অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️পর্ব___৩৮ [প্রথম অংশ]

অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️পর্ব___৩৮ [প্রথম অংশ]
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

কখনো আকাশের মতো নীল, কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ—এমন স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটুম্বর এই টাঙ্গুয়ার হাওর। ইতিমধ্যে ট্রলারের ইন্জির স্টার্ট হওয়াতে সেটা তাহেরপুর ঘাট থেকে ছুটে অনেক দূরে চলে গিয়েছে হাওরের উদ্দেশ্যে। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি , চেনা অজানা অগণিত পাখির কলকাতান আর করচ-হিজল বনের আপরূপ সৌন্দর্য ও সমারোহে বিমূঢ় হয়ে রইলো আফরা। সময়টা এখন বর্ষাকাল। আষাঢ়ের শেষ সময় পাড়ি দিয়ে যেকোনো সময় রূপ নিবে শ্রাবণ হাওয়ায়। চারিদিকে তাই থই থই করছে জলাধার। আকাশ পরিষ্কার, সেই নীল আকাশের সাথে হাওড়ের পানিকে লাগছে আয়নার মতো স্বচ্ছ। ইলা-রৌশিন-মারুফ তিনজন ট্রলারের ছাদে চড়ে জমপেশ আড্ডা দিচ্ছে। সাথেই বসে রয়েছে আফরা। তবে ওদের আড্ডায় মেয়েটার কোনো হুঁশ জ্ঞান নেই। ইলা জিজ্ঞেস করলো,

-আপু এত চুপ হয়ে আছো কেনো তুমি?

-এখানকার রূপের কারনে চুপ হয়ে আছি।

মিনমিনিয়ে বলে ওঠলো আফরা। ওর ঘোর এখনও কাটেনী। অপার নয়নে তাকিয়ে রইলো সে প্রশস্ত হাওড়ের দিকে। অগোচরে মুচকি হাসলো রৌশিন। আফরা মেয়েটার এই বিমূঢ় রূপে মারাত্নক লাগে। তাই তো ফাহিম বোধহয় পছন্দ করেছালো আফরাকে , ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রৌশিন। মাঝে মাঝে আফরাকে দেখলে ওর হিংসে হয়, এককথায় প্রচন্ড রকমের হিংসে হয় এমন সুন্দর রূপ দেখে। আচ্ছা আফরার এক শতাংশ রূপ যদি আজ রৌশিনের কাছে থাকতো তবে কি ফাহিমও পছন্দ করতো রৌশিনকে? পরক্ষণেই এসব উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো রৌশিন। বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,

-দুনিয়াটাই এমন। যে যাকে চায় তাকে সে পায় না, তার গুরুত্বটাও বুঝে না।

আফরা যেহেতু ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলো তাই অনেকগুলো ছবি তুলে নিলো হাওরের। ইতিমধ্যে নিচ থেকে ট্রলারের ছাদে উঠে এলো ফারহান। কপালে ফারহানের বিন্যস্ত অল্পবিস্তর ঘাম, পুরু ঠোঁটগুলো কাঠফাটা রোদে শুকিয়ে গেলেও লালাভ ভাবটা যায়নি। চুলগুলো সুন্দরভাবে একপাশে আছড়ে রাখা। আফরার হার্টবিট মিস হয়ে গেলো ফারহানকে দেখে। এই মানুষটার প্রতিটি মুভমেন্টই ওকে বড়সড়ভাবে আকর্ষিত করে ফেলে। ফারহান এতক্ষণ নিচে ফাহিমের সাথে একান্তেই কথা বলছিলো , অনেক সময় নিয়ে। এই দুই ভাইয়ের পেটে এত কি কথা কে জানে?

