৭+৮+৯+১০
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:৭
দুপুরের দিকে মায়মুনা বেগম ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন।উনার প্রেশার বেড়ে গেছেন,সকালে উনি ইরিনের গালে সটাং করে চড় বসিয়ে দিয়েছেন।ওকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে উনি হয়রান হয়ে গেছিলেন,শেষে আর রাগ সামলাতে পারেন নি।ইরিন কিছুতেই ভর্তি হতে যাবে না।এদিকে আজকে লাস্ট ডেইট।অথচ সে গোঁ ধরেছে মেডিকেলে পড়বে না।ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জুওলজি পেয়েছে,ওটা নিয়েই পড়বে।হঠাৎ করে ওর এমন মতিভ্রম হলো কেন সবাই বুঝতে পারছে না।আয়াজের বাবা হেলাল সাহেব নিজে এসে বুঝিয়ে গেছেন,তবুও তার সিদ্ধান্ত বদল হলো না।
ঘড়িতে কাটায় কাটায় আড়াইটা বাজে। কলিংবেল বেজে উঠলো।তার সাথে একবার নকও হলো। ইরিন দরজা খুলতে গেলো।মায়মুনা বেগম ঘর আটকে বসে আছেন।উনি বেরোবেন না।
আয়াজকে দেখে ইরিন চমকালো না।তার কেন জানি মনে হয়েছিলো আয়াজ আসবে!ওকে ঝাড়ি মেরে বলবে কি পাগলামি শুরু করেছিস তুই? হ্যাঁ! ক্লান্ত,বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ।কোন রকম ভনিতা ছাড়াই বলল,
—“রেডি হয়ে আয়।”
—“কেন?…আমি এখন কোথাও যাবো না।”
—“আমার মেজাজ খারাপ করিস না ইরিন!যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।”
ইরিন রেডি হতে চলে গেলো।ফিরে এসে দেখলো আয়াজ সোফায় বসে আছে।
—“রেডি?”
ইরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
গাড়ি নিলো না আয়াজ।রিক্সা আগেই ঠিক করে রেখেছিলো।বাসার নিচে দাঁড় করিয়ে উপরে উঠে এসেছে সে।ইরিনকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো।ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এসে রিক্সা থামলো।রিক্সা থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার সময় ইরিনের ডান হাত চেপে ধরে রাস্তা পার করলো।ইরিনের লজ্জা লাগছে।এতবড় মেয়েকে কেউ ধরে ধরে রাস্তা পার করায়? ফিসফিস করে বলল,
—“আমার হাত ছাড়ুন আয়াজ ভাই।আমি রাস্তা পার হতে পারবো।”
আয়াজ ছাড়লো না।এমনকি ইরিনের কথার জবাবে কোন কথা বললো না।গেটের সামনে এসে হাত ছেড়ে দিলো।তারপর দুজনে একসঙ্গে ভেতরে ঢুকলো।
★
ভালোলাগা,আবেগ,আনন্দ,লজ্জা সবমিলিয়ে অদ্ভুত এক উত্তেজনা চলছে ইরিনের ভেতর।আয়াজের পাশে রিক্সায় বসে আছে সে। ভর্তি শেষ।বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট ইরিন।
আয়াজ থমথমে গলায় বলল,
—“আমার আটহাজার সাতশো টাকা আমাকে ফেরত দিয়ে দিবি।”
—“দেবো না।”
—“দিবি না মানে?”
—“দেবো না মানে দেবো না।”
—“তোদের গুষ্ঠিসুদ্ধ সবাই বাটপার নাকি?..তোর বোন সেদিন আমার ভাইয়ের পকেট থেকে সাড়ে নয় হাজার টাকা সরিয়েছে।ভাইয়াকে দেখলাম প্যানপ্যান করছে!এটা তো রীতিমত ডাকাতি!তোরা ডাকাতের বংশধর?
ইরিন চোখ পাকালো।আয়াজ সমঝোতার ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বলল,
—“যাইহোক আমার টাকা আমাকে ফেরত দিবি।”
—“আচ্ছা দেবো।কিন্তু ভর্তি তো আটহাজার চারশো আপনি বাকি তিনশো টাকা বেশি চাইলেন কেন?”
—“গাড়িভাড়া কি তোর শ্রদ্ধেয় আব্বাজান দিয়েছে?”
—“কিপ্টা!”
—“কি কিপ্টা?”
—“আপনি একটা কিপ্টুস!”
—“তুই তো বিরাট নির্লজ্জ রে ইরিন!…আমি যে এত কষ্ট করে তোকে ভর্তি করিয়েছি তোর সেই কৃতজ্ঞতা বোধ পর্যন্ত নেই।…ডিউটি করতে করতে দম ফেলার সুযোগ পাই না,তাও তোর জন্য জানমাটি করে আসতে হলো।…তুই টাকার হিসেব করছিস?”
—“আমি কি আপনাকে আসতে বলেছি?”
—“তুই বললে আমি আসতাম?..তোর শ্রদ্ধেয় আম্মাজান ফোন দিয়ে কান্না জুড়ে দিলেন!তোকে ঠিক করার দায়িত্ব তো উনি আমার ওপরই দিয়েছেন,তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো।”
—“আম্মা আপনাকে ফোন দিয়েছে?”
—“জ্বি দিয়েছে।আপনার শ্রদ্ধেয় আব্বাজানও দিয়েছে।”
ইরিন আবারও আশাহত হলো।আয়াজের ক্লান্ত লাগছে।এই নির্বোধ মেয়েটার জন্য টানা আঠারো ঘন্টা ডিউটি শেষে খেতে পর্যন্ত পারে নি সে।মায়মুনা বেগমের কাছ থেকে সব শুনে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো।বোকা মেয়েটা যে তার ওপর জেদ করেই মেডিকেলে পড়বে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটুকু বুঝতে ওর অসুবিধে হলো না।অনেক দৌড়ঝাঁপ করে ছুটি নিয়ে ইরিনকে ভর্তি করাতে এসেছে সে।খাওয়ার সময় টুকু পর্যন্ত পায় নি। এখন খিদেয় ওর পেট চোঁ!চোঁ! করছে।রাস্তার পাশে একটা হোটেলের সামনে রিক্সা থামালো।
★
আয়াজ খাচ্ছে,ইরিন নিচু গলায় বলল,
—“আপনি এমন রাক্ষসের মত খাচ্ছেন কেন আয়াজ ভাই?..আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কতদিনের অভূক্ত আপনি।জেলখানার কয়েদিদের মত খাবারের ওপর হামলে পড়েছেন!
একটুখানি হাসলো ইরিন।আয়াজ খাওয়া বন্ধ করলো না।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,”আমার হাত খালি নেই,তা না হলে এইমুহূর্তে তুই আমার হাতে ঠাটিয়ে দুটো চড় খেতি।”
ইরিন আবারও হাসলো।আয়াজ খেতে খেতে বলল,
—“বিল তুই দিবি!”
ইরিন ভেংচি কাটলো।অসভ্য লোকটা নিজে নিজেই খেয়ে চলেছে, ওকে একটাবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করে নি খাবে কিনা!এখন আবার বলছে বিল ওকে দিতে হবে!!
—“আমি কেন দেবো? খাচ্ছেন তো আপনি..তাছাড়া আমি টাকা আনি নি।”
—“কেন দিবি মানে? তোকে নিয়ে যে বেগার খাটলাম?তার কোন দাম নেই?..টাকা না থাকলে পরে দিবি।”
—“তারমানে আপনি মজুরী চাচ্ছেন? পারিশ্রমিক?”
