অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৫০

0
584

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৫০

বাসায় ব্যাগপ্যাক রেখেই ছুটলাম শান্তি কুঠিরে। না জানি কি অবস্থায় আছে ওরা। আমরা শান্তি কুঠিরের গেইটে পা রাখতেই গার্ড দু’জন পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। নাকীব কিছু বলবে তার আগেই বাচ্চাকাচ্চা সব হৈহৈ করতে করতে আমাদের দিকে ছুটে এলো। গার্ড দুজন হকচকিয়ে গেল। নাকীব একচোখ টিপে গার্ড দুজনকে বললো,
“আরে ভাই, আমরাই ওদের গার্জিয়ান, বাড়িটার কর্তা।”
গার্ডদের চেহারা হলো দেখার মতো। নাকীব হাসতে হাসতে বললো,
“এবার আপনাদের ছুটি।”
“স্যার না বলা পর্যন্ত আমাদের ছুটি নেই।”
“স্যারের হয়ে আমি বলছি তো। আমরা এসে গেছি না?”
“অকে।” গার্ডরা চলে গেল।

আমরা ভেতরে গেলাম। কতদিন পর! অন্যরকম প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল। দৌড়ে দাদুর রুমে গেলাম।
“একি!” দাদুকে দেখে আমরা দুজনই আঁৎকে উঠি।

এ কি হাল হয়েছে দাদুর? বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। চোখ খুলে তাকাতে পারছেন না।
“কি হয়েছে দাদুর?”
“দাদু ওযু করতে গিয়ে কলপাড়ে পড়ে গিয়েছিলো।” ঝিলি বললো।
“কিহ? কখন?”
“পরশু দিন।”
“আমাকে একটাবার বললি না? তোরা কি মানুষ?”
”তোমরা বেড়াতে গিয়েছো তাই বলিনি। তাছাড়া গার্ড আঙ্কেলরা ডাক্তার এনেছিলো। ওরা ডাক্তার দেখিয়েছে দাদুকে। ডাক্তার বলেছে, ক’দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে।” কুলসুমের জবাব।
“ক’দিনের মধ্যে সুস্থ হওয়ার মানে কি হ্যাঁ? তোরা আমাকে জানাবি না? এতবড় একটা ঘটনা ঘটেছে আমিই জানি না। আমি ওখানে সুন্দরমতো রয়ে গেছি। তোরা একা বলে ওখান থেকে আসার একটা রাস্তা খুঁজছি অথচ তোরা এতবড় অঘটন ঘটার পরও কিচ্ছুটি বললি না আমাকে? তোদের একটাকেও আমি ছাড়বো না। সবগুলোর জন্য শাস্তি আছে।”

আমি দাদুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনিও বললেন না দাদু?”
“আপু, দাদু আমাদেরকে নিষেধ করেছে বলতে।” মাহফুজ বললো।
আমি কটমট করে তাকালাম ওর দিকে। তখনও হাতমুখ অব্দি ধোওয়া হয়নি আমাদের, পোশাকও বদলানো হয়নি। আমরা দাদুর সেবায় লেগে পড়লাম।

আমাদের কথা বলার ফাঁকে একগাদা ছেলে ঢুকলো হৈহৈ করে। টেবিলের ওপর থেকে জগ উল্টে ফেলে দিলো। স্টিলের গ্লাসটা ঝনঝন করে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। চেয়ার টেনে নিয়ে উঠানে ছুঁড়ে মারলো। আকষ্মিক আক্রমণে আমরা তাজ্জব হয়ে গেলাম। নাকীব বাঁধা দিতে যেতেই ওকে কষে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। দেখে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। এক ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে সরিয়ে দিলাম। তখনই কোথা থেকে জাফর এলো। ওর একহাত কনুইয়ের নিচ থেকে কাটা। দেখেই শিউরে উঠলাম। হিংস্র চেহারাটা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো৷ ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেদিনকার প্রতিশোধ আজ ও নিবেই নিবে। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকেছে আমার। অস্ফুট স্বরে একবার নাকীবকে ডাকলাম। ও সাড়া দিলো না। চার-পাঁচজন মিলে ওকে চেপে ধরেছে। কথা পর্যন্ত বলতে দিচ্ছে না। আরও তিন-চারজন দাদুসহ বাকীদের আটকে রেখেছে। আমি প্রাণপণে আল্লাহকে ডাকছি৷ যার আল্লাহ আছে তার আর কাকে লাগে? আল্লাহ গো! বাঁচিয়ে দাও আমায়, আমার ইজ্জত। সেদিনও তো তুমিই আমায় বাঁচিয়েছিলে। আমি স্বীকার করছি আমার অক্ষমতা। আমি ভরসা করি তোমার ওপর। জাফর আমার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ওর ভয়াল থাবা আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম একহাতে আর কতটুকুই বা পারবে আমার সাথে? কিন্তু না! তার একহাতকে আমি সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়েও বাঁধা দিতে পারছি না। অবশেষে দু’হাত দিয়ে ওকে ঠেলে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। রাগে, ক্ষোভে চোখ বেয়ে নামলো অশ্রুর ঢল। মুহুর্তের মধ্যে কি এমন হয়ে গেল বুঝলাম না৷ কি সুন্দর আমরা কথা বলছিলাম এরমধ্যেই এমন ভয়াল দানবের দল কোথা থেকে চলে এলো? থাবা আমার শরীরে পড়ার আগমুহূর্তে ধুপ করে কিছু পড়ার আওয়াজ পেলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি আরেকজোড়া পা জাফরের পায়ের ওপর। জাফর ভয়াবহ চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। জাফরের হাতটা পেছনের দিকে গুটিয়ে ফেলেছে অজ্ঞাত মানুষটা। মানুষটাকে তখনও দেখিনি আমি। মনে মনে দোয়া করলাম, আল্লাহ! এই মানুষটা যে-ই হোক তাকে তুমি ভালো রেখো, তার সব মনোবাসনা পূর্ণ করে দিও।