আফরার হঠাৎ মনে হলো এসময়ে যদি অগোচরে ফারহানের একটা ছবি না তোলা হয় তবে ঘোরতর পাপ হবে, ঘোরতর পাপা। এমন মুখ্যম সুযোগ আর কখনও নাও পেতে পারে।তাই সময় বিলম্ব না করেই অগোচরে ফারহানের কয়েকটা ছবি তুলে নিলো আফরা। কিন্ত ওর ভাগ্য সহায় ছিলো না আজ।শেষ ছবিটা তোলার সময়ই ক্যামেরার সাথে চোখাচোখি হলো ফারহানের। ধরতে পারলো যে কি করছে আফরা। তাই তৎক্ষণাৎ সে বাধাঁ দিলো আফরাকে। শীতল গলায় বলে ওঠলো,

-পার্মিশন ছাড়া কারও ছবি তোলা বাড ম্যানার্স জানেন না আপনি? যেখানে আমি ছবি তোলার ঘোর বিরোধী সেখানে আপনি নির্ভয়ে আমার ছবি তুলেছেন, আপনি কি ভাবছেন আপনাকে ছেড়ে দেবো?

আফরা ঠোঁটে সুচালো হাসি ফুটিয়ে এগোলো ফারহানের কাছে। মিনমিনিয়ে বললো,

-ছেড়ে না দিলে আমায় ধরে রাখবেন বুঝি? রাখতে পারেন। আই ডোন্ট মাইন্ড।

ফারহান অবাক প্রসন্ন হয়ে আফরার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এমন এক্স্ট্রা এক্সট্রোভার্ট টাইপ মেয়ে এই প্রথম দেখলো ফারহান। আফরা এমন একজন মেয়ে যার মুখে কোনো বাঁধ নেই। অনায়াসেই যেকোনো কথা বলে দিতে পারে। ফারহান এবার সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলো আফরাকে। আর যাই হোক, এতগুলো মানুষের সামনে কিছুতেই অস্বস্তির শিকার হবে না এই আফরার কাছে।

____________

ট্রলার এবার টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের সামনে থেমেছে। রৌদ্দুরের উত্তাপে ঝিকমিক করছে চারিদিক। টলটলে পানির দৃশ্যটা ওয়াচটাওয়ারের কাছাকাছি আসার পর খানিকটা ঘোলাটে দেখা দিলো। আফরা অদূরেই খেয়াল করলো ইট পাথরের তৈরি একটা সুন্দর ওয়াচ টাওয়ার। মাঝখানে সুন্দর গোলাকৃতি করে সিড়ি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আফরা রৌশিনেক জিজ্ঞেস করলো,

-এখানে ট্রলার থামিয়েছে কেনো রৌশিন?

-ওয়াচটাওয়ারের সামনে মূলত সুইমিং করার জন্যই ট্রলার থামায়। সবাই তো অলরেডি প্রস্তুত। তুমিও করতে চাও সুইমিং আপু?

ঘোরাফিরা আর সুইমিং, এই দুটোর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আফরার। পানি দেখলেই ওর ঝাপিয়ে পড়তে মন চায়। আর ফারহানের সাথে সাতগাঁওয়ের বিলের সেই শেষ অভিজ্ঞতাটা মনে পড়তেই ওর মধ্যে ‘ওয়েদার ডিমান্ডস’ মনোভাবটা চাড়া দিয়ে ওঠলো স্নায়ুতে। ফারহান ইতিমধ্যে লাইফ জ্যাকেট পড়ে ফেলছে। সেই সাথে ফাহিম, সাব্বির আর শামসুও। আফরাও এবার পানিতে নামবে বলে পণ করলো। যেই ভাবা সেই কাজ, আচমকা সবাইকে অবাক করেদিয়ে সে লাইফ জ্যাকেট না পড়েই ঝাঁপ দিলো হাওরের টুইটুম্বুর পানিতে। প্রথমে সবাই বিস্মিত হয়ে গেলেও ক্রমেই বোধ ফিরে পেলো সবাই।মনে বাসা বাধলো উদ্রেক। এই ভরা বর্ষায় কিভাবে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া পানিতে ঝাঁপ দিলো আফরা? কিছু হয়ে গেলে………..ফারহান পুরো ব্যাপারটা ভাবার আগেই হঠাৎ পানিতে ঝাঁপ দিলো। পানিতে ঝাপ দেওয়ার দরুন টুইটুম্বুর শব্দটা কানে বাজছে সবার। এই মাত্র কি করলো এটা ফারহান? ফারহানের এই নতুন গুণের সাথে একেবারেই অপরিচিত সবাই৷ ফারহান এবার সাঁতরেই চলে গেলো আফরার কাছে। আফরা ততক্ষণ শীতল পানির সংস্পর্শে এক অন্য আনন্দে ছিলো। তবে ওর আনন্দ নিমিষেই থমকে গেলো গালে ঠাসঠাস করে কিছু একটা পড়াতে। ফারহান থাপ্পড় মেরেছে ওকে। আফরা পানিতে ভাসতে ভাসতেই গালে হাত দিয়ে তাখকালো ফারহানের মুখে। রাগে রি রি করছে ফারহানের শরীর। ঠোঁটজোড়া অল্পবিস্তর কেপে রক্তিম রং ধারন করেছে।

