অতঃপর প্রণয় পাঠ-৪+৫+৬

৪+৫+৬
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:৪

ইরিনের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছে আয়াজের।প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজীতে ত্রিশ পেয়েছে ইরিন।মায়মুনা বেগম আয়াজকে ডেকে নিয়ে বিচার দিয়েছেন।বর্তমানে ডাইনিং এর পাশে ওয়াশরুমে ঢুকে মেঝেতে থম মেরে বসে আছে ইরিন।এই মুহূর্তেই ওর বুক ফেটে কান্না আসার কথা কিন্তু আসছে না।আয়াজ তাকে প্রচুর ধমকাধমকি করেছে।মায়মুনা বেগম সেই সাথে তাল দিয়েছেন।

মূলত তিনি ইরিনের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইছিলেন।যেই মেয়ে ইংরেজীতে তেত্রিশ পেয়ে পাশ করতে পারে না তাকে পড়িয়ে লাভ কি হবে? আয়াজ বুদ্ধি করে ইরিনকে বকাবকি করার ফলেই তিনি আর বেশি কিছু বলতে পারছেন না।কিন্তু সেইটুকু বোঝার মত জ্ঞান ইরিনের নেই।তার ধারনা আয়াজ সুযোগ বুঝে পুরোনো সব রাগ তার ওপর ঝেড়ে ফেলেছে।তাই আয়াজের মুখের ওপর দরজায় বাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলো সে,কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন দেখলো আয়াজ ওর পেছনে দাঁড়িয়েছিলো।দড়াম করে দরজার বাড়ি লাগলো আয়াজের কপালে। কপাল ফুলে আলু হয়ে গেছে।ইরিন ভয়ে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম ঢুকে যায়।সেই থেকে বিগত পনেরো মিনিট যাবত ওয়াশরুমে বসে আছে।

দুম করে ওয়াশরুমের দরজায় বাড়ি মারলো। আয়াজ।ইরিন সাড়া দিলো না।

——–“ইরিন দরজা খোল, কথা আছে তোর সাথে!”

অনবরত দরজায় বাড়ি মেরে যাচ্ছে আয়াজ।অনেক্ষন বাদে ইরিন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।মুখ বাকিয়ে বলল,”কি হলো আয়াজ ভাই?.আপনি ওয়াশরুমে যাবেন?..আমার হয়ে গেছে আপনি যেতে পারেন।”

ইরিনের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে একটু আগে কিছুই হয় নি। আয়াজ অগ্নিকন্ঠে বলল,

—“আমার কপালের কি অবস্থা করেছিস দেখেছিস,তারপরেও আবার উলটো রাগ দেখাচ্ছিস? কি রে তুই? দেখি সর আমি মাথায় পানি ঢালবো।মাথা ঘুরছে।”

কপালের অবস্থা দেখে ইরিনের খাপার লাগছে।সত্যিই ফুলে আলু হয়ে গেছে।হাতের তালু দিতে কপাল চেপে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ।ফর্সা না লাল হয়ে গেছে।

—“কি হলো?..সর?

—“আমি কি আপনার মাথায় পানি ঢেলে দেবো?”

—“লাগবে না।তুই সর আমি ঢালছি।”

—“কেন আমি ঢাললে কি সমস্যা?

—“কোন সমস্যা নেই।কিন্তু আমি তোর হাতে পানি ঢালবো না।আমার ইচ্ছে।তুই সর আমার সামনে থেকে।”

—“আমি ঢালি না?”

—“ইরিন সামনে থেকে সর।”

ইরিনের রাগ উঠে গেলো।সে পানি ঢাললে সমস্যাটা কোথায়? ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,,

—“ভালো ছাত্র হয়েছেন বলে মাটিতে পা পড়ে না তাই না? অন্যদের মানুষ মনে হয় না?

আয়াজ অবাক হয়ে বলল,

—“তোকে আমি কি করেছি?”

—“আপনি আমাকে এতগুলো কথা শোনালেন কেন? আমি আপনার খাই না পরি?

আয়াজ চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে,ইরিনের কথা গুলো যতটা না ওর কানে লাগছে তার চেয়ে বেশি অন্য কোথাও লাগছে!কতবড় বড় অসভ্য এই মেয়ে!

—“কি বললি তুই?…আবার বল কি বলেছিস?..এখন কথা বলছিস না কেন? তুই ভুল করলে আমি তোকে শুধরে দিতে পারবো না? ”

ইরিন এবার আর একফোঁটাও জবাব দিলো না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।আয়াজের কষ্ট লাগছে।ইরিন তাকে এতবড় কথা বললো কি করে? সে কি ইরিনের খারাপ চায়? দাঁতেদাঁত চেপে বলল,

—“লজ্জা থাকলে আমাকে এই কথা গুলো বলতি না তুই!ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষায় যখন ইংরেজীতে ফেল করেছিলি মনে আছে? তখন তোর আম্মাজান শ্রদ্ধেয় মায়মুনা বেগম এসে আমার হাতে পায়ে ধরেছিলো,তোকে পড়ানোর জন্য।গাধার মত খেটেছি তিনমাস!…যেই মেয়ে ইংরেজীতে তেরো পায় সেই মেয়ে ঊননব্বই পেয়ে পাস কারছে কার জন্য?.একটা কানা কড়ি দিয়েছিস?তুই এখন আমার সাথে মুড নিয়ে কথা বলিস?…যা সর আমার চোখের সামনে থেকে।”

—“আপনি আমাকে টাকার খোঁটা দিয়েছেন? ”

ছলছল চোখে প্রশ্নটা করলো ইরিন।ওর চোখের পানি দেখে আয়াজের রাগ কমে গেলো।শীতল কন্ঠে বলল,

—“হ্যাঁ দিয়েছি।ইটের জবাব পাটকেলে না দিলে হয় না।তুই আমাকে হার্ট করেছিস তাই আমিও তোকে হার্ট করেছি।এবার সর!”

