#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ১৮।
সাদাফের সাথে শুভ্রার বিয়ের কথা শুনে ইলিয়ানার শুভ্রার সাথে ভালোই রেশারেশি শুরু হয়েছে। এসেছে থেকেই সাদাফের অনুপস্থিতিতে শুভ্রাকে মোল্লা, বেগডেটেট, বাটু বলে বলে বলে খুচা দিচ্ছে। শুভ্রা এসব শুনে চুপচাপ থাকলেও কুবরা ঠিকই তার পালটা জবাব দিচ্ছে।
এক পর্যায়ে কুবরার সাথে না পেরে রুমে গিয়ে গুপটি মেরে বসে থাকে। পিছু পিছু তার ভাই আবির ও যায়।
আবিরঃ কেন শুধু শুধু মেয়েটার পেছনে লেগেছিস বল তো।সাদাফ তো তাকে ভালোবেসেই
বিয়ে করছে।
ইলিয়ানাঃ দেখ ভায়া জ্ঞান দিতে আসিস না তো।
আবিরঃ তুই জেদ করিস না। দেখ ইলু আমি, আম্মু, আব্বু ভালো করেই জানি যে তুই সাদাফকে ভালোবাসিস না। দুদিন আগেই কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি সেটা ধরা খেয়েছিস। মাসে তো কয়টা পাল্টাস সেটারও হিসেব নেই। আর সেই তুই আমাদেরকে বলবি তুই সাদাফকে ভালোবাসিস আর সেটা আমারা মেনে নিবো? আর কেউ জানুন না জানুন আমি অন্তত তোকে ভালো চিনি।
ইলিয়ানাঃ হলো তো শুরু আলিবাবার জ্ঞান! দেখ এসব দুনিয়াবি জিবনে ভালবাসা টাসা না কিচ্ছু ম্যাটার করে না। টাকা পয়সা ই সব। যার বেশি টাকা পয়সা, সে ই ভালোবাসা। আর ওই মেয়ের চেয়ে আমি কি কম? আমার কতো ফেম, গ্লেমার, হ্যা হতে পারে আমার বাবার টাকা পয়সা সাদাফদের তুলনায় চেয়ে কম, তাই বলে কি আমি কি ওই শুভ্রার মতো ফকিরের মতো থাকি নাকি? আমি যথেষ্ট মডার্ন, স্টাইল আর এট্রাক্টিভ। ( ভাব নিয়ে)
আবিরঃ টাকা পয়সা আর নেইম ফেইম ই কি সব কিছু রে?? এসবের পেছনে পড়ে আছিস বলেই তো মাছির মতো তোর পেছনে ছেলেরা ভো ভো করে।
ইলিয়ানাঃ ধুর ছাড় তো। আবাইল্লা জ্ঞান দিস না তো। ভেবে দেখ এসব কিছু সম্পত্তির মালিক সাদাফ। একবার যদি আমি ওর বউ হতে পারি তাহলে সবকিছু তো আমারই হবে। আর আমি তো ওই মেয়ের সাথে সাদাফের বিয়ে কিছুতেই হতে দিবো না। এই বিয়ে আমি ভেঙেই ছাড়বো।
।এদিকে যে দরজার উপারে একজন দাড়িয়ে তাদের সব কথা শুনছে তা তাদের ধারণারও বাইরে। বাকা হাসি দিয়ে তাদের কথা শেষ হলেই চলে যায়।
রাতে খাওয়ার সময় সবাইকে যখন খাবার দিচ্ছিলো শুভ্রা তখন ইলিয়ানার কাছে ডাল দিতে গিয়ে ইলিয়ানা শুভ্রাকে হাতের বাহুতে ধাক্কা দেয়।
শুভ্রা ধাক্কা লাগার সাথে সাথে বাটি টা যেন ইলিয়ানার গায়ে না পড়ে তাই নিজের দিকেই বাটিটা আনায় গরম ডাল সবগুলো বাটিশুদ্ধ শুভ্রার পায়ে পরে।
