#অচেনা_তুমি
#মহিমা_হাছনাত_মাহি
#পার্টঃ০৩
প্রায় দুইটার দিকে সোহেল হাসিমুখে বাড়ি ফিরলো। কলিং বেল চাপার কিছুক্ষন পর শুভ্রা এসে দরজা খুলে দিল। সোহেল দৌড়ে গিয়ে আগে তার মায়ের রুমে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে এক প্রকার ছোট চিতকার দিয়ে বলল
সোহেলঃ আম্মু আম্মু আম্মু!!!! জানো আজকে আমি চাকরি টা পেয়ে গিয়েছি। আজই প্রথম ইন্টারভিউ দিলাম আর আজই সিলেক্ট হয়ে গেলাম আর কাল থেকেই জয়েন করছি।
মিসেস লুতফাঃ উমমম দেখতে হবে না কার ছেলে ( একটা বিরাট ভাব নিয়ে) তা এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল সব? অসিফ কোথায়? আর বেতন কতো?
সোহেলঃ দাড়াও দাড়াও এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?? একটু থামো! অফিস আমাদের একদম কাছেই বোঝছ? আমার কেবিন থেকেই কিন্তু আমাদের বাড়ির সব রুম দেখা যায়।
মিসেস লুতফাঃ কি বলিস কি? হেয়ালি না করে বল তো আমায়।
সোহেল তার মা কে জানালার কাছে এসে পাশের বিল্ডিংটি দেখায়। এই দেখ এটাই আমার অফিস বোঝেছ? আর ওই ৪ তলার বাম পাশে যে রমটা দেখা যাচ্ছে সেটাই আমার কেবিন। আর জানো আমাকে ওখানকার মেনেজার হিসেবে সিলেক্ট করেছে। বেতন নগত ১ লাখ টাকা। ভাবতে পারছো মা!!! যেখানে আমি ৫০/৬০হাজারের ও আশা করিনি সেখানে ১ লাখ টাকা বুঝতে পারছো তুমি??
মিসেস লুতফা তো রীতিমতো ছেলের বেতনের কথা শুনে খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠেছে। যেখানে তিনি তার বিল্ডিংয়ে ভাড়া থেকে পান মাত্র ৭০ হাজার টাকা । আর মি.আনিসুর রহমান এর বেতন তো ৪০ হাজার টাকা মাত্র। ছেলের বেতনের কথা শুনে তো তেনার অহংকারে বড়ায়ে বুক ফুলে উঠেছে। তারপর তিনি গিয়ে ছেলের হাতে ৭/৮ হাজারের টাকার বান্ডিল গজিয়ে দিয়ে বললেন তার বন্ধুবান্ধব দের কে মিষ্টি মুখ করাতে আর বাড়ির জন্য কয়েক কেজি মিষ্টি আনতে। ফ্ল্যাট এর সবাইকে তো জানাতে হবে নাকি। শুকনো মুখে কি আর এতোবড় খবর সবাইকে জানানো যায়?
