অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤পর্ব -১৬+১৭
#কায়ানাত_আফরিন
ফারহানের দেওয়া টিশার্ট পড়ে দ্রুতপায়ে বড় গেটের উদ্দেশ্যে চলে গেলো আফরা। তারপর পিচ ঢালাই রাস্তার অপার সৌন্দর্যের ভেতর দিয়েই সবাই জগিং শুরু করলো। আফরার কাছে এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা। জীবনে বহুবার জগিং বা মর্নিং ওয়াক করেছে তবে চা বাগানের নিপুণতার ভীড়ে সবকিছু লাগছে নতুন। পথে মাঝমধ্যে কিছু উপজাতি মানুষের দুরন্তবেগে চা বাগানে ছুটে চলার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তো কখনও দেখা যাচ্ছে এখানকার বড় বড় বাংলোবাড়িতে কর্মরত মানুষদের নাস্তা নিয়ে এখানে ওখানে যাওয়ার দৃশ্য। একটা জিনিস দেখে আফরার বড়ই ভালোলাগলো যে এখানকার মানুষরা বড্ড কৌতুহলী। নতুন কিছু দেখলে অবাক ন্যায় সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তবুও আন্তরিকতার কোনো যেন কমতি নেই। কেননা যতবারই আফরার কারও সাথে চোখাচোখি হয় প্রতিবারই কেউ না কেউ ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে সাধুবাদ জানাচ্ছে। আফরার মনে হঠাৎ অ্যামেরিকায় থাকাকালীন এক নিত্যসাধারন দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠলো।
ভোর হওয়ার পরপরই আফরা ওদের ডিসির ফ্ল্যাটের বাইরে যেই পার্ক আছে ওখানে জগিং করতো। বলা বাহুল্য অ্যামেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি অন্য উন্নত চার-পাঁচটি দেশের রাজধানীর মতো না। এখানে আধুনিকতার ছোয়ার তুলনায় আভিজাত্যটাই একটু বেশি। আর তাই ডিসির পথে সকালে হেঁটে বেড়ানোটাতে এক অন্য আনন্দ পেত আফরা। তবে সেখানকার মানুষের যেন অন্যের দিকে চোখ তুলে তাকানোর মতো বিন্দুমাত্র ফুরসত নেই। না আছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ। আফরা চোখ বন্ধ করলেই অ্যামেরিকার সৌন্দর্য আর ওর ব্যাক্তিগত জীবনের কথাগুলো মনে পড়লেও সেখানকার আশেপাশের মানুষদের কথা বড়ই কম মনে পড়ে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হলো উল্টো। এখানে সৌন্দর্য যতটা মানুষকে কাছে টানবে তার থেকেও বেশি কাছে টানবে এখানকার অধিবাসীরা।
ফারহানের ইতিমধ্যে চোখ গেলো আফরার দিকে। আফরা আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে জগিং করছে আনমনে। ফারহান কিছু একটা ভেবে হাতের কব্জি চেপে ধরে থামিয়ে দিলো ওকে। ভাবনায় সুতো হঠাৎ ছিড়ে যাওয়ায় আফরা অবাক। ফাহিমও ইতিমধ্যে থেমে গিয়েছে। ফারহান চাপা কন্ঠে বললো,
–ভাবাভাবি বন্ধ করে প্লিজ সকালের এই সৌন্দর্যটা দেখুন। শ্রীমঙ্গলের ওয়ান অফ দ্য মোস্ট পিচ্ছিল রাস্তা একটা। অসাবধান হলেও ডিরেক্ট পা ভেঙে যাবে। এমনিতেও তো পকর পকর করে মাথা খান আমার। এবার কি পা ভেঙে আমাদের জ্বালাতন বাড়ানোর ইচ্ছে আছে নাকি?