টাল সামলাতে না পেরে কিছু ডাল ইলিয়ানার পায়ে পরে। তবু সে জুতো পড়েছিলো বলে পায়ে লাগে নি।
একটু গরম লাগাতেই ইলিয়ানা চিৎকার দিয়ে উঠে।
ইলিয়ানাঃ আয়ায়ায়ায়া। এই মেয়ে তুমি কাজ করতে পারো না তো করো কেন?? এমনি তো এসেছি থেকে দেখছি সবাই তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই তোমার কাজ। ওওও বুঝেছি তুমি ইচ্ছে করেই আমার পায়ে ফেলেছ। আমি জানি।
কুবরাঃ এই আপু তুমি একদম মিথ্যা কথা বলবা না। আমি দেখেছি তুমি আপ্পিকে ধাক্কা দিয়েছ। আসলে তুমি ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিয়েছ এসব বলার জন্য৷
এই দিকে গরম ডাল পড়ে শুভ্রার পা দুটো পুড়ে লাল হয়ে থাকা সত্ত্বেও আহহ ছাড়া টু টি ও আওয়াজ করে নি। জ্বালা করায় চোখে শুধু একটু পানি এসেছিল। ইলিয়ানা, কুবরার কথা কাটাকাটিতে শুভ্রার দিকে কারো খেয়াল ই ছিলো না।
সাদাফ শুভ্রার দিকে তাকিয়েই দৌড়ে চেয়ার থেকে উঠে আসে শুভ্রার দিকে।
সাদাফঃ শুভি কি হয়েছে।
সাদাফ এসেই দেখে শুভ্রার সাদা পা গুলো গরম ডাল পড়ে লাল হয়ে আছে। অথচ চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।
সাদাফঃ শুভি!!! একি করেছো তুমি?? তোমার পা টা কতো পুড়ে গেছে দেখেছ??
শুভ্রাঃ কিছু হবে না। আপনি বসুন আমি এগুলো পরিষ্কার করে নিচ্ছি।
এই বলে হাটতে নিলে পোড়ার জ্বালায় শুভ্রা আর পা চালাতে পারছে না।
সাদাফঃ এতো পাকামি কে করতে বলে তোমাকে৷
এই বলে সাদাফ শুভ্রাকে কোলে তুলে নিয়ে সোফায় রাখে। কুবরা গিয়ে ঠান্ডা পানি নিয়ে এসে শুভ্রার পা ধুয়ে দেয়। সাদাফ এন্টিসেপ্টিক লাগানোর জন্য শুভ্রার পায়ের দিকে হাত দিতে গেলেই শুভ্রা বার বার পা টেনে নেয়। এবার সাদাফ পা ধরে টেনে আলতো হাতে শুভ্রাকে মলম লাগিয়ে দেয়।
এই দৃশ্য দেখে ইলিয়ানা তো জ্বলে পুরো আগুন হয়ে যাচ্ছে। গিয়েছিল শুভ্রাকে আঘাত করতে আর পরিনামে হলো কি।
ইলিয়ানাঃ আয়ায়ায়া স্যাডি তোমার ফিয়েন্স তো আমার পায়ে ডাল ফেলে পুরো লাল করিয়ে দিলো। মম আমার তো খুব জ্বলছে পায়ে। স্যাডি আমার পায়ে একটু দাও না।
সাদাফঃতুমি তো জুতো পড়েছ ইলিয়ানা তাহলে তোমার পায়ে পড়লো কই। আর যদি পড়েই থাকে তাহলে এই নাও নিজ দায়িত্বে লাগিয়ে নাও।
ইলিয়ানাঃ স্যাডি। তুমি শুভ্রাকে মলম লাগাতে পারলে আমাকে কেন পারবে না?
