#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ০৫
দুপুর বেলা কলিং বেল বাজতেই শুভ্রা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দেখে সোহেল এসেছে। সাথে একটা সুন্দর করে লম্বা মেয়ে। শাড়ি পড়েছে, চুলগুলো উন্মুক্ত খোলা। সোহেল মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ঢুকে সোজা তার রোমে নিয়ে গেলো। শুভ্রা ভেবেছে হয়তো সোহেলের কোনো কলিগ বন্ধুকে নিয়ে এসেছে। তাই সে রান্নাঘরে গিয়ে দুপুরের খাবার নিয়ে আসলো। তারপর কিছু নাস্তা ও তৈরি করে রেখেছে। সময় পেরিয়ে ঘন্টা হতে চলল তাদের রুম থেকে বের হওয়ার নাম গন্ধ নেই। শুভ্রার এবার নিজের ই খিদে লেগে যাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে নিজে রান্নাঘরে বসে খেয়ে নিল। ইতিমধ্যে আসরের আজান দিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা গিয়ে আসরের নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ শেষে শুভ্রা ড্রয়িং রুনে এসে দেখলো খাবার তো সেই কখন থেকে যেমন দিয়েছিল তেমন ই রয়ে গেলো। সোহেল শুভ্রার উপর চেচামেচি করবে এই ভেবে অগত্যা ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে সোহেলের রোমের সামনে এসে দাড়াতেই যে দৃশ্য দেখলো তাতে সে রীতিমতো কাপাকাপি শুরু করে দিলো। হাতে থাকা নাস্তার কাপের প্লেটের ঝনঝন আওয়াজে সোহেল আর মেয়েটির হোশ ফিরলো। শুভ্রাকে দেখা মাত্রই সে তার শাড়ি ঠিক করে নিতে লাগলো। সোহেল আর মেয়েটি খুবই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় একে অপরের কাছে ছিল। এমন দৃশ্য৷ শুভ্রা কখনোই দেখে নি তাও আবার বাস্তবিক জিবনে না ই। সোহেল আর মেয়েটি এতোই উন্মাদ ছিল যে দরজাটা লক করতেই ভুলে গিয়েছিল। বাড়িতে একজন লোক আছে এটা যেন তার মাথাই নেই ই। সোহেল দৌড়ে এসে সটান শুভ্রা কে জুরে দুই গালে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে দিলো।
সোহেলঃ ঠাসসসসসসস। লজ্জা করে না এভাবে অনুমতি ছাড়া অন্যের রুমের সামনে আসতে? এসব ন্যাকামি আগ বাড়িয়ে তোকে কে করতে বলেছে?? আমি বলেছিলাম তোকে?? বাড়িতে কেউ নেই বলে সাপের পাচ পা দেখেছিস না?? যা এখনই বেড়িয়ে যা। দূর হো বলছি চোখের সামনে থেকে।
শুভ্রা কিছু না বলেই নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ট্রে টা গিয়ে টেবিলে রেখে দৌড়ে চলে গেলো।
বিকেলের আবছা সূয্যি মামা সাগরের সাথে প্রায় মিশে মিয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের এই দিকটা একেবারে নির্জন৷ একেবারে কেউ নেই বললেই চলে। মাঝে মধ্যে স্কুল পড়ুয়া কাপল আসে। তাও স্কুল টাইমে। তবে আজ একেবারে লোকসমাগমহীন পূর্ণ হয়ে রয়েছে জায়গাটা। হয়তো আজ পরিস্থিতি আর পরিবেশ টা সময়টা শুধু শুভ্রাকেই দিতে চায়। যখনি শুভ্রার মন খারাপ হয় তখনই সে এখানে এসে বসে থাকে। আজ শুভ্রার ইচ্ছে করছে মন উজাড় করে কাদতে। কি দোষ করেছে যে আল্লাহ তাকে এভাবে পরিক্ষা নিচ্ছে।