—“আপনি জানেন আপনি খুব খারাপ এবং জঘন্য প্রকৃতির একজন লোক?আমি আপনাকে বদদোয়া দিচ্ছি আপনি জীবনে শান্তি পাবেন না।দুনিয়ার সব কষ্ট আল্লাহ আপনাকে দিবেন।আপনার বউয়ের ডেলিভারির সময় যেন পেইন আপনার উঠবে!আপনি তখন ব্যথায় ছটফট করতে করতে নিজের গালে নিজে চড় বসাবেন,মাথার চুল ছিঁড়ে টাক হয়ে যাবেন।”

—“শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।আর শোন,পারলে পড়াশোনা করে দেখিয়ে দে।এসব ফালতু রাগ দেখিয়ে কোন লাভ নেই।”

আয়াজ ঠাস করে ইরিনের নাকের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো।পানির কল চালু করে মাথায় পানি দিলো সে।তার মাথাটা ঘুরছে।ইরিনের কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।ঠাস করে ইরিনের গালে একটা চড় বসাতে ইচ্ছে করছে তার।মাথা ফাটিয়ে দিয়েও শান্তি হয় নি ফাজিল মেয়েটার।উল্টোপাল্টা কি সব জঘন্য বদদোয়া করে গেছে তার জন্য।বদ মেয়ে!

এদিকে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলো ইরিন।এখন থেকে জানপ্রাণ লাগিয়ে পড়াশোনা করবে সে।আর কোনরকম ফাঁকিবাজি করবে না।খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে।
সেদিনের পর থেকে আয়াজদের বাসার ত্রিসীমানায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইরিন।বারান্দায় দাঁড়ানোও পুরোপুরি বন্ধ।আয়াজের ইন্টার্নি শুরু হয়ে গেছে।সে ব্যস্ত তার হস্পিটাল, ডিউটি,বিসিএস এর প্রিপারেশন, এসব নিয়ে।

তার প্রায় তিনমাসপর আয়াজের বড় ভাই মহসিন এর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো ইরিনের খালাতো বোন মুক্তার সাথে।মুখে না বললেও এতগুলো দিন আয়াজকে খুব মিস করেছে সে।একধরনের শূন্যতা অনুভব করেছে।

হলুদের দিন পুরো এপার্টমেন্ট আলোতে ঝলমল করছে।মরিচ বাতি দিয়ে পুরো বিল্ডিং সাজানো হয়েছে।বাড়ির সামনে রাস্তা পর্যন্ত লাইটিং করা হয়েছে।মামীরা,খালামনিরা কাজিনরা সব এক হয়েছে।সবাই একজোট হয়ে গল্পগুজব,হাসি ঠাট্টাতে মজে আছে।ইরিন এসবের কিছুতে যোগ দিলো না।
নেক্সট মান্থে ওর ফাইনাল পরীক্ষা।প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে।

ওর পড়ার রুমে কারো ঢোকা নিষেধ।দরজা আটকে ধুমছে পড়াশোনা করছে সে।পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিং এ আসতেই আয়াদের গলার আওয়াজ পেয়ে থমকে গেলো।আজকেই এসেছে আয়াজ।ইরিনের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ শুরু হয়ে গেলো।হাতের গ্লাসটা কাঁপছে। দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে সরে গেলো সে।রুমের এসে ভালোকরে দরজাটা লক করে দিলো।বই নিয়ে পড়তে বসে গেলো।কিন্তু পড়ায় মন বসছে না,বসার কথাও না।আজ কতদিন পর মানুষটার গলা শুনেছে সে!কতদিন পর!

ইরিন ঘরের বন্ধ দরজায় অনবরত নক করছে মুনা!ইরিন বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দিলো।মুনা কোন কথাবার্তা ছাড়া খাটের নিচ থেকে একজোড়া নারকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।দরজার বাইরে আয়াজ দাঁড়িয়ে ছিলো।ইরিন খেয়াল করে নি।দরজা আটকানোর সময় চোখে চোখ পড়ে গেলো।অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইরিনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো,

—“আপনি?

—“কি অবস্থা তোর? পড়াশোনা ঠিক মত করছিস?”

—“সেটা জেনে আপনার কি দরজার?”

আয়াজ হাসলো।মায়মুনা বেগমের কাছ থেকে সব খবরই পেয়েছে সে।ইরিন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে।খবরটা শুনে আয়াজের ভালো লাগছে,ওর ওপর জেদ করে হলেও পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে ইরিন।ইরিন ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,

—“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

—“ভাবছি।তুই সত্যি সত্যি পড়াশোনা করছিস কি না কে জানে? নাকি ভাব ধরে বসে আছিস?”

—“আপনি যান,বেরোন।”

—“যাবো না।দেখি ঠেলে বের করতে পারিস কি না?”

—“আমার পড়া আছে।”

—“কি পড়ছিস তুই?”

—“আপনি জেনে কি করবেন?”

—“বাব্বাহ্,রাগ করেছিস?”

—“আপনি আমার কন্সেন্ট্রেশন নষ্ট করছেন।”

—“ইহ্।”

—“কিসের ইহ্? আপনি যান আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

—“তুই এমন করছিস কেন আমার সাথে?..কি করেছি আমি তোকে?”

—“কিচ্ছু করেন নি।কিন্তু আপনি যান।আমি পড়তে বসবো।আমার সময় নষ্ট করছেন আপনি।”

আয়াজ ভ্রু নাচিয়ে ভিলেনটাইপ হাসি দিয়ে বলল,

—“যাচ্ছি,যাচ্ছি,আমি তো ভুলেই গেছিলাম তুই বোর্ড ফার্স্ট হওয়া স্টুডেন্ট,দশমিনিট না পড়লে তোর প্লেস করা আটকে যাবে।তখন তো আবার মহা মুসিবত।”

—“আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন?”