ফাহিম, সাব্বির, ইলা, মারুফ সহ সবাই অবাক ফারহানের এমন কান্ডে। এই প্রথম ফারহান কোনো মেয়েকে কষে চড় মারলো তাও কিনা এমন একজন যে ওদের অতিথি। ছলছল করে ওঠলো আফরার চোখ। শিথিল হয়ে গেলো ওর পুরো শরীর। পানিতে গভীরে তলিয়ে যাওয়ার পূর্বেই ফারহান শক্ত করে ওর কোমড় চেপে টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। নিজের বুকের সাথে মিহিয়ে ধরলো আফরার সিক্ত শরীর। ফারহান এমনভাবে ওকে চেপে ধরেছে যেন ছেড়ে দিলেই হয়তো চলে যাবে পানির গভীর অতলে। যা মোটেও নিতে পারবে না ফারহান। থমথমে গলায় সে বলে ওঠলো,

-আপনি কি পাগল আফরা? এভাবে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কি হিসেবে ঝাঁপ দিলেন? এখানকার গভীরত্বের কথা আন্দাজ আছে আপনার? তলিয়ে যেতেন পানিতে। নিজে তোমরতেনই , সাথে আমার নিঃশ্বাসও কেড়ে নিতেন।

আফরার মস্তিষ্কের নিউরন অচল হয়ে গিয়েছে ছেলেটার কথায়। ফারহানের চোখে মুখে রাগের সাথে ভয় আর উদ্রেকের চরম রেশ। আফরা প্রথমে ফারহানের এমন ব্যবহার নিতে পারছিলো না কোনোভাবেি৷ এতদিন ইগ্নোর করাও ঠিক ছিলো তবে ফারহান যে কখনও ওকে চড় বসিয়ে দিবে এটা ও ভাবতেই পারিনি৷ হু হু করে বইছে হাওরের বাতাস। পানিতে ভেসে থাকা দুজন মানব মানবীর চোখের ভাষা ভিন্ন। যা এই প্রথম ফাহিম দেখলো অন্য নজরে৷ কিছু একটা আছে আফরা আর ফারহানের মধ্যে যা অজান্তেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে আরও।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব__৩৮ (দ্বিতীয় অংশ)
নিজের পছন্দের মানুষের কাছ থেকে থাপ্পড় খাওয়ার পর স্বভাবতই একজন মানুষ সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ে, আফরার ক্ষেত্রে সেই ব্যাপারটি চলে গিয়েছে অতিরিক্ত পর্যায়ে। পুরোটা জার্নিতে আফরা ছিলো মুখ গুমড়া করে। ফারহান প্রথম প্রথম অনেক রেগে থাকলেও পরন্তু নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়েছে বেশ। এই একটা দোষ ফারহানের, রেগে গেলে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। কখন ঠিক কিরূপ প্রতিক্রিয়া করা উচিত তা যেনো ভুলেই যায় সে। ফারহান তাই পরবর্তীতে আমতা আমতা করে সরি বললো আফরাকে। বললো, যে এভাবে সবার সামনে চড় মারাটা উচিত হয়নি ওর। মারুফ, ইলা, সাব্বির , শামসু রৌশিন সাবই ফারহানের সাথে তাল মিলিয়ে আফরাকেবঅনুনয় বিনিময় করে চললো ফারহান ভাইকে মাফ করার জন্য। যতই হোক, ওদের সবার চোখের মধ্যমণি ফারহান ভাই।