আয়াজ খাওয়া থামিয়ে দিলো।ইরিন হাসছে।আয়াজের রাগী রাগী মুখ দেখেও কোনভাবেই থামছে না তার হাসি।আয়াজ আচমকা ইরিনের মুখের ভেতর আস্ত লেগপিস ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,”বেয়াদপি করতে না করেছি না?..হাস!এবার ভালো করে হাস!হাত পা ছড়িয়ে হাস!গড়িয়ে গড়িয়ে হাস!তোর যেভাবে মন চায় সেভাবে হাস!”
হাসি থামিয়ে ইরিন কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে আয়াজের দিকে তাকালো!আয়াজ নামক জল্লাদটার সাথে মজা করার শাস্তি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সে।আশেপাশের লোকজন সবাই হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে আছে,আর ভাবছে বেচারী!..অসহায়!
তবে আয়াজকে শিক্ষা দেওয়ার ভালো একটা ফন্দি আটলো মনে মনে।মাংসের টুকরোটা মুখে নিয়ে বসে রইলো চুপচাপ। আয়াজ টেনে ওর গাল থেকে লেগপিসটা বের করতে চাইলো।কিন্তু শক্ত করে কামড়ে ধরে বসে আছে সে।ফেলছেও না গিলছেও না।
—“এই তুই খাবি? আমি কিন্তু এটাতে মুখ দিয়েছি!
ইরিন ফেললো না।আগের মতই বসে রইলো।
—“আজব!মুখে ধরে রেখেছিস কেন?..হয় খা!..নয়ত ফেলে দে!”
—-“আম্মার ম্মমুড়ে ঢুকিয়েছিল্লেন গেনো?”
ইরিনের এই কথার মানে হচ্ছে ‘আপনি আমার মুখে ঢুকিয়েছেন কেন?’ কিন্তু মাংসের টুকরোটা মুখের ভিতর থাকায় তার কথার কিছুই বুঝে নি আয়াজ।সরু চোখে তার দিকে চেয়ে রইলো।
—“তুই মুড়ে গুড়ে কি বলছিস এসব?”
ইরিন জবাব না দিয়ে মাংসটা চিবানো শুরু করে দিলো।আয়াজের মুখের ওপর এবার বিরাট আকারের একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলে উঠেছে,এর মানে হচ্ছে,”আমার চিবানো মাংস তুই খাচ্ছিস কি করে?”
ইরিন হাসলো,আগের মতই আয়াজের আধখাওয়া মাংসটা খেতে খেতে বলল,”দারুণ টেস্টি!”
—“আস্তে খা!..মুখের চারপাশে লেগে যাচ্ছে তো!”
এই বলে সে পকেট থেকে রুমাল বের করে ইরিনের দিকে বাড়িয়ে দিলো,”মুখ মোছ!”
—“মুছিয়ে দিন।”
—“ঢং করবি না।..নে ধর!”
ইরিন ঠোঁট ফুলিয়ে রুমালটা নিয়ে মুখ মুছলো।সে তো ভুলেই গেছে এই মানুষটা বেরসিক,নিরস,জঘন্য রকমের মানুষ।এর কাছে কিছু আশা করাটাই বোকামি।
★
খাওয়া শেষে দুজনে বেরিয়ে আবার রিক্সায় উঠলো।আয়াজ বিরক্ত গলায় বলল,”তুই আমাকে আরো আশিটাকা বেশি দিবি।”
—“কেন?”
—“আমার নতুন রুমাল তুই নষ্ট করেছিস তাই।”
ইরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বলল,”আর কি কি বাদ আছে মি.আয়াজ রহমান!আমাকে নিতে আসার জন্য আপনি যেই শার্ট,প্যান্ট পরে এসেছেন তার দাম বাকি কেন?সেগুলোর কথাও বলুন?আমি দিয়ে দেবো!আপনার সব টাকা আমি দিয়ে দেবো..চাইলে আন্ডারওয়্যারের দামও দিয়ে দেবো।”
——-“এই কি বিড়বিড় করছিস তুই?”
ইরিন চুপ মেরে গেলো।ভাগ্যিস আয়াজ শুনতে পায় নি!পেলে হয়ত সত্যি সত্যি আন্ডারওয়্যারের দাম ধরে বসতো!ছি!ছি!
★
ভর্তি হয়েছে এসেছে মাসখানেকের বেশি হয়ে গেছে।ভর্তি হয়ে আসার পর থেকে অলস সময় কেটেছে ইরিনের।
এখন রাত দুটা,ইরিন বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।কালকে ওর অরিয়েন্টেশন ক্লাস,নতুন জীবন শুরু করবে।হালকা টেনশন হচ্ছে, আসলে ঠিক টেনশন না উত্তেজনা।নতুন ক্যারিয়ার!জীবনের নতুন দিক!
আয়াজদের বারান্দায় ছায়া দেখা যাচ্ছে।কেউ বসে আছে মনে হচ্ছে।আয়াজ তো নেই,তাহলে কে বসে আছে?
ইরিন আবার তাকালো।নেই।একটু পর আবার দেখলো।বিরক্ত লাগছে।কি হচ্ছে এসব তার সাথে?সারাদিন আয়াজকে ভেবে ভেবে মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে,রাতদুপুরেও জ্বালাতন!
হঠাৎ আয়াজের ডাক শুনেই চমকে উঠলো।
—“হরিণ?”
ইরিন জবাব দিলো না।ওর দৃষ্টিভ্রম এর সাথে কি শ্রুতিভ্রমও হচ্ছে ?..সিউর না।রুমে ঢুকে যাবে?যদি সত্যি সত্যি আয়াজ হয়?
আয়াজ ফোনের টর্চ অন করে ওদের বারান্দায় আলো ধরলো।আলোটা ঠিক ইরিনের চোখ বরাবর এসে পড়েছে,হাত দিয়ে আলো ঢাকার চেষ্টা করলো সে।
—“এত রাতে বারান্দায় কি করিস?তোর না কালকে ক্লাস?”
—“আপনি?”
—“হ্যাঁ আমি।”
—“আপনি সত্যি সত্যি?”
—“আশ্চর্য!..আমিই তো!”
—“আপনি কবে এসেছেন?”
—“আজকে সন্ধ্যায়।”
ইরিনের মন খারাপ হয়ে গেলো।কত আশা করে রেখেছিলো কালকে হস্পিটালে গিয়ে ও আয়াজের সাথে দেখা করবে,ওর মেডিকেল লাইফের প্রথম দিন বলে কথা।কিন্তু আয়াজ তো বাসায় চলে এসেছে।
—“থাকবেন নাকি?”
—“দুদিন আছি।”
ইরিন নিরস গলায় বলল,”ওহ!”
আয়াজ ওকে মৃদু গলায় ধমক দিয়ে বলল,
—“তুই এত রাতে চুল ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় কি করিস?…চুল বাধ!”
ইরিন হাতখোঁপা করে চুল বেধে ফেললো।
—“ঘুম আসছে না।”
—“অলস লোকের ঘুম কম হয়।তুই তো অকর্মার ঢেঁকি,তাই তোর ঘুম কম হয়।অবশ্য মেডিকেল লাইফে রাত জাগতে পারাটা ভালো অভ্যেস। ঘুম যত কম যেতে পারবি ততই মঙ্গল।রাত জেগে পড়াশোনা করা যায়।তবে তোর ব্যাপার আলাদা,তুই তো বিশ্বফাঁকিবাজ!”
—“আপনিও তো রাতে ঘুমান না?..গুনগুন করে গান গান আর কফি খান?”
আয়াজ হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে আছে।তারপর বলল,”সে তো অনেক রাতের দিকে।তুই রাত জেগে আমাকে পাহারা দিস?”
ইরিন ঠোঁট কামড়ালো।তারপর বলল,”পাহারা দেবো কেন?প্রায়ই আপনাকে দেখি তাই।”
—“যা শুয়ে পড়!সকালে তো তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।”
ইরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।আজকে সারারাত আয়াজের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে তার।
—“দাঁড়িয়ে আছিস কেন?তোকে যেতে বললাম না?”
