#অচেনা_তুমি
#লেখিকাঃমহিমা_হাছনাত_মাহি
#পর্বঃ৪২
দ্রুত গতিতে আশেপাশের সব গাছগাছালি, ঘর বাড়ি, পশুপাখি আপন গতিতে ছুটছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সকলে এক। জায়গায় বসে আছে বাইরের পৃথিবী ছুটে চলেছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে কানে ভেসে আসছে ট্রেনের ঝকঝকাঝক আওয়াজ। ঢাকায় আসাতে এবারে প্লেনে চড়ার এক্সপেরিয়েন্স তো হলো এবার ট্রেনে চড়ার এক্সপেরিয়েন্স টাও কাটিয়ে নিতে চায় সকলে। ট্রেনের এক কেবিনে এপাশ আর ওপাশ বসে আছে শুভ্রা, কুবরা,নাদিম,সাদাফ, শুভ্রার মা আর সাদাফের মা বাবা।
” এই তোমাদের কাছে এটা কেমন ঘোলাটে লাগছে না? হুট করে একই দিনে দুজনের বিয়ে! ” ( বাদাম খেতে খেতে বলে উঠে কুবরা)
শুভ্রাঃ ঘোলাটে? এখানে ঘোলাটের কি আছে? কাকতালীয় ভাবে মিলে যেতেও পারে। এরে অসম্ভব কিছু তো না।
কুবরাঃ আ হা। সামথিং ইস ফিশি হেয়ার আই থিংক। আচ্ছা কোনো এরকম নই তো বিয়েটা অদের দুজনের মধ্যেই হচ্ছে! আর এটাই সারপ্রাইজ?
নাদিমঃ তুমিও আবার মিমির মতো গোয়েন্দাগিরি কবে শুরু করে দিয়েছো কুবরা? আবার ওর মতো মাথায় এই ভুত চাপালে নাকি?
শুভ্রার মাঃ বেশি কথা বলিস তুই এমনি। আগে আগে বাড়তি কথা বলা তোর অভ্যাস। আগে গিয়ে দেখ তারপর না হয় বলিস। ট্রেনে করে যাওয়ার জন্য তো সাদাফের প্লেনের টিকিট ও ক্যান্সেল করে দিলি। এখন এতো বকবক না করে দেখ আর বাদাম খা না।
সাদাফের বাবাঃ আহহ মালিহা.. শুধু শুধু আমার মেয়েটাকে কথা শুনানো ও তোর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়ে করে শশুর বাড়ি চলে গেছে আর তুই এখনো জামাইয়ের সামনে নানান কথা শুনাচ্ছিস।
নাদিমঃ জামাই আর কি বাবাই। আমি তো বরাবরই আপনাদের ছেলেই ছিলাম। আলাদা করে জামাই বলে এতো লজ্জায় ফেলে দিও না।
কুবরাঃ ও তাই নাকি? তাহলে তো আপনি আমার ভাই হয়ে গেলেন 😃😃।
নাদিমঃ এহ!!
কুবরাঃ এ এ করার কি আছে? আমি যদি বাবাইয়ের মেয়ে হই আর আপনি যদি ছেলে হোন তিবে তো আমিরা ভাই বোন তাই না??
নাদিম লজ্জায় হতভম্ব হয়ে প্রত্যেকের চেহার দিকে তাকিয়ে দেখে মুখ টিপে টিপে সকলে তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আসছে।
নাদিমঃ ও সেটাতো খেয়াল করিনি। এখন তো তুমি আমার বোনততো বউ হয়ে গেলা ( মেকি হেসে)
কুবরাঃ এহ😳😳।
সাদাফঃ উম… নাদিম এখানে আমি আর শুভিও কিন্তু আছি ভুলে যাস না।
নাদিমঃ তো সমস্যা কি? ওদের ভাষ্যমতে এটাই তো উত্তর তাই না??