শুভ্রাঃ হায় আল্লাহ!!! তুমি আমার সহায়। আল্লাহ আমার মুক্তি চাই। এই জীবন থেকে আমায় মুক্তি দাও তুমি। আমি তো আর সহ্য করতে পারছি নাহ। আমার যে খুব কষ্ট হয়।
এই বলে কাদতে কাদতে প্রায় গলা ধরে আসছে তার। কাদতে কাদতে তার প্রায় পানির পিপাসা লেগে গিয়েছে। কাদতে কাদতে একপর্যায়ে তার হেচকি উঠতে শুরু হয়ে গেলো। তবুও তার কান্নার শেষ নেই।
এই নিন জল। একটু গলা ভিজন। ভালো লাগবে।
শুভ্রার সামনে পানির বোতল দেখে মনে হলো এক ঢুকেই বোতলের সব পানি শেষ করে দিতে পারবে।
পানি খেতে খেতে মনে হলো কোনো পুরুষ তাকে পানির বোতলটি দিয়েছে। খেতে খেতে সামনে লক্ষ করে দেখলো সাদাফ একটা হাত পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাতে একটা রুমাল নিয়ে শুভ্রার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন হাজারো উত্তেজনা, হাজারো প্রশ্ন তার চোখে। সাদাফকে দেখামাত্রই শুভার বিষম পেয়ে গেল। কাশতে কাশতে মেয়েটার দম যায় অবস্থা।
সাদাফঃ কুল কুল। রিলেক্স!! আমি তো কোনো বাঘ ভাল্লুক নই, আমায় দেখলেই এমন করে উঠেন আপনি। সমস্যা নেই, আর ভয় ও নেই। একা মেয়ে মানুষ বলে আমি কিছুই করবো নাহ। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন মিস শুভ্রা।
সাদাফের মুখে মিস শুভ্রা শুনে এবার সে সাদাফের চুখে চুখে তাকায় সে।
সাদাফঃ আরে ওইদিন যে আপনি বিকাশের দোকানে গিয়েছিলেন, দোকানদার আপনার নাম ধরে ডেকেছিল সেখান থেকেই জানা।
সাদাফ যে শুভ্রার নাম জেনেছিল তাতে শুভ্রা মোটেও অবাক হই নি। অবাক হয়েছে এটা দেখে যে, এই প্রথম কেউ তাকে মিস.শুভ্রা বলে এতো শ্রদ্ধাময় কন্ঠে ডেকেছে। শুভ্রার তাকিয়ে থাকা দেখে সাদাফ তার দিকে রুমাল টা এগিয়ে দিলো।
সাদাফঃ এই নিন চোখ মুখ মুছে নিন। মুখের কি অবস্থা হছে জানেন তো? পুরো ফুলে এক্কেবারে লাল গোলাপ জাম হয়ে গিয়েছে। আর চোখ দুটু তো এক্কেবারে লালে টইটম্বুর করছে। এই নিন নিন। ( শুভ্রাকে সহজ হতে দেওয়ার জন্যই বলা)
শুভ্রা প্রথমে নিতে চাইনি। তারপর সাদাফ জোর করেই শুভ্রার হাতে রুমাল টা গুজে দেয় তারপর চোখমুখ মুছে নিতে বলে। শুভ্রা আস্তে আস্তে তার মুখ মুছে এবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
সাদাফ শুভ্রার দিকে তাকিয়ে দেখে ধবধবে সাদা মুখটায় দুই গালের দুই পাশে আবারও চার আংগুল এর স্পষ্ট ছাপ। দেখা মাত্রই এক অজানা রাগে তার চোখমুখ গরম হতে লাগলো।
সাদাফঃ তা মিস পালাই পালাই? প্রতিদিন কি মশা মেরে মেরে এভাবে গাল দুটো লাল করে রাখেন নাকি?
শুভ্রা সাদাফের কথা শুনে পুরোই লজ্জা পেয়ে গেলো। এতো বড় মেয়ের গালে কারো থাপ্পড়ের ছাপ ফুটে উঠা মোটেই মানসম্মানের ব্যাপার নয়। তাও শুভ্রা ভালোই বুঝতে পেরেছে যে তাকে অস্বস্তিতে না ফেলার জন্যই কথাটা এভাবে বলা। প্রসঙ্গ কাটাতে শুভ্রা এবার মুখ খুললো।
সুভ্রাঃ মিস. পালাই পালাই?? আপনার কোন এংগেল থেকে আমাকে মনে হয় যে আমাই পালাই কিংবা পালানো আমার স্বাভাব?? মি…..