সোহেল তারপর ফ্রেশ হতে যায়। সে দুপুরের খাবার বাইর থেকে খেয়ে এসেছে তাই লুতফা বেগম আর আগ বাড়িয়ে আয়োজন করেন নি। ছেলেকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন কারন সে তার স্বভাব সবই পেয়েছে। বিকেলে সোহেল বের হয়ে যায়। সাদিয়া ও প্রাইভেট এ গিয়েছে। মি.আনিসুর রহমান গিয়েছে তার অফিসে। বাড়িতে লুতফা বেগম আর শুভ্রা ই রয়েছে।
বিকেলের সময় টাতে তেমন কোনো কাজের চাপ নেই আর বাড়িতেও কেও নেই। তাই সে ছাদে উঠেছে তার করা বাগান পরিচর্যা করতে। শুভ্রা এবাড়িতে কাজ করে প্রায় মাস সাতেক হলো । ছাদে যখন প্রথম এসে দেখে পুরো ছাদটাই খালি, কেমন ফাকা ফাকা লাগে। কারণ শুভ্রাদের বাড়িতে যে উঠান টা রয়েছে সেখানকার এক পাশে সে সবজি বাগান করেছিল আর আরেক পাশে হরেক রকমের ফুলের বাগান। তারপর সে মি.আনিসুর রহমান এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ছাদের চারদিকে দেওয়ালের কাচায় কাচায় বিভিন্ন সবজির চারা রোপণ করেছিল। এসব দেখে মিসেস লুতফা অবশ্য অনেক কটু কথা শুনিয়েছিল তবে পরবর্তীতে তিনি খেয়াল করলেন এতে তার ছাদটার আরো সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে। সেখানে যখন শুভ্রার যত্নে চারাগাছ গুলো তে টমেটো, বেগুল, ডেড়স, পেয়ারা, আম, বড়ই এসব ধরছে। তিনি তো মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছিল। মোটামুটি শুভ্রার কাজে তিনি ও মনে মনে বেশ খুশি। তবে তিনি তা প্রকাশ করেন না। বাইরের লোকের প্রতি আর বাড়তি আগ্রহ বা টান তেমন কিছুই তিনি পছন্দ করেন না।
শুভ্রা পানি নিয়ে চারাগাছ গুলোতে পানি দিচ্ছে। সে যখন পানি দিচ্ছলো দুটো চোখ যে তাকে সেই তখন থেকে তৃষ্ণার্তের মতো তাকিয়ে আছে তার শুভ্রার নিজের ও খেয়াল নেই।
অফিস আওয়ার শেষে সাদাফ এর ইচ্ছে হলো একটু ছাদে যেতে। ছাদে গেলে সেখান থেকে কক্সবাজারের সমুদ্র বেশ সুন্দর করেই দেখা যায়। তাই মাইন্ড ফ্রেশ হতে এসেছিল। আসার আগে সে পিয়নকে বলেছিল কফি নিয়ে যেতে। ছাদে উঠে কিছুক্ষন পর হাটাহাটি করার মধ্যেই কফি চলে এসেছে। কফিটা নিয়ে ছাদের এক কোনায় গিয়ে খানিকটা নিচে তাকাতেই চোখ আটকে যায় সকালের সেই মায়াপরীকে দেখে। কি সুন্দর পরম আবেশে গাছে পানি দিচ্ছে আর গাছের আগা-গোড়া খুটিয়ে খুটিয়ে খেয়াল করছে। মাঝেমধ্যে আবার গাছ থেকে কিছু নিচ্ছে ও। হালকা উচু আর একটু দূরে হওয়ার স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না।৷ শুভ্রা যে বিল্ডিংটা থাকে সেটা ৭ তলা আর সাদাফদের অফিস মোট ১০ তলা হলেও ৮ তলার অর্ধেক অফিসের অংশ আর অর্ধেক খোলা যায়গা বাকি অর্ধেক এর উপরের তলায় পানির ট্যাংক এর এক বিশাল জায়গা অবশ্য সেখানেও উঠার এবং বসার সুন্দর সুযোগ রয়েছে তারপর ট্যাংক এর উপরেও সিড়ি বেয়ে উঠতে পারে। ৮ তলায় উঠলেই মুটামুটি ভালোভাবে সমুদ্র দেখা যায় এখান থেকে।
শুভ্রা কাজ করতে করতে মনে হলো কেউ যেন আশেপাশে আছে কিংবা তাকে দেখছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, না তো! ছাদে তো কেও নেই। সে আবার তার কাজে মনোনিবেশ করবে তখনি তার চোখ যায় পাশের বাড়ির ছাদের দিকে।
সে দেখলো একজন ফর্সা করে লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক হাত পকেটে আর এক হাতে মগ নিয়ে ঠায় ছাদের কোনায় তার দিয়ে এক মনে তাকিয়ে আছে। লোকটার মুখের মধ্যে বিকেলের মিষ্টিরোদ এসে পড়তে তেমন অবয়ব বোঝা যাচ্ছে না। কোনো পুরুষ মানুষ তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে শুভ্রা বেশ অস্বস্তিবোধ করছে। সে তাৎক্ষনাত বাগানের জিনিসপত্র জায়গামতো রেখে একপ্রকার জোরে দৌড় দিতে লাগলো।
এদিকে যে কোনো কারন ছাড়াই সাদাফ শুভ্রার দিকে তাকিয়ে ছিল তা শুভ্রার চলে যাওয়ার পর নিজেই হচকচিয়ে উঠল।
সাদাফঃ ধ্যাত কি করছি আমি এসব সকাল থেকে। বারবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। এবার তো নিশ্চয় সে আমার এভাবে তাকিয়ে থাকাতে লজ্জা পেয়েছে।তাই এভাবে পালিয়েছে! পালিয়েছে?? লাইক সিরিয়াসলি?? আমাকে দেখেও কেউ পালায়??