দুজনের কথা শুনে উপস্থিত সকলেই হু হা করে হেসে উঠে। বিয়ের পরেও এখন আর বাচ্চামোটাই গেলো না তাদের। হাসিখুশিতে সময় কাটাতে কাটাতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। ট্রেন এবার এসে চট্টগ্রাম স্টেশনে থামে। এরপর একটা পিকাপ নিয়ে সকলে যাত্রা দেয় কক্সবাজারের উদ্যেশ্যে।
গাড়িতে উঠে এবার সকলেই এবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করে। বিয়ের দাওয়াতে তো যাচ্ছে এইবার কার বাড়িতে আগে যাবে? বাহারছড়া গেলে সাদাফের অফিসে থাকতে হবে যেহেতু ইলিয়ানাদের বাড়ি ওতো বড় নয়। আবার রামুতে পারভেজ দের বাড়ি যথেষ্ট বড় তারপর তো শুভ্রাদের পুরানো বাড়ি রয়েছেই। শুভ্রার মা বলে রামুতে গেলেই সব ক্ষেত্রে উপক্রিত হবে। আর তাছাড়া তো একবার টাউনের দিকে বেড়িয়েছিলো এবার ন হয় গ্রামে হোক সফর। সাদাফ আর নাদিম মিলে তো শুভ্রাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য এক্সাইটেড হয়ে উঠে সবচেয়ে বেশি। তাই সকলে মিলে ডিসাইড করে প্রথমে গ্রামের বাড়ি যাবে সেখান থেকে পরের দিন ইলিয়ানাদের বাড়ি।
মাগরিবের আগে আগে সকলে মিলে শুভ্রাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঢুকে। আহহ কতোই না সুন্দর মনোরম পরিবেশ বাংলার গ্রাম গঞ্জের। সরু রাস্তার চারপাশে সারি সারি উচু নিচু নারকেল আর সুপারি গাছ। আর কিছু গাছের আগায় কচি কচি সুপারি কিংবা নারকেলের ফুল কিংবা থোকা থোকা সুপারি আর নারকেল এর ঝোপ। গ্রামের ঢুকার সাথে সাথে রাস্তার ধারে লাগানো বড় একটা পুকুর। শান্ত সুনিবিড় পরিবেশে ক্যাচ ক্যাচ করে খাবারে সন্ধানে মাথার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে চম্পা বাদুড়।
সাদাফঃ আচ্ছা আব্বু খালামনিদের একটা ফার্মহাউজ আছে না রামুর এই দিক টায়??
সাদাফের বাবাঃ হ্যা এদিকে কোথাও হবে বেশ কয়েকবছর আগে আমি আর জামাল মিলে এসেছিলাম এইদিকে ওই ফার্মহাউজটা কিনতে। ভুলে গেছি রাস্তাটা তবে, অনেক দিন আগের কথা।
আজ কতোদিন পর নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে এসেছে শুভ্রা কুবরা। পুরোনো স্মৃতি মনে জেগে উঠতেই ফুরফুরে হয়ে উঠে দুজনের পুলকিত আবেগ। সাদাফ আর নাদিম তো মুগ্ধ হয়ে আশেপাশের মানুষ আর পরিবেশ দেখছে। ছোটবেলা থেকে যেখানে ইট পাথরের মাঝে বড় হয়েছে সেখানে খোলা শান্ত পরিবেশে সত্যিই খুব ভালো লাগছে তাদের।
শুভ্রার মা কিছুক্ষন পর একটা বড় উঠানের মাঝখানে গাড়িটা থামাতে বলে।
শুভ্রার মাঃ ব্যাস ব্যাস চলে এসেছি আমরা৷ এবার সবাই নামতে পারো৷
তারপর সকলে মিলে ব্যাগ লাগেজ নিয়ে একে একে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়৷ কিছুদূর গিয়ে সাদাফের মনে হলো সামনে পরিচিত কাউকে দেখছে সে।
সাদাফঃ এই শুভি এটা আমাদের ইলু বলে মনে হচ্ছে না?? ( কিঞ্চিত ভ্রু কুচকে)
শুভ্রা আর পারভেজদের বাড়ি পাশাপাশি লাগানো। বলতে গেলে একি ভিটায় দুই বাড়ি সামনে বড় উঠান।।
শুভ্রা তাকিয়ে দেখে তাদের বাড়ির পাশের উঠানে মানে পারভেজদের ওঠানে মোড়া নিয়ে কয়েকজন বসে আছে। কিন্তু সেখানে আরো ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে ইলিয়ানার মতোই যেম কেউ বসে আছে।
শুভ্রা আর সাদাফ নিজেদের বাড়ির দিকে না গিয়ে পারভেজদের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। পেছন পেছন বাকি সকলে।
শুভ্রা মেয়েটির পিঠে হাত দিয়ে ঘুরে তাকালেই দেখে এ তো সত্যি সত্যিই ইলিয়ানা!