আয়াজ শব্দ করে হেসে উঠে বলল,

—“ইনসাল্ট বানান কর তো দেখি? তুই তো ইংরেজীতে ডাল।দেখি পারিস কি না?”

—“করবো না।আমি কি আপনার কথা মত চলবো?”

—“আচ্ছা থাক।আমার কথা মত চলতে হবে না।আমি যাচ্ছি তুই পড়।অবশ্য পড় তেমন কোন লাভ হবে কি না কেন জানে?রেজাল্ট বেরোলে দেখা সেই গোল্লা পেয়েছিস। যাই হোক আমি যাই।”

আয়াজ বেরিয়ে গেলো।ইরিনের রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।যে করেই হোক ভালো রেজাল্ট করে আয়াজকে দেখিয়ে দিতে হবে।তার জন্য যতদূর পর্যন্ত যেতে হয় ইরিন যাবে।দরকার হলে দিনরাত এক করে পড়াশোনা করবে।ইরিনকে নিজের অবস্থান তৈরী করতেই হবে।আয়াজের ভোঁতা মুখ যে করেই হোক থোতা করতে হবে।
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:৫

আয়াজ হেলাল সাহেবের সামনে চুপচাপ বসে আছে।তাকে কেন ডাকা হয়েছে সে জানে না।হেলাল সাহেব নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন।ছেলের দিকে তাকিয়ে মধুর হাসি হেসে বললেন,

—“বাবার তোর সাথে কিছু কথা আছে।”

—“বলো বাবা।”

—“যদিও এখন এইসব বলা ঠিক না।তবুও জানিয়ে রাখা ভালো।তুই পাশ করে বেরিয়েছিস।ইন্টার্নি শেষ হলে তোর বিয়েশাদী দিতে হবে।তাই তোর মা বলল তোকে আগে থেকেই যেন সব জানিয়ে রাখাই ভালো।”

—“বিষয়টা কি বাবা?”

—” ইরিন!”

আয়াজের ভ্রু জোড়া অটোমেটিক কুঁচকে গেলো।ইরিনের প্রসঙ্গে হেলাল সাহেব কি কথা বলবেন সে বুঝে উঠতে পারছে না।

—“আমার আর তোর মায়ের ইরিনকে খুব পছন্দ,তোর মা বলছিলো তোদের দুজনকে খুব মানাবে,আমারও তাই মত!”

আয়াজের হাসি পাচ্ছে।কেন পাচ্ছে সে নিজেও জানে না।হাসি চেপে চুপ করে বসে রইলো সে।ইরিন বাস্তবিকই প্রচন্ড সুন্দরি।ওদের এপার্টমেন্ট সুন্দরী অবিবাহিতা মেয়ে হিসেবে প্রচুর জনপ্রিয়তা আছে তার।
হেলাল সাহেব ছেলের মনোভাব উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন।আয়াজ হালকা হেসে বলল,

—“আমাকে কি করতে হবে বাবা?”

—” ইরিনের আম্মারও তোকে খুব পছন্দ। ছোটবেলা থেকেই তোকে খুব পছন্দ করেন তিনি।তোর মা উনার সাথে আলাপ করেছে।উনাদের কোন আপত্তি নেই।এখন তোর মতামত জানতে চাইছি।”

সরাসরি বাবার সামনে সম্মতি প্রকাশ করতে লজ্জা লাগছে আয়াজের।বলল,

—“বাবা,ইরিনের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।এখন এসব আলোচনা ওর কানে গেলে তো পড়াশোনা লাটে উঠবে।কন্সট্রেশন নষ্ট হয়ে যাবে।”

ছেলে জবাবে হেলাল সাহেব ছেলের উত্তর বুঝে গেলেন। ছেলেকে আশ্বস্ত করে বললেন,

—“ইরিন কিচ্ছু জানবে না।আমি তোকে কথা দিচ্ছি।ইরিনের পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই ব্যপারে তাকে কিচ্ছু জানাবো না।”

আয়াজ চুপ করে রইলো।হঠাৎ করেই বাবার সামনে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে।হেলাল সাহেব ধীর কন্ঠে বললেন,

—“আসলে সামনের বছরই ইরিনরা এই বাসা থেকে শিফট হয়ে যাচ্ছে।যাত্রাবাড়ীতে ইরিনের বাবার নামে আরেকটা ফ্ল্যাট আছে।সেখানেই যাচ্ছেন তারা।ওদের সাথে আমাদের একটা ভালো সম্পর্ক আছে।আর তোর মাও ইরিনকে খুব পছন্দ করে।সেই জন্যই ওরা চলে যাওয়ার আগে কথাবার্তা সব এখনই ফাইনাল করে রাখতে চাচ্ছে।”

—“কিন্তু ইরিনের মতামত?”

—“ইরিনের মতামত অবশ্যই নেওয়া হবে।তার মতামত ছাড়া তো আর বিয়ে হবে না।তবে এখন থাক,আগে পড়াশোনা শেষ করুক!”

—“ঠিক আছে।”

আয়াজ উঠে দাড়ালো।হেলাল সাহেব থামিয়ে দিয়ে বললেন,

—“শোন।”

আয়াজ দাঁড়িয়ে গেলো।হেলাল সাহেব মুচকি হেসে বললেন,

—“ইরিনের দিকে খেয়াল রাখবি।মেয়েটা ভালো।কিন্তু বয়স তো কম।এই বয়সে মেয়েদের মনমানসিকতা অন্যরকম থাকে।আমার চেয়ে তুই ভালো বুঝবি।তাই ওকে দেখে শুনে রাখার দায়িত্ব তোর।তোর হবু স্ত্রী এখন, তার প্রতি খেয়াল রাখার দায়িত্ব তোর।”

আয়াজ লাজুক হাসি হাসলো।ইরিন তার হবু স্ত্রী? ভাবতেই হাসি পাচ্ছে।ইরিনের সাথে দুই সেকেন্ড বনিবনা হয় না তার।বিয়ের পরে যে কি হবে আল্লাহই জানে!