ইরিন ভেতরে ঢুকে গেলো,কারন যতক্ষণ না ইরিন ভেতরে ঢুকবে ততক্ষণ আয়াজ চিল্লাচিল্লি করেই যাবে,তার চেয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়াই ভালো।
রুমে ঢুকে ইরিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।আয়াজ গুনগুন করছে,ইরিনের মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর সুর ওর কানে বাজচ্ছে।আয়াজ ভাই সিংগার হলেই পারতো!একটু রোমান্টিকও হতে পারতো!..আহ্!আফসোস।
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:৮
পরেরদিন সকালবেলা লিফটের কাছে আয়াজকে দাঁড়ানো দেখে ইরিন অবাক হয়ে গেলো।কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,”এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
—“হস্পিটালে!”
—“আপনি না ছুটি নিয়েছিলেন?”
—“হ্যাঁ!..আর্জেন্ট একটা কাজ পড়ে গেছে।”
—“ভালোই হলো আপনার সাথে যেতে পারবো।”
—“আমার একটা কাজ আছে।কাজ শেষে আমি হস্পিটালে যাবো।তোর দেরী হয়ে যাবে,তুই চলে যা!”
—“হোক দেরী আমি আপনার সাথেই যাবো।”
—“আমি যেতে যেতে তোর ক্লাস মিস হয়ে যাবে তো?”
—“হবে না।”
—“আচ্ছা আয়।”
—“আপনার আবার কোন সমস্যা হবে না তো? মানে আপনার বন্ধুবান্ধবরা যদি কেউ দেখে?”
—“হবে না।”
—“ওরা যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে কি বলবেন?”
আয়াজ চিন্তায় পড়ে গেলো। সত্যিই তো কি বলবে সে? ইরিন ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
—“কি হলো? কি বলবেন ওদেরকে?”
—“বলবো।আমার কাজিন।ছোট বোনের মত।”
ইরিন চটে গেলো,
—“আমি কেন আপনার ছোট বোন হতে যাবো?”
—“তুই রাগছিস কেন? আমি কি ছোট বোন বলেছি নাকি? আমি ছোট বোনের মত। কাজিন সিস্টার।”
ইরিন গটগট করে বেরিয়ে গেলো।পেছন ফিরে তাকালো না পর্যন্ত।আয়াজ মুখ টিপে হাসছে।সে যা ভাবছে ইরিন যদি সত্যি সত্যি সেই কারনে রেগে থাকে তাহলে আজকে আয়াজ সবাইকে ট্রিট দেবে।ইরিন হেঁটে অনেক দূর চলে গেছে।আয়াজ বড়বড় কদম ফেকে ওর কাছে এগিয়ে গেলো।সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকালো।ইরিন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আয়াজ মুচকি হেসে বলল,
—“ইদানীং তুই যে অল্পতেই আমার ওপর রেগে যাস সেটা কি তুই জানিস?”
—“জানি।”
—“তাহলে রাগিস কেন?”
—“আমার ইচ্ছে।”
—“আচ্ছা?”
—“হ্যাঁ।আপনি সরুন আমার ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
—“তুই না বললি আমার সাথে যাবি?”
—“না।যাবো না।”
—“কেন যাবিনা? তোকে কাজিন সিস্টার বলেছি বলে? আচ্ছা তুই বল আমি কি বলবো তোকে?”
—“আপনার বান্ধবী!”
আয়াজ হো হো করে হাসা শুরু করে দিলো।ইরিনের মাথায় চাটি মেরে বলল,
—“ইশস!আমার বান্ধবী।আমার বয়স কত জানিস?”
—“কতো?”
—“ছাব্বিশ!”
—“তো কি হয়েছে?”
—“বোকার মত কথা বলিস না তো ইরিন।ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট একজন ইন্টার্ন ডাক্তারের বান্ধবী,মানে বুঝিস এর? পরে যখন তোর ব্যাচমেটরা ক্ষ্যাপাবে তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবি না।”
—“আপনাকে ক্ষ্যাপাবে না?”
—“না।”
—“না কেন?”
—“সেটা তোর জানার দরকার নেই।আয় গাড়িতে ওঠ।এবার সত্যি সত্যি দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
ইরিন গাড়িতে উঠে বসলো।আয়াজ ওকে ক্লাসের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।ইরিন সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
★
পড়াশোনায় ডুবে থাকতে থাকতে সময় যে কত দ্রুত চলে যাচ্ছে সেটা ইরিনের মাথাতেই নেই।আজকে ওর টার্ম ফাইনাল শেষ। বাসায় আসবে ইরিন।সাথে ইত্তিহাদ আর আসিফ আছে।আসিফ ছেলেটার স্বভাব ভালো না
তবে সাথে ইত্তি আছে তাই ভরসা।ইত্তির বাসাও ধানমন্ডির কাছাকাছি!
ইরিন ব্যাগ পত্র নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আয়াজের নাম্বারে ফোন দিলো,রিসিভ হল না।ইরিনের বিরক্ত লাগছে।এই লোককে ফোন দিয়ে সহজে পাওয়া যায় না।উনি কি ওর ফোন দেখলেই এমন করে নাকি সবার সাথেই এমন?
আয়াজ হোস্টেল থেকে লাঞ্চ শেষে ডিউটির জন্য বেরিয়েছে।ইরিনকে গেটের সামনে দেখে বলল,”ব্যাগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
—“বাসায় যাবো।”
—“ছুটি আছে?”
—হ্যাঁ।পাঁচদিন!
—“তো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
—“একা যাচ্ছি না তো।ইত্তি আর আসিফের জন্য ওয়েট করছি।ওদের সাথে যাবো।”
—“কার সাথে??”
—“ইত্তিহাদ!আমার ক্লাসমেট!”
ওদের কথার মাখখানেই ইত্তি ফোন দিয়ে জানালো সে যেতে পারবে না।তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে বেরোবে।বিরক্তি ফুটে উঠলো ইরিনের চেহারায়।আয়াজ ওর বিরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
—“কোন সমস্যা?”
—“ইত্তি যাচ্ছে না।আমাকে আসিফের সাথে যেতে হবে।”
—“তুই ওর সাথে যাবি?”
—“হ্যাঁ।আমি ইত্তিকে বাসায় যাবো বলেছিলাম তখন আসিফ বলল সেও যাবে।”
—“ওর সাথে যাওয়ার দরকার নেই।ফোন করে বারণ করে দে।বল তুই যেতে পারবি না।”
—“কেন?.. আমার তো ছুটি আছে।”
—“আমি বলেছি তাই।”
—“আমি আম্মার সাথে দেখা করে চলে আসবো।”
—“আমি নিয়ে যাবো তোকে।”
ইরিন চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে আয়াজ দিকে।আয়াজ কি ওকে সত্যি সত্যি নিয়ে যাবে?
—” আপনি সত্যি যাবেন? আপনার ডিউটি আছে না?”
—“তোকে যা করতে বলেছি কর!.এত কথা বলিস কেন?”
—“কিন্তু আপনার ছুটি?”
—“আবার কথা বলে?..আমার ছুটি আমি ম্যানেজ করে নেবো।তুই আগে ওকে ফোন কর!
ইরিন ফোন করে আসিফকে না করে দিলো।আয়াজ ওকে অবাক করে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
—“যা এবার হোস্টেলে যা।”
—“কেন?হোস্টেলে কেন যাবো? আপনি না বলেছেন আমাকে নিয়ে যাবেন?”
—“হ্যাঁ যাবো বলেছি।এরপর থেকে বন্ধ পেলে আমাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখবি আমি নিয়ে যাবো।কিন্তু এবার যেতে পারবি না।”
—“এবার কি সমস্যা?…আমি অনেক দিন আম্মার সাথে দেখা করি না।”
—“শুক্রবারে নিয়ে যাবো।যা এখন হোস্টেলে যা,আমার ডিউটি আছে।দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
—“আমি বাসায় যাবো।”
—“তুই এত ত্যাড়ামি করিস কেন?..আমি যখন বারণ করেছি তখন তো নিশ্চই কোন কারন আছে?”
