#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৩৩
আজ পৌষ মাসের প্রথম দিন। পরিবেশ টা কেমন শীত শীত আমেজে ভরে উঠেছে। তবু ভ্যাপসা গরম তো সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লেগে থাকা। বিলের পর একটু একটু শীত শীত অনুভব হয়।
পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। শত শত পাখির ঝাক পশ্চিম থেকে পূর্ব আর পূর্ব থেকে পশ্চিম ডানা মিলে দিচ্ছে উড়ান। শীতময় হালকা বাতাস বসে চলেছে আপন গতিতে। তেমনি আপন গতিতে দোল খেয়ে খেয়ে গানে মত্ত বিষন্ন কুবরা। আজই সাদাফ একটা নতুন মোবাইল গিফট করে কুবরাকে।
মোবাইল পাওয়া মাত্রই ছাদে এসে আগে ফেসবুক একাউন্ট খুলে নাদিম কে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠায়। তবে সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো নাদিমের প্রফাইল লক। আধঘন্টা যাবত ঘাটাঘাটি করার পরেও নাদিমের টিকিটির ও খবর পেলো না। কুবরা নিজের আসল নাম এবং তার একটা ছবি নিয়ে একাউন্ট খুলে। এতোক্ষন তো নাদিম ফেসবুকে ঢুকলে মাস্ট বি দেখার কথা। তবে কি নাদিম তাকে ইগনোর করছে সেদিনের ব্যাপার টার জন্য?? ভাবতেই কলিজা ঢুকরে কান্না চলে আসছে তার। আজ প্রায় ১০ দিন হতে চললো তার প্রিয় মানুষটির কোন দেখা নেই এই ক্ষুদার্ত দুটি চোখের।
মন খারাপকে সাঙ্গ করে মোবাইলে লাউড স্পিকারে ছেড়ে দেয় আতিফ আসলামের হ্রদয় জোড়ানো সেই গানটি—-
Teri yaadein, mulakaatein,
Main kaise bhulu chahat ki woh barsaatein
Teri yaadein, mulakaatein,
Main kaise bhulu chahat ki woh barsaatein
🎶🎶🎶🎶🎶
Tuhi mera dil hai, tuhi meri jaan
Tuhi mera dil hai, tuhi meri jaan
Tuhi mera dil hai, tuhi meri jaan
Tuhi mera dil hai, tuhi meri jaan..
🎶🎶🎶🎶🎶🎶
Kabhi to paas mere aao
Kabhi to nazarein mujhse milao
Kabhi to dil se dil ko milao
O jaana..
🎶🎶🎶🎶🎶🎶
Meri jaan palke yun na jhukana
Meri jaan mujhse door na jaana
Meri jaan mujhko bhul na jaana..
O jaana..
🎶🎶🎶🎶
Mujhe lauta de woh mera pyaar
Mujhe lauta de woh mera pyaar..
গান শুনতে শুনতে চোখ থেকে টপটপ করে বেয়ে পড়ে দুফোটা লোনা জল। চোখ বন্ধ করে এক মনে গান শুনছে। হঠাত গালে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে দ্রুত চোখ খুলে ফেলে কুবরা।
চোখ খোলার পর চোখেত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কে দেখে অবাকে আতকে উঠে কুবরা। এই যে স্বয়ং নাদিম সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্বপ্নে যে চোখ বন্ধ নাদিম কে এতোক্ষন কল্পনা করছে, তা কি চোখ খুলার পরেও দেখছে। একি শুধু চোখের মরিচিকা নাকি সত্যিই বাস্তব!!
