অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৫৩

0
1090

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৫৩

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সন্তর্পণে দরজার তালাটা খুললাম। খুলেই ভেতরে ঢুকে ভালোমতো দরজা আটকে ভেতরের রুমে চলে এলাম। বাইরের ঘরে আলো জ্বালানো যাবে না। রাফিনের চ্যালাগুলোকে ফাঁকি দিয়ে বহুকষ্টে শান্তি কুঠিরে প্রবেশ করেছি। এবার একটু শান্তি পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় পৃথিবীর সব শান্তি ‘শান্তি কুঠিরেই’ জমা। এত শান্তি আর কোথাও নেই।

মাগরিবের নামাজ পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে করতেই এশার নামাজের সময় হয়ে এলো। এশার নামাজ আদায় করে একেবারে ঝরঝরে হয়ে নিলাম। গত একবছর ধরে রমজান মাস ব্যতীত সারা বছর কুরআন খতম দেওয়া শুরু করেছি। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম, জীবন থেকে অনেকগুলো সময় অযথা গলে যাচ্ছে। ভাবলাম ওগুলোকে কাজে লাগাই। জান্নাতে গেলে আমাদের কোনো আফসোস থাকবে না, কিন্তু একটা জিনিসের জন্য খুব আফসোস হবে আমাদের। সেটা হলো সময়। হেলায় ফেলায় নষ্ট করা সময়গুলোর জন্য সেদিন বড্ড আফসোস হবে আমাদের। ভাবলাম, দিনে মাত্র দশটা মিনিট ব্যয় করবো কুরআন তিলাওয়াতের পেছনে। দৈনিক দশ মিনিট অর্থাৎ, সারাদিনে পাঁচ পৃষ্ঠা কুরআন পড়ি। এতেই চারমাসে আমার পুরোপুরি একবার কুরআন শেষ হয়ে যায়৷ এরপর ভাবলাম সময় তো অঢেল আছে। দৈনিক দশ পৃষ্ঠা করে পড়ি। প্রতি নামাজের পর দু’পৃষ্ঠা করে। এতে করে দু’মাসেই কুরআন খতম হয়ে গেল। তারপর অর্থসহ পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাছাড়া দিনে একশো যিকর করতাম আগে। এখন এক হাজার বার করে আল্লাহর যিকর করি। একদিনে একশো যিকর বছর শেষে ছত্রিশ হাজার পাঁচশোতে গিয়ে দাঁড়ায়। আর এক হাজার যিকর তো আরও অনেক বেশি। দুনিয়ায় একবার আল্লাহর যিকর করলে জান্নাতে একটি করে গাছ উৎপন্ন হয়। জান্নাতের বিশাল রাজপ্রাসাদটায় তো অজস্র গাছের প্রয়োজন। সুতরাং, আমাদের সেই অনুযায়ী যিকরও করতে হবে। দুনিয়াবি জীবনটাকেই যদি ইবাদতের কাজে না লাগালাম তবে আখেরাতে সফলতা আশা করাটা বোকামি।