—“কোন কারন নেই।আমি জানি আপনি ইচ্ছে করে আমাকে আসিফের সাথে যেতে দিচ্ছেন না।”
—“বেশি জানিস না তুই!”
—“সত্যি বলেছি না?”
আয়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে আসিফের নাম্বারে ডায়াল করলো।স্পিকার অন করে দিলো ইরিন যাতে শুনতে পায়।
—“হ্যাঁ,ওয়ালাইকুম আসসালাম আসিফ। কি অবস্থা তোর?”
—“আলহামদুলিল্লাহ ভাই!..ভালো আছেন?
—“আছি আলহামদুলিল্লাহ..তুই কি বাড়ি যাচ্ছিস নাকি?
—“জ্বী ভাই।পাঁচদিন বন্ধ আছে।”
— “ওহ!..বেরিয়ে গেছিস?”
—“না ভাই,এখনো বেরোই নি।কেন আপনি যাবেন?”
—“আরে নাহ,আমার ডিউটি আছে না? তোর সাথে একজনকে পাঠাবো। তুই কষ্ট করে একটু গেটের কাছে আয় তো।”
আয়াজ ফোন কেটে দিয়ে কঠিন গলায় বলল,”যা!..আমি ওকে আসতে বলে দিয়েছি।”
ইরিন রাগে গজগজ করতে করতে ব্যাগ নিয়ে হোস্টেলের দিকে হাঁটা ধরলো।আয়াজ পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলল,”কি রে যাবি না?..এতক্ষণ লাফালি কেন তাহলে?..বেয়াদব!”
ইরিন জবাব দিলো না।রাগ লাগছে তার,প্রচুর রাগ!রাগে আয়াজের মাথাটা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।ওকে জব্দ করে কি আনন্দ পায় আয়াজ?
মনে মনে মায়মুনা বেগমকে দোষারোপ করলো সে।এখানে আসার আগে মায়মুনা বেগম ইরিনকে বলে ছিলো,”সাবধানে থাকবি আর কোন সমস্যা হলে তোর আয়াজ ভাইয়াকে জানাবি।”
আয়াজ তখন সামনেই ছিলো।গলায় মধু ঢেলে বলেছিলো,”আপনি ওকে নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না আন্টি।কোন সমস্যা হলে আমি তো আছি।”
এরপর মায়মুনা বেগম বাংলা সিনেমার অসহায় মায়েদের মত আয়াজের হাত ধরে কেঁদে ফেলে বললেন,
—“তুমি একটু খেয়াল রেখো বাবা।ওর তো হুঁশজ্ঞান কম।তুমি আছো বলেই ভরসা পাচ্ছি,কোন বিপদ আপদ হলে তোমাকে জানাতে পারবে।”
সেই থেকে ইরিনের জীবন তামা তামা।কোথাও যেতে হলে আয়াজকে জানিয়ে যেতে হয়।আয়াজ ভেটো দিলে যাওয়া নিষেধ।ইরিন দুচার বার গোঁ ধরেছিলো,তাতে কোন লাভ হয় নি।মায়মুনা বেগম তার থেকে বেশি আয়াজকে বিশ্বাস করেন। আয়াজ অবশ্য তার কথার মান রেখেছে।খুব বেশি সমস্যা না হলে ইরিনের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে নি সে।কিন্তু ইরিন যতবার তার নিষেধ অমান্য করে কাজ করতে গিয়েছে একটা না একটা গণ্ডগোল পাকিয়েছেই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো সে।ভালো হয়েছে আসিফের সাথে যায় নি।ব্যাচের মেয়েরা আসিফের সম্পর্কে নানারকম আজেবাজে কথা বলে।ইরিনের সাথে তার তেমন কথাবার্তা হয় নি।ছেলেটা সত্যি সত্যি খারাপ কি না কে জানে?তবে আয়াজের ওপর রাগ কমলো না।আয়াজ নিজে ইরিনকে নিয়ে যাবে বলে বোকা বানিয়েছে।তার সাথে কোন কথা বলবে না ইরিন।
★
সন্ধ্যার দিকে বেলকনিতে হাঁটাহাটি করছিলো ইরিন।হালকা বাতাসে শীত লাগছে ওর,বসন্তের শুরু সবে তাই ঠান্ডা ভাব এখনো আছে।পুরো ফ্লোর ফাঁকা।মেক্সিমামই বাড়িতে চলে গেছে।
ফোনে ভাইব্রেশন হতে স্ক্রিনের দিকে তাকালো।আয়াজ কল করেছে
রিসিভ করলো না।আবারও রিং হলো।এবারেও কেটে গেলো।তৃতীয়বার রিসিভ করলো ইরিন,
—“হ্যালো!”
—“দশমিনিট সময় দিলাম তোকে।রেডি হয়ে নিচে আয়।একমিনিট দেরী হলে বাসায় যাওয়া ক্যান্সেল।”
ফোন কেটে গেলো।তড়িৎগতিতে রুমে ঢুকলো ইরিন।চিন্তাভাবনার কোন সময় পেলো না।ব্যাগে জামাকাপড় ঢুকিয়ে,গায়ের জামাটা গায়ে দিয়ে নিচে নামলো।আয়াজ ওকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
—“এসে গেছিস?..ভেরি গুড!”
—“আপনি একটা হনুমান।আমাকে এভাবে দৌঁড় করালেন?”
আয়াজ হাসিমুখে ওকে নিয়ে সামনে এগোলো।
★
আধঘন্টা ধরে ইরিন হস্পিটালে বসে আছে।আয়াজ ওকে বসিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকেছে তারপর আর কোন খবর নেই।
আরো পনেরো মিনিট বাদে বিশ্বজয়ের হাসি নিয়ে বেরিয়ে এলো সে।যদিও হাসিটা দেখেই ইরিনের রাগ পড়ে গেছে তবুও ওকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না সে।
আয়াজ হাসি হাসি মুখে বলল,
—“ছুটি পেয়েছি!”
—“আপনি আমাকে পৌনে একঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে ছুটি নিতে গেছিলেন?”,চেঁচিয়ে উঠলো ইরিন।
—“আরে না।ভেবেছিলাম তোকে দিয়ে আবার চলে আসবো,পরে ভাবলাম যাচ্ছি যখন দুদিন থেকে আসি।তাই ছুটি নিতে গেছিলাম।…আয়, আয়!সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে।”
—“সেটা আমাকে হোস্টেল থেকে বের করে নিয়ে আসার পর আপনার মনে পড়লো? আমাকে দশমিনিটের আল্টিমেটাম দিয়ে আপনি পৌনে একঘন্টা বসিয়ে রেখেছেন কেন?”
—“তুই ইদানীং বেশ বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছিলি।তাই তোকে একটু শিক্ষা দিলাম।এবার চল!”
আয়াজ ওর হাত ধরে গেট থেকে বের হতে নিলে ধমকে উঠলো ইরিন।
—“খবরদার আপনি আমাকে ধরবেন না।আমি আপনার সাথে কোন কথা বলবো না।”
আয়াজ এবারও হাসলো।মাথা নাড়িয়ে বলল,
—“ঠিক আছে।মনে থাকে যেন?”