ফারহানের এই কথাটা সর্বাঙ্গে আগুন ধরিয়ে দিলো আফরার। ঠোঁট চেপে হাসফাস করে যাচ্ছে। একটা মানুষ এতটা বজ্জাত কিভাবে হতে পারে? দেখতে যতটাই না সুন্দর……..তার থেকে বান্দর বেশি। ফাহিম ফারহানের কথায় মিনমিনিয়ে হাসতে যাবে তবে আফরার অগ্নিচেহারা দেখে তা আর হলো না। ফারহানের পিঠে হালকা বারি দিয়ে বললো,,
–ফারহান রে! তোমার কথার কূল-কিনারা বুঝি না। আফরা বেড়াতে এসেছে আমাদের এখানে……..তোমার কাট কাট কথা শুনে তো বিরক্ত হয়ে চলে যাবে। এমন মিষ্টি মেয়ের সাথে এমন করে কথা বলতে তোর ঠোঁট কাপে না?
–মিষ্টি না ছাই।
কথাটা ফারহান বিড়বিড়িয়ে বলেই সামনের দিকে রওনা হলো। আফরাও ফারহানের সাথে কোনো কথা বাড়ালো না। শক্তপোক্ত গলায় ফাহিমকে বলে ওঠলো,,,
–সামনে চলুন।
.
.
অবশেষে শ্রীমঙ্গলের পাওয়ার হাউসের সামনে থামলো ওরা তিনজন। এর রাস্তাটি এখানকার একটু উচু পথ হলেও সমান্তরাল হওয়াতে হাঁটতে বেশ।আফরা আড়চোখে তাকালো ফারহানের দিকে। ফারহান হাপাচ্ছে। দু’হাত হাটুতে ভর দিয়ে উবু হয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ক্রমাগত। চুল বেয়ে ঘাম পড়ছে খানিকটা। দৃশ্যটা একটু অন্যরকম। ফাহিম হাতঘড়ি দেখে বলে ওঠলো,
–১ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে প্রায়। এবার তাহলে ফিরে যাওয়া যাক?
–তোমার এই একটা সমস্যা ফাহিম। সবকিছু টাইম ট্যু টাইম করতে চাও। বিষয়টা ভালো তবে সবসময় না। এইযে এখন সকালটা দেখছো?অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক স্বচ্ছ। আর পাওয়ার হাউসের এই পয়েন্টটা আমার সবচেয়ে পছন্দের একটি জায়গা এখানকার ভিউ এর জন্য। সো চিল এন্ড ইন্জয় ইট।
ফাহিমের কথা শেষ হতে না হতেও শীতল কন্ঠে বলে ওঠলো ফারহান। আফরার ঠোঁটের কোণে একটা সুক্ষ্ণ হাসি ফুটে উঠলো ওর কথায়। কেননা ফাহিমের এই কথাটি ওরও ভালোলাগছিলো না। কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই ফারহান তা সুন্দরভাবে হ্যান্ডেল করে নিলো। ফারহানের এই বিষয়টাই অন্যরকম। হয়তো অনেক গম্ভীর , একরোখা মানুষ,,,,,তবে অজানা এক টান কাজ করে। আফরা সময় ব্যয় না করে বলে ওঠলো,
–আপনার প্রকৃতি ভালোলাগে ফারহান?
ফারহান তাকালো আফরার দিকে। আফরার সরু চোখের দৃষ্টি ফারহানের মধ্যেই আবদ্ধ। ফারহান মৌনস্বরে প্রতিউত্তর দিলো,
–হুমম।
–আপনার এই ক্যারেক্টারটাই আমার সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে। আই লাইক ইট।
আফরার ঠোঁটে সুক্ষ্ণ হাসি। ফারহান যেন আফরার এমন কথায় মজা পেলো এবার। সাথে ফাহিমও। হঠাৎ ফারহান নিজের হাত ভাজঁ করে বলে ওঠলো,,,,
–আমার আর কিছু ভালো লাগে না?
ধ্যান ফিরলো আফরার। একটু আগের কথাটা ওভাবে বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি। অপ্রস্তুত হয়েছে বেশ। আফরাকে অপ্রস্তুত হতে দেখে ফারহান ভ্রু নাচালো এবার। চোখে মুখে রম্যতা। এই প্রথম আফরাকে অপ্রস্তুত হতে দেখে মনে অনাবিল শান্তি কাজ করছে। আফরা আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললো,,,
–সেটার উত্তর এখন দেবোনা। আপনার নেচার লাভিং ক্যারেক্টারটা আমার ভালোলাগে , আর আমি সেটা বলে ফেললাম….দ্যাটস ইট।
ফারহান সামান্য হাসলো আফরার উত্তর শুনে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠলো,,,,
–আপনি কি ভাবেন আফরা আপনি বাংলা অনেক ভালো বলতে পারেন?