খিদে পেয়েছে, কিছু খাওয়া দরকার। রান্নাঘরে কিছু আছে কিনা কে জানে? রান্নাঘরে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। সব জিনিস এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। চুলার ওপর তরকারির ঝোল, ভাতের ফ্যান, মরিচ, মশলার গুঁড়ো। জগ পড়ে আছে কাৎ হয়ে। তাকে মরিচের কৌটা কাত হয়ে পড়ে আছে, লবণের বয়ামের ঢাকনা খোলা। চা-পাতা ছড়িয়ে আছে মেঝেজুড়ে। কি অবস্থা করেছে এরা? ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে সব গোছালাম। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। হয়তো এই রান্নাঘরে আর আসা হবে না, রান্না করা হবে না। আমি খুব যত্ন নিয়ে সবটা গোছাতে থাকলাম। গোছানো শেষে দাদুর রুমে গিয়ে খাটের তলায় উঁকি দিলাম। হয়তো কোনো শুকনো খাবার থাকতে পারে। কিছু ফলমূল এবং বিস্কুট, মুড়ি, চানাচুর পাওয়া গেল। সেগুলোই খেলাম বসে বসে। এরপর পানি খেয়ে দরজার খিল আরও ভালোভাবে লাগিয়ে ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে মনে পড়লো বাড়ির কথা। আমাকে না পেয়ে এতক্ষণে কি তুলকালাম ঘটছে কে জানে? ওরা কি মনে মনে ভেবে নিবে যে, আমি বিয়ে করতে চাই না বলে পালিয়েছি? ধুর না! ওরকম কিছু ভাববে না। পাড়া-পড়শীরা কি গালমন্দ করবে আমার নামে? আমার বিয়ের কথা তো তেমন কেউ জানে না। করলে করুক গে, আমি ঘুমাই তো। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম নিমেষেই।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দুপুর অব্দি শান্তি কুঠিরের আনাচে-কানাচে প্রত্যেকটা জায়গা ঝরঝরে পরিষ্কার করে ফেললাম। আর কখনোই তো আসা হবে না। কতদূরে বিয়ে দিচ্ছে আমায়। ওদের ছাড়া থাকবো কিভাবে কে জানে? দুপুরে অল্প কিছু ভাত আর আলুভর্তা করেছিলাম। সেগুলো খেয়েদেয়ে সামনের রুমের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। অনেক দূর অব্দি চোখজুড়ানো ধানক্ষেত দেখা যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ বেয়ে কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আর কখনো কি এমন একলা দুপুর আসবে আমার জীবনে? কখনো কি বাচ্চাদের সাথে হৈ-হুল্লোয় মেতে উঠতে পারবো? ওদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটানো হবে কখনো? অতিথি হয়ে আসবো, দু’দিন পর চলে যাবো। কত আপন মানুষগুলোর কাছে পর হয়ে যাবো। তাদের সাথে কথা বলতে হলে আগে কতকিছু ভাবতে হবে। সম্পর্কে ফর্মালিটি চলে আসবে আপনাআপনি। অথচ যাকে চিনি না, জানি না তার সাথে গড়ে উঠবে সখ্যতা। এ কেমন জীবন? বিয়ে নামক একটা অধ্যায়, একটা সম্পর্ক মুহুর্তেই সবগুলো সম্পর্কের চেহারা একাধারে পাল্টে দেয়।

আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে কারো গভীর কন্ঠের আবৃত্তি শুনে। অতি চেনা কন্ঠস্বর। কেন আমার পিছু ছাড়ছে না কে জানে। জীবনটা তো ওর দিকে এগোচ্ছে না, তবুও কেন বারবার এসে মায়া লাগিয়ে যাচ্ছে? আমার জীবন থেকে দুনিয়াবি মায়া অনেক আগেই উঠে গেছে৷ গতরাতে দিল লাগিয়ে তওবা করেছি। আমি আর কখনো কোনো পরপুরুষের দিকে তাকাবো না, কথাও বলবো না। সম্পূর্ণ আল্লাহর রাস্তায় চলবো। এখন কেউ এসে আমার জন্য তার বুক ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে ফেললেও হারাম পথে পা বাড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না। এই জীবন জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। এই জীবন এখন আর আমার নেই। পুরোপুরি আল্লাহর হাতে চলে গেছে। আল্লাহ যা বলেছেন আমি তা-ই করবো। এর বিরুদ্ধে একটা কাজও আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি কোনোভাবেই শয়তানের প্ররোচনায় পা বাড়াবো না, নিজের নফসের কথা শুনবো না। আমি অবশ্যই আমার রূহকে শান্তি দিবো।

“চুপচাপ দূরে সরে যাব, নিঃশব্দে
একা আকাশের মত,নিঃসঙ্গ।
যতটা দূরে গেলে-
তোমার দহনে আর পুড়বে না মন,
যতটা দূরত্বকে লোকে বলবে ‘আকাশ এমন’।” [১]

রাফিন আবৃত্তি করছে। আমি আকাশপানে তাকিয়ে আছি। একদিন ছুটে যাবো ঐ দূরে, যতটা দূরে গেলে দুনিয়াবি লোভ-লালসা আমায় ছুঁতে পারবে না। ছুটে যাবো রবের পানে। সাক্ষাৎ পাবো প্রাণের চেয়ে প্রিয় নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। ভাবতেই সারা শরীরে শিরশির অনুভূত হলো। দেখা হবে সাহাবায়ে কেরামগণের সাথে। সুমিষ্ট আলাপ হবে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। ওখানে তো সময়ের কোনো শেষ নেই। সেই সুমধুর মুহুর্ত পাওয়ার জন্য হলেও দুনিয়াকে পায়ে ঠেলে এগিয়ে যাবো ইন শা আল্লাহ।

