#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃ_মহিমা হাছনাত মাহি
#পর্বঃ০১
গ্রীষ্মের ই এক দিনের শুরু । চারদিকে ফযরের আজান দিচ্ছে। একটু পর আবার সব মসজিদে বেজে উঠল “আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম “। শুরু হয়ে গেল পাখির কিচির মিচির আওয়াজ। ভোর ৫ টা নাগাত ঘুম থেকে উঠে শুভ্রা তার প্রতিদিনকার নিত্যনতুন কাজ সারছে। সকালে ঘুম থেকে উঠা, নামাজ পড়া, সারা ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ঘর গুছিয়ে রাখা , তারপর আবার সকলের জন্য একে একে নাস্তা তৈরি করা, তাও আবার একেক সদস্যের জন্য এক এক আইটেম। নাস্তা বানানো শেষ হলে আবার ৭ তলায় ছাদে গিয়ে সারাদিনের জন্য পানি আনা। অবশ্য বাড়িটার ৪ তলাতেই থাকে তারা। অত শিড়ি উঠতে কষ্ট হলেও কলসি, পানির বোতল নিয়ে নামতে তেমন ফুসরত যায় না তার। এ যেন সকল কিছু বাড়ির চাকর ঝি এর ই কাজ। চাকর!!!! হ্যা চাকর ই তো বটে। যেখানে ৩ বছর আগেও যে নিজেদের বাড়িতে চাকর রাখার ক্ষমতা ছিল, আজ সে অন্যের বাড়িতে চাকরের কাজ করছে। ভাগ্যের নিয়তি আজ তাকে কোথায় ঠেলে দিয়েছে! ভাবতে ভাবতে তার যেন মনে হলো চোখ দুটো ভিজে আসছে। এসব উথাল-পাতাল চিন্তা করতে করতে কলসি পানির বোতল নিয়ে ৪ তলায় পৌছাল শুভ্রা। দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে ডুকে দেখলো মি.আনিসুর রহমান খবরের কাগজে মুখ গুজে খবর পড়ছেন। সুভ্রাকে দেখা মাত্রই বললেন,
মি. আনিসুর রহমানঃ এসেছিস! আচ্ছা সারাদিন এতো কাজ কেন করিস বলতো হ্যা। একটু অন্যদের মতো ফাকি দিয়ে রেস্ট নিতে পারিস নাকি। শরীরটার অবস্থা দেখেছিস তুই?
সুভ্রাঃ ফাকি দিয়ে যদি রেস্ট নিই তাহলে কাজ গুলো কে করবে শুনি আংকেল?? আমাকে তো কাজ করার জন্যই তো রাখা হলো নাকি আংকেল? (একটা শুকনো মিষ্টি হাসি দিয়ে)
শুভ্রার কথা শুনে আনিসুর রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে মনে বলেন ( সত্যিরে আজ তোকে এই অবস্থায় দেখলেই আমার বুকটা হাহাকার হয়ে উঠে । এরকম টা তো তোর সাথে না ও হতে পারতো)
এসব ভাবতে ভাবতে শুভ্রা গিয়ে আনিসুর রহমান এর সামনে একটা চা এর কাপ আর বিস্কুট রাখে। আর রাখতে রাখতে বলে,
শুভ্রাঃ কাজ করার জন্য যখন এসেছি, যে কাজের জন্য প্রত্যেকদিন ৫০০ টাকা দাও , তার ন্যায্য পরিমাণ কাজটা তো করতে হবে নাকি?? এক দিনে ৫০০ টাকা কতটা বলো তো!! ফাকি দিলে তো বেঈমানী করা হবে আংকেল।
এরই মাঝে হায় তুলতে তুলতে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেন মিসেস লুতফা বেগম।
মিসের লুতফাঃ কিসের এতো ফাকি টাকির কথা হচ্ছে শুনি?? দুজনে মিলে কিসের এতো আলোচনা সমালোচনা হ্যা?
