#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৪৮
রাফিনের নৌকা আমার নৌকা ছাড়িয়ে চলে গেছে। ও আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। ওর ভুলটা আমাকে ভাঙ্গাতেই হবে। আর ওর সাথেই আমার ফিরতে হবে। আমি আর পারবো না নৌকা বাইতে। রাফিন অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে হলো চিৎকার করি। কিন্তু পারছি না। গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে জমা হচ্ছে। অনেক কষ্টে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ডাকলাম,
“রাফিন, প্লিজ হেল্প মি!”
আমার ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না এলো। ডাক দিয়েই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নৌকায় বসে পড়লাম। জীবনে কখনো রাফিনকে নাম ধরে ডাকিনি আমি। আমার ডাক শুনেই ওর নৌকা থেমে গেছে। আমি জানি ও এদিকেই আসছে। আমি চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। রাফিনের নৌকা আমার নৌকার সামনে এসে থামলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“উঠে এসো।”
নৌকায় পা দিতেই নৌকা দুলে উঠলো। চোখ ঝাপসা থাকায় খেই হারিয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম। তার আগেই রাফিন হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নৌকায় উঠিয়ে নিলো আমাকে। তারপর বিরক্তি নিয়ে বললো,
“স্যরি!”
বিড়বিড় করে বললো, ”একটা কাজ যদি ঠিকঠাক মতো পারতো।”
আমি গোমড়া মুখে এককোণায় গিয়ে বসলাম। রাফিন যেখানটায় ধরেছে সেখানে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে লাল করে ফেলেছি। হাত গরম হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড় দেখা গেল। ঘাটের সামনে এসে রাফিন একাই নেমে গেল। আমি নৌকা থেকে নেমেই সিঁড়িতে বসে পড়ি। শক্তি সব শেষ আমার। রাফিন মাঝিকে ভাড়া মিটিয়ে উপরে উঠতে উঠতে আবার বিড়বিড় করে বললো, “কি সীমাহীন জেদ!”
সিঁড়ি পার হয়ে বললো, “আমার সাথে যাবে নাকি বিপদ আরও কিছু বাড়ানো বাকি আছে?”
রাত নেমেছে অনেকক্ষণ আগেই। ঘাটে হলদে বাতি জ্বলছে। রাস্তায়ও হলুদ বাতি। আমি উঠে এসে ওর পেছনে হাঁটতে লাগলাম চুপচাপ। নিজেকে শক্ত করে বললাম,
“তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।”
“নন-মাহরামের সাথে আমার কথা নেই।”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ও নিজেই আবার বললো, “বলো কি বলবে।”
“আমি খুবই দুঃখিত ঐ সময়ের ব্যবহারের জন্য। তোমার সাথে কখনোই ঐরকম ব্যবহার করতে চাইনি আমি। হঠাৎ যে কি হলো…”
“নন-মাহরামের সাথে কথা বলা যাবে না ভাবানো ঐ ভুতটা চেপে বসেছিলো মাথায়। ব্যাপার না। আমি কিছু মনে করিনি। এত লেইম বিষয় নিয়ে চিন্তা করার টাইম নেই আমার।”
আমি আবার চুপ করে থাকলাম। ও বললো,
“দুটো কথা শোনো। ফার্স্টলি, নন-মাহরামের সাথে কথা বলো না ঠিক আছে বাট প্রয়োজনে কথা বলা যায়৷ তুমি সীমাহীন একটা বিপদে ছিলে। ঐ বিপদ থেকে নিশ্চয়ই তোমাকে কোনো মেয়ে গিয়ে বাঁচিয়ে আনতে পারতো না। আর এখানে তোমার বাবা আর নাকীব ছাড়া তোমার কোনো মাহরাম নেই। তোমাকে মাঝনদীতে গিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে কোনো মাহরাম পৌঁছানোর পসিবলিটি জিরো পার্সেন্ট। মাহরামের আশা করলে ওখানে আজীবন থাকতে পারতে। সবসময় যুক্তি খাঁটে না, বুদ্ধিও কাজে লাগাতে হয়।”
“হু, বুঝতে ভুল হয়েছিলো আমার।”
“সেকেন্ডলি, রাগ কখনোই সুফল বয়ে আনে না। তুমি রাগ করেই মাঝনদীতে গিয়েছো। তারপর এই লম্বা ঘটনা ঘটলো। আমার সাথে মিসবিহেইভ করলে। ফল হলো খারাপ। আমি চাইলে তোমাকে না নিয়ে ফিরতে পারতাম। আফটারঅল, ইউ আর নোবডি টু মি, একদমই কেউ নও। তুমি নদীর মাঝখানে মরে পড়ে থাকলেও আমার কিচ্ছু যায়-আসতো না। ইউ আর নাথিং টু মি, নাথিং!” শেষ কথাগুলো বলার সময় রাফিন দাঁড়িয়ে পড়েছিলো আর আমিও এবং সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। রাগে ওর চোখ জ্বলজ্বল করছিলো। কথাগুলো বলে একমুহূর্তও দাঁড়ালো না ও। দ্রুত হেঁটে নিমেষেই আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল।