–হঠাৎ এ প্রশ্ন? আর আপনি আমায় জাজ করছেন আমার ল্যাংগুইজ স্কিল নিয়ে? দেখুন…..হয়তো আমি অ্যামেরিকায় বড় হতে পারি তবে বাংলা অনেক ভালোমতো শিখেছি ছোটবেলাতেই।
তাচ্ছিল্যের গলায় বললো আফরা। যেন ফারহানের এমন কথা ওর কাছে কোনো ব্যাপারই না। ফারহান পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা হাসি দিলো পুনরায়। অতঃপর আফরার কাছে এগিয়ে আসতেই আফরা কিঞ্চিত অবাক হলো। আড়ষ্ট কন্ঠে ফারহান এবার বলে ওঠলো,,,
–আমার প্রশ্নের উত্তর একটু আগেই দিলেন আপনি। হ্যাঁ,,,,মানছি আপনি বাংলা শিখেছেন ছোটবেলায় তবে নিজের মম-ড্যাড ছাড়া কখনোই কারও সাথে বাংলায় কথা বলেননি। তাই আপনি একাধারে বাংলা বলতে পারেননা। অল্প ভাষাতেই সব বলার চেষ্টা করেন। আর যখন কোনো কথা তিন-চার লাইনের বেশি বলার চেষ্টা করেন তখনই গোলমাল লেগে যায় আপনার কথায়। তারপর বাংলা আর ইংরেজী দুইটাই মিশিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেন। এজ এক্সামপেল আপনার শেষের কথাগুলোই মনে করে দেখুন। সেখানে বাংলা কতটুকু বলেছেন আর ইংরেজী কতটুকু বলেছেন?
আফরা স্তব্ধ ফারহানের বিচক্ষণতা দেখে। এটা আসলেই সত্য যে সে একাধারে বাংলা বলতে পারেনা। তবে আজ পর্যন্ত কেউই ওর এই দুর্বলতাটি ধরতে পারেনি। তাহলে ফারহান কিভাবে বুঝলো। ফাহিম অবাক ন্যায় বললো,,,,
–আর ইউ সিরিয়াস ফারহান? কেননা আসলেই ওর কথায় আমি কোনো খুঁত লক্ষ্য করি নি।
–আমি খেয়াল করেছি। বেশ কয়েকবার। সো মিস আফরা ! আপনি মানতে বাধ্য যে আপনি হয়তো অনেক ভালো বাংলা বুঝেন , তবে ভালো কথা বলতে পারেন না।
আফরার দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। বিড়বিড়িয়ে ফারহানের উদ্দেশ্যে বলে ওঠলো , ‘বাস্টার্ড একটা!’। আফরার ইচ্ছে করতে এই অভদ্র , অসভ্য মানুষটাকে ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দিতে। মিসেস নাবিলা হয়তো এজন্যই ওর ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য ওকে দেখতে পারেন না। ফারহান এবার হাত ঘড়ি দেখে ব্যাস্ত হয়ে ওঠলো হঠাৎ। হাতে সশব্দে তালি দিয়ে বলে ওঠলো,,,
–অনেকক্ষণ হয়ছে এখানে আছি। এবার ফিরে যেতে হবে আমায়। আজ চেয়্যারম্যানের বাড়িতে কাজ আছে আমার।
–এভাবেই চেয়্যারম্যানের বাড়িতে যাবে নাকি। জামা পাল্টাবে না?