সেদিনের এর এক্সিডেন্টলি সরি বলার পর সাদাফ শুভ্রার মুখ থেকে টু কথাটি ও শুনেনি আর। আজ আবার তার কান্না জড়িত কন্ঠ শুনে দ্বিতীয়দফা ক্রাশ খেল সে। নিজেকে সামলে তারপর বলল
সাদাফঃ- সাদাফ, সাদাফ। আমার নাম সাদাফ মাহমুদ চৌধুরী। আর আমি যখনই আপনাকে দেখি কিংবা আপনি আমাকে দেখেন তখনই কেমন পালিয়ে যান। কারণ টা কি জানতে পারি।
শুভ্রা এবার বুঝতে পারে তাকে মিস.পালাই বলার কারণ টা কি।
শুভ্রাঃ আসলে পরপুরুষ দের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি। যথা সম্ভব কাজের কাজ করতে হলে তখনই প্রয়োজন পড়লেই কথা বলি। অযথা কথা বলে আমি সময় আর কাজ দুটোই ব্যয় করতে চাই না।
সাদাফঃ তাই বলে সেদিন সরি বলার টাইম টাই তো দিলেন না। আসলে সেদিন ভুল আমারই ছিলো। আমিই বেখেয়ালি না দেখে ধাক্কা দিয়ে দিয়েছিলাম। আর সরি বললেন আপনি।
শুভ্রাঃ ইটস অকে। আসলে সেদিন বাজার করতে করতে আমার অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই আমার ধাক্কা লাগাতে সরি বলেই ধ্রুত চলে আসি। আসলে অন্যের বাড়িতে কাজ করি তো। সময়ে সময়ে হিসেব দিতে হয় তাদের।
সাদাফঃ এমন কসাই দের বাড়িতে কাজ না করলেই তো হয় ।
শুভ্রাঃ জ্বি??
সাদাফঃ বলছি যে যে বাড়িতে কাজ করে ডেইলি মশার জন্য আপনার চড় খেতে হয় সে বাড়িতে কাজ না করলেই তো হয়।
শুভ্রা সাদাফের কথা শুনে মেকি হেসে সমুদ্রের ঢেউ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাদাফ ও শুভ্রার দৃষ্টি অনুসরণ করে সমুদ্রের দিকে তাকায়৷
শুভ্রাঃ আমার যা যোগ্যতা তার জন্য তো আমাকে আমাকে মশার কামড় থেকেই যে করে হোক বাচার জন্য চড় খেতে হবে মি.চৌধুরী।
সাদাফঃকেন? আপনি কি একদম পুরোপুরি ই অশিক্ষিত নাকি যে আপনার অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হবে আর রোজ রোজ তাদের অত্যাচার সহ্য করতে হবে??
শুভ্রাঃ আপাতত আমার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা তা দিয়ে বাংলাদেশে এটাই চলে৷ তাও তার আমাকে ভালো ই মাইনে দেয়৷ অন্তত আমার পরিবার তো চলে।
সাদাফঃ কেন? আপনার পড়াশোনা কদ্দুর। দরকার পড়লে আমি আপনাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিবো৷
শুভ্রাঃ আপনার মনে হয় না একজন অপরিচিত কারো জন্য একটু বেশি ওয়ারিড?