গানের মধ্যে যখন গেয়ে উঠে “kabhi to pass mere aao ” তখন কুবরা নাদিমের আরও কাছে চলে আসে। আবার যখন গেয়ে উঠে “Kabhi to nazre mujse milao ” তখন কুবরা অপলক দৃষ্টিতে নাদিমের চোখ বরাবর চেয়ে থাকে।
আজ ১০ দিনের মতো হলো নাদিম তার প্রেয়সীকে একটি বারের মতো দেখতে পারে নি। এই দশ দিন যেন তার কাছে দশ হাজার বছরের সমতুল্য।
মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে কুবরার চেহারা পুরো রুগ্ন শুষ্ক হয়ে উঠেছে। চোখের নিচে কালি দাগ পড়ে গিয়েছে। কদিনের মধ্যেই সমস্ত চেহারার জৌলুশতা পানসে গিয়েছে সম্পুর্ন।
কুবরা এখনো চুপচাপ শান্ত দৃষ্টিতে নাদিমের পানে চেয়ে আছে। আগের সেই স্পাইক করা চুলের ভাজই কোথায় উধাও। চাপ দাড়ির শেইপ এলোমেলো হয়ে কিছুটা লম্বা হয়ে গিয়েছে। চোখে ঘুমের কাতরতা।
দুজন দুজনের দিকে ক্ষুদার্ত এর ন্যায় চেয়ে আছে পলকহীন ভাবে। নাদিমের এমন অবস্থা দেখে টপ করে আবারও গড়িয়ে পড়ে কুবরার চোক্ষুকোটর থেকে সেই পরিচিত লোনা জল। নাদিম নীরবে চোখের জ্বল মোছার জন্য কুবরার গালে হাত দিতেই কুবরা সেই হাত বাহুবদ্ধ করে নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নাদিম শান্ত ভাবে কুবরার মাথায় হাত বুলালে কুবরা আরও শক্ত করে নাদিমের পিঠের শার্ট খামচে ধরে।
নাদিম ঘাড় নিচু করতেই কুবরার কাধ থেকে বেয়ে আসে সেই মিষ্টি গন্ধ। প্রত্যেক মানুষের নাকি নিজস্ব আলাদা গায়ের গন্ধ রয়েছে। একেক জনের একেক রকম। নাদিম যখনই কুবরার কাছে আসতো, তখনই সেই মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসতো। আর মূলত এটাই নাদিমকে কুবরার দিকে বেশি টানতো। আজ আবারও তার প্রেয়সীর সুমিষ্ট সেই গন্ধে মন টা ভরে উঠে নাদিমের। কুবরার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে সেই ঘ্রান শুকতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
নাদিম মাথা তোলে মুচকি হেসে বলে” দেখলে তো আজ নিজেই তুমি আমার কাছে আসলে!! তুমি আসলে কিছুনা আর আমি আসলেই দোষ?? ”
কুবরা নাদিমের বুক থেকে মাথা তোলে ঢুকরে ঢুকরে বলে ” এই জন্য বুঝি এতোদিন সবকিছু ফেলে চলে গিয়েছিলেন আমায় শাস্তি দেওয়ার জন্য?? ”
নাদিমঃ আমি কি তোমায় শাস্তি দিতে পারি?? ( কুবরার দুই গালে হাত রেখে)
কুবরাঃ হ্যা। নিশ্চয় ওই দিনের কথায় আপনি রেগে গিয়েছিলেন। তাই তো কাজের বাহানায় এক্কেবারে দেশের বাইরে চলে গিয়েছেন আমায় শাস্তি দেওয়ার জন্য। ( নাক টানতে টানতে)
নাদিমঃ পাগলি মেয়ে। আমার সত্যিই কাজ পড়ে গিয়েছিলো। আর সাদাফকে তো আমি বলেছিই। বাইরের একজনের জন্য যদি কেউ একজন এভাবে কাদে তবে চলবে কি করর? আমি কি তোমায় কেউ না।
কুবরাঃ কচু আপনি। কে বলেছে আপনি বাইরের মানুষ। আপনি বুঝেন না ,আপনাকে না দেখলে আমার কষ্ট হয়? বুঝেন আমি আপনাকে কতটা…….
কুবরা আর কিছু না বলে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে আহত দৃষ্টিতে নাদিমের চোখের দিকে চেয়ে থাকে।
নাদিমঃ আমাকে কি?? কেন কষ্ট হয় বলো? …..
নাদিম ভেবেছিলো আজ কুবরা এই কষ্টে নাদিমকে তার মনের কথা সব খুলে বলে দিবে। কিন্ত নাদিমের সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে বুকে হাত গুজে পেছন ফিরে রয় কুবরা।
নাদিমঃ কুবরা?? এই কুবরা?? ওদিক হয়ে আছো কেন? বলো!!