–শামসুর বাড়িতে যাচ্ছি এখন । তুমি আফরাকে নিয়ে ফিরে যাও।
ফাহিমকে শীতল গলায় প্রতিউত্তর দিয়েই ফারহান প্রস্থান করলো জায়গাটি। আফরার কাছে এখন কেমন যেন বিরক্তির লাগছে সবকিছু। তাই ফাহিমের সাথে তাড়াতাড়ি সেও রওনা হলো নেলসন টি এস্টেট এর উদ্দেশ্যে।
_____________
চেয়্যারম্যান সাহেবের বাড়িতে গোল বৈঠকে বসে আছে সবাই। ঘড়ির কাটা ক্রমাগত ঘুরে সময় পার করছে তবুও বৈঠককারী ব্যাক্তিবর্গের একজনের মধ্যেও কোনোরকম কোনো রকম কোনো কথা নেই। ছাত্রদলের প্রধান নেতা নিয়াজি সাহেব তার সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের নিয়ে বসে আছেন নীরবে। চেয়্যারম্যান সাহেব শান্ত থাকলেও উনার ব্যাক্তিগত সহকারী হাসান সাহেবের কপাল বেয়ে ছুটছে তরতর করে ঘাম। অনবরত পানি খেয়েও যেন শান্ত হচ্ছেন না। একপর্যায়ে উনার বোতল শেষ হতেই হঠাৎ খেয়াল করলো কেউ উনার দিকে বোতল এগিয়ে দিয়েছে। হাসান সাহেব তাকালেন সেদিকে। আগন্তুকটি বলে ওঠলো,,,,,
–খেয়ে নিন হাসান সাহেব। আপাতত পানি আমার থেকে আপনার বেশি দরকার।
এমন গম্ভীর কন্ঠে তটস্থ হয়ে পড়লেন হাসান সাহেব। যেন আগেই সে সতর্কবার্তা দিয়ে দিচ্ছে আজ উনার কপালে শনি আছে। হাসান সাহেব ভয়ার্ত চোখে তাকালেন ব্যাক্তিটির দিকে। মানুষটা ফারহান। গেরুয়া রঙের পান্জাবীর হাত ভাঁজ করে বসে আছে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে। তবে ঠোঁটে বরাবরের মতো চাপা হাসি। বড় বড় চোখজোড়ার তীক্ষ্ণ নজর যেন নিমিষেই ভস্ম করে দিতে পারবে। হয়তো গোসল সেরে এখানে এসেছে বলে অত্যন্ত গোছালো মনে হচ্ছে। এমন তাগড়া সুদর্শন যুবকের কথায় যে মধ্যবয়স্ক হাসান হাসেব এতটাও ভয় পেয়ে যাবেন বিষয়টা হয়তো হাসান সাহেবের নিজেরও কল্পনায় ছিলো না।
–কি উদ্দেশ্যে এই গোলবৈঠক করতে বললেন সেটা আগে পরিষ্কার বরুন নিয়াজি সাহেব।
চেয়্যারম্যানের শান্ত কন্ঠ। ফারহান এবার হাসলো কিঞ্চিত। অতঃপর আগ বাড়িয়ে বলে ওঠলো,,,,,,
–আপনার নাকের নিচে কি ধরনের কাজ হচ্ছে সেটা আপনার চোখে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।
যুবকের সাহসিকতা দেখে অবাক না হয়ে পারলোনা চেয়্যারম্যান সাহেব। নিয়াজি সাহেবকে তাই প্রশ্ন করলেন,,,,
–এই ছেলে কি আপনার দলের কোনো নেতা-টেতা নাকি? বয়সতো অল্প মনে হচ্ছে। তবে এমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের হলে যে সামনে বিপদে পড়বে ধরিয়ে দেবেন না?
নিয়াজি সাহেব বললেন,
–সে আমার দলের কোনো নেতা-টেতা না। আমাদের ভার্সিটির ছাত্রদলের হয়ে কাজ করে। রাজনীতি করার ক্ষমতা আছে দেখে উপরপক্ষের অনেকের নজর কেড়েছে এই ফারহান জুবায়ের। তবে কখনই সে কোনো দলের হয়ে রাজনীতি করেনি। আর এরকম অজস্র বিপদ ওর কাছে তুচ্ছ। নতুন নতুন চেয়্যারম্যান তো ! তাই এই যুবকটা কে চিনতে পারেননি।
ফারহান টেবিলে শব্দ করে বলে ওঠলো,,,
–এবার মেইন পয়েন্টে আসি চেয়্যারম্যান সাহেব। সরকার যেই ডোনেশন দিয়েছে নদীতে বাঁধ দেয়ার জন্য সেটা কৃপা করে দেখে নিন। আপনার লোকজন বিশাল অঙ্কের টাকা এখান থেকে উড়িয়ে বউ-বাচ্চাদের সাথে সংসার করছে সে খেয়াল কি আছে?