বউ এর কথায় রীতিমতো এক প্রকার ঢুক গিললেন আনিসুর রহমান সাহেব। তা দেখে বুঝতে পেরে শুভ্রা আনমনেই নিজে নিজে হেসে ফেলল সে। লোকটা খুব বেশিই ভয় পায় তার বউটাকে। অবস্য সব স্বামীরাই তার বউকে ভয় করে। একসময় তো সে ও তার বাবাকে দেখেছে এভাবে৷শুভ্রা মুখ টিপে হাসছে দেখে মিসেস লুতফা আড়চোখে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বললেন,
মিসেস লুতফাঃ বাব্বাহ আমি এমন কি বললাম যে হেসে কুটুকুটি হয়ে যাচ্ছিস?? কি ফন্দি আটছিলি যে দুজনে মিলে যে তোর আংকেল চুপসে গিয়েছে?
মি.আনিসুর রহমানঃ আরে নাহ নাহ। আমি বলছিলাম যে পাশের ফ্ল্যাট এর ভাড়াটি যারা আছে তারা আর কি, ওদের বাড়িতে যে কাজের মেয়েটা আছে না? ও আর কি, শুধু নাকি ফাকি দেওয়ার ধান্দা। কবে টুকটাক কাজ করে পালাবে সেই চিন্তা। এই দিকে তো টাকার জন্য দুকদম এগিয়ে ঝগড়া লাগাতে আসবে। এই ই বলছিলাম৷
মিসেস.লুতফাঃ ও এই বলো!! সবাই একই বুঝেছ?? কেউ কারো থেকে কম যায় নাহ খুজ নিয়ে দেখ ( শুভ্রার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে) তা শুভ্রা মেমসাহেবা আপনি কি দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনবেন নাকি খাবার দাবারের ব্যবস্থা করবেন?
কথা টা যে শুভ্রাকে ইংগিত করে বলা হয়েছে তা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে। তবে সে এতোদিনে ভালোই অভ্যস্ত হয়ে মিসেস লুতফার এই কটু কথায়।
শুভ্রাঃ না না এইতো যাচ্ছি। (শুভ্রা এইবার লজ্জা পেয়ে গেল)
শুভ্রা চলে যেতে গেলেই মিসেস লুতফা শুভ্রার বা গালে স্পষ্ট খয়েরী রঙের চারটি দাগ দেখতে পেল। তিনি শুভ্রার যাওয়ার পথে আবার বাধ সাজে।
মিসেস লুতফাঃ এই দাড়া দাড়া। এদিকে দেখ তো! এই তোর মুখে এটা কি?? থাপ্পড় কে মেরেছে তোকে?? পুরো ৪ আংগুল বসে আছে! কারো বাড়িতে চুরি টুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিস নাকি?? মিসেস লুতফার কথায় শুভ্রা রীতিমতো থতমত খেয়ে ফেলল। শুভ্রার মন যেন রীতিমতো আতকে উঠলো। শরীর টা কেমন অবশ হয়ে আসছে আস্তে আস্তে ভয়ে। মি. আনিসুর রহমান খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে শুভ্রা কে দেখে কিছু বলতে যাবে তখন ই মিসেস লতিফা বলে উঠেন,
মিসেস লুতফাঃ খবরদার যদি এরকম কোনো খবর আশেপাশে শুনি। আমার নাম ইজ্জত যদি কাটা যায় তাহলে আজ ই তোর এই বাড়িতে শেষ দিন বলে দিলাম।
শুভ্রা নিজেকে কোন মতে সামলে বলল ঃ না না আন্টি সেরকম কিছুই না আসলে রাতের বেলা মুখে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম তো তাই হাতের ছাপ বসে গিয়েছে।
[সত্যিটা জানলেও কি আমাকে কখনো বিশ্বাস করতেন আপনি? আমি তো এবাড়ির কাজের লোক মাত্র। কাজের লোকের আবার নিজেদের অসুবিধার কথা মালিকদের বিশ্বাস করাও যে বিশেষ কঠিন তা তো আপনার কথাতে বুঝে নিতে হয় প্রতি পদে পদে ] (মনে মনে) ।
মিসেস লুতফাঃ ও আচ্ছা তাই বলিস। আমি আরও ভাবছি নিচের তলার সালমার সাথে মিলে কিছু করেছিস। তোদের তো আবার বেশ ভাব!