ইরিনের রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।আয়াজের ভিলেনটাইপ হাসি দেখে।গেট থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠলো দুজনে।
রিক্সায় বসে ইরিন ওর ডান হাতটা চেপে ধরতেই আয়াজ বলল,
—“এখন তুই আমাকে ধরেছিস কেন?..ছাড় আমার হাত।”
ইরিনের মনে হচ্ছে আয়াজ যেন আগে থেকেই জানতো রিক্সায় ঝাঁকুনি হবে তাই ইচ্ছে করেই ইরিনের কথার কোন প্রতিবাদ করে নি।কিন্তু এখন ইরিন না ধরে বসলে যে বিপদে পড়ে যাবে।রিক্সা যেই পরিমান ঝাঁকাচ্ছে তাকে যে কোন মুহূর্তে দুম করে নিচে পড়ে যাবে ইরিন।মিনমিন করে বলল,
—“রিক্সা ঝাঁকাচ্ছে,আমি পড়ে যাবো।”
আয়াজ হাসল। ইরিনের হাতটা সরালো না। বলল,”পড়বি না।শক্ত করে বসে থাক।পা দিয়ে সামনে ঠেস দে।আমাকে ছাড়!”
ইরিন দাঁত বাকিয়ে কিড়মিড় করে বলল,
—“কেন আমার হাতের ছোঁয়া লাগলে কি আপনার গা পঁচে যাবে? নাকি চর্মরোগ হবে?”
আবারও তীব্র ঝাঁকুনি শুরু হলো।অল্পের জন্য রিক্সা থেকে পড়ে যেত ইরিন।আয়াজ ওর হাত চেপে ধরে কোনমতে সামলায়।
আয়াজ হাসিহাসি গলায় রিক্সাওয়ালা কে বলল,
—“মামা!..আস্তে চালান না।বুঝেনই তো মহিলা নিয়ে উঠেছি পড়ে হাত পা ভাংলে তো সমস্যা!”
রিক্সাওয়ালা পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে বলল,
—“রাস্তা খারাপ মামা! গাড়ির দোষ নাই।”
এমনিতেই রিক্সার ঝাঁকুনিতে ইরিনের নাজেহাল দশা,তারওপর আয়াজের গা জ্বালানো কথাবার্তা!ওকে বলে কি না মহিলা?.. কোন দিক দিয়ে মহিলা সে?..তার কি বিয়ে হয়েছে? নাকি ডজন খানেক বাচ্চা আছে?..খবিশ একটা!
সোজা হয়ে রিক্সার একপাশে চেপে বসতেই আয়াজ ওর বাহু চেপে ধরলো,ছাড়লো না!টেনে নিজের কাছে নিয়ে গেলো ওকে।বিদ্যুৎ খেলে গেলো ইরিনের শরীরে,আয়াজ ওকে নিজের গায়ের সাথে লেপ্টে জড়িয়ে ধরেছে।আয়াজের পারফিউম মেশানো ঘামেভেজা শরীরের উন্মাদনা ওর হৃদয় ছড়িয়ে মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে।
—শুঁটকির মত ফিগার বানিয়েছিস,বাতাসেও গড়াগড়ি খায়!
—“আমি মোটেও শুঁটকির মত না।রিক্সায় ঝাঁকুনি বেশি হচ্ছে তাই!
—“হু।ঝাঁকুনি শুধু তোরই লাগে।কই আমি তো ঠিকমতই বসে আছি।”
ইরিন ভোঁতা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।সংগে সংগেই আয়াজ রিক্সাওয়ালাকে বলল,
—“মামা সামনে একটু রাখেন তো।”
আয়াজ লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে গেলো।সম্বিত ফিরে পেয়ে ইরিন বলল,
—“কোথায় যাবেন আপনি?”
—“তুই পাঁচমিনিট বয়।আমি আসছি,যাবো আর আসবো।”
—“কিন্তু আপনি যাচ্ছেন কোথায়?”
—“বাসার জন্য কিছু নিবো।”
—“আসার সময় আমার জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে আসবেন।”
আয়াজ ইরিনকে অনুকরণ করে বলল,
—“আসার সময় আমার জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে আসবেন।শখ কত!আমার টাকা কি কোৎকোৎ করে? তুই আমার আগের টাকাও তো দিস নি।”
—“এমন করেন কেন আয়াজ ভাই?”
আয়াজ আবারও মেয়েলি সুরে ভেঙ্গালো,
—“কারন টাকা টা যে আমার হরিণ আপু!”
—“ঠিক আছে।না আনলে না আনবেন।কিন্তু মনে রাখবেন আইস্ক্রিম না আনলে আপনি একটা মেয়ে!”
কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দিলো ইরিন।আয়াজ ধমকে উঠে বলল,
—“এই কি বললি তুই? অসভ্য,ফাজিল,বেয়াদপ!হোস্টেলে গিয়ে এইসব শিখেছিস?”
ইরিন মুখে হাত দিয়ে আসছে।আয়াজ দাঁতেদাঁত চেপে বলল,
—“বাসায় যাই তারপর তোর হাসি আমি বের করবো!ফাজিলের ফাজিল!”
আয়াজের রাগী চেহারা দেখে ইরিন হাসি থামানোর ভঙ্গি করে আবারও হেসে ফেললো।
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:৯
ছুটি কাটিয়ে হোস্টেলে ফিরে এলো দুজনে।আগের মতই খোঁচাখুঁচি চলমান।কখনো সরাসরি কখনো ফোনে।বেশিরভাগ সময়ই ফোনে হয়।কারন আয়াজ ব্যস্ত থাকে।ওর দেখা খুব কমই পায় ইরিন।
তবে আজকে ইরিনের মন ভালো।তার এক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।সবাইকে দাওয়াত করেছে।আয়াজকে ফোন করে দেখা করার কথা জানালো।হাতে খানিকটা সময় থাকায় আয়াজও রাজী হয়ে যায়।
দুজনে মিলে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে ওরা।
আয়াজ কফি খাচ্ছে,চোখ দুটো হাতে থাকার ফোনের স্ক্রিনের দিকে,একমনে কি যেন দেখছে।ইরিন হাতের তালু ঘষছে।অনেক্ষন যাবত চিন্তাভাবনা করেও কোন রকম আশার আলো খুঁজে পেলো না সে।তবুও একবার বলে দেখবে যদি রাজী হয়।
—“আয়াজ ভাইয়া?…ও আয়াজ ভাইয়া?”
—“শুনছি বল।”
—“একটা কথা আছে।”
—“শুনছি তো বলনা?”
—“আমার একটা ফ্রেন্ড আছে না রিতু?”
—“হুম আছে।”
—“ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে।আগামীকাল গায়ে হলুদ।”
—“তো?”
ইরিন ইতস্তত করছে।আয়াজ ভ্রুজোড়া কুঁচকে বলল,
—“এখন কি তোর বিয়ে করার শখ জেগেছে?..শখ জাগলেও কোন লাভ নেই, এই বিষয়ে আমি আন্টিকে কিছু বলতে পারবো না।…দেখা যাবে উনি কি ভাবতে কি ভেবে বসে আছেন।…তোর যদি বিয়ে করার খুব বেশি শখ হয়ে থাকে তুই নিজে গিয়ে বল।”
—“উফফ!আপনি সহজভাবে কিছু ভাবতে পারেন না?”
—“বিয়ের মত জটিল একটা বিষয়কে সহজ করে ভাবতে যাবো কেন?”
—“ঠিক আছে ভাবুন!ভাবতে ভাবতে আপনি ভাবনাবিদ হয়ে যান,কিন্তু দয়া করে আমাকে পুরো কথাটা শেষ করতে দিন।”
—“ঠিক আছে বল, তবে তোর বিয়েশাদী নিয়ে কিছু হলে কিন্তু আমি এর মধ্যে নেই!”
—“আবার?”
—“আচ্ছা,বল,বল।”
—“আমার বান্ধবীরা সবাই রিতুর গায়ে হলুদে যাবে।আমাকেও জোর করছে!”
—“তুই তো বাচ্চা না যে তোকে জোর করবে?”