–মুখ সামলে কথা বলো ছেলে। প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
ফারহান হেসে চেয়ারে আয়েশ করে বসলো আবার। একটা ফাইল উনার দিকে এগিয়ে বলে ওঠলো….
–এই নিন ব্যাংক ব্যালেন্সের ডকুমেন্ট। আর আপনাদের মার্কেটপ্রাইজের কপিও আছে এখানে। এগুলোই আপনার জন্য যথেষ্ট। তাই………..(কিছুটা টেবিলের দিকে ঝুঁকে) বিষয়টা দেখুন চেয়্যারম্যান সাহেব। অন্যত্র কি করতে পারি তা আপনার ধরার বাইরে। এন্ড লাস্ট কথা ! কল মি ফারহান। এসব ছেলে টেলে বলা চলবে না।
দম ফেললেন চেয়্যারম্যান সাহেব। ফারহানের তীক্ষ্ণ কথাবার্তায় শরীর কেপে ওঠেছে তার। একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ফারহান গোল বৈঠক ত্যাগ করলো। পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো সাব্বির-শামসু এবং নিয়াজি সাহেবও। চেয়্যারম্যান এবার সুক্ষ্ণ চোখে হাসান সাহেবের দিকে তাকালেন। ভয়ে উনার অবস্থা আধমরা। কেননা তিনিও এই দুর্নীতির মধ্যে সামিল যা ফারহান ধরতে পেরেছে আর কখনোই উনাকে ছেড়ে দিবে না।চেয়্যারম্যান সাহেব পান্জাবির উপরের দুটো বোতাম খুলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেন এবার। জড়ানো গলায় বললেন,
–এর আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতে বিপদ হয়ে যাবে আমার!
____________
এখন প্রায় পড়ন্ত সন্ধ্যা। ইলার দুজন বান্ধবী এসেছে আজ আফরার সাথে দেখা করতে। মেয়ে দুটির নাম রিমি আর সোহা। ওরা সবাই একসাথে পড়ে। আফরা বেশ কৌতুহল নিয়ে মেয়ে দুটিকে ড্রইংরুমে দেখলো। কথাও হলো বেশ।আফরা অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির । অনেক সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। তাই অল্প সময় ব্যয় হওয়ার পরই ওরা আফরার সাথে মিশে গেলো। অতঃপর শুরু হলো জমপেশ আলাপ।তন্মধ্যে সোহা আফরাকে জিজ্ঞেস করলো,,,
–আপু তোমার কেমন টাইপের লাইফ পার্টনার পছন্দ?
এর উত্তর দেওয়ার জন্য আফরা ভাবলো কিছুক্ষণ। কেননা এ ব্যাপারে অতটা গভীরভাবে ভাবেনি সে। ওর কাছে রিলেশন ছিলো টাইমপাসের মতো। সেখানে বিয়ের মতো চিন্তাভাবনা তো ওর কাছে কল্পনাতীত ব্যাপার। আফরা মৃদু হেসে বললো,,,,
–এমন টাইপের মানুষ যার জন্য কখনও আমাকে যেন চেন্জ হতে না হয় ; আমি যেমন ঠিক তেমনভাবেই ভালোবাসবে আমায়।
আফরার এই উত্তরটি বেশ পছন্দ হলো ইলা সহ সোহা আর রিমির। রিমি এবার ফিসফিসিয়ে বললো,
–আমার তো ফারহান ভাইকে অনেক ভালোলাগে। যদি পারতাম না উনাকেই বিয়ে করে নিতাম।
আফরা ঠোঁট চেপে হাসলো রিমির কথায়। সকালে ফারহানের কথাগুলো মনে হতে অন্যরকমও লাগছে বেশ। টিশার্টটা এখনও ফেরত দেওয়া হয়নি তাকে। আফরা মিনমিয়ে বলে ওঠলো,,,,,
–এই মানুষটাকে যে বিয়ে করবে তার লাইফ খাল্লাস!