এই পুরোটা সময় শুধু নির্বিকারে রইলো ফাহিম। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। তখনকার ফারহানের বিরূপ ব্যবহার ভাবিয়ে তুলছে ওকে। ফারহান তখনই ভয়ংকরভাবে রাগে যখন ওর নিকটবর্তী কোনো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে হিসেব করলে আফরা একেবারেই দূরের কেউ ফারহানের। আসলেই কি তাই? আর যাই হোক, আজ ফারহান আর আফরা দুজনের মুখের যেই ভাবভঙ্গি দেখেছে ফাহিম নিশ্চিত ওদের মধ্যে কিছু একটা আছে। যেটা হয়তো গভীরতায় ছুঁই ছুঁই। কিন্ত ফাহিম কোনোক্রমেই মানতে চাইছে না বিষয়টা। ফারহান ওর কাছে আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি কিছু। ফারহান আহত অবস্থায় থাকলে নিজের সকল কাজকর্ম ফেলে সে ছুটে যায় ফারহানের কাছে ওকে রিকভার করার জন্য। একজন রাজনৈতিক নেতা হওয়ার দরুন কম গুলিবিদ্ধের শিকার হতে হয়নি ফারহানকে। এসময় ফাহিম ছিলো ওর পাশে। ফাহিম ফারহানকে এতটাই বিশ্বাস করতো যে আফরার সম্পর্কে প্রথম অনুভূতিটা সে জানিয়েছিলো ফারহানকে। আর সেই ভাই ওর কাছ থেকে এত বড় সত্য লুকালো? যদি ফারহান আগেই বলতো যে দুজন দুজনকে পছন্দ করে ফাহিম কল্পনাও করতো না আফরার ধারপাশে ঘেষার । সেখানে দুটো মানুষই ওর ইমোশানস নিয়ে খেলেছে। ফাহিমের মুখ দিয়ে এই প্রথম, এই প্রথম একটি অশ্রাব্য ভাষা বেরিয়ে এলো ফারহানের জন্য। সুযোগ হোক, ফারহানকে এর জবাবদিহিতা করতেই হবে যে কেনো এত বড় সত্যটা সে লুকোলো।

_________________

বিকেলে যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে তখন অপরূপ লাগে দেখতে এই টাঙ্গুয়ার হাওর। নীলাদ্রী লেকের পাহাড়ি সৌন্দর্য হাওরের ট্রলারে বসা প্রতিটি মানুষকে বিমোহিত করে তুলেছে। অদূরের এক প্রান্তে বসে আছে সাব্বির আর ইলা। আপাতদৃষ্টিতে ওদের আচার আচরণ সবার কাছে সাধারণ মনে হলেও কেবল মারুফ আর রৌশিন জানে পুরো ঘটনাটি। মারুফ এবার রৌশিনের কাধে বারি মেরে বললো,

-ওই চড়ুই দুইটা দেখলে মোর হিংসে হরে রৌশিন। চল তুই আর আমি মিলে আর এক জোড়া চড়ুই হয়ে যাই।

রৌশিন এবার মারুফের কান টান মারতেই মারুফ আত সুরে বললো,

-ছাইড়া দে বইন। আমি তো মজা করসিলাম।

-তোর বিতড়ামি আমি হাওরে ফেলমু শালা। সাহস কতো, আমার লগে ফ্লার্টিং করস?