হলুদের প্রোগ্রামে শুরু হয়েছে। সবার শেষে ইরিন সাজগোজ করে বেরোলো।হলুদ লাগিয়েই আবার পড়তে বসবে।যদিও তার সাজগোজের খুব শখ তবে আজকে বেশি সাজগোজ করে নি।হলুদ রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরে চুল বেধে নিলো।হলুদ দিয়ে এসে পড়তে বসতে হবে ওকে, প্রচুর পড়তে হবে!পৃথিবী জুড়ে আইলা, সিডর, টর্নেডো যাই হোক না কেন ওকে পড়তে হবে।

ছাদের সিঁড়ি কাছে উঠতেই আয়াজের সাথে দেখা।সিঁড়িপথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,ফোনে কথা বলছে।ইরিন পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

আধঘণ্টা পর হলুদ লাগিয়ে নামার সময়ও সেই একই জায়গায় আয়াজকে দাঁড়ানো দেখলো।ফোন নিয়ে ব্যস্ত।
এত কার সাথে কথা বলছে?..তাও আধঘণ্টা যাবত দাঁড়িয়ে?..স্পেশাল কেউ?..হোক! ইরিনের কি?ইরিন কেন মাথা ঘামাচ্ছে? দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো সে।


ফোনে কথা শেষ হলে আয়াজ ছাদে উঠলো। রেশমি এসে বলল,

—“ইরিকে একটা ফোন লাগা তো আয়াজ।”

—“কেন?”

—“আমার ফোন ওর কাছে রাখতে দিয়েছিলাম।ভুলে নিচে নিয়ে গেছে বোধহয়।”

—“ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।”

আয়াজ তুতুরীকে নিয়ে নিচে নামলো।
ওদের ফ্ল্যাটের তালা বন্ধ।সোহেলি তালাবন্ধ করে ছাদে আছেন।ইরিনদের ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা।
ভেতরে ঢুকতেই সোফায় ওপর রেশমির ফোন রাখা দেখলো।তুতুরীকে দিয়ে ছাদে ফোন পাঠিয়ে দিলো সে।ইরিনদের বুয়া রান্মাঘরে কাজ করছে।আয়াজ ফ্যান চালু করে ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসলো।ইরিনের ঘরের দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলো,দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো সে। সে যেখানে বসেছে সেখান থেকে ইরিনের ড্রেসিংটেবিলের আয়না স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ইরিন জামার চেইন খোলার চেষ্টা করছে।আয়াজ উঠে সাবধানে ইরিনের ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিলো।তারপর আবার সোফায় এসে বসলো।

দ্রুত জামা চেইঞ্জ করে বেরলো ইরিন।ড্রয়িংরুমে পানি খেতে এসে দেখলো আয়াজ সোফায় বসে আছে।ইরিনের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছে সে।
ইরিন চোখটা ভালো মত কচলে নিলো।আয়াজ কি সত্যি সত্যি সোফায় বসে আছে নাকি ওর দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে?

আয়াজের ফোন বাজছে।পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করল সে।ইরিন এখনো দাঁড়িয়ে আছে।আয়াজ ওকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে ইশারায় পানি খাওয়াতে বলল।

ইরিন পানি এনে ওর সামনে রাখলো।ইতিমধ্যে আয়াজের কথা বলা শেষ।সামনে রাখা পানির গ্লাস তুলে নিয়ে পানিতে চুমুক দিলো সে।পানি খাওয়া শেষ হলে মৃদু শব্দ করে গ্লাসটা সেন্টার টেবিলের ওপর রাখলো।ওর দৃষ্টি ফোনের দিকে।ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—“ওড়না গায়ে দিয়ে আয়।”

নিজের দিকে তাকিয়ে তব্দা খেয়ে গেলো ইরিন।সে এতক্ষন আয়াজের সামনে ওড়না ছাড়া বসে ছিলো?..ইন্নালিল্লাহ!
বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে গেলো।তারপর এক ছুটে এসে রুমে ঢুকলো।
চাদরের মত ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো।প্রচুর লজ্জা লাগছে।নিজের গালে কষে দুটো চড় বসাতে ইচ্ছে করছে।

আয়াজ হাতঘড়ি খুলে টেবিলের ওপর রাখলো।ইরিনকে বেরিয়ে আসতে দেখে বলল,

—“দরজা খোলা রেখে তুই জামাকাপড় চেইঞ্জ করছিস?তোর আক্কেল আন্দাজ নেই? এখান থেকে বসলে তোর ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সব দেখা যায়।তুই এত বোকা হলি কি করে ইরিন?”

ইরিন বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো।পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো,সে রুমে জামা চেইঞ্জ করেছে?.ওয়াশরুমে যায় নি?..মনে করতে পারছে না।মাথাটা খালি খালি লাগছে।সিঁড়িতে আয়াজকে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে সেই চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো,অন্য কিছু ম্যামরিতে ঢুকেই নি।হায় আল্লাহ!

আয়াজ ধীরস্থির শান্ত কন্ঠে বলল,

—“বড় হয়েছিস,বুঝজ্ঞান খরচ করে চলতে শিখ।এমন বোকার মত কান্ড করিস কেন?”

