অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️পর্ব__৪৫
#লেখিকা- কায়ানাত আফরিন
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির জন্য সিক্ত হয়ে ওঠেছে সবকিছু। দূর দূর তাকালেই দেখা যাবে বৃষ্টির পানিকণা আর চা বাগানের অধুষ্যিত অঞ্চলে সবুজের সমারোহ৷ ফারহানের দৃষ্টি নিবদ্ধ পিচঢালাই পথে। কোনোরকম কোনো কথা না বলে গাড়ি এলোমেলো ভাবে ড্রাইভ করতে মগ্ন। আফরার চোখে মুখে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। ফারহানের কীর্তিকলাপ সব ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ছেলেটাকে এমন পাগলাটে পাগলাটে রূপে দেখে নিঃশ্বাসও আটকে আসছে বারবার। গুছিয়ে প্রশ্ন করার জন্য কিছুতেই স্থির করতে পারলো না আফরা নিজেকে। সন্ধ্যা নেমে যাওয়াতে আকাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে পুরোটা। আফরা এবার দম নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘হ….হয়্যার উই আর গোয়িং ফারহান?’
আফরাকে স্পষ্ট বিচলিত দেখা যাচ্ছে। তাই গুছিয়ে বাংলাতেও কথা স্পষ্ট বলতে পারছে না৷ ফারহান তবুও প্রতিউত্তর দিলো না আফরার কথায়৷ গাড়ি থামালো একটা নির্জন ঘাটের সামনে। আফরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো বাহিরে৷ জনমানব কম। একে তো রাত তার ওপর বৃষ্টি থাকাতে ঘাটের সামনে নির্জন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ ঢেউয়ের ধাক্কায় নড়ে ওঠছে অস্পষ্ট নৌকাগুলো৷ সেখানে একজনকে দেখে চমকে ওঠলো আফরা। মানুষটা আর কেউ নয়, ফারহানেরই বিশ্বস্ত লোক শামসু। ঘাটের এক প্রান্তে রেইন কোর্ট আর হাতে টর্চ লাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানের গাড়ি থামা মাত্রই শামসু গাড়ির কাছে এগিয়ে আসলো। ফারহানকে বললো,
‘ আপনার কথামতো সব ব্যবস্থা করসি ভাই। কিন্ত এত রাতে আপনের নৌকা লাগবো ক্যান!’
‘ এত প্রশ্ন করার তো প্রয়োজন দেখছি না আমি শামসু!’
শামসু অসন্তুষ্ট হলো এ কথায়। অভিমানি সুরে বলে ওঠলো,
‘ আপনি বদলায়া গেসেন ভাই। আগে আমারে আর সাব্বিররে কোনো কিছু না বইলা আপনি একটা কামও করতেন না৷ আর এখন কোনো কিছুই বলতে চান না। তার ওপর এই প্রথম কাওরে এমনে তুইলা আনসেন আপনি৷ আর যা-ই কন ভাই, আপনার যে কখনও এমন দশা হবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনাই।’
ফারহান স্থিরভাবে গাড়ির ইন্জিন বন্ধ করে বললো,
‘ তোর কথা হয়েছে? তুই যেতে পারিস এখন।’
শামসু আর কিছু বললো না। অদ্ভুত প্রলাপ করতে করতে চলে গেলো স্থান ত্যাগ করে। আফরা এবার সম্পূর্ণ ঘুরে বসলে ফারহানের দিকে। বিচলিত কন্ঠে বললো,
‘ আপনি করছেন টা কি একটু বলবেন আমায়? এতদিন কোনে খবর ছিলো না হুট করে তুলে এই স্ট্রেঞ্জ প্লেসে নিয়ে আসলেন৷ আর ইউ গ’না ম্যাড মি. ফারহান। সে সামথিং! ‘
আফরা অতিষ্ঠ হয়ে যাছে। চাড়া দিয়ে ওঠেছে প্রবল অভিমান৷ ফারহানকে কিছুতেই মাফ করতে পারবে না আফরা। এতদিনের ক্ষোভ, অভিমান কিছুতেই আর যাই হোক, ভুলার মতো নয়। ফারহান তপ্তশ্বাস ছাড়লো। বলে ওঠলো,
‘ এটা রাতারগুল আফরা!’
আফরা শান্ত হয়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো সেদিনকার কথা যদিন আফরা রাতারগুল আসার ইচ্ছে পোষণ করেছিলো৷ ফারহান আবার বললো,
‘ আমি, আমি কথা দিয়েছিলাম আপনাকে যে আপনাকে পুরো সিলেট ঘুরে দেখাবো। এর মধ্যেই রাতরগুল টাই বাকি ছিলো। তাই কথা না বাড়িয়ে এখানে নিয়ে এসেছি।’
‘ এজন্যই এতকিছু?’
আফরার সিক্ত কন্ঠ। ফারহান কথা বললো না। কেন যেন এড়িয়ে যেতে চাইলো প্রশ্নটা। তবুও বললো,
‘ আজ আরও একবার এখানকার বৃষ্টি উপভোগ করুন আফরা।’
বলেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ফারহান। সেই সাথে আফরাও। বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছে ওদের দেহ। ফারহান ঘাটের নৌকায় চড়ে বসলো। আফরাকেও বসালো নৌকাতে। নৌকা চালাবে ১৬-১৭ বছর বয়সী ছোট একটি ছেলে। এখানকার প্রত্যকেটা মানুষ কিছু পারুক আর না পারুক, নৌকা চালানো রপ্ত করেছে কিশোরকালেই। ছেলেটাও তার ব্যাতিক্রম নয়।
.
