অন্য একটা মেয়ে আসতো তাহলে কি সে তার গার্লফ্রেন্ড হয়ে যেত?”

দাঁতে দাঁত লাগিয়ে কিড়মিড় করে তাকালাম ওর দিকে।
“তুই আমার অতীতের পাপের একটা অধ্যায় জানিস তাই বলে সেটা নিয়ে এখনও আমাকে খুঁচিয়ে যাবি?”
”না মানে তোমার তো আজকাল ভাইয়ার প্রতি কোনো ফিলিংস নেই। খোঁচালেও বা কি? তুমি তো ঐ ডায়েরি নিয়েই আছো। অন্যের ঘর, অন্যের ডায়েরি।”
“যার ঘর তার ডায়েরি।” অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম।
“ওহ ইউ মিন, ডায়েরিটা তোমার? বাট এই ঘরটা কিন্তু রাফিন ভাইয়ার।”
“তো আমি কি করবো? বের হ তুই আমার সামনে থেকে।”
নাকীবকে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিলাম। বের হতে হতে ও বললো,
”রাফিন ভাইয়াও তোমার মতো ইস্ত্রি করতে পারে ভালো। তুমি ওর স্ত্রী হয়ে গেলে ভালো হবে।”
নিচে একটা খালি বোতল পরে থাকতে দেখে সেটা উঠিয়ে নাকীবের দিকে ছুঁড়ে মারলাম।
“ফাযিল কোথাকার! অসভ্য, ইতর। আর আসিস তুই।”
“জেলাসি গার্ল! লুক বিহাইন্ড।”

নাকীব ধুপধাপ আওয়াজ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল। পেছনে তাকিয়ে দেখি রাফিন আসছে। আমি ঝট করে রুমে ডুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। উহ! শব্দটা বেশ জোরেই হলো।

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here