—“হ্যাঁ আমি বাচ্চা না।কিন্তু ওরা আমাকে জোর করছে।সবাই যাবে।”
—“ওরা কি বলছে তুই না গেলে তোকে টেনে নিয়ে যাবে,..নাকি ওরা বলেছে যে তোকে কোলে করে নিয়ে যাবে?”
—“আপনি আম্মাকে একটু ফোন দিয়ে বলেন না!”
আয়াজ ফোন বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল,”কেন আমি বলবো কেন?..তুই যেতে চাস তুই বলবি!আমাকে টানছিস কেন?..তুই আবার আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিস না তো?”
ইরিন মনে মনে ভেংচি কাটলো,” হ্যাঁ!আপনাকে সাথে নিয়ে যাই তারপর আপনি আমার আনন্দের বারোটা বাজিয়ে দেন!..জীবনেও না!আপনি নিজে বললেও আমি আপনাকে নেবো না!
—“আরে না।আমি বলছি যদি আপনি বলেন তাহলে আম্মা রাজী হবে,তাই।”
—“তারমানে তুই আমাকে যেতে বারণ করছিস?..মতলব কি তোর? আমি গেলে তোর কি? সমস্যা হয়ে যাবে?..হাংকি পাংকি করতে পারবি না তাই তো?”
—“আশ্চর্য!আমি আপনাকে যেতেও বলছি না আবার বারণও করছি না।আমি শুধু বলছি আপনি আম্মাকে ফোন দিয়ে একটু বলে দিলে ভালো হত!
—“বাসা কোথায় তোর বান্ধবীর?”
—“চিটাগাং।”
আয়াজ চোখ উলটে ফেললো।যেন ইরিন কোন ভয়াবহ কথা বলে ফেলেছে।বিস্মিত কন্ঠে বলল,
—“তুই ঢাকার বাইরে যাবি?..এত সাহস তোর?..আবার আমাকে দিয়ে দালালী করাতে এসেছিস?…যা ভাগ!”
—“প্লিজ আয়াজ ভাই!”
—“দেখ ইরিন আমি এই ব্যাপারে নেই।তোর যদি খুব যেতে ইচ্ছে করে তুই আন্টিকে গিয়ে বল।আমি পারবো না।আমার পক্ষে তোকে ঢাকার বাইরে একা ছাড়ার কথা আন্টিকে বলা কিছুতেই সম্ভব না।”
আয়াজ উঠে চলে গেলো।ইরিন হতাশ হয়ে বড় একটা নিশ্বাস ফেললো,তারমানে রিতুর বিয়েতেও ওর যাওয়া হচ্ছে না?সবাই কত মজা করবে আর সে হোস্টেলে বসে বসে আফসোস করবে!…আহা!জীবন!
★
বাস এসে গেছে।পুরো আপাদমস্তক বোরখা দিয়ে ঢাকা ইরিনের।হাত মোজা,পা মোজা সব পরেছে সে।কিন্তু বাসে উঠতেই বড়সড় ধাক্কা খেলো।আয়াজ বসে আছে!হায় আল্লাহ উনি কি জেনে গেছেন যে ইরিন রিতুর বিয়েতে যাচ্ছে?..ইয়া আল্লাহ!রক্ষাকরার মালিক তুমি।ইরিন নেমে যেতে নিলো।আসিফ নামের ছেলেটা হঠাৎ ওর কনুই চেপে ধরে বলল,
—“কেউ তোমাকে চিনবে না।নিশ্চিন্তে বসো।”
ইরিন চমকে গেলো।আসিফ কি করে জানলো ইরিন ভয় পাচ্ছে।বোরখার ভেতর দিয়ে ইরিনকে চিনলো কি করে সে? কৌতুহল দমন করে সীটের দিকে এগোলো।
আয়াজের পেছনের সীট ওর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, আল্লাহ আল্লাহ করে আয়াজের পাশ কাটিয়ে গেলো,কিন্তু কোন রিয়েকশন পেলো না।আয়াজ ফোন নিয়ে ব্যস্ত!স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ইরিন।যাক আপাতত বাঁচা গেলো।…কিন্তু আয়াজ বাসে কেন? সে-ও কি যাবে?..কেন??
যাত্রা শুরু হতেই পুরো বাস জুড়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো।সবাই হৈ হুল্লোড় করছে।আর ইরিন??.. চুপচাপ বসে আছে।কথা বললেই সর্বনাশ!গলা চিনে ফেলবে আয়াজ !
—“এই ইরিন একটা গান ধর না?”
কথাটা বলেই জিভ কাটলো ইত্তিহাদ!ইরিন দাঁতমুখ বিচ্ছিরিভাবে খিঁচে ফেললো, সাবধানে আয়াজের দিকে তাকালো।নাহ!আয়াজ কানে হেডফোন লাগিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
ইত্তিহাদ কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
—“সরি,দোস্ত মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
—“উনি টের পেলে কি হবে জানিস?..আমার ওপর আজাব নাজিল হবে!”
—“সরি,সরি,আর হবে না।”
রিতুদের বাড়িতে পৌঁছানো পর,সবার শেষে বাস থেকে নামলো ইরিন।কোনভাবেই আয়াজ ক্রস করতে চায় না সে।ধরা খেলে সর্বনাশ!
★
ভেতরে আসার পর রিতুর কাছ থেকে জানতে পারলো ইরিন বরের ছোটভাই আয়াজের বন্ধু।ইরিনের ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।ভীষণ বোকামি করে ফেলেছে এখানে এসে,পুরোপুরি ফেঁসে গেছে।একবার যদি আয়াজ জানতে পারে সে এখানে এসেছে তাহলে ওর হাড্ডিমাংস গুঁড়া হওয়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।মায়মুনা বেগম ওকে মেরেই ফেলবেন।
পরেরদিন সকাল থেকেই হলুদের আয়োজন চললো।ইরিন আসামী মত লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।সন্ধ্যের দিকে আয়াজ সেজেগুজে হিরো হয়ে বেরিয়েছে।সাদা পাঞ্জাবির ওপর হলুদ কোটি!তার সাথে চুড়িদার পায়জামা!চুলগুলো স্পাইক করা!গলায় ক্যামেরা ঝোলানো!
অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
ইরিন আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে ফলো করছে।স্টেজের কাছে সবাই আনন্দ করছে,কিন্তু সে যেতে পারছে না।তবে খুব বেশি আফসোস হচ্ছে না।তার দৃষ্টি আয়াজের দিকে।বেশ লাগছে আয়াজ নামক বদ ছেলেটাকে।
★
হলুদ প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে অনেক দেরী হয়ে গেলো।ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো সবাই।কেবল ঘুম আসছে না ইরিনের।অন্যদের মত সে লাফালাফি কতে পারে নি।সে ছিলো লুকিয়ে লুকিয়ে।ঘুম আসছে না দেখে এপাশ ওপাশ করছিলো সে।তারপর দরজা খুলে চুপিচুপি উঠানে বেরিয়ে গেলো।আলোতে ঝলমল করছে চারদিক!পুকুরপাড় সহ পুরো বাড়ি লাইটিং করা হয়েছে।
পুকুরপাড়ে সিঁড়ির ওপর গিয়ে বসলো ইরিন,ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে,ঝিঁঝিঁ পোকার। ডাক,মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ!
আচমকা বিকট আওয়াজে চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠলো।ইত্তিহাদের গলা মনে হচ্ছে! ভূত,ভূত বলে অনবরত চিৎকার করছে,ইরিন লাফ দিয়ে উঠে গেলো।তারপর কোন কিছু না ভেবেই এক দৌঁড়ে ঘরের ভিতর!বুক ধড়ফড় করছে!সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়েছে সে।
উঠানে মানুষ জমা হয়ে গেছে।রিতুর চাচা,আয়াজ,রিতুর বড়ভাই,বর সবাই উঠে চলে এসেছে ইত্তিহাদের চিৎকার শুনে।
রিতুর বড়চাচা গম্ভীর গলায় বললেন,”বাত্তির আলোয় চারদিকে ফকফক করতেছে,ভূত আসবো কই থেইক্যা?