শুভ্রাঃ ইলু আপ্পি!! এটা সত্যিই তুমি?? মানে সারপ্রাইজ কি এটাই?
ইলিয়ানা শুভ্রাকে দেখে খুশিতে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে কোলাকুলি করে।
ইলিয়ানাঃ এতোক্ষণ লাগে বুঝি আসতে তোদের? সেই কবে থেকে অপেক্ষা করে বসে আছি।
সাদাফঃ মানে? তোদের ও কি এখানে আসার কথা ছিলো নাকি?
ইলিয়ানাঃ না বাট আমরা তো জানতাম তোমরা সবাই এখানেই আসবে। তাই তো আমরা সকাল বেলাই ফার্মহাউজে চলে আসি। তারপর এখানে ঘুরতে আসি।
সাদাফঃ আর কদিন পর না তোর বিয়ে এখানে ঘুরতে চলে এলি।
ইলিয়ানার মাঃ বিয়ে তো এখানেই হবে। তাই তো চলে এলাম।
শুভ্রাঃ মানে বুঝলাম না এখানে বিয়ে? আর আপনারা জানতেন কি করে আমরা সোজা এখানে আসবো?
পারভেজের মাঃ এটাই তো সিক্রেট ছিলো। আর আসল সারপ্রাইজ টা হলো আমাদের পারভেজের সাথে ইলিয়ানার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর এসবের মূল ঘটক হলো এই যে তোর এই মা। ( শুভ্রার মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে)
কুবরার বিয়ের পর যখন সবাই কক্সবাজার চলে আসছিলো তখন পারভেজের মা ইলিয়ানার মায়ের নাম্বার নিয়ে নেয় শুধুমাত্র এই বিষয়ে কথা বলার জন্য। ইলিয়ানাকে উনার শুরু থেকেই পছন্দ ছিলো। শুভ্রার মায়ের সাথে কথা বলে এবার তিনি পাকাপোক্ত হোন যে ইলিয়ানার মায়ের ও পারভেজের উপর মন আছে। যখন দু পক্ষেরই সম্মতি তখন শুভ কাহে আর দেরী কিসের। যেহেতু আর কয়েকদিন পর পারভেজ ও বিদেশ চলে যাবে।
কুবরাঃ ও এটা তো আমি আগেই টের পেয়েছিলাম। এতে সারপ্রাইজ এর কি আছে। দেখলে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করো নি। এখন হলো তো আমার কথা সত্যি। আমি এসব বিষয়ে পিএইচডি করেছি বুঝেছো? যা দরকার সব জ্ঞান আমার কাছ থেকে নিবা এবার থেকে। ( বুকে হাত গুজে ভাব নিয়ে)
” তবে রে?? খুব পেকেছিস তাই না? তোর পাকনামি কি করে গলিয়ে দিতে হয় সে মহাঔষুধ আমার কাছে আছে “।
পেছন থেকে হঠার কেউ কান টেনে নেওয়ায় আর পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে কুবরার বুঝতে বাকি রইলো না সে কে?
কুবরাঃ আহহহ ভাইয়া লাগছে তো কানে ব্যথা পাচ্ছি…
পারভেজঃ লাগুগ। কান মোলা দিচ্ছিনা অনেক দিন হচ্ছে তোর। নিজেকে খুব বড় বড় মনে করিস না তুই?? ( হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা তার মাকে দিয়ে)
কুবরাঃ সরি সরি ভাইয়া আর বলবো না। প্লিজ ছাড়ো এবার আমার মান সম্মান সব পেলাস্টিক হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া।
পারভেজঃ নেহাত তোর হাসবেন্ড আছে তোর সামনে। নাহলে আগের মতো উদুম কেলানি দিতাম।।
কুবরাঃ 🥺🥺🥺🥺 ভাইয়ায়ায়ায়ায়া…
পারভেজ ইলিয়ানার খুনসুটি দেখে সকলেই একত্রে হেসে উঠে। এরপর সন্ধ্যা হতে হতে শুভ্রাদের বাড়িতে ঢুকে সকলে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নেয়।
রাত ৮ টা কি ৯ টার দিকে পারভেজের মা, ইলিয়ানার মা, শুভ্রা আর সাদাফের মা উঠানের বড় চুলায় চালের গুঁড়া, খেজুর গুড়, নারকেল, দুধ, নিয়ে বসে হরেক রকমের পিঠা বানানোর জন্য। সাদাফ আর ইলিয়ানার বাবা নিরব দর্শকের মতো এক জায়গায় বসে গল্প করছে। শীতকালে গ্রামে এসেছে আর পিঠা পিকনিক হবে না তাই কখনো হয়??