কুবরাঃ এতোই বিজি যে সারাদিনে ফেসবুকে ও ঢুকতে পারেন নি? আমি যে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দিয়েছি সেটা সত্যিই দেখেন নি? আমায় চেনেন না?
নাদিমঃ কিইই তুমি ফেসবুক একাউন্ট খুলেছো? আর আমি তো এয়ারপোর্ট থেকে মোবাইল ই টাচ করি নি। তুমি কবে পাঠিয়েছো?
কুবরাঃ এই…. এই তো এক… ঘন্টা মতো হবে..।
নাদিমঃ বুঝো কান্ড তখন তো মে বি আমি দেশে ল্যান্ড করছিলাম। সেখান থেকে সোজা এখানে। বাড়ি ও যাই নি। একমাত্র তোমায় দেখার জন্য। জানো কতো মিস করেছি তোমায়! ( কুবরার দুই গালে হাত রেখে)
কুবরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সিড়ি দিয়ে শুভ্রা হাক পাড়ে।
শুভ্রাঃ আরে ভাইয়া আপনি এখানে! আর আমি আপনাকে সারা বাড়ি খুজে বেড়াচ্ছি। এতো দূর থেকে জার্নি করে এসেছেন। মামনী ডাকছে আপনাকে।
শুভ্রা শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিলো নাদিম আর কুবরা একে অপরকে ভালোবাসে। নাদিমের কথা, কেয়ারিং সবকিছুতেই তার জানান পাওয়া যায়। তাছাড়া সাদাফ ও সে কথা শুভ্রা কে বলে। তবে নাদিমকে তার ভালো মানুষ ই মনে হয়। সবসময় বড় ভাইয়ের মতো সাঙ্গ দেয়। কুবরার জন্য তাতে কোনো আপত্তি নেই। আর এটাও জানে যে একমাত্র কুবরার জন্য ই সোজা দেশে ফিরে সাদাফদের বাড়ি আসে। কিন্তু বাড়ির লোকতো আর তা জানে না।
নাদিম বাড়িতে আসার কথা শুনে সাদাফের মা তাকে দেখার জন্য আকুল হয়ে পড়ে। কোথাও খুজে না পেয়ে তিনি সিড়ি ধরলেই শুভ্রা এসে বলে উনার কোমর ব্যাথা নিয়ে যেন ছাদে না উঠে। শুভ্রাই গিয়ে দেখে আসুক। সিড়ি বেয়ে ছাদের দরজায় পা রাখতেই সামনে তাকিয়ে দেখে কুবরা আর নাদিম একে অপরকে আলিঙ্গন করে কাধছে। বোনের এমন পরিস্থিতিতে দুজন কে লজ্জায় না ফেলার জন্য পিছিতে যায় শুভ্রা। আবারও কিছুক্ষণ পর নিচের দিয়ে হাক পাড়ায় দূর থেকে ডাক দিয়ে দিয়ে আসে শুভ্রা, যাতে তারা সতর্ক হয়ে যায়।
শুভ্রা ডাকার পর নাদিম, কুবরা, শুভ্রা সকলে ছাদ থেকে নেমে আসে। তারপর সাদাফের বাবা মা কে সালাম করে বিদেশে যে প্রজেক্টটার জন্য যায় তার সফলতার কথা ও বলে। সাদাফের মা তো নাদিমের মাথায় দুই হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে।
সন্ধ্যা হতে হতে সাদাফ ও অফিস থেকে ফিরে আসে।
সাদাফঃ কিরে তুই বলে তোর ফার্স্ট প্রজেক্ট পাস করেছিস?
নাদিমঃ কার বন্ধু দেখতে হবে না। দ্যা গ্রেড সাদাফের বন্ধু যদি এইটুকু কাজ না করতে পারলে তা কেমন হয়?