সাদাফঃ কে বললো আপনি অপরিচিত? এইতো আমাদের ইতিমধ্যে ৩/৪ বার দেখা হলো । আর আজ তো আপনার সাথে বেশ ভালোই কথা হলো৷
শুভ্রাঃআচ্ছা আজ আসি আমি। মাগরীবের আজান দিচ্ছে৷ বাড়ি যেতে হবে ।
সাদাফঃ চলুন আমি আপনাকে এগিয়ে দিই।
শুভ্রাঃনা না তার দরকার নেই। আমি একা এসেছি একাই যেতে পারবো।
সাদাফঃ মিসেস শুভ্রা। আপনি কি আমাকে এভয়েড করতে চাচ্ছেন? আমি বলেছি আপনাকে। আপনি আমাকে নিরদ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারেন। আপনার বিশ্বাসের গাফিলতি করবো না আমি। কিনবা আপনার কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবো না। আপনি ভেবে দেখতে পারেন।
শুভ্রা কিছু না বলেই একদৃষ্টিতে সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদাফের চোখের চাহনি জানান দিচ্ছে সে যেন সত্যিই বলছে৷ একবার হলেও সাসাফের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্ত পরেক্ষনে সোহেলের কথা মনে পড়তেই গা তার ঘিন ঘিন করে উঠলো। মস্তিষ্ক শুধু একটা কথাই জানান দিলো নিজের রক্তের সম্পর্ক ছাড়া পৃথিবীতে কেও আপন নয় কেউ নাহ। তারপর সেখান থেকে দৌড়ে চলে আসে৷
এদিকে আজ সাদাফের মা বাবা কক্সবাজার আসবে। সাদাফের বাবার বাতের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। কক্সবাজারে খুব নামি একজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন । ছেলে ও কক্সবাজার থাকাতে তাদের বেশ সুবিধাই হয়েছে। বিচ থেকে রুমে আসার পর নাদিম আর সাদাফ বের হলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য। আজ রাতেই তারা ল্যান্ড করছেন।
শুভ্রা বাড়ি গিয়ে দেখলো দরজা খুলা। ঢুকে গিয়ে দেখে দুপুরের খাবার যেরকম রেখে গিয়েছে সেরকম ই রয়ে গেলো। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো না সোহেল বাড়ি ফিরলো না বাড়ির অন্যান্য সদস্য! রাত ১২ টার পর সোহেল বাড়িতে আসে। তারপর কটমট করে নিজের রুমে ঢুকে ধরাম করে দরজা লক করে দেয়। শুভ্রা দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের রোমে চলে যায় ঘুমাতে। রাত প্রায় অনেক গভির। শুভ্রা অনুভব করলো কেউ তার পেটের দিকে খুব খারাপ ভাবে জুরে চেপে ধরেছে। সময়ের সাথে সাথে মনে হলো কেউ তার নরন পেটটা পিষে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। এদিকে অন্ধকারে সে কিছুই দেখছে না। শুভ্রা সুয়া উঠার শক্তিই পাচ্ছে না যেভাবে তাকে আটকে ধরা হয়েছে। কোনো মতে নখের খামছি মেরে উঠে আগে গিয়ে সে লাইট জালায়। লাইট জ্বালানোর সাথে সাথেই ফুটে উঠে সোহেলের অই হিংস্র মুখ।
শুভ্রার ভালো করেই মনে আছে সে দরজায় লক করে ঘুমিয়ে ছিল। তবে কি….. দরজার দিকে তাকাতেই দেখে সেখানে চাবি ঝুলনো সোহেল শুভ্রার চিন্তার ভিতর দিয়ে কাছে যেতেই সে চিতকার করে উঠে
শুভ্রাঃ খবরদার আমার কাছে এসে আমাকে ধরার চেষ্টা করেন তো।
সাদাফ জুড়ে এগিয়ে এসে শুভ্রার হিজাবের উপর চুলের মুঠি ধরে বললঃ কি করবি রে দু টাকার কাজের লোক? তোর কি সাধ্য আমাকে আটকানোর। দুপুরে তো সব কিছু ভেস্তে দিলি। আর যদি ভুলেও এসব কথা যদি বাইরে বলতে যাস আজ যা দেখেছিস তোকে সেদিন ই মেরে পুতে ফেলবো। তার ধারনাই নেই আমি কি করতে পারি তোর সাথে।সারাদিন পুরো মুড টাই খারাপ করে আরামে ঘুমোচ্ছিস? এবার তোকে দিয়ে মিটাই সেই সাধ। অবশ্য তুই ও তো রুপে কম যাস না। কিছু না হয় টাকা টিপস হিসেবে দিয়ে দিবো আজ!!
শুভ্রা এবার গলা ফাটিয়ে চিতকার দিয়ে উঠে। সোহেল গিয়ে শুভ্রার গালে শক্ত করে চেপে ধরে বলে। খবরদার আরেকবার চিল্লাবি তো।কাজ করার জন্য যখন এবাড়িতে থাকিস মালিক কে তো খুশি রাখা তোর কর্তব্য। এরকম বলে প্রায় দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। সোহেল শুভ্রাকে থাপ্পড় মারছে, হাত দিয়ে এভাবে শক্ত করে বার বার তার গায়ে ছোচ্ছিল পুরো দাগ বসে যাচ্ছে। তার ওপির সোহেল শুভ্রার নরম ওই শরীরে নখের খামছি বসিয়ে দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে শুভ্রা কোনো মতে সোহেলকে রোমের বাইরে নিয়ে যায় আর দৌড়ে এসে সটান দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
#চলবে।