ইরিনের এখানে বসে থাকতে লজ্জা লাগছে।লজ্জায় আয়াজের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে।আয়াজের সামনে থেকে উঠে যাওয়ার বাহানা করে বলল,

—“আমার অনেক পড়া বাকি আছে আয়াজ ভাই।আমি পড়তে বসবো।”

—“পড়ে লাভ কি?পড়াশোনা মানুষ কি জন্য করে? জ্ঞান অর্জনের জন্য।তোর তো ব্রেইনই নেই।পুরো মাথা ফাঁকা,তুই জ্ঞান রাখবি কোথায়?”

ইরিন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।আয়াজ হঠাৎ মোলায়েম কন্ঠে বলল,

—“এভাবে বোকার মত কাজ আর কখনো করবি না।চেইঞ্জ করার সময় হয় ওয়াশরুমে যাবি আর না হলে রুমের দরজা লক করে চেইঞ্জ করবি!মনে থাকবে?”

—“থাকবে।”

—-“ঠিক আছে যা।”

—“আপনি চা খাবেন আয়াজ ভাইয়া?”

—“তুই বানাতে পারবি?”

—“পারবো।”

—“ঠিক আছে,বানা।”

আয়াজ চা খাচ্ছে।ইরিন ওর পাশে বসে আছে।আয়াজ ওর দিকে একবার তাকালো।চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল,

—“বারবার পড়তে বসবো,পড়তে বসবো করছিলি,এখন যাচ্ছিস না কেন?”

ইরিন সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো।বলল,

—“আপনি কি ছাদে যাবেন?”

—“নাহ!..আমি কিছুক্ষন রেস্ট নিবো। ডিউটি শেষে সরাসরি বাসায় এসেছি,মাথাটা ধরে আছে।ছাদের গেলে আরো বেড়ে যাবে,পুরো বিল্ডিং কাঁপিয়ে ফেলছে সবাই মিলে।”

—“কয়দিনের ছুটি নিয়ে এসেছেন?”

—“তিনদিনের।”

—“সোফায় শুতে পারবেন? মাহিনের বিছানা ঠিক করে দিই?”

—“তোর পড়া আছে না?..এতক্ষন তো পড়তে বসবো পড়তে বসবো করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিস,এখন যাচ্ছিস না কেন?..যা নিজের কাজে যা।”

ইরিন মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।আয়াজ ঠোঁট উলটে বলল,

—“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার কথা বুঝিস নি?”

—“বুঝেছি!”

—“এবার যা পড়তে বয়।”

দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো ইরিন,আশ্চর্য তার একফোঁটাও পড়তে ইচ্ছে করছে না।হঠাৎ করেই আয়াজের পাশে বসে থাকতে মন চাইছে।
বই বন্ধ করে উঠে গেলো সে।বেশ সাজগোজ করলো,এবারে হলুদ লেহেঙ্গার সাথে ভারী মেকাপ করেছে,সাথে মেচিং জুয়েলারি।আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই হাসলো কিছুক্ষন।উদ্দেশ্য ছাদে যাবে।এখন আর পড়া হবে না।শুধু শুধু বসে থেকে লাভ নেই।তার চেয়ে মজা করাই ভালো।

আয়াজ কে দেখতে পেলো।সোফায় লম্বা হয়ে ঘুমাচ্ছে।তার একটা হাত সোফার বাইরে ঝুলছে,অন্যহাতে মাথার নিচে রাখা।

ইরিন বেরোতে গিয়ে দরজা থেকে ফিরে এলো।ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে না!আয়াজ এর ক্লান্ত,অচেতন মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।এত সুন্দর কেন?চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপালের ওপর ছড়িয়ে আছে।পাঞ্জাবী প্রথম দুটো বোতাম খোলা,ফর্সা বুকের খানিকটা দেখা যাচ্ছে!

ইরিন ওর পাশে এসে হাটুমুড়ে বসলো।ঝুলে থাকা হাতটা তুলে দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না।লজ্জা,ভয়,অস্বস্তি ওকে আটকে দিচ্ছে।
একবার ভাবলো আয়াজকে ডাকবে পরে ভাবলো ঘুম নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।নিশ্চই ভীষণ টায়ার্ড!
আলতো করে আয়াজের হাতটা বুকের ওপর তুলে দিতেই আয়াজের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

ইরিন থতমত খেয়ে লজ্জিত কন্ঠে বলল,

—“না মানে আমি আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম,রুমে গিয়ে শোবেন চলুন।এখানে নিশ্চই ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে?”

—“তুই আমাকে ডাকার জন্য এত সেজেছিস?..মতলবটা কি তোর?”

—“ছাদে যাবো তাই!”

আয়াজের মুখটা রাগে ত্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো।

—“ছাদে যাবি মানে? তুই না পড়তে বসেছিস?”

—“হ্যাঁ কিন্তু এখন মন বসছে না,শুধু শুধু বসে থেকে তো লাভ নেই।”

—“মন বসছে না মানে কি? মনের নাম মহাশয়!যেভাবে বসাবি সেভাবে বসবে!..যা পড়তে বয়।”

—“আমি এখন ছাদে যাবো।”

—“বেরো তুই!তোর ঠ্যাং যদি আমি না ভেঙেছি তো আমার নামও আয়াজ না।”

—“দিন।আমার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিন।আপনার যা মন চায় করুন।”

—“আবার মুখে মুখে তর্ক!..যা পড়তে বয়!”

—“আমার এখন পড়ায় মন বসবে না।মরে গেলেও না।”

—“তুই যাবি?”

