অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৪৯

0
601

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৪৯

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে জানলাম, আমরা আজকে রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। সাথে আমার জীবনের অন্যতম ঘটনার সূত্রপাত ঘটতে যাচ্ছে বলে জানালেন মা। আজ থেকে ঠিক চৌদ্দ দিন পর আমার বিয়ে। সবকিছু চূড়ান্ত।

দুপুরে খাবার-দাবার খেয়ে চারটার দিকে আমরা বের হলাম রাফিন ও ওর বাবাসহ। রাফিনকে তো বেরুতে দিতেই চাচ্ছেন না খালামণি। আদরে আদরে শেষ করে দিচ্ছেন। বুড়া একটা লোককে এত আদর করার কি আছে কে জানে। আজাইরা সব। রাফিনকে আদর করার পর আমার কাছে এলেন খালামণি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“জানি খুব বিরক্ত হয়েছিস এবার। আগামীবার মাহরাম নিয়ে আসবি আর ভালোমতো ঘোরাঘুরি করবি৷ বিয়ের আগে এই বাড়ি আর আসবি না তুই বলে রাখলাম। আমার ডাবল মেয়ে হয়ে তারপর আসবি, ছেলের বউ হয়ে না।”
রাফিন খুকখুক করে কাশলো। বললো,
“মা, দেরি হচ্ছে আমাদের। আর আদর না করো। বউ হলে তারপরই আদর করো ভালো করে।”
নিজের বেলায় আদর পুষিয়ে নিয়েছে আমার বেলায় আসতেই হা হুতাশ। স্বার্থপর!

“আগে তো খালা নাকি? শ্বাশুড়ি হলে আর খালার মতো আদর করতে পারবো? তখন তো শাসন করতে হবে হু।”
“আচ্ছা এখন বের হই তাহলে। নাহয় সত্যিই দেরি হয়ে যাবে।” নাকীব বললো।

আসার আগে আমার ব্যাগটা তানভীর ভাইয়া নিয়ে নিলেন। নৌকা পর্যন্ত এলেন আমাদের সাথে। স্টেশন পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলেন রাফিন না করেছে। বলেছে, আর কষ্ট করতে হবে না। এটা অবশ্য খুব ভালো করেছে। নৌকায় ওঠার পর বললেন,
“জেদি, জেদটা কম করিস। তোর জেদ দেখি রয়ে গেছে। এরকম হলে তো চলবে না।”
আমি স্মিত হেসে বললাম, “আচ্ছা।”

বাবা-মা এবং আঙ্কেল নৌকায় গিয়ে বসেছে। বাবা-মা না শুনে মতো রাফিন নাকীবকে বললো, “ম্যাডাম আসবেন কিনা জিজ্ঞেস করো। নাকি নিজেই নৌকা চালিয়ে যেতে পারবেন!” বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসি আড়াল করার চেষ্টা করলো।
ওর কথায় তানভীর ভাইয়া পর্যন্ত হেসে ফেললো। ফাযিল!
“আপু, চলো চলো।”
নৌকায় উঠলাম। নৌকা চলতে শুরু করেছে। রাফিন মাঝখানে বাবা-মায়ের দিকে মুখ করে বসেছে। আমি ও নাকীব ওর পেছনে। তারও পেছনে আঙ্কেল। নাকীবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আচ্ছা ব্রো, বলতো আমার গায়ের কোথাও কি ‘নন-মাহরাম’ ট্যাগ লাগানো আছে?”
নাকীব আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “কই না তো!”
“তাহলে আমাকে দেখলেই কেন কারো কারো নন-মাহরামের কথা স্মরণ হয়? অন্যদের বেলায় হয় না কেন?”

স্পষ্ট খোঁচা! এসেছি পর্যন্ত তানভীর ভাইয়ার সাথে একটা কথাও বলিনি আমি। ওর সাথে বিয়ে হবে চৌদ্দদিন পর, কথা বলবো না একটুও? বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীদের নিজেদেরকে জানার উদ্দেশ্যে কথা বলা তো জায়েয। এটাও জানে না মনে হয়। আর আমি কি এমন বলেছি হু?শুধু বলেছি ‘আচ্ছা।’। আর যাই বলি না কেন তাতে ওর কি?