দোয়া করতে করতেই মানুষটার আওয়াজ এলো কানে। আওয়াজটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমার কানে বাজতে থাকলো। বাজতেই থাকলো। আজও আল্লাহ সেই মানুষটাকেই পাঠালো…!

“সেদিন এত পেঁদানির পরও তোর শিক্ষা হয়নি? আবার হাত বাড়িয়েছিস ওর দিকে। তোর এই হাতের আজ কি দশা আমি করি শুধু দেখ।” ফিসফিস করে কথাগুলো বলেই রাফিন জাফরের হাতটা মুচড়ে দিলো। ওর চোখ ভয়ানক লাল হয়ে গেছে। আমরা খট করে আওয়াজ শুনলাম৷ সেই আওয়াজ ছাপিয়ে গেল জাফরের তীব্র আর্তনাদের স্বরে।

আমি এবার তাকালাম রাফিনের দিকে। এতক্ষণ পর, দীর্ঘদিন পর গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। মুখভর্তি লম্বা দাড়ি, চেহারায় অন্যরকম সতেজতা, ছিমছাম পোশাক, টাখনুর ওপরে প্যান্ট। এ যেন অন্য এক বদলে যাওয়া রাফিন।

রাফিন থামলো না। জাফরের অন্যহাতটাও বোধহয় ভেঙে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর কোথায় যেন ফোন দিলো ও। শান্তি কুঠিরের ঠিকানা দিয়ে বললো,
“সবগুলোকে এক্ষুনি জেলে ভরার ব্যবস্থা করুন। এই এলাকায় কোনোরকম দূর্নীতি যেন আমার চোখে না পড়ে। তাহলে সর্বনাশের আর বাকি থাকবে না। মাইন্ড ইট!”

রাফিনের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। ও কি এই এলাকার অনেক বড় কেউ? একটা কল কেটে অন্য জায়গায় কল দিলো ও। ধমকে বললো,
“তোমাদেরকে বলেছিলাম আমি এখান থেকে যেতে? সাহস কি করে হয় আমার কথার বাইরে যাওয়ার? এই তোমাদের সিকিউরিটি? এই তোমাদের দায়িত্বশীলতা? দায়িত্বজ্ঞানহীন! এক্ষুনি আগের জায়গায় এসে গার্ড দাও। এই চাকরি তোমাদের পার্মানেন্ট। কাম ব্যাক, স্টুপিড!”

নাকীব কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, “ভাইয়া, আমিই বলেছি ওদেরকে চলে যেতে।”
রাফিন রেগে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই পুলিশ এসে সবগুলো ধরে নিয়ে গেল। পুলিশগুলোকেও একগাদা কথা শুনিয়ে দিলো রাফিন। আমার চোখের সামনে পুরোপুরি অন্য এক রাফিন। ওর একেক সময়ের একেক রূপে আমি দ্বিধান্বিত।

চলে যাওয়ার সময় একবার পেছন ফিরে আমার দিকে তাকায় শুধু। পরক্ষনেই দৃষ্টি নামিয়ে নাকীবকে বলে,
“সাবধানে থেকো। আর দাদুকে দেখে রেখো।”

বুঝলাম, আজকের রাফিন আমায় উদ্ধার করতে আসেনি। বরং একজন মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওর দৃষ্টি আজ অবনমিত। আমিও নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। আজ মানুষ হিসেবে রাফিনের দিকে তাকিয়েছিলাম। মানুষ হিসেবেই তাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। অন্য কোনো দৃষ্টিতে আমরা কেউই কারো দিকে তাকাইনি এটুকু আমি হলফ করে বলতে পারি।