সাদাফঃ বিকজ সি ইস মাই ফিয়েন্স অলসো সি ইন ইনফ্রন্ট অফ মি। এবং আমি আগেও শুভ্রা ছাড়া কোনো মেয়ের গায়ে হাত দেইই নি আজও অন্য মেয়ের গায়ে হাত লাগাবো না।
ইলিয়ানা সাদাফের কথা শুনে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো।
সাদাফঃআরেকটা ইম্পোরটেন্ট কথা। আমার আপাতত এখানকার কাজ সব শেষ আমারা কালই ঢাকা ব্যাক করছি। আমি সবার জন্য টিকেট কেটে রাখছি। আর খালামনি তোমারাও কি একসাথে আমাদের সাথে যাবে মানে সামনেই তো বিয়ে। তাই একেবারে গেলে মন্দ হতো না। চলো না আমাদের সাথে।
সাদাফের মা তো ছেলের এসব কথায় বিশ্বাস ই করতে পারছেন না। তবে কি এসব সে সত্যি সত্যিই বলছে।
অন্যদিকে শুভ্রার মায়ের মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না।
তিনি আপাতত চুপ আছেন সাদাফের বাবা ইলিয়ানার ব্যাপারটা উনাকে ভালোভাবে বুঝিয়েছেন তাই।
ইলিয়ানার মাঃ বিয়ে যখন, তখন অবশ্যই যাবো। তবে আমাদের ও তো তৈরির ব্যাপার স্যাপার আছে তাই না। আমরা না হয় গোছগাছ করে কয়েকদিন পর যাবো।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে ফেলেছে।
পরদিন সকাল বেলা ইলিয়ানারা নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়ে। ইলিয়ানাও আর শুভ্রার সাথে ঝামেলা করার সুযোগ পাই নি। তবে সে সাদাফদের সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মা আর ভাই এক প্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে গেলো। সাদাফদের ফ্লাইট ২ টাই এখনো অনেক দেরি আছে।
ইলিয়ানারা চলে যেতে নিলেই সাদাফের মা আগে সাদাফের কান টেনে ধরে।
সাদাফঃ আহ আহহ আম্মু….. ছাড়ো আমার ব্যাথা লাগছে তো। এতো গুলো মানুষের সামনে তুমি কান টানছো। আমি তো এখন বড় হয়ে গিয়েছি।
সাদাফের মাঃ শয়তান ছেলে……. লাগুগ। একশবার ধরবো কান। কিইই কি করবি তুই?? বিয়ে করবি?? আমাদের না জানিয়ে তুই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে? আমরা কি মরে গিয়েছি?? আমরা থাকতে তুই যাকে খুশি তাকে বিয়ে করতে পারবি বলে মনে হয়??
শুভ্রা তো মনে মনেই শেষ। তবে কি মামনি আমায় মেনে নিবে না? সত্যি তারা রাজি হবে না। মনে মনে এসব ভাবতে থাকে শুভ্রা।
এদিকে শুভ্রার মা ও শুভ্রার কান টেনে ধরে।
শুভ্রার মাঃ কি রে টাউনে পাঠিয়ে খুব চালাক হয়ে গিয়েছিস না?? আমাদের ছাড়াই নিজেরা পাকা কথা ঠিক করে ফেলেছিস।
সাদাফের মাঃ পাকা কথা কি বলিস রে নাজু ডিরেক্ট বিয়ের ডেইট ও ফিক্স করে ফেলেছে। কেমন সাহস দেখেছিস। আমি বেচে থাকতে এই বিয়ে কখনোই হতে দিবো না।
শুভ্রার মাঃ আমাকে কোন ঠেলায় পাইছে যে আমি আমার মেয়েকে তোমার মেয়ের সাথে বিয়ে দিবো? এই বিয়ে টিয়ে আমি কিচ্ছু মানি না।
কুবরা আর নাদিম তো অবাক হয়ে আছে। তারা বেশ খুশি হয়েছিলো তাদের বিয়ের কথা শুনে। শেষ মেশ কিনা আম্মু রাই ভিলেন হয়ে সাধলো!! ।
সাদাফের তো বিশ্বাসই হচ্ছে না এসব কথা তার মা বলছে। করুন চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মন টা পুরাই মরে গেছে দুইজনের দুই মায়ের কথা শুনে।
ছেলেমেয়ের মুখের এমন অবস্থা দেখে দুই মা ই ভুবন কাপানো হাসিতে ফেটে পড়লেন। বাকি সবাই তো আগের মতোই অবাক হয়ে তাকি আছে তাদের মতো। বেশ কিছুক্ষন হয়ে গেলেও তাদের হাসি থামছে না। এবার সাদাফের বাবা এসে মুখ খুললেন।
সাদাফের বাবাঃ তোমরা যে হারে স্টার জলসা দেখো এখন তো দেখছি ভালো অভিনেত্রী হয়ে যাবা। এতো ভালো অভিনয় করে দিলে তো আমার বাচ্চাগুলোর মন ভাঙিয়ে। একটু ও কি করে আটকালো না বলোতো তোমাদের এই নাটক করতে। আমি শুধু দেখছি আর কি।
সাদাফের বাবার কথা গুলো যেন শুভ্রা,কুবরা, নাদিম, সাদাফের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
সাদাফঃ এক মিনিট, নাটক মানে। এসব কি হচ্ছে। আর আম্মু এভাভে হাসছো কেন? দেখো আম্মু একদম হেয়ালি করবে না।
সাদাফের মাঃ ওরে আমার পাগল ছেলে আমারা যে তোদের সিদ্ধান্তে কতো খুশি হয়েছি তা বলার মতো না। আমরা তো অনেক আগেই তোদের বিয়ের কথাবার্তা বলছিলাম। শুধু তুই রাগ করবি বলে বলতে পারি নি। আর এখন জেনে তো খুশিতে বাধ সাধছে না।
সাদাফ মায়ের কথা শুনে খুশি হবে কিনা রাগ দেখাবে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে শুভ্রা উপর দিয়ে কোনো রিয়েক্ট না করলেও মনে মনে খুব স্বস্তি ফিল করছে।
সাদাফঃ এসবের কোনো মানে ছিলো আম্মু?? কতো টেনশন এ ফেলে দিয়েছ বলোতো??