ইরিন হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালো।রুমে ঢুকে রাগে বই ছুঁড়ে মারলো,ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর।আয়াজ বুয়াকে দরজা আটকে দিতে বলে ছাদে চলে গেছে।ইরিনের মন চাইছে আয়াজকে টেনে এনে তার সাথে বসিয়ে রাখতে।বদ লোক!ওকে একা ফেলে চলে গেছে।
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:৬

বিয়ের পরের দিনের পরদিনই আয়াজ চলে গেলো।দুপক্ষের মেহমানে ভর্তি পুরো বাসা!ইরিনের মনে হচ্ছে সে যদি আয়াজের মত কাজের দোহাই দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারতো তাহলে খুব ভালো হত!এদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া যেত।রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পর্যন্ত পারে না এদের জন্য,চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ি উঠিয়ে ফেলছে।

তারপর প্রায় দুইমাস যাবত পরীক্ষা চললো ইরিনের।এবার অনেক পরিশ্রম করেছে সে।পরীক্ষা শেষেও বিরতি নেই।ভর্তি পরীক্ষার জন্য আগের চেয়ে দ্বিগুন পরিশ্রম করতে হচ্ছে।সময় কোন দিক দিয়ে কেটে যায় টেরই পায় না।তবে মাঝে মাঝে অবসর পেলে বিয়ের ছবিগুলো দেখে আর হাসে!আয়াজের বিভিন্ন ভাবে পোজ দিয়ে তোলা ছবি।হলুদে মজা করতে না পারলেও বিয়েতে একেবারে জমিয়ে দিয়েছে!নাচানাচি থেকে শুরু করে লুডু খেলা পর্যন্ত সব করে ফেলেছেন!আর ইরিন? আয়াজ যেই কয়দিন ছিলো সেই কয়দিন বইয়ে মুখ গুঁজে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছে সে কিন্তু মাথায় কিছু ঢোকাতে পারে নি।

আজকে সকাল থেকে ভীষণ টেনশনে আছে ইরিন।তার এইচএসসির রেজাল্ট বেরোবে।যোহরের নামাজের বিছানায় বসে আছে সে।এখন বাজে দেড়টা,দুইটায় রেজাল্ট বেরোবে।মায়মুনা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেছেন,মেয়ে যদি ফেইল করে বসে?..বিয়ে দেবেন কি করে?লজ্জায় তো উনার মাথা কাটা যাবে।আয়াজের ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ে হবে,মেয়েকে শিক্ষিত হওয়া দরকার।

ইরিন রেজাল্টের জন্য মেসেজ পাঠিয়ে বসে আছে।হাত পা কাঁপছে ওর।এখনো রিপ্লাই আসে নি।একমিনিট এর ভেতর মেসেজ টিউন বেজে উঠলো।আল্লাহ আল্লাহ করে মেসেজ ওপেন করলো।
রেজাল্ট দেখে পাক্কা তিরিশ সেকেন্ডের মত হ্যাং মেরে বসে ছিলো!তারপর পুরো বাসা কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।ওর চিৎকারে মায়মুনা বেগম ভয় পেয়ে গেছেন,ছুটে এলেন মেয়ের কাছে।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”রেজাল্ট কি আসছে মা?..চিৎকার দিলি কেন?..খারাপ কিছু?”

ইরিন মায়ের গলা জড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,”আমি এ প্লাস পেয়ে গেছি আম্মা।”
বলতে বলতে কেঁদে ফেললো সে।ঠিক তখন ওর ফোনে আবারও মেসেজ টোন বেজে উঠলো।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো টেলিটক থেকে মাত্র মেসেজ এসেছে।তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিলো এতক্ষন?..হায় আল্লাহ!দিবাস্বপ্ন?এটা কি করে হয়?

নাহ!আবার দেখলো রেজাল্ট ঠিকই আছে। তাহলে প্রথম মেসেজটা পাঠালো কে?ও ফোন হাতে নিয়ে সেই নাম্বারে কল করলো,কিন্তু রিসিভ হলো না।

মায়মুনা বেগম সন্দিগ্ধ গলায় বললেন,

—“কাকে ফোন করছিস?রেজাল্ট কি ভুল এসেছে?”

—“রেজাল্ট ভুল হবে কেন?আমি নিজে মিলিয়ে দেখেছি আমার রোল নাম্বার রেজিট্রেশন নাম্বার, এই যে দেখো?”

মায়মুনা বেগমের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলো সে।মায়মুনা বেগম নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন,”তাহলে ফোন করলি কাকে?”

অপরিচিত নাম্বারটা কার ইরিন জানে না।মিথ্যে বলল সে,
—“আমার এক বান্ধবীকে।ওর রেজাল্ট জানার জন্য!

—“ফোন ধরে নি?”

—“উহু!…এখন তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াও তো আমি সালাম করবো।আব্বা কোথায়?”

মায়মুনা বেগম মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,”তোর আব্বা মসজিদে।”

রাতের বেলা আবার সেই অপরিচিত নাম্বারে ডায়াল করলো ইরিন।দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো।ইরিন বিনয়ী কন্ঠে সালাম দিয়ে বলল,

—“এই নাম্বার থেকে দুপুরে আমার ফোনে মেসেজ এসেছে!”

—“হ্যাঁ তো?”

—“আয়াজ ভাই আপনি?”

—“হ্যাঁ আমি। রেজাল্ট পেয়ে ভাবলাম তোকে মেসেজ পাঠিয়ে দেই।”

ইরিনের কি যে খুশি লাগছে সে বলে বোঝাতে পারবে না।আবার দুঃখও লাগছে আয়াজ তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে না কেন?

—“তুই কি আর কিছু বলবি?”

—“না।”

—“তাহলে রাখি।”

—“শুনুন?”

—“আবার কি?”

—“আপনি কিছু বলবেন না?”

—“আমি আর কি বলবো? ভালো রেজাল্ট করেছিস ভালো কথা।ভর্তি পরীক্ষার জন্য মন দিয়ে পড়াশোনা কর।আসল চ্যালেঞ্জ ঐখানে।ভালো রেজাল্ট করে কোথাও চান্স না পেলে সেই রেজাল্টের কোন মূল্য থাকবে না।সুতরাং ঢিলেমি করলে চলবে না।প্রত্যেকটা মুহূর্ত কাজে লাগাতে হবে।ঠিক আছে?”