মিসেস লুতফা ব্যাপার টা বিশ্বাস করলেও আনিসুর সাহেবের কেমন একটা খটকা লাগছে খুব। সত্যিই কি আসলে মুখে হাত দিয়ে ঘুমালে এরকম দাগ হয়ে বসে থাকে?? । এসব ভাবতে ভাবতে মিসেস লুতফা আবার শুভ্রাকে আদেশ করলেন যেন তার ছেলের ঘরে সকালের নাস্তাটা দিয়ে আসে। শুনা মাত্রই শুভ্রা বুকের ভিতর আবার তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। ভয়ে আবার হ্রদয় কাপতে লাগলো। তাহলে কি আবার!!!!! আনিসুর রহমান বলেন উঠে এসে আমাদের সাথে খেলেই তো হলো । তখন মিসেস লুতফা বলেন আজ নাকি তার চাকরির ইন্টারভিউ আছে তাই তাকে আর ডিস্টার্ব করছি না। এই শুভ্রা যা তো দিয়ে আয়। সাত পাচ ভাবতে ভাবতে শুভ্রা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এলো । মূহুর্তে মনে পড়ে যায় কাল রাতের সেই মুমূর্ষু ঘটনা ।
{ ঠিক রাত দুটো কিংবা আড়াইটা রাতের কাজ সেরে নিজের রুমে ঢুকেছে মাত্র। সবাই তো ১২ ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। হাত মুখধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নিজের বিছানা বিছাচ্ছিলো সে। হঠাৎ পেছন থেকে দরজা বন্ধের আওয়াজ শুনে পেছনে ফিরে দেখে সোহেল দরজায় হুক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই শুভ্রার মনে শুকনো মোচড় দিয়ে উঠলো। এতো রাতে সোহেল কে তার রুমে দরজা বন্ধ করতে দেখাটা মোটেও ভালো কাজ নয়। ঢুক গিলে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো,
শুভ্রাঃ ভায়া কিছু চাই??
সোহেলঃ হুম চাই তো?
এই বলে সোহেল শুভ্রার দিকে এগোতে লাগলো।
শুভ্রাঃ দেখুন ভায়া দাড়ান। আপনার যা লাগবে আমি এনে দিচ্ছিব। আর আপনি এভাবে আমার রুমের দরজা লক করেছেন কেন?
শুভার বলতে দেরি হলো কিন্তু সোহেলের দৌড়ে এসে হিজাবের উপর শুভ্রার চুলের মুঠি ধরতে দেরি হলো না। শুভ্রা সারাক্ষন ই হিজাব পড়ে হাত পর্যন্ত। মাথা থেকে কখনোই কাপড় ফেলে না। আর পরের বাড়ীতে অন্য পুরুষদের সামনে তো না ই। ব্যাথায় আহহ বলে কুকিয়ে উঠলো সে। তারপরেও সোহেল আরো জুড়ে ধরে আছে সে। এমনিতে এতোদিন কাজ করার সময় সোহেলের অদ্ভুত গা জ্বলানি চাহনি মোটেও সহ্য হতো না তার তার উপর আজকে সে আমার রুমে এসে চুলের মুঠি ধরে টানছে।
সোহেলঃ কিসের তোর রুম হ্যা?? আমার বাড়ি আমি যখন খুশি তখন যে সে রুমে যেতে পারবো। কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মতো থাক না। আর সবসময় এরকম মোল্লা সেজে কেন থাকস রে?? আর আমাকে দেখে এরকম নাক সিটকাস কেন??