কথাগুলো আমার বুক ফুঁড়ে হৃদয়ের গহীনে গিয়ে লাগলো। ও এভাবে বলতে পারলো আমায়? একটু নাহয় মিসবিহেইভ করেছি, ভুল বুঝেছি ওকে। তার জন্য তো স্যরিও বলেছি। আচ্ছা, আমি যদি তার কেউই না হই তাহলে সে এত কড়া কথা আমাকে শোনালো কেন? একদমই অপরিচিত কাউকে কি সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে ‘ইউ আর নোবডি টু মি’ বলে থ্রেট করা যায়? ‘ইউ আর নোবডি টু মি!’ তোর বডি নিয়ে তুই থাক। আমার কি? হুহ! একটা ভেংচি দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাড়ির সামনে আসতেই দেখি গাছগাছালির ফাঁকে রাখা দোলনাটায় বসে দুলতে দুলতে রাফিন ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে আর হি হি করে হাসছে। নিশ্চয়ই তার হবু বউয়ের সাথে কথা বলছে। আমাকে ধমকিয়ে এখন আবার হেসে হেসে বউয়ের সাথে কথা বলা হচ্ছে। লজ্জা শরমের বালাই নেই। যত ধমকাধমকি সব আমার জন্য, বাকীদের জন্য তার কি সুমিষ্ট ব্যবহার। আমি যাকে বিয়ে করবো সে আমাকে কখনোই ধমকাবে না। সে যথেষ্ট নরম মনের মানুষ। অবশ্য যে আমার সে আমাকে ধমকালেও আমি মেনে নিবো কারণ সে তো আমারই। অন্য কেউ কেন আমাকে ধমকাবে? তার ধমক শোনার জন্য আমার জীবন যেন থেমে আছে। এখনও আমাকে ধমকাধমকি করছে। আমি তার কেউ না অথচ ধমকাচ্ছে যেন কাছের কেউ। বিরক্তিকর লোক একটা। একদম তাকালাম না তার দিকে। আবার মনে মনে দশটা ভেংচি দিয়ে বাসায় চলে এলাম।
বাসায় আসতেই মায়ের জেরার মুখে পড়লাম।
“কোথায় গিয়েছিস তুই একা? তোকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমরা।”
“নদীতে গিয়েছিলাম। আমরা কবে ফিরবো?”
“তোর শুধু ফেরার কথা। বিয়ে ঠিক হয়েছে কোথায় শ্বশুরবাড়ি চিনে নিবি তা’না আছে শুধু ফেরার তালে।”
“শ্বশুরবাড়ি বউ হয়ে এলে তখন চেনা যাবে। বউ হওয়ার আগে এখানে আর থাকবো না।”
“ছেলেটা মাত্র কাল এলো। ও তো আমাদের সাথেই ফিরবে বললো। আর ক’টা দিন থেকে যাই।”
“আজব তো! ছেলেটার সাথে আমাদের কি? সারাক্ষণ ছেলেটা ছেলেটা করো কেন? ও ছাড়া আর কেউ নেই তোমাদের ভাবনায়?”
মা দরজার দিকে তাকিয়ে আমাকে থামাতে চাইলেন ইশারায়। আমি থামলাম না। মা মুচকি হেসে দুষ্টুমির সুরে বললেন,
“উনি ‘ও’ হয়ে গেল কবে?”
রাগে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। এই সময়ে মজা করছে আমার সাথে।
“আমি কি মজার পাত্র? সবাই মিলে মজা করছো আমার সাথে?”
নাকীব দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“পাত্র না, তুমি হলে পাত্রী।”
আমি ঠাঁটিয়ে ওর গালে একটা চড় মারলাম। এতক্ষণের জমানো রাগ। ও গালে হাত দিয়ে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেল। আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
“তোর জন্য সব হয়েছে।”
চেঁচামেচি শুনে খালামণি চলে এলেন। মা রেগে গিয়ে বললেন, “তুই অযথা আমার ছেলেকে মারলি কেন?”
“তোমার ছেলেকে আমি মারিনি, আমি আমার ভাইকে মেরেছি।”
বলে পেছনে ফিরতেই দেখি দরজায় রাফিন দাঁড়িয়ে। সাথে সাথেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। রাফিন এসে নাকীবের হাত ধরে বললো,
“চলো, বিষয়টা বোঝাচ্ছি।”
আমি আবার উল্টো ফিরে এসে নাকীবের অন্য হাত ধরে টেনে আমার সাথে নিয়ে এলাম। রাফিন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো আমাদের দিকে।
“আমার ভাইকে আমি বোঝাবো, কাউকে কিচ্ছু বোঝাতে হবে না।”
আসতে আসতে শুনলাম রাফিন খালামণিকে বলছে,
“তোমার ভাগ্নীটা এমন পাগলাটে কেন মা?”