সাদাফঃ তা না হয়। তবে আমি জানি তুই সবসময় যে কাজ করিস সেটা সাক্সেস হোস ই। তবু আলসেমি করিস। এখন দেখ মন দিয়ে কাজটা করেছিস বলেই তো সফল হয়েছিস।
নাদিমঃ হুম তা তো কাউকে জিততে সফল হতেই হবে। নাহলে যে বাদাম ব্যবসায়ী হতে হবে। ( কুবরার দিকে তাকিয়ে)
নাদিমের কথা শুনে সকলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বেচারি কুবরা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফ্লোরর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার সময় আজ নাদিমের পছন্দনুযায়ী রান্না করেছে। কুবরা ও শুভ্রাকে হেল্প করেছে।
নাদিমঃ উমমম ভাবিইইইই যাস্ট ফাটিয়ে। দারুম হয়েছে খেতে। তোমার রান্নার তো সত্যিই লাজাবাব।
কুবরাঃ ওটা আপু নয়। আমি বানিয়েছি 😒😒।
নাদিমঃ ওওও তাইইইইই…. এতোটাও ভালো হয় নি। আমি তো ভাবিকে খুশি করার জন্য বলেছি। রান্নার হাত আরো ভালো করা উচিত। নাহলে তো তোমার জামাইর কপালে দুঃখ আছে!! ( দুষ্টুমি করে)
কুবরা এক লুমকা মুখে দিয়ে দেখে খেতে বেশ ভালোই হয়েছে। নাদিম ইচ্ছে করে কুবরাকে পচাচ্ছে।
কুবরাঃ কচু হয়েছে। মুখে কি তেতু আচার লাগিয়েছেন নাকি? আমার রান্না যথেষ্ট মজা আর আমার জামাই আমার রান্না খুব তৃপ্তির সাথে খেতে পারবে। এতোই যদি প্রবলেম হয় তাহলে নাহয় নিজে রান্না করে খাবে। ( দাতে কটমট করে)
সাদাফঃ এইই নাদিম… শুধু শুধু বেচারিকে নাড়িস কেন বল তো। এই কুবরা সত্যিই খুব ভালো হয়েছে। তবে তো শুধু রান্নাবান্না করলেই চলবে না, পড়াশোনা ও করতে হবে। ঢাকায় এসে তো এসব পুরোই ছেড়ে দিয়েছো। আমি এখানকার একটা ভালো কলেজের হেড টিচার এর সাথে কথা বলেছি। উনি তোমাকে আর শুভ্রাকে কাল ই নিয়ে এডমিট করাতে বলেছে।
কুবরার মাথায় তো যেন আকাশ ভেঙে পড়াশোনার কথা শুনে। আর শুভ্রার তো মনে মনে লাফাতে ইচ্ছে করছে। ভেবেছিলো বাবা মারা যাওয়ার পর সংসার টানার তরে পড়াশোনা টা বুঝি আর করা হবে না। কিন্তু সাদাফের এই বিষয়ে যথেষ্ট ধ্যান ছিলো। দুজন বোন হলেই দুজনের ইচ্ছা আর পছন্দ দুই মেরুর। পড়াশোনার কথা শুনেই কুবরার মুখটা কালো হয়ে যায়।
কুবরাঃ কিইইইই আবার পড়াশোনা। উফফফফ এখানে এসেও।
সাদাফঃ বলো কি। মাত্র তো এই বছর এসএসসি দিলা। এই বার তোমাকে আর শুভ্রাকে সেইম ইয়ারে দিবো। শুভ্রার ও তো গতো বছর পরিক্ষা দেওয়ার পর আর পড়া হয় নি। কেন তুমি খুশি হও নি?
নাদিমঃ খুশি হবে কি করে। এক নাম্বারের ফাকিবাজ। পারভেজ ভাইয়ের কাছ থেকে নাকি শুধু পিটা খেতো। ( ঠোঁট টিপে হেসে হেসে)
শুভ্রার মাঃ আর বলিও না বাবা সত্যি এক নাম্বারের ফাকিবাজ। পড়াশোনার ভয়ে চালের ড্রামে লোকে থাকতো এই মেয়ে। সারা বছর তো এভাবে টেনেটুনে পাশ করে।
কুবরার সকলের উপর রাগে, লজ্জায় দুই হাত দিয়ে টেবিলের উপর ঠাসসস করে বারি দিয়ে। নাদিম আর তার মায়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে হন হন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
কুবরা চলে যাওয়াতে ডাইনিং এ উপস্থিত সকলেই ভুবন কাপানো হাসিতে ফেটে উঠে।
#চলবে