.
রাতের আকাশে নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার। আশপাশে টুপটাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির জন্য। চারিদিকে তাকালেই আঁধার আর জঙ্গল। কেননা রাতারগুল জায়গাটাই এমন। বর্ষাকালে ঘন গাছের আচ্ছাদনের মাঝে দিনে যতটা সুন্দর লাগে, রাতে ততটাই লাগে ভয়ঙ্কর। এখানে তাই এসময়ে সাপ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নৌকা খুবই সন্তর্পণে এগিয়ে যেতে মগ্ন। তবুও আফরা যেন প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। একহাত খামচে ধরে আছে ফারহানের। একেতো কেমন যেন অন্ধকার, তার ওপর গাছপালার বাহার। এত রাতে জায়গাটি অনন্য মায়াবী মনে হলেও কেন যেনো নিরাপদ নয়। নৌকা চালানো ছেলেটা এবার ফারহানকে বললো,
‘ আফনের ডর লাগেনা ফারহান ভাই? এই রাইতে আমরা জিন্দেগিতেও ওয়াচ টাওয়ারের ওদিক যাইতে সাহস পাইতাম না৷ আপনার লেগাই ডর পেটে গুইজ্জা যাইতেসি ওহানে৷ এখন যদি সাপে টাপে আইসা কামড় দিলো আফনাগো?’
আফরা ছেলেটার কথা বুঝতে কষ্ট হলেও মাথায় ধরতে সময় নিলো না। তাই আরও সিটিয়ে গেলো উদ্রেকে। শুকনো গলায় বললো,
‘ আমার……আমার রাতারগুলো যাওয়ার দরকার নেই ফারহান। আমায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিন। আমি….আমি চলে যেতে চাই!’
‘ আর একটা কথা বলবেন, তাহলে এখানেই ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো। বলেছি না আর কয়েক ঘন্টা আমায় সহ্য করতেই হবে? আপনাকে এখানে আমার থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্য নিয়ে আসিনি৷ ‘
ফারহানের কথাগুলো জট পাকিয়ে দিচ্ছে আফরার মাথায়। আসলে মানুষটা কি করতে চাইতে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। আফরা চুপ করে বসে রইলো এবার। ও সবসময় এটাই চাইতো যে মানুষটা ওর ওপর নিজের কথা প্রয়োগ করুন। আফসোস সেই সময়টার সাথে ইচ্ছেটাও ফুরিয়ে গেছে। ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো আফরা।
নৌকাটা এবার ঠিক থামলো ওয়াচ-টাওয়ার এর সামনে। এতক্ষণ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হঠাৎ ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। প্রকৃতি যেন এতক্ষণ এটারই অপেক্ষা করছিলো যে কখন এই পায়রাজোড়া আসবে আর ছড়িয়ে দিবে প্রেমবর্ষণ। ফারহান এবার নৌকা থেকে নেমে গেলো। হাত বাড়ালো আফরার দিকে। মৃদু অন্ধকারে সুঠাম দেহের এই অবয়ব আফরাকে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানছে। সেই সাথে চাড়া দিয়ে ওঠেছে প্রবল অভিমান। আফরা হাত ধরলো না। ইঙ্গিত দিচ্ছে ওকে দ্রুত এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফারহান জোরপূর্বক আফরার হাত টেনে উঠে দাঁড় করালো এবার। এতে আফরা ফারহানের সাথে মিশে যাওয়াতে আফরা যেন চরম অবাক। এই প্রথম নিজ থেকে ওকে কাছে টেনেছে ফারহান৷ মৃদু গলায় তাই আফরা বললো,
‘ আপনি কি আজ ড্রিংক করেছেন কমরেড? এসব আচরণ কিন্তু ভাবিয়ে তুলছে আমায়।’
ফারহান হাসলো। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলো,
‘ আপনার সৌন্দর্যে আমি অলরেডি ড্রাংকড আফরা। এই ক্রেজিনেস এই জনমে আমার কাটবে না।’
আড়ষ্ট কন্ঠে আফরার শরীরে আলাদা এক শিহরণ বয়ে গেলো ক্রমশ। ফারহান নির্বিকার। এদিকে বৃষ্টির গতি বাড়ছে। ফারহান তাই বলে ওঠলো,
‘ ওয়াচ-টাওয়ারে ওঠে রাতারগুলের নিশি রাতের সৌন্দর্য দেখবেন না আফরা?’
আফরা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মাথা নাড়ালো। বললো,
‘ দেখবে তো! হয়তো শেষবারের মতো দেখবো৷ আপনার সাথে!’
.
.
.
.
~চলবে
পর্বটি ছোট হয়ে গিয়েছে জানি। তবে লেখার জন্য একবারেই সময় পাইনি৷ আজকেও দিতে পারতাম না হয়তো তবে অনেক কষ্টে টাইম ম্যানেজ করেছি। ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখার অনুরোধ থাকবে।