ওদের কাজকর্ম দেখে আফরার যেন হাসি থামছে না কোনো ক্রমেই। হাওরের এক পাশের উত্তরে হাওয়া সারা গায়ে হিম জরিয়ে দিচ্ছে। ফারহান আড়চোখে লক্ষ করলো আফরার প্রানবন্ত হাসিকে। সে এতক্ষণ মোবাইলে আলাপচারিতায় মশগুল ছিলো। আজ বহুদিন বাদে কল দিয়েছে নিজাম সাহেব। পুনরায় সতর্ক করে দিয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ফারহানের প্রানাশঙ্কা আছে। যা ফারহান ভালোমতই জানে। তবুও মনে ওর কোনো ভয়নেই। সকল দুশ্চিন্তা, ক্লান্তি সবকিছু নিমিষেই যেন আফরাকে দেখলে উধাও হয়ে যায়। ফারহান এবার ফাহিমের কাছে বসে পড়লো। কথা বলতে যাবে তবে ফাহিম খুব কড়াকড়ি ভাবে এড়িয়ে গেলো ফারহানকে। ফারহান হঠাৎ হকচকিয়ে গেলো নিজেরই ভাইয়ের এমন কান্ডে। হলো টা কি ফাহিমের?

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ট্রলার এবার ছুটে চললো তাহেরপুর ঘাটের দিকে। আফরা ট্রলারের একদম প্রান্তে বসে রইলো। পাশে বসলো ফারহান। জিজ্ঞেস করলো,

-কেমন লাগলো আজকের ট্রিপ?

-আপনার স্ল্যাপ খাওয়া ছাড়া সবটুকু ভালো ছিলো।

আফরা বললো মিনমিনিয়ে। ফারহান হেসে ফেললো হঠাৎ। বলে ওঠলো,

-তো কি করতাম বলেন। আপনি যে ফার্মের মুরগি জানতাম, সেই সাথে ব্রেইনলেস ফার্মের মুরগি জানলে আপনার হাতই ছাড়তাম না।এখন বর্ষাকাল আফরা! হাওরের পানি এসময় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। যেখানে ভালো সাতাঁরুরাও লাইফ জ্যাকেট ছাড়া থাকতে পারবে না সেখানে আপনি কিভাবে বেইনলেস ফার্মের মুরগির মতো ঝাঁপ দিলেন পানিতে?

মুখ ক্রমশ সাল হয়ে গেলো আফরার লজ্জায়। অপমানের মাত্রাটাও রি রি করে বাড়ছে। তবে ফারহানকে অবাক করে দিয়ে আফরা কিছুই বললোনা আজ। ফারহান ঠোঁটে দাম্ভিক হাসি ফুটিয়ে বললো,

-উমমম! ব্যাপার কি আফরা। আপনি তো এখন আগের মতো আমার ওপর ক্ষেপে যান না। এট এনি চান্স আমার ওপর আসক্ত হয়ে পড়েছেন নাকি?

শেষ কথাটা ফারহান বললো খানিকটা ঝুঁকে, ফিসফিসিয়ে। আফরা চাপা কন্ঠে বললো,

-আসক্ত হলেই কি, না হলেই বা-কি?

-নাহলে কিছু না। তবে আমার প্রতি যদি আসক্ত হন, সেটা আমার কাছে অনেককিছু।

আফরা খপ করে তাকালো ফারহানের চোখে। ফারহানের চোখ অন্যকিছুই বলছে আজ। যা নিমিষেই আফরার হৃদয় কাপিয়ে তুলতে পারবে। হাওড়ের বাতাসের দরুন সমানতালে উড়ে চলছে আফরার অবাধ্য চুল। বেগুনি সালোয়ার কামিজের ওড়নাও সেই সাথে উড়ছে। ফারহান কিছুক্ষণ মোহাচ্ছন্ন ভাবে আকৃষ্ট হয়ে রইলো এই রূপে। মনে নিষিক্ত কিছু উন্মাদনা কাজ করছে। পরক্ষণের নিজের কান্ড ভেবে নিজেরই সে অবাক হয়। ‘আফরা’, ‘আফরা’ নামেই এই ভীনদেশি মেয়েটি ওর হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।ফারহান ঘোর বশতই আফরার চুলগুলো গুঁজে দিলো কানের পিঠে। বরাবরের মতো মিহি স্বরে বলে ওঠলো,