শুভ্রাঃ ছাড়ুন আমার লাগছে চুলে। হিজাব পড়ে পর্দা করি বলে আপনার মোল্লা মনে হচ্ছে?? টাকা রোজকার করার উপায় নেই বলে বাধ্য হয়েছি লোকের বাড়িতে কাজ করার। নাহলে যে বাড়িতে এরকম ছেলে আছে সে বাড়িতে কাজ করার আমার দুমুঠো ইচ্ছে ও নেই।
সোহেলঃ বেশি পাকা পাকা কথা না?? পড়াশোনা কি করেছিস মনে হয় একটু তা নিয়ে এতো স্পষ্টবাদী?? তোর মুখ যদি না বন্ধ করি না…..
এই বলে সোহেল এগুতে যাবে তখন ই সে চিতকার করে উঠে
শুভ্রাঃ আয়ায়ায়ায়ায়া বাচাও বাচাও সাপ। ও আল্লাহ সাপ। আংকেল দেখ জানালায় সাপ পেচিয়ে বসে আছে।
সোহেল যেন শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। সে স্পষ্ট দেখছে যে জানালার কাচ বন্ধ। এসব চিন্তা করছে দেখে
শুভ্রা বলল ঃ নিজের মানসম্মান রক্ষা করতে চান তো বেরিয়ে যান এই রুম থেকে। খবরদার আমার সাথে পরবর্তীতে এরকম ব্যবহার করবেন না।
সোহেল রেগে প্রায় আগুন হয়ে গিয়েছে শুভ্রার কথা শুনে৷ হঠাৎ ই সজোরে ঠাসসসস করে চড় বসিয়ে দেয় শুভ্রার গালে।
সোহেলঃ আমার সাথে চালাকি?? তর দেমাগ যদি না আমি ছাড়িয়েছি আমার নাম সোহেল নয়। পরের বার যখন চালাকি করতে আসবি তখন চড় না এমন ব্যবস্থা করবো কাউকে মুখ দেখাতে পারবি নাহ।
এই বলে হন হন করে চলে চলে গেল সে শুভ্রার রুম থেকে। শুভ্রা জানে এই গরমে ফুল স্পিড ফ্যান দিয়ে তার আংকেল, আন্টি যে হারে ঘুমায় তাতে শুভ্রার সেই চিৎকার তাদের কানে যাবে না। কোনো মনে আজ বেচে গিয়েছে। }
রাতের ওসব স্মৃতিচারন করতে করতে শুভ্রা নাশতা নিয়ে সোহেলের দরজার সামনে এসে টুকা দিলো। ভিতর থেকে ঝাঝালো কন্ঠে ভেসে আসলোঃ দরজা খোলা।
ভেতরে সহসা ভয় পেলেও সে সাহস করে ঢুকে দেখে সোহেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। পেছন থেকে গিয়ে খাবারটা কোনোমতে টেবিলে রেখে দৌড় দিতে গেলেই পাশ থেকে হঠাৎ হাতটা মুচড়ে ধরে সোহেল। যেটার ভয় এতক্ষণ পাচ্ছিল। এখন সেটাই হলো । হাতটা আরো শক্ত করে ধরে সোহেল। শুভ্রার মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে হাতের কবজির হাড় গুলো গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে।
শুভ্রাঃআহ লাগছে আমার ছাড়েন ভায়া।
সোহেলঃ এতো ছাড়েন ছাড়েন কেন করিস রে? বিল্ডিং এর সবাই যেখানে আমার ঘা ঘেসতে চায় আর তুই কোন দেমাগে এতো বড়াই দেখাস? দু’টাকার কাজের লোক।
#চলবে
(বিঃদ্রঃআমি আজ জীবনের প্রথম গল্প লিখেছি। কেমন লেগেছে জানাবেন।আপনাদের অনুপ্রেরণা পেলে এর পরের পার্ট লিখবো।
ইনশাআল্লাহ)