আমি রুমে চলে এলাম। রাতে নাকীব নিতে এলো আমায়।খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো তৈরি হয়ে নিতে। আমিও তৈরি হয়ে চলে এলাম। বাসায় এসে দেখি পরিস্থিতি একদম স্বাভাবিক। আশ্চর্য! এমন তো হওয়ার কথা না।

রাতে শাওন শুয়েছে আমার সাথে। বাড়িতে যাওয়ার নামগন্ধ নেই ওর। শাওন-ই আমাকে বললো,
“তুই যে কাল পালিয়ে তোর ভাঙ্গা বাড়িটায় উঠেছিস সবাই অনেক চিন্তা করছিলো। ফাইয়াজ বললো সে খোঁজ নিয়েই জানাচ্ছে। ফোন রাখার দু’মিনিট গেল না সে ফটাফট বলে দিলো তুই তোর ভাঙ্গা বাড়িতে আছিস।”

শাওনের কথাবার্তা ওলটপালট হয়ে গেছে। আর ইদানিং ও বেশ বাচাল প্রকৃতির হয়ে গেছে।
“ফটাফট জিনিসটা কি?”
“ফটাফট মানে হলো ঝটপট।”
“ঝটপট বললেই হতো।”
“ঐ যে কথার স্পিড।”
”হুম, সেটা যে খুব বেড়েছে তা টের পাচ্ছি।”
“ফাইয়াজ কিভাবে জানলো জানিস? ওর আগেই সন্দেহ ছিল তুই ওখানে যাবি৷ ওখানে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলো ঘরের তালা খোলা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ব্যস, ও বুঝে নিলো৷ কি বুদ্ধিমান দেখেছিস? তোর তো ওর ছিঁটেফোঁটা বুদ্ধিও নেই।”
“কেন পালিয়েছিলাম মনে আছে?” কটমট করে তাকালাম শাওনের দিকে। ও আর রিস্ক নিলো না। প্রসঙ্গ পাল্টালো মুহুর্তেই।

“কাল তো তোর বিয়ে। কেমন ফিলিংস হচ্ছে তোর?”
“জিরো ফিলিংস!”
“জিরো ফিলিংস? কি বলিস? আমার তো বিয়ের আগের রাতে পেট মুচড়ে, দলা পাকিয়ে বমি হলো। পেট খারাপ হয়ে টয়লেটে বসেছিলাম। সারারাত একবার আসি একবার যাই। টয়লেটে যাওয়া-আসা করতে করতেই রাত কেটে গেল। কি যে ভয়াবহ অবস্থা। শুধু মনে হচ্ছিল কিভাবে থাকবো মানুষটার সাথে? প্রথম কথা কিভাবে বলবো? বাসর ঘরে তো আমি একা বসে থাকবো। সে ঢোকার পর কি করবো? কদমবুসি করবো? নাটক-সিনেমায় তো তাই দেখলাম আজীবন। নাকি…”
“উফ! চুপ করবি একটু? আমার এসব টেনশন হচ্ছে না। আমাদের আগে থেকেই চেনা-জানা আছে।”
“চেনা-জানা আছে? তারমানে তুই সব জেনে গিয়েছিস?”
“কি জানবো?”
“চেনা-জানা থাকলেও বুঝলি বিয়েটা হচ্ছে অন্যরকম ফিলিংস।”
“আল্লাহর দোহাই লাগে তুই একটু চুপ কর। এত কথা বলা কবে থেকে শুরু হয়েছে তোর?”
“এখন কি আর আমি একা আছি? আমি তো দোকা হয়ে গেছি৷ কথা তো আমি একা বলছি না। ভেতরে বসে বসে অন্যজনও কথা বলছে। ওরগুলোও তো আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে নাকি!”

আমি পাশ ফিরে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শাওন কথা বলতেই থাকলো। ততক্ষণে আমি ঘুম। হয়তো অবিবাহিত জীবনের শেষ ঘুম। আমার সত্যিই সবকিছু অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে বিয়ের আগে এটাই হয়তো শেষ ঘুম, শেষ শোয়া, শেষ এটা, শেষ ওটা৷ সব শেষ!

রেফারেন্স:
[১] কবিতা: ভালোবাসি একটি কবিতার নাম | সালমান হাবীব

#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here