—“ঠিক আছে।”

—“রাখি আমি।খোদা হাফেজ!”

—“খোদা হাফেজ।”

ইরিন ফোন রেখে চুপ করে রইলো।ঠিকই বলেছে আয়াজ ভালো রেজাল্ট করে ভর্তি পরীক্ষায় কোথাও চান্স না পেলে মান ইজ্জত শেষ।এবার থেকে আরো অনেক বেশি করে পড়াশোনা করতে হবে তাকে।সবাই নিশ্চই অনেক আশা করে আছে তার ওপর।


অবশেষে জান লাগিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা ফল ইরিন পেলো, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধা তালিকায় সাতানব্বই তম হয়েছে সে।পুরো এপার্টমেন্টে খুশির রোল পড়ে গেছে।ইরিনের বাবা পুরো মহল্লার লোকজনকে মিষ্টি খাইয়েছেন।উনার মেয়ে যে এত প্রতিভাবান উনি জানতেনই না।মায়মুনা বেগম স্থির করে ফেলেছেন,মেয়ে যতদূর পড়তে চায় পড়বে।মেয়ের অমতে বিয়েশাদী দেবেন না।এত ভালো রেজাল্ট করেছে ভাবতেই উনার বুকটা ভরে যাচ্ছে।

রেজাল্ট বেরোনোর সপ্তাহ খানেক পর আয়াজ বাসায় এলো।ইদানীং তার ভীষণ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।প্রিলিতে চান্স পেয়ে গেছে সে,বাকি আছে রিটেন আর ভাইবা।ব্যস্ততার জন্য এই কয়েকমাসের মাঝখানে মাত্র একদিন এসেছিলো,তাও সোহেলির অসুস্থতার কথা শুনে,এছাড়া আর কোন ছুটি পায় নি।

বিকেল বেলা ছাদে উঠলো ইরিন।আয়াজকে দেখে চমকে গেলো।দিনদিন কি আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে নাকি মানুষটা?..আর এভাবে কেন এসেছে? ডাক্তার মানুষ!পরনে একটা শর্টস আর টিশার্ট।কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে।মনে হচ্ছে সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা টগবগে তরুণ!আয়াজ ওকে দেখতে পায় নি।

ইরিন ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।এতদিন বাদে আয়াজের সাথে দেখা,সে নিশ্চই ইরিনের রেজাল্টের খবর পেয়েছে?

ছাদে উঠে চুপচাপ গিয়ে রেলিং এর ধার ঘেষে বসলো সে।সাথে সাথেই আয়াজ ধমকে উঠলো।

—“বাদরের মত ঝুলে বসেছিস কেন?তুই কোনদিন মানুষ হবি না তাই না?..এখনো দাঁড়িয়ে আছে।..নাম!”

ইরিনের দৃষ্টি ওর ফর্সা পায়ের মিশকালো লোমগুলোর দিকে,গোড়ালির ওপর থেকে হাটুর সামান্য নিচ পর্যন্ত! উফফ!..হার্ট এটাক করে ফেলবে সে।এভাবে শর্টস পরে ছাদে উঠার কি দরকার?..দেখানোর জন্য?

—“এই নামতে বলেছি না তোকে?..নাম!”

ইরিন নেমে গেলো।কোন প্রতিউত্তর দিলো না।আয়াজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।ইরিনের মনে মনে আনন্দ হচ্ছে।আয়াজের এর কাছে সরে এসে বলল,”কবে এসেছেন?”

—“তুই জানিস না?”

—“আমি জানবো কি করে?”

—“তুতুরীকে চকলেট দিয়েছিলি কেন?”

ইরিন শুকনো ঢোক গিলল।তুতুরীকে বলেছিলো আয়াজ ছাদে এলে সে যেন ইরিনকে চুপিচুপি এসে বলে যায়।কিন্তু তুতুরী সে কথা আবার আয়াজকে বলে দিয়েছে।ইরিন লাজুক ভাবে হাসল।বাচ্চা মেয়েটাকে বলাটাই ওর উচিৎ হয় নি।আমতা আমতা করে বলল,
—“আসলে আপনার সাথে জরুরী আলাপ ছিলো।আপনি ব্যস্ত মানুষ তাই তুতুরী কে বলেছিলাম আপনি ছাদে এলে যাতে আমাকে ইনফর্ম করে।”

—“ছাদে ইনফর্ম করার দরকার কি?বাসায় গেলি না কেন?”

মেহরিন বিড়বিড় করে বলল,”বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি বেশি যাওয়া ভালো না।” কিন্তু শব্দ করে বলল,

—“আমি তো আপনাদের বাসায় যাবো না।আপনার সাথে না আমার ঝগড়া হয়েছিলো?”

—“নাটক করছিস? ঠাস করে একটা মারবো!ফাজিল!”

ইরিন আশাহত হলো।আয়াজ তো সেই আগের মতই ব্যবহার করছে।সে কি ইরিনের ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার খবরটা জানে না?

—“আচ্ছা বাদ দিন।আপনার বান্ধবী শিলা কেমন আছে?..ঐ যে যাকে আপনি আপনার রেজাল্টের দিন নীল একটা জামদানী গিফট করেছিলেন।”

—“ওর বিয়ে হয়ে গেছে।হাজবেন্ডের সাথে কানাডা চলে গেছে।”

ইরিন শুকনো কন্ঠে বলল,”ওহ!”

—“তুই ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

—“এমনিতেই, উনি ঢামেক এর ছাত্রী না?”

—হ্যাঁ।তো?”