দীর্ঘ জার্নি শেষে রাত নয়টায় আমরা ট্রেনে উঠলাম। গাড়িতে এবং ট্রেনে সারা রাস্তা আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসেছি। ট্রেনে যখন মাঝরাতে সবাই ঘুমাচ্ছিলো তখন আমি জেগেছিলাম। রাফিন ও আঙ্কেল আলাদা কেবিন নিয়েছে। মা, বাবা, আমি ও নাকীব অন্য কেবিনে। মা ঘুমাচ্ছে। আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে রেখেছি। বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরিঝিরি। আমার চোখেমুখে বৃষ্টির ফোঁটা আঁছড়ে পড়ছে। অন্য এক ভালোলাগায় হারিয়ে যেতে থাকলাম আমি। হঠাৎ গতরাতে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো। স্বপ্নটা ছিল এমন,

আমি ও রাফিন এক নৌকায় পাশাপাশি শুয়ে আছি। মাঝনদীতে নৌকা চলছে আপন ছন্দে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। শুধু আমরা দুজন। দুজন দু’দিকে মাথা দিয়েছি। পাশাপাশি মাথা রেখে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে আছি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন। হঠাৎ টুপ করে একফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়লো আমার চোখের পাতায়। দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেল আমার। রাফিনেরও পলক পড়লো। পানির ছিটে ছড়িয়ে পড়লো সারা মুখে। পানি মুছেই আবার ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর চোখেমুখে অন্যরকম স্নিগ্ধতা। খাড়া নাক, মুখে ঘন কালো দাঁড়ি, টানা টানা চোখ, লম্বা চোখের পাপড়িতে বৃষ্টির ছোঁয়া। হালকা গোলাপি ঠোঁটে গোলাপের পাপড়িতে লেগে থাকা শিশিরের ন্যায় বৃষ্টির ছিটে পড়েছে। ঠান্ডায় হালকা কাঁপছে ও, মৃদু কাঁপছে ঠোঁটজোড়াও।

হঠাৎ ওর সুন্দর গোলাপি ঠোঁটগুলো নড়ে উঠলো আমার প্রশংসায়।
“গোলাপের সৌন্দর্য হার মানবে তোমার রূপের কাছে,
চাঁদেরও অমন ঝিলিক নেই যতটা তোমার রূপে আছে।
এক দৃষ্টিতেই হারিয়ে যাই তোমার দীঘল কালো চুলে
তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্তে ধ্বংস হই সমূলে।”

আশ্চর্য! স্বপ্নে শোনা কবিতাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। এমনটা কখনো হয়নি আমার সাথে। স্বপ্ন অতটুকুই মনে আছে। এরপর কোথা থেকে কোথায় হারিয়েছি আর মনে নেই।

হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখার কোনো কারণ আমি খুঁজে পেলাম না। হয়তো সারাদিনের কর্মফল আর ঘুমানোর আগে এলোমেলো চিন্তাভাবনার প্রতিচ্ছবি। চিন্তাভাবনাগুলোই ঘুরেফিরে স্বপ্নে আসছে। স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে জানালায় চোখ রাখলাম। বৃষ্টি বাড়ছে। বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সাবধানে কেবিনের দরজা খুলে ট্রেনের প্রধান দরজার কাছে গেলাম। দরজায় ইতিমধ্যেই একজন দাঁড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করছে। বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছে। আর তার হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে গাছের অজস্র ডালপালা। আমারও খুব ইচ্ছে হলো ওভাবে বৃষ্টি ধরতে৷ কিন্তু সামনের ব্যক্তিটি না সরলে তো সম্ভব না। মন খারাপ করে ফিরে আসবো তখনই ভরাট কন্ঠের আবৃত্তি শুনতে পাই৷ কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়াই। কান পেতে শুনি আকুতি ভরা কবিতার সুর৷

যেহেতু অভিমান, অভিযোগ
লিখে রাখার জন্য আকাশ ব্যতীত
আমার দ্বিতীয় কোনো রাফখাতা নেই।
নেই নোটখাতা’র মতোন একান্ত ব্যক্তিগত
কোনো প্রেয়সী কিংবা প্রিয়জন।
যেহেতু আমার দুঃখবোধ শোনার জন্য
কেউ কান পাতেনি, এগিয়ে আসেনি দু’পা।

হৃদয়ের যত ব্যথা, যত সুর, যত কাতরতা,
আমি তাই আকাশের বুকে লিখে রাখি।
অশ্রুর কালিতে লেখা আকাশ আমার
একান্ত ব্যক্তিগত রাফখাতা।

লিখে রাখা সেই সব কথা শোনার জন্য
প্রতি রাতে এক মহান সত্তা ছয় আসমান
পেছনে ফেলে আকাশে নেমে আসেন।
অথচ মানুষের পৃথিবীতে আমার দুঃখবোধ
শোনার জন্য কেউ দু’পা এগিয়ে আসেনি। [১]

আমি দু’পা পিছিয়ে এলাম। কোথায় যেন পা লেগে খট করে আওয়াজ হলো। রাফিন ফিরে তাকালো। উফ! আবার একটা তুলকালাম হওয়ার ভয়ে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখি কেউ নেই। চারপাশে তাকালাম, কোথাও কেউ নেই। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলাম। বৃষ্টির চোটে আমার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মনের সুখে গান করি৷ আল্লাহ যখন খুশি হন তখন তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। বৃষ্টি আসলেই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত বাড়িয়ে বলতেন, “এই পানি মাত্রই আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে।” আমিও হাত বাড়িয়ে তা-ই বললাম। একসময় বৃষ্টি থেমে গেল। আমি চলে এলাম কেবিনে। ভোরের মৃদু আলোয় আমরা স্টেশনে এসে পৌঁছালাম।