—“আমি দেখেছি চাচা।চুল ছেড়ে দিয়ে পুকুর পাড়ে বসে ছিলো।”
উনি টর্চ নিয়ে পুকুর ঘাটে নামলেন।ইত্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—“কোন সিঁড়িতে বসা দেখছো?”
ইত্তি হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলো।ইরিন ঘরের ভেতর জানালা দিয়ে সব দেখছে।ইত্তিহাদের বাচ্চা ওকে দেখে ভূত ভেবেছে,ওকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল!বলদের বলদ!এতজোরে কেউ চিৎকার দেয়?..ভীতুরাম!
আয়াজ ইত্তিহাদের পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন,”আয় চল ঘুমাবি।ঘুমের ঘোরে মাঝেমধ্যে এমন হয়।…আয়!”
ইত্তিহাদ করুণ চোখে আয়াজের দিকে তাকালো।আফসোস হচ্ছে তার।কথা তার কেউ বিশ্বাস করছে না!
★
বিয়েরদিন সকালবেলা ইরিন চুপিচুপি ইত্তিহাদের রুমে ঢুকলো।ইত্তিহাদ বোধহয় ঘুমাচ্ছে!রাতের ঘটনাটা খুলে বলবে ভেবেই ভেতরে ঢুকেছিলো সে।
কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই ভয়ে জমে গেলো। ইত্তিহাদ নয় খাটের ওপর আয়াজ শুয়ে আছে।ইরিন যেভাবে এসেছিলো চুপিচুপি আবার সেভাবে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো,কিন্তু হাতে বাধা পড়লো, পেছন ফিরে দেখলো আয়াজ ওর হাত ধরে রেখেছে।
ইরিনের হাতপাঁ কাঁপছে,গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে।বুক ধড়ফড় করছে,আয়াজ এবার ওর কি অবস্থা করবে আল্লাহই জানে,মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে নিলো সে!
—“দরজা বন্ধ করে আয়।”
—“দরজা বন্ধ করবো কেন?”
ইরিনের ভয় করছে,দরজা বন্ধ করে আয়াজ কি তাকে শাস্তি দেবে?
—“কথা আছে তোর সাথে।”
—“আমি রেডি হবো,আপনার কিছু বলার থাকলে পরে বলবেন।”
—“ইরিন? তুই কেন শুধু শুধু নাটক করছিস?”
ইরিন দরজা বন্ধ করে খাটের কাছে দাঁড়ালো।আয়াজ কিছু বললো না,ঘাড়ের কাছে হাত রেখে উলটো হয়ে শুয়ে পড়লো।
—“এদের বিছানাগুলো প্রচুর শক্ত,রাতে ভালোমত ঘুমাতেও পারি নি,শেষরাতে যা-ও একটু চোখ লেগে এসেছিল তোর ভূতনীগিরিতে সেটাও উধাও হয়ে গেলো।চুল ছেড়ে দিয়ে পুকুরঘাটে বসে ছিলি কেন?এই জন্যই তোকে একা ছাড়তে চাই না।”
ইরিনের বুকটা ধক করে উঠলো,তারমানে আয়াজ আগে থেকেই জানতো যে ইরিন এখানে এসেছে?..কিন্তু কীভাবে??
—“ঘাড় প্রচণ্ড ব্যথা করছে।আমার ব্যাগে লাল রংয়েরর একটা মলম পাবি,পেইন কিলার।নিয়ে আয়।”
ইরিন ব্যাগ খুলে মলমটা পেলো।
—“আমি মালিশ করে দিই?”
—“আয়।”
ইরিন ঘাড়ে মালিশ করে দিচ্ছে।আয়াজ আরামে চোখ বন্ধ করে আছে।
—“আয়াজ ভাই?”
—“হু?”
—“আম্মাকে কিছু বলবেন না প্লিজ!”
—“কোন ব্যাপারে?”
—“প্লিজ!”
আয়াজ আরামে “উউউউ!” করে উঠলো।
—“সত্যি কিছু বলবেন না?”
—“আমি কখন বলেছি কিছু বলবো না?”
—“তাহলে ‘উউ’ করলেন কেন?…প্লিজ আয়াজ ভাই প্লিজ আম্মাকে বলবেন না,..প্লিজ,প্লিজ।
—“কেন বলবো না?”
—“আম্মা আমাকে মেরে ফেলবে।”
—“সেই ভয় আগে ছিলো না?..এখানে আসার আগে?..এখন ধরা খেয়ে তারপর মনে পড়লো?”
—“আর হবে না,আমি সত্যি বলছি এইবারই শেষ।”
আয়াজ সামনে ঘুরলো।ইরিন থেমে গেছে।ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো সে।আয়াজ শীতল কন্ঠে বলল,
—“সত্যি বলছিস তো? আর হবে না?”
—“হবে না।”
—“ঠিক আছে যা, বলবো না।”
ইরিন দরজা খুলে আস্তে করে বেরিয়ে গেলো।আয়াজ হাসছে।মিটমিট করে হাসছে।ঘাড়ের কাছে হাত রেখে নিশ্বব্দে হাসছে।
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:১০
একটু পর আবার ফিরে এলো ইরিন।আয়াজ তখন উপুড় হয়ে শুয়েছিলো।ইরিনের গলার আওয়াজ পেয়ে সামনে ঘুরলো।ইরিন ইতস্তত করে বলল,
—“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
আয়াজ মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে ইরিন কি জানতে এসেছে।হেয়ালি করে বলল,
—“শুধু একটা?”
ইরিন প্রসঙ্গ পাল্টাতে দিলো না।সরাসরি প্রশ্ন করলো সে,
—“আপনি হুট করে এখানে কেন এসেছেন আয়াজ ভাই? আপনি কি আগে থেকেই জানতেন আমি বিয়েতে আসছি? কিন্তু কীভাবে? কার কাছ থেকে?”
আয়াজ হাসলো।রহস্যজনক হাসি।ইরিন ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে।
—“কি হলো? চুপ করে আছেন যে?”
আয়াজ টেবিলের পাশে রাখা তার ফোনটা ইরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
—“চার্জে লাগিয়ে দে তো।”
ইরিন হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। কিন্তু সাথে সাথে কানেকশন দিলো না। বলল,
—“আমার উত্তর?”
—“আমি জানি না।”
—“আপনি তাহলে বলবেন না?”
ইরিন রেগে গেলো।আয়াজ আবারও হাসলো।হাসি হাসি মুখে বলল,
—“তোর এত কৌতুহল কেন? তুই আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলি আমি যেন তোর এখানে আসার কথা আন্টিকে না জানাই,আমি জানাবো না বলেছি।বাকি কে,কি,কেন এলো এসবের তোর কি দরকার?”
—“এর মানে কি দাঁড়ালো? আপনি আমাকে বলবেন না তাইতো?”