“আমিও তো বুঝতে পারছি না কিছু। শান্তশিষ্ট মেয়েটা হঠাৎ এমন কেন করছে?”
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ধপ করে বসলাম বিছানায়। নাকীব তখনও গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে শান্ত করে নাকীবকে বললাম,
“কোথায় ছিলি সারাদিন?”
”আগে বলো আমাকে মারলে কেন?”
“তুই সারাদিন কোথায় ছিলি?”
“তুমি এমন পাগলাটে আচরণ করছো কেন?”
“প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করবি না। আগে আমার কথার জবাব দে।”
“বাইরে ছিলাম।”
“তুই জানিস আমি এখানে একা একা আছি। তুই ছাড়া কথা বলার মতো কেউ নেই। তাহলে তুই আমাকে একা রেখে সারাদিন টইটই করছিস কেন? কাল সারাদিনে কি আমাদের একবারও দেখা হয়েছিল?”
“তুমি তো একা থাকতেই পছন্দ করছো। আর তোমার ডায়েরিটা আছে না?”
“নেই, ডায়েরি শেষ।”
“সেটা কি আমি জানি? রাফিন ভাইয়া এলো এতদিন পর তাই একটু ঘোরাঘুরি করছি আর কি। ওকে একটু টাইম দিচ্ছি।”
“রাফিন ভাইয়ার সাথে তোমার ভাব যে কতটা গভীর সেটা বুঝতে আমার আর বাকী নেই। তোমার যা খুশি করো রাফিন ভাইয়ার নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবে না একদম।”
“আমি বুঝতে পারছি রাফিন ভাইয়ার সাথেই কোনো ঘটনা ঘটেছে। কি ঘটেছে সেটা ঝটপট বলে ফেলো। নয়তো চড়ের বোমা আমি আর সহ্য করবো না। আমিও লাগিয়ে দিবো টপাটপ।”
“বলবো না আমি৷ ওর কাছ থেকে শুনে নে।”
“ওর কাছ থেকে শুনবো কেন? তুমি না তোমার ভাইকে ওর সামনে থেকে টেনে এনেছো?”
“ও আমাকে ধমকাবে কেন? ও কে হয় আমার? নিজের বউয়ের সাথে যত হাসাহাসি আর আমাকে ধমকানো না? আমি কি ওর রাগ মিটানোর যন্ত্র? এখন আর সেসব চলবে না বলে দিবি ওকে।”
“বউ? কার বউ? কে বউয়ের সাথে কথা বলছে?”
“তোর রাফিন ভাইয়া। আর কে?”
“ওহ আল্লাহ! কি বলছো এসব? রাফিন ভাইয়ার বউ মানে?”
“আমি কি জানি!”
“অকে, যা জানো তা নিয়েই চুপ করে থাকো। আর রাগারাগি করো না। তোমার ইমেজ খারাপ হচ্ছে সবার কাছে। আমি চেষ্টা করবো কালই ফেরার ব্যবস্থা করার।”
নদী থেকে ফেরার পর থেকে না চাইতেও বারবার মনে রাফিনের ভাবনা চলে আসছে৷ রাগ, অভিমান, কষ্ট, দুঃখ কত ভাবনা যে আমার মনে আসছে। রাতে শুয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হলো, ওর কথায় আমি যেমন আঘাত পেয়েছি, কষ্ট হয়েছে তেমনই আমার কথায়ও হয়তো ও কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমি তো স্যরি বলেছি, ও তো আবার রাগ দেখালো। হুট করে মনে হলো, রাফিনের এই ব্যবহারের পেছনেও হয়তো কোনো আড়াল গল্প আছে। ও কি সেটা কোনো ডায়েরিতে লিখে রাখছে? ডায়েরিটা কোথায়? সেটা কি ওর কাছেই আছে? এখন তো আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ও কি এখন আর আমায় নিয়ে ডায়েরি লিখবে? কখনোই না। এই গল্পের আড়াল গল্পও হয়তো নেই। এখন আমি ওর কেউ না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওর ভাবনা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
আমি আবার তওবার নামাজ পড়ে কাঁদলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কেন যেন। আমার কষ্ট লাঘব করার জন্য একজনই আছেন, আমার রব। সারারাত রবের সাথে কথা বলে মনকে শান্ত করলাম। শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নও দেখলাম একটা রাফিনকে নিয়ে।
#Be_continued_In_Sha_Allah ❣️