সাদাফের মাঃ আরে টিপিকাল মায়েদের মতো একটু ভিলেন সাজতে হবে না। আর এরকম না করলে বুঝতি কি করে আমরা কতো ভালো অভিনেত্রী ( ভাব নিয়ে)
সাদাফঃ হ্যা হ্যা তোমাদের ভালো অভিনয় দেখিয়ে আমাদের তো পরানের পাখি উড়িয়ে দিচ্ছিলে।
সাদাফের মাঃ বাব্বাহ। ছেলে আমার এখন বিয়ের জন্য কত্তো পাগল হয়ে যাচ্ছে। বলি আগে তো বিয়ের কথা বললেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতি। বলি শুভামা কি যাদু করেছিস রে আমার ছেলেটাকে?? ( ভ্রু নাচিয়ে)
সাদাফ তো লজ্জায় হেসে মাথা চুলকাচ্ছে আরেকবার শুভ্রার দিকে তাকাচ্ছে। বেচারি লজ্জাত পুরো মিইয়ে গিয়েছে।
সাদাফের মা এবার শুভ্রার কাছে এসে বললেনঃ তোকে তো আমি সেই প্রথম দিন থেকেই নিজের ছেলের বউ হিসেবে ভেবে নিয়েছিলাম। তুই তো আমাদের পরিবারকে মিলিয়ে দেওয়ার একমাত্র উছিলা। তুই নিজেও জানিস না যে তুই আমাদের কতো খুশি করেছস। ওরে তোকে যদি আমি পুত্রবধূ হিসেবে পাই এটা তো আমার ভাগ্য। কিরে তুই পারবি না আমার ঘর আলো করে আসতে?? ( শুভ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে)
শুভ্রা শুধু মুচকি হেসে মাথা নিচু করে নেয়।
সাদাফের মা এবার শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে।
শুভ্রার মা এবার সাদাফের কাছে গিয়ে বলেঃ তোকে আমি তোর মায়ের মতো করে বড় করেছি। বড়বেলায় না থাকলে ও ছোট বেলায় ঠিকি আমি তোকে মানুষ করেছি। তোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমি আমার মাতৃত্যকে অনুভব করেছি। তোর উপর আমার পুরো ভরসা আছে। কিরে পারবি না আমার মেয়েটাকে সারাজীবন আগলে রাখতে??
সাদাফ এবার শুভ্রার মায়ের হাত নিজের হাতে তুলে ধরে বলেঃ এই হাত দিয়ে যেদিন আমাকে ধরেছিলেন সেদিনই আমার তোমাকে খুব কাছের মনে হয়েছিল। খুব আপন মনে হয়েছিল। একজন আপনজনের কথা কি করে ফেলা যায়। এই আমি কথা দিলাম তোমার মেয়েকে সারাজীবনের জন্য সঙ্গী করে নিবো আমি। কখনো এক মুহূর্তের জন্য ছাড়বো না।
এই বলেই সাদাফ শুভ্রার মাকে জড়িয়ে ধরে।
সাদাফের বাবাঃ বাব্বাহ এখন আমিই একা হয়ে গেলাম। আমি তাহলে কারো জন্য নয়।
কুবরাঃ কেন আমি আছি না। এক মেয়ে নেই তো কি হয়েছে আরেক মেয়ে তো আছে।
নাদিমঃ আর আমিও বা বাদ যাই কেন হুম?? এক ছেলে নেই তো কি হয়েছে আমি তো আছি।
এই বলে সকলে মিলে একটা আনন্দের হাসি দিয়ে উঠলো। আজ যেন সত্যিই পরিবারটাকে পরিপূর্ণ সুখি পরিবার মনে হচ্ছে।
#চলবে।