—“কিছু না।”

আয়াজ আবারও ফোনে মনযোগ দিলো।ইরিনের বিরক্ত লাগছে।আয়াজকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে।ইরিনের রেজাল্ট নিয়ে একটা কথাও বলছে না সে?ইরিন উশখুশ করে বলল,

—“আমি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছি মাহমুদ ভাই।”

—“শুনেছি।বাসায় আসার পর ভাবী বলেছে।”

—“সাতানব্বই তম হয়েছি।”

—“হুম।”

—“কি হুম?..আপনি কি আমার কথা শুনেছেন?..আমি সাতানব্বই তম হয়েছি।”

—“শুনেছি।”

—“না শোনেন নি।এত ভালো একটা কথা বললাম আপনাকে আপনি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন?”

আয়াজ বিরক্ত গলায় বলল,”তো আমি কি করবো মাথায় তুলে নাচবো তোকে?…আজব!এতবার বলার কি আছে?

—“আমি মাত্র দুবার বলেছি।”

—“তোর দুবার বলাটাই আমার দুশবার বলার চেয়ে বেশি বিরক্ত লেগেছে।”

—“আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন?”

—“রাগবো না তো কি করবো?…শো অফ করছিস কেন?.. চান্স পেয়েছিস ভালো কথা,এখানেই তো সব শেষ নয়? আগে পাশ করে বেরো।এখনই নাচানাচি করছিস কেন?এত সহজ না মেডিকেল লাইফ!

ইরিনের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।শিক্ষা হয়ে গেছে ওর।আয়াজ বিরক্ত কন্ঠে বলল,
—-“তুই কি বলতে এসেছিস বলে বিদায় হ।”

ইরিন জবাব দিলো না,হাঁটা ধরলো।নিজেকে কি ভাবে আয়াজ?সে কি আরবের খোরমা খেজুর? নায়ক সালমান খান? নাকি ওমার বোরকান আল গালা? ইরিন আর কখনো তার সাথে কথা বলবে না।নিজের মত থাকবে সে, আয়াজ থাকুক তার ভাব নিয়ে।ওকে ফিরে যেতে দেখে তড়িৎগতিতে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো আয়াজ।ইরিনকে এভাবে বলা ঠিক হয় নি তার।ইরিনের সাথে ঝগড়া করতে করতে সব কিছু নিয়ে ঝগড়া করার অভ্যেস হয়ে গেছে তার।কিন্তু এইমুহূর্তে ইরিনকে এভাবে হার্ট করা একদমই উচিৎ নয় নি।নরম কন্ঠে বলল,

—“যাচ্ছিস কেন?”

—“কি বলতে এসেছিলাম ভুলে গেছি।”

আয়াজ দুষ্টু হেসে বলল,

—“ভুলে গেছিস?এত ভুলে যাস কেন তুই?..তোর কি ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া?..ওড়না পড়তে ভুলে যাস,চেইঞ্জ করার সময় দরজা বন্ধ করতে ভুলে যাস,কি বলতে এসেছিস সেটা ভুলে যাস!মন কোথায় থাকে?”

তবে ইরিনের রাগ পড়লো না।নাকমুখ লাল করে বলল,
—“অ্যামনেশিয়া কি না জানি না,তবে বুঝেন তো গাধাটাইপ স্টুডেন্ট ব্রেইন অতো শার্প না,তাই সব ভুলে যাই।”

—“আমি কখন বললাম তুই গাধা টাইপ স্টুডেন্ট?”

—“আপনি সরুন আমার সামনে থেকে।আমি নিচে নামবো।”

—“না,এখন তুই নামতে পারবি না।হুট করে আমাকে একটা কথা বলে ব্লেইম করে দিলি।উইদআউট এক্সপ্লেনেশন তো তুই চলে যেতে পারবি না।”

ইরিন হাত জোড় করে মাফ চাইবার ভঙ্গি করে বলল,
—“আমি সরি আয়াজ ভাই,আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি আর কখনো এমন বেফাঁস কথা বলবো না।এবারের মত মাফ করে দিন।”

ওর সূক্ষ্ম তিরস্কারটা ধরতে আয়াজের সময় লাগলো না।ইরিনের রাগের পরিমানটা আন্দাজ করে ফেললো।মুচকি হেসে বলল,

—“আচ্ছা যা সরি।”

—“আমি আপনাকে কিছু বলেছি?”

ইরিন আবার হাঁটা ধরলো।আয়াজ আবার তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল,

—“সরি বললাম তো।”

—“আপনি আমার সামনে থেকে সরুন।”

—“না।আগে বল তুই সরি এক্সেপ্ট করেছিস?”

—“না করি নি।আমি কষ্ট পেলে তারপর তো সরি এক্সেপ্ট করবো? আপনি আমার কে যে আমি আপনার কথায় কষ্ট পাবো?”

—“ইরিন?”

—“ইয়েস।ইউ আর নাথিং টু মি।”

আয়াজের মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো।ইরিন কি বদলে যাচ্ছে? আগে তো এমন ছিলো না? তার সাথে অনেক ঝগড়া হয়েছে আয়াজের কিন্তু এমন কথা তো আগে কখনো সে বলে নি? তাহলে? বিয়েতে হ্যাঁ বলে কি কোন ভুল করেছে আয়াজ? ইরিন যদি রাজী না হয়?দীর্ঘশ্বাস ফেললো আয়াজ।হতে পারে!ইরিনের জগৎ আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।ছোটবেলার মত আয়াজের সাথে পাগলামি দুষ্টুমি তার নাও ভালো লাগতে পারে।মলিন মুখে বলল,
—“সব সময় উলটো বুঝিস কেন তুই আমাকে? আমি কি তোর খারাপ চাই?”

ইরিন জবাব দিলো না।আয়াজ সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল,

—” ঠিক আছে যা তোর যেখানে মন চায় যা।”

ইরিন কিছুক্ষন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো।তারপর চুপচাপ নেমে গেলো।ফিরেও তাকালো না।
আয়াজ বিষন্ন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে!।মন খারাপের বৃষ্টি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here