স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে মেইন রোড পর্যন্ত গেলাম। তারপর রাফিন আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। ও সবাইকে বিদায় জানিয়ে ব্যাগ টানতে টানতে সামনে এগোচ্ছে। আঙ্কেল যাচ্ছেন অন্যদিকে। দুজন দু’দিকে কেন ব্যাপারটা বুঝলাম না। আমি পেছন থেকে তাকিয়ে আছি। ঘন কুয়াশার আড়ালে ও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মনটা হঠাৎ করেই বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। রাফিনকে কি খুব দুঃখ দিয়েছি আমি? ও কি খুব কষ্ট পেয়েছে? ওকে নিয়ে মনে মনে কত কি ভেবেছি। এখন সেসবের জন্য খুব খারাপ লাগছে। ওর সাথে ওরকম ব্যবহার না করলেও চলতো।

আমার মনে পড়ে গেল সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর কিভাবে নিজেকে ওর স্মৃতির বেড়াজাল থেকে বের করেছিলাম। আমারও ওর মতো রেলের আওয়াজ সহ্য হতো না প্রথমে। ল্যাম্পপোস্টের আলো সহ্য করতে পারতাম না। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো দেখলেই ওর ভাবনারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। অনেক কষ্টে ওর স্মৃতিগুলোকে মুছেছি। এতদিন পর ও আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। এই ক’দিনের স্মৃতিরা আবার আমার পিছু নিবে। একদিন পরিকল্পনা ছিল শুধু আমরা দুজন ট্রেনে থাকবো। আজও ট্রেনের সবাই ঘুম ছিলো। আমরা দুজনই জেগে বৃষ্টিবিলাস করতে এলাম। এই স্মৃতি আমি ভুলতে পারবো এত সহজে? আমি পারবো তানভীর ভাইয়াকে বিয়ে করতে? তানভীর ভাইয়ার প্রতি কোনো অন্যায় করে ফেলবো না তো? রাফিন অন্যকারো হয়ে যাবে সেটাও কি আমি দেখতে পারবো? ও কেন এলো আবার? আমার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকদিন পর ধুকপুকানি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। ওর চলে যাওয়াটা আমার ভেতরটায় কাঁপাচ্ছে। আমাদের শেষ বিদায়!

আমি পারবো তো নিজেকে সামলাতে? বুক ভেঙ্গে কান্না আসতে চাইলো। কই, তানভীর ভাইয়ার জন্য তো একবারও এমন অনুভব হয়নি আমার? তানভীর ভাইয়াকেও তো ছেড়ে এসেছি। অথচ আসার সময় একবারও তার কথা মনে হলো না। মনে মনে আমি রাফিনকেই দুষছিলাম তখন। সে-ই তো ওকেই ভাবছিলাম। তবে আমি কি আবার পাপের রাজ্যে ফিরে যাচ্ছি? না, না তা কি করে হয়? বুকে পাথর বেঁধে হলেও আমি আল্লাহর রাস্তায় থাকবো। এই রাস্তা থেকে সরে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। যতই কষ্ট হোক, এখনও আমি প্রিয় নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফে যে কষ্টটা হয়েছিলো তার বিন্দুমাত্র কষ্টও অনুভব করিনি। কষ্টে বুক ফাটলেও আমি কিছুতেই আমার আল্লাহ-রাসূলের বিপক্ষে যাবো না। আল্লাহ নিষেধ করেছেন মানে সেটা আমার জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে তো আমি ভুল করেও তাকাবো না। মোটেও আকৃষ্ট হবো না গায়রে মাহরামের প্রতি। চোখ জ্বালা করছে খুব। কেউ হাতটা শক্ত করে ধরলে ভালো হতো। কারো কাঁধে মাথা রেখে যদি একটু কাঁদতে পারতাম! আর সহ্য হচ্ছে না। অবৈধ স্মৃতিগুলো এত বেপরোয়া কেন? আস্ত বেয়াড়া। কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। যদি জীবনটা আরেকবার শুরু থেকে শুরু করতে পারতাম তবে কখনোই কাউকে ভালোবাসতাম না। ভালোবাসায় এত যন্ত্রণা কেন? এই এতবছর পরও আমার পিছু ছাড়ছে না। আল্লাহ গো! আমায় শক্তি দাও। এই ফেৎনাময় পরিবেশে আর লড়াই করতে পারছি না আমি। আর পারছি না। আহ!

রেফারেন্স:
[১] কবিতা: আহ্বান; লেখা: সালমান হাবীব

#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here