-সুন্দর।

_____________

সন্ধ্যার সময়ে সবাই ঘাটে এসে পৌঁছুল। দিকবিদিক ছাড়িয়ে গিয়েছে আঁধারে। পশ্চিমাকাশের লালাভ আভা এখনও দৃশ্যমান। সবাই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঘাট থেকে নামলো, একে একে সবগুলো রেখে দিলো গাড়িতে। তবে বিপত্তি বাঁধলো রৌশনিকে নিয়ে। বিকেল ঢলে পড়ার পরই রৌশিন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। সকালে বেশ সকালে ওঠার কারনেই ওর এ দশা। মারুফ গালে হালকা বারি দিয়ে ঢাকলো রৌশিনকে। যতটুকু চোখ রৌশনি খুলেছে, বেশ কষ্ট করেই খুলেছে সে৷ রোশিনের বাসার রাস্তা যেহেতু ওদের বাসা থেকে একেবারেই উল্টো পথে, তাই এ অবস্থায় কাউকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে ঘুমন্ত রৌশিনকে। ফাহিম যাবে বলে মনস্থির করলো৷ ফারহানের গাড়িতে যখন ইলা আর আফরা ঢুকছিলো ফাহিম একপলক আহত চোখে তাকিয়ে নিলো রৌশিনের দিকে। তারপর গাড়ির ইন্জিন স্টার্ট করে রওনা দিলো রৌশিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

_________

ছিমছাম অন্ধকার। দুধারের উঁচু উঁচু গাছের পাতা গুলো হাওয়ার ন্যায় দুলছে আনমনে। চা পাতার এক কড়া ঘ্রাণ ভেসে এলো ফাহিমের নাক বরাবর। পাশেই ঘুমন্ত রৌশিন৷ মাথাটা জানালার ধারে বেঁকে বসেছে। ঠোঁটটা সামানো উল্টানোর কারনে কিউট লাগছে দেখতে।

তবে মনে উথাল পাতাল ঝড় ফাহিমের। ফারহানের সেই বলা কথাগুলো, আফরার প্রতি ওর দৃষ্টিগুলো ক্রমেই ভাবিয়ে তুলছে ওকে। মন না চাইতেও সায় দিচ্ছে ওদের অন্তরের কোনো সম্পর্রকের ব্যাপারে। এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি এসে থামলো রৌশিনদের বাসার সামনে। ফাহিম তারপর সিটবেল্ট খুলে দিলো রৌশিনের। একপলক দেখে নিলো ওর ঘুমন্ত মুখশ্রী। তারপর কোমল কন্ঠে ডাক দিলো,

-রৌশিন, এসে পড়েছি আমরা। ঘুম থেকে উঠো।

প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। ফাহিম ছোট করে শ্বাস ছাড়লো। আবার হালকা করে ডাক দিলো রৌশিনকে। বললো,

-রৌশিন? আর কত ঘুমাবে তুমি?

তখন এক অবাক কান্ড করে বসলো রৌশিন। ঘুমের ঘোরে ফাহিমের গলা জড়িয়ে ধরতেই ফাহিম ভারসাম্যহীন ভাবে পড়ে গেলো ওর ওপর। নিজের ঠোঁটজোড়া অস্বাভাবিক ভাবেই মিশে গেলো রৌশিনের গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটে। ফাহিম হতভম্ব। ওর স্নায়ু কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজের ওপর প্রচুর ভার অনুভব করতেই রৌশিন যখন পিটপিট করে চোখ খুললো, নিজেদের এমন অবস্থা টের পেতেই হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা দিলো ফাহিমকে। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে গিয়েছে দুইজন৷ পুরো গাড়িতেই ভ্যাপসা আভাস। রৌশিন অস্বস্তির দরুন ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে৷ ও ভাবতেও পারেনি যে ঘুমের ঘোরে এমন কিছু করে বসবে।
রৌশিন একদন্ড গাড়িতে থাকলো না৷ গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত বাড়িতে ঢুকে গেলো। একপলক ও তাকালো না সে ফাহিমের দিকে। এদিকে ফাহিম এখনও বাকরুদ্ধ। বেসামালভাবে সে হাত দিলো নিজের ঠোঁটজোড়ায়। সেই সাথে চোখের পলক পড়াও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here