সাদাফ, নাদিম, পারভেজ, আবির মিলে উঠানের আরেকটা জায়গায় আগুন ধরায়। ততোক্ষনে কুবরা বারবিকিউ গ্রিল নিয়ে আসে আর শুভ্রা আর ইলিয়ানা মুরগীমাংস, গরুর মাংস নিয়ে আসে। বাইরের শীতল আবহাওয়ায় পরিবেশটা কতো রমরমা হয়ে উঠে।
কুবরাঃ এই ভাইয়া পিঠে পুলির গানটা গাও না। আগে যেমন গাইতে!!
পারভেজঃ এই যা ধুর তুই শুধু গানের বাহানা খুজিস সবসময়।
নাদিমঃ না না না এর আগের বারেও আপনার গাওয়া গান আমি মিস করেছি। এবার যখন দেখা হয়েছে গান আমি শুনবোই। হতেও তো পারে আমাদের আর কোনো দিন দেখাই হবে না। বউ সংসার নিয়ে বিদেশে থেকে আমাদের ভুলেই যাবি।
পারভেজঃ আগের বারের গান মিস করেছো ঠিকি কিন্তু তখন কুবরা তোমাকেই বেশি মিস করছিলো। কি তাই না? আর বেচে থাকলে ইনশাআল্লাহ দেখা হবে। ( নাদিমে কাধে হাত দিয়ে)
সাদাফঃ এই নাও গিটার। নাও এবার গান ধরো। পিকনিক হবে আর গান হবে না তাই কখনো হয়? ( পারভেজের হাতে গিটার ধরিয়ে দিয়ে)
পারভেজঃ বাবাহ তুমি তো দেখছি খুব ফার্স্ট। আমার সাথে কিন্তু তোমাদের সাথেও তাল মিলাতে হবে।
বলো বলো কার কটা চাই ভাই
মিছে মিছে করো কেনো খাই খাই
পিঠেপুলি নরম পেলে মন জুড়িয়ে যায়
বলো বলো কার কটা চাই ভাই ( কুবরা গেয়ে উঠে)
মিছে মিছে করো কেনো খাই খাই
পিঠেপুলি নরম পেলে মন জুড়িয়ে যায় ( নাদিম গেয়ে উঠে)
বাঙালির মিষ্টি হলেই হয়, গুণীজন বলে শুধু তাই
নারকোল ক্ষীর, নলেনগুঁড়ের পাটিসাপটা চাই
মোদের বলতে নাহি লাজ ,মোদের মিষ্টি খাওয়াই কাজ( সাদাফ আর শুভ্রা গেয়ে উঠে)
মোদের বলতে নাহি লাজ , মোদের মিষ্টি খাওয়া কাজ
দুধপুলি আর মালপোয়াটা জমিয়ে বসে খাই
বলো বলো কার কটা চাই ভাই( ইলিয়ামা গেয়ে উঠে)
মিছে মিছে করো কেনো খাই খাই
পিঠেপুলি নরম পেলে মন জুড়িয়ে যায়( আবির ও গলা মিলায়)
বাঙালির মিষ্টি হলেই হয় ,গুণীজন বলে শুধু তাই ( সকলে মিলে একসাথে গেয়ে উঠে)
রসবড়া আর চিতলপিঠে বেশি করে চাই
মোদের বলতে নাহি লাজ, মোদের মিষ্টি খাওয়াই কাজ
মোদের বলতে নাহি লাজ, মোদের মিষ্টি খাওয়াই কাজ
নকশিপিঠে, ছানারপুলি আরো আরো আরো চাই।
সকলেই হাসি খুশিতে পিঠা উৎসবে মেতে উঠে। রাত গভির হতেই ইলিয়ানারা ফার্ম হাউসে চলে যায়। যেহেতু কাছে তাই পারভেজ নিজে গিয়ে তাদের এগিয়ে দিয়ে আসে। তারপর সকাল সকাল উঠতে হবে বলে আর দেরি না করে অন্যরাও যার যার ঘরে ঘুমুতে চলে যায়। আর লং জার্নির ফলে সকলে এমনিও টায়ার্ড অনেক
#চলবে।