.
.
রাতে আফরাকে ডিনারের জন্য অনেক জোরাজুরি করলো মিসেস নাবিলা। কিন্ত কোনোক্রমেই উনি আফরাকে খাওয়াতে পারলেন না। আফরা আজ মনক্ষুন্ন। মেয়েটাকে এত মনমরা হয়ে থাকতে দেখে মিঃ ইফাজ প্রশ্ন করলেন,,
–কি হয়েছে আফরা? শরীর খারাপ করেছে ?
–না আঙ্কেল। আমার আজ আসলে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।আপনারা খেয়ে নিন।
কথাটি বলেই ড্রইংরুম প্রস্থান করেই সে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। আজ দিনটা বড্ড একঘেয়েমিতে অতিবাহিত হয়েছে। কারনটি আফরার অজানা। যদিও আজ অনেকদিন পর ড্যাডের সাথে কথা হয়েছে তবুও যেন মনে শান্তি নেই। অজানা এক অস্থিরতা কাজ করছে।আফরা চোখ বুজে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করলো ক্রমাগত। পুরো রুম নীরব। শুধু ফ্যানের শব্দটাই একটা আওয়াজ সৃষ্টি করছে। আফরার আজ বড্ড মনে পড়ছে ওর নিজের জন্মস্থানের কথা। ফ্রেন্ডসদের কথা,,,,,ওয়াশিংটন ডিসির প্রত্যেকটি রাতের অভাবনীয় সৌন্দর্যের কথা,,,এরিকের কথা। হয়তো এরিককে আফরা ভালোবাসেনি তবে মানুষটাকে নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধু বলে মানতো সে। সামার ক্যাম্পিং,,সিয়াটল ট্রিপ,,লস এন্জেল ট্যুর এগুলোর কথাও খুব মনে পড়ছে।
আফরার অবচেতন মন হঠাৎ বলে ওঠলো যে সে নিজে দোটানায় ভুগছে। এভাবে জীবন চলে না। তাহলে জীবন চলে কিভাবে?
নিজের জন্মস্থান ছেড়ে এক অন্য দেশ যে দেশটা ওর বাঙালিত্বের পরিচয় বহন করছে এখানেই এই প্রথম জীবন সম্পর্কে ভাবতে বসলো আফরা যে জীবন বলতে কি বুঝায়? এটা কি শুধুই উপভোগ করতে হয় নাকি অন্যকিছু। অ্যামেরিকা ব্যস্ততম দেশ। সেখানে কাজ আর ক্যারিয়ারটাই সবার উর্ধ্ধে । তারপর হলো অন্যকিছু। তবে এই প্রথম আফরা অনুভব করলো জীবনটা উপভোগ করতে হলে একজন মানুষ প্রয়োজন,,,,নিতান্তই আপন হতে হবে সে মানুষটা। আচ্ছা ফারহান কি এরকম কেউ হতে পারবে?
আফরার মনে পড়লো ফারহানকে ওর টিশার্টটি ফেরত দেওয়া হয়নি।উঠে বসলো সে,,,আগামীকালই ওর টিশার্ট ওকে ফেরত দিতে হবে।
.
.
.
.
#চলবে………..ইনশাআল্লাহ
নোটবার্তাঃ ২০০০+ শব্দের পর্ব দিলাম আজ। ঈদের আগের দিনের আনন্দ উল্লাস স্কিপ করে ৬ ঘন্টা লাগিয়ে লিখলাম শুধুমাত্র আপনাদের অনুরোধের জন্য। তাই আজকে প্রত্যেকেই কমেন্ট করবেন যাতে মনটা ফুড়ুৎ করে ভালো হয়ে যায়। সবাইকে পবিত্র ঈদ-উল-আযহা’র শুভেচ্ছা!!!