ওরা দুজন সামনে গিয়ে আরও অনেকক্ষণ কথা বললো। কি বললো কে জানে। আমিও আর দাঁড়ালাম না। এতগুলো পরপুরুষের সামনে বেইজ্জতি হওয়ার কোনো মানে হয় না৷ আমার সারা শরীর তখনও কাঁপছিলো। গিয়ে নামাজে দাঁড়ালাম। দু’রাকাত শুকরিয়ার নামাজ আদায় করলাম মহার রবের দরবারে। পুনরায় আমার ইজ্জত বাঁচানোর জন্য। আমি বারংবার ভুল করি আর এই মহান সত্তা বারেবারে ক্ষমা করেন, আমি বারবার বিপদে পড়ি তিনি বারবার আমায় বাঁচান। এছাড়া পার্থিব প্রতিটা প্রয়োজন তিনি পূরণ করেই চলেছেন অথচ আমি বেখবর। আমার শরীরের যে কত চাহিদা তা আমি নিজেও জানি না। অথচ তিনি তা অবলীলায়, অনায়াসে রোজ পূরণ করে যাচ্ছেন। আমি কিভাবে সেই মহান সত্তার অবাধ্যতা করি? কিভাবে তাঁকে ছেড়ে তাঁর সৃষ্টির প্রেমে মশগুল হই? নাহ! আমি কখনোই পারবো না। আমি এই জীবন কাটিয়ে দিবো শুধুমাত্র রবকে ভালোবেসে। সত্যি বলতে, আজ রাফিনকে দেখার পরও বিন্দুমাত্র অনুভূতি কাজ করেনি আমার। শুধু অবাক হয়েছি খানিকটা। ও কিভাবে এলো, কেন এলো সেসব জানারও কোনোরূপ ইচ্ছে পোষণ করলাম না। নাকীবও সেগুলো আমায় বললো না৷

বিকেলে দাদুর কাছে বসেছিলাম আমি ও কুলসুম। মাহফুজ, নাকীব, আবরার তিনজনই কেথায় যেন বেরিয়েছে। আবির গল্পের বই পড়ছে দাওয়ায় বসে আর ঝিলি শুনছে৷ ঝিলি দৌড়ে রুমে এসে ‘আপুউউ’ বলে দিলো এক ডাক। আমি লাফিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বললাম, “আস্তে, দাদু ঘুমাচ্ছে।” কিন্তু ততক্ষণে দাদুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে।

ঝিলি উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে আমাকে টেনে ধরে বসিয়ে বললো, “আপু, ভালো ভাইয়া এসেছে বাইরে।”
“ভালো ভাইয়া? কেন?”
“দাদুকে দেখতে।”
“আচ্ছা আসতে বলো।”

দাদুকে রেখে আমি ভেতরের রুমে চলে গেলাম। রাফিন দাদুর রুমে ঢুকলে আমি বাইরে এলাম। আবিরের পাশে মোড়ায় বসে রইলাম চুপচাপ। আবির বললো,
“আপু, একটা গল্প শুনবে?”
“বল?”
“একটা ছেলে আর মেয়ে দুজন ছোটবেলা থেকে প্রিয়বন্ধু ছিল। ওরা সবসময় একসাথে থাকতো। ছেলেটা একদিন মেয়েটাকে বিয়ে করতে চায়৷ কিন্তু মেয়েটা সম্মতি দেয়নি। একদিন অন্য একটা ছেলে এসে মেয়েটাকে বিয়ে করে নিয়ে যায়৷ বিয়ের পর মেয়েটা বুঝতে পারে সে আসলে তার বন্ধুকে ভালোবাসে। কিন্তু তখন তার আর কিছুই করার ছিল না।”
“ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। গল্পটা সুন্দর।”
“আপু, এটা গল্পের মূলভাব ছিল। পুরোটা এখনও লিখা হয়নি।”

আমি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালাম।
“তুই লিখছিস?”
”হ্যাঁ।”
“বাহ! ক্যারি অন। তবে হ্যাঁ, শুরু থেকেই রোমান্টিক গল্প ধরিস না। আরেকটু বড় হ, তারপর। এখন কিশোর উপন্যাস লিখ।”
“লিখেছি আপু। রহস্যে ভরা কিশোর উপন্যাস। নাম রহস্যময় জঙ্গলবাড়ি।”
“ফ্যান্টাস্টিক। তোকে আমার খালার বাড়ি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। অসাধারণ থিম পেতিস।”
“আমি যেতে চেয়েছিলাম আপু। মাহফুজ ভাইয়া যেতে দেয়নি।”
“ওকে আচ্ছামতো কয়টা দিতে পারলে আমার শান্তি লাগতো। হাড় বজ্জাত ছেলে। ও যা যা করে আমায় বলবি তো। ওকে শায়েস্তা করা প্রয়োজন।”
“আপু, ভালো ভাইয়া বোধহয় বের হচ্ছে। তুমি ভেতরে যাও।”
“আচ্ছা তুই থাক তাহলে।”

আমি মুচকি হেসে দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়লাম। আবিরের বলা শেষ কথাটা খুব ভালো লেগেছে আমার।

#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️

[ বি.দ্র: আজ থেকে টানা তিনিদিন তিনটা পর্ব দিবো ইন শা আল্লাহ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here