—“ইয়েস।নাউ গো ফ্রম হিয়ার।”
ইরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা চার্জে লাগালো।আয়াজের মুখ থেকে কোন কথা বেরোবে না সে ভালো করে বুঝে গেছে।ফোন চার্জে লাগিয়ে বেরিয়ে এলো।
আয়াজ হাসলো।ইরিন বড্ড বোকা।সে জানে না,তার বিশ্বস্ত বন্ধু ইত্তিহাদই আয়াজের ইনফর্মার।অসম্ভব ভালো একটা ছেলে।সে-ই ইরিনের লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়েতে এটেন্ড করার ঘটনা আয়াজকে জানিয়েছে।পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ইরিনের একা একা বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়াটা ইত্তি সমর্থন করতে পারে নি।যদিও সে মনে প্রানে চাইছিলো ইরিন তাদের সাথে যাক।কিন্তু কাউকে না জানিয়ে যাওয়াটা রিস্কি।বিপদ আপদের কোন সময়জ্ঞান নেই।কখন কি হিয়ে যায় বলা যায় না।তাই অবশ্যই ফ্যামিলি মেম্বার দের কাউকে জানিয়ে যাওয়া উচিৎ।ইরিনকে অনেক বুঝিয়েছে সে।কিন্তু ইরিন কিছুতেই বাসায় জানাবে না।অবশেষে বাধ্য হয়ে আয়াজকে খবরটা দিলো সে।আয়াজের সাথে তার ভালো সম্পর্ক।এমনকি ইরিনের সাথে আয়াজের বিয়ের কথাটা একমাত্র তাকেই জানিয়েছে আয়াজ।
★
বিয়েতে খুব সাজলো ইরিন,একেবারে জমকালো সাজগোজ! লাল টুকটুকে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং গোল্ডেন স্টোনের গয়না!ভারী মেকাপ, বেশ গর্জিয়াস লাগছে ওকে।ইতোমধ্যে অনেকের কাছ থেকেই প্রশংসামূলক অনেক কিছু শুনে ফেলেছে সে।
সোহাগ ছেলেটাকে আয়াজ সুবিধার লাগছে না,রিতুর খালাতো দেবর,এসেছে থেকেই ইরিনের ওপর চোখ! চোখে চোখে রাখতে হবে ব্যাটাকে।
একটুপরই শোরগোল শুরু হলো।বর এসে গেছে ইরিন ফুলের ডালা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলো,অসাবধানতাবশত সোহাগের সাথে ধাক্কা খাওয়ায় ফুল সব দুজনের মাথার পড়ে,ইরিনের ওড়নাটা হিন্দি ফিল্মের নায়িকাদের মত সোহাগের বাহুতে আটকে যায়।
আর তখনই সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো আয়াজ!..পড়বি তো পড়,একেবারে মালির ঘাড়ে?
ইরিন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আয়াজের দিকে তকিয়ে আছে।আয়াজ একমুহূর্ত চেয়ে থেকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলো!!
সোহাগের মুগ্ধতার সাগর তখন আবেগে টইটুম্বুর!!
মোহনীয় দৃষ্টিতে ইরিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে।ইরিনের মেজাজ বিগড়ে গেলো।কিন্তু সেটা সোহাগের চোখে ধরা পড়লো না।
আসার পর থেকেই মেয়েটিকে ওর ভালো লাগে।এমনিতেই বাসায় ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
তার দৃঢ় বিশ্বাস ওর মত হ্যান্ডসাম,বিসিএস কেডার প্রফেসরকে যে কোন মেয়ের বাবাই জামাই বানাতে রাজী হয়ে যাবে।
তাই আগে খানিকটা বাজিয়ে দেখতে চাইছে ইরিনকে।
ইরিনের মুখ খুলতেই ওর আবেগের সাগর নিমিষেই মরুভূমির মত শুকিয়ে গেলো।
—“চোখ পকেটে রেখে হাঁটছিলেন??…সব ফুল পড়ে গেলো!…হাঁ করে আছেন কেন?..মুখ বন্ধ করুন!”
—“এভাবে কথা বলছো কেন?..মেয়েদের কথা হবে নমনীয়,এমন কর্কশ নয়।”
—“আপনি আমার কে লাগেন যে আমি আপনার সাথে লুতুপুতু গলায় কথা বলবো?”
—“অপরিচিত কারো সাথে ভদ্রভাবে কথাবলা নরমাল ম্যানার্স এর মধ্যে পড়ে।”
—“আর অপরিচিত একজন মেয়েকে তুমি বলা?…রামছাগল!”
ইরিন গটগট করে চলে গেলো।সোহাগ দাঁত খিঁচড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কতবড় সাহস হাটুর বয়সী একটা মেয়ে ওকে রাম ছাগল বলে গেলো?..ওর মত ব্রিলিয়ান্ট একজন প্রফেসর এর এই মর্যাদা?..দেশ আসলেই রসাতলে যাচ্ছে!
★
ইরিন স্টেজে বউয়ের পাশে বসে ছিলো।ইত্তি এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
—“তোকে আয়াজ ভাই ডাকছে।”
—“কেন?”
—“আমি জানি না।আমাকে বলেছে তোকে ডেকে নিয়ে যেতে।”
ইরিন চারপাশে চোখ বুলালো।স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে আয়াজ ফোনে কথা বলছে।ভালো করে খেয়াল করলো সে।আয়াজের মুড কি ঠিক আছে? সে কি ইরিনের ওপর রেগে আছে? সোহাগ গাধাটা এখনো ইরিনের পিছু ছাড়ছে না।স্টেজের পাশে ঘুরঘুর করছে।ইরিন বিরক্ত হয়ে উঠে আয়াজের কাছ চলে গেলো।
আয়াজ সরাসরি ইরিনের দিকে তাকিয়েই কথা বলছে।অস্বস্তি লাগছে ইরিনের। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রইলো।আয়াজের মতিগতি কিছু বোঝা যাচ্ছে না।ভয় লাগছে তার!সকালের ঘটনার জন্য আয়াজ কি এখন তাকে বকাঝকা করবে?..উফফ!কেন এই বিয়েতে এসেছিলো সে?..আসার পর থেকেই একটা না একটা ক্যাড়াকলে ফেঁসেই যাচ্ছে।আয়াজ ফোন রেখে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“সোহাগ তোকে কি বলেছে?”
—“কোন সোহাগ?”
—“যাকে তুই ফুল দিয়ে বরণ করেছিস,সেই সোহাগ!”
—“আই লাভ ইউ!”
—-“কী?”
—“আই লাভ ইউ।”
আয়াজ হতবম্ভ হয়ে চেয়ে রইলো।ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।চাপা কন্ঠে বলল,
—“ইরিন আমি তোর সাথে মজা করছি না।আমি জানতে চাইছি সোহাগ তোকে কি বলেছে?”
—“আই লাভ অউ।”
—“ইরিন শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি,এবার কিন্তু ঠাস করে গালে একচড় বসিয়ে দেবো।”
—“কি আশ্চর্য আয়াজ ভাই? আপনি কানে শুনতে পান না? আমি কতবার করে আপনাকে বলছি,সোহাগ আমাকে আই লাভ ইউ বলেছে।তাও আপনি আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছেন? এর মানে কি?”
—“ফালতু কথা বলবি না একদম।ও তোকে প্রথম দেখাতেই আই লাভ ইউ বলতে যাবে কেন? তুই আমার সাথে মশকরা করিস?”
—“প্রথম দেখাতে কে বলল? সে নাকি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে।আমি নাকি তার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মত সুন্দরী!”
—“ইরিন? আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করিস না।”
—“সত্যি বলছি তো।বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনাকে ছুঁয়ে বলবো?”
—“তুই কি এখানে এসেও আমার হাতে মার খেতে চাস? এখন যদি আমি তোর গালে কষে একটা চড় লাগাই,তারপর কি বলবি? আয়াজ ভাই খারাপ,আয়াজ ভাই জঘন্য,আয়াজ ভাই অসভ্য…..”
—“আপনি তো খারাপই।আপনাকে ভালো বললো কে?”
—“তুই বলবি না সোহাগ তোকে কি বলেছে?”
ইরিন না-সূচক মাথা দোলালো।দুষ্টু হেসে বলল,
—“আপনিও তো আমাকে বলেন নি,আপনি কার কাছ থেকে আমার বিয়েতে আসার খবর পেয়েছেন? তাই আমিও বলবো না।”
ইরিন ওড়না দোলাতে দোলাতে চলে গেলো।আয়াজ চোখমুখ লাল করে বসে আছে।তার ধারণা ভুল।এই মেয়ে মোটেও বোকা নয়।হাড়ে হাড়ে শয়তান!