–এক্সাক্টলি!! তোকে দেখেও কোনো মেয়ে পালারো রে!!!
পেছন থেকে মসকরার কন্ঠ ভেসে আসতেই সাদাফের বুঝতে কষ্ট হলো না যে কে? কক্সবাজার আসার সময় সে তার বন্ধু নাদিম কে নিয়ে এসেছিল সাথে। একদম ছোটবেলা থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ড তারা। বলতে গেলে জিগরি দোস্ত।
নাদিমঃ কি রে চুপ করে আছিস যে? কার দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিলি যে সে লজ্জায় এক্কেবারে পালিয়ে গেলো? এ ও হয়!! যে সাদাফ এর একটু চোখের আকর্ষণের জন্য মেয়েরা তার সামনে ঘুরঘুর করে। আর তার সামনে আসায় কেউ পালালো?? আবার যে সাদাফ আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে একনজর তাকানো তো দূরের কথা সে কিনা সেই সক্কাল থেকে তাকিয়ে আছিস?? কিরে মামা প্রেম ট্রেমে পড়ে গেলি নাকি?? অবশ্য পড়তেই পারিস। কক্সবাজারের মেয়ে গুলো কিন্তু সেই সুন্দর সুন্দর মামা (চোখ টিপ দিয়ে😉)
সাদাফঃ ফাইজলামো বন্ধ কর। সেই যে সকালে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার পর বেড়িয়ে গিয়েছিলি আর তো ফোনকল ও রিসিভ করার ফুসরত পাস নাই। কই ছিলি এতক্ষন??
নাদিমঃ আহ দোস্ত! বললাম না,,,কক্সবাজারের মেয়েগুলো কতো রূপবতী!!
সাদাফঃ শালা এখানেও এসে লুইচ্চাগিরি শুরু করে দিয়েছিস? এই কেমনে পারস বল তো তুই হ্যা?? চেনা নেই যানা নেই এমন জায়গায় গিয়েও ছক্কা মেরে দিয়ে আসিস তুই। আর এখন তো কক্সবাজার আমার সাথে এই বছরে ২ বার এলি। পটিয়ে ও ফেলতে পারিস তুই বটে!
নাদিমঃ কেন রে? আমি কি তোর চেয়ে কম সুন্দর নাকি রে?? কিসে তফাৎ আছে বলতো আমাদের দুজনের গড়নে? ও চেহারা টা একটু আলাদা এই আর কি। আর টাকা কি আমারো কম আছে নাকি রে? আমার বাবার যা টাকা আপাতত তোর ৩/৪ টা অফিস কিনে নেওয়ার ক্ষমতা ঠিক ই আছে।
সাদাফঃ হুম সব ই টাকা আর চেহারা!!! ( একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আজকালকার মেয়েদের কাছে শুধু টাকাটাই ফ্যাক্ট। ইমোশনস বলতে এখন কিছুই নেই। এই জন্যই তো আমি মেয়েদের তেমন পাত্তা দিই না। যার টাকা আছে শুধু তার কাছেই তারা সবসময় এট্রাক্টিভ হতে চায় তাকেই নিজে থেকে এসে ধরা দেয়।
নাদিমঃ তো দোস্ত তুই এমন কারে এভাবে পাত্তা দিলি যে, সে একদম লজ্জায় পালিয়ে গেল?
সাদাফঃআর বলিস না গাড়ি খারাপ হওয়ার পর একটু হাটছিলাম এমন সময় একটা মেয়ের সাথে আমার ধাক্কা লাগে। তুই নিজেও ভাবতে পারবি না মেয়েটা কেমন অদ্ভুত চাহনি দিয়ে তাকায়। তার চোখ গুলো আমায় বড্ড টেনেছিল। মনে হচ্ছে আমি তাকে চিনি । কিন্ত আমার জানা মতে এই কক্সবাজারে আমার কোনো আত্মীয় নেই। আর মেয়েটা কেমন অদ্ভুত। জানিস?আমার ওকে দেখে মনে হলো ও কোনো বাড়িতে কাজ করে। তবে তার কথাবার্তা আর চালচলন দেখে মোটেই বুঝা যাবে না যে সে কোনো বাড়ির কাজের লোক। আর অবাক করার বিষয় হলো,তখন আমার মুখ থেকে ভুল করে ইংরেজি বলে ফেলেছিলাম তাকে। ভেবেছিলাম সে বুঝবে না তাই বাংলা বলতে যাচ্ছি তখন সে আমাকে তার উত্তর দিয়ে চলে গেল।
নাদিমঃ কি বলিস কি রে?আমার তো এখন ব্যাপারটা কেমন লাগছে রে।
সাদাফঃ আর মেয়েটাও কেমন শুধু পালাই পালাই করে। তখনও তার উত্তর দিতে দেরি হয়েছে গায়েব হতে নয়। ভেবেছিলাম এখানে সব রহস্য শেষ। কিন্তু দেখি ৪ তলায় আমার অফিস আর বেডরুম থেকে অকে আবার দেখতে পেলাম তারপর এই ছাদে।
নাদিমঃ মামা আমার তো মনে হচ্ছে এই আমাদের ফিউচার ভাবি!!! যে সাদাফ দা গ্রেট ইগো ম্যান কোনো মেয়েকে পাত্তা দেয় না। সে আজ অপরিচিত একটা মেয়েকে দেখে এতোকিছু ভাবছে। আমার তো মনে হচ্ছে তোরে আমি সেই ধাক্কাধাক্কির লগে ঘর বাধতে দেখমু। মাগার সে তো দেখি কোনো বাড়ির কাজের লোক!
সাদাফঃ সস্তামার্কা কথা বলিস না নাদিম্মা। তুই জানিস আমি কারো ক্লাস দেখে বিচার বিবেচনা করি না। কাজের লোক আর বড়লোক, মানুষ তো মানুষই। আল্লাহ যার ভাগ্যে যা লিখেছেন তাই হবে।
নাদিমঃ মামা চেইত্তা যাচ্ছিস কেন। আমি তো তোরে নাইড়া দেখছি। তুই তো দেখি মামা ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস। একদিনের মধ্যেই এতো কিছু!দেখিস মিলাই নিস আমার কথা।এইসব টুকিটাকি কথা বলতে বলতে মাগরিবের আজান দেয়। তারা তাদের কাজে চলে যায়।
এদিকে শুভ্রা বাড়িতে এসে দেখে এতক্ষনে মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে মিসেস লুতফা হৈহুল্লুড় শুরু করে দিয়েছে। শুভ্রাকে দেখা মাত্রই একপ্রকার ঝাড়ি দিয়েছেন “কাজের সময় কোথায় যাস রে তুই?খালি ফাকি দেওয়ার ধান্দা না!টাকা নেওয়ার সময় তো টাইমের গাফিলতি হয় না।এই দিকে কাজ করার সময় ঠিক ই উধাও। আয় আমাকে হেল্প কর ” এই বলে শুভ্রাকে এক গাদা কথা শুনিয়ে চলে গেলেন।
#চলবে।