অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
২৯|
সন্ধ্যার মাতোয়ারা পরিবেশ। আচ্ছা, বৃষ্টি কী সদা সুন্দর ছিলো? না-কি আজই বেলীর কাছে এতো সুন্দর লাগছে।। অস্ফুটস্বরে বৃষ্টির টুপটুপ আওয়াজ গুলো যে বেলী শুনতে পাচ্ছে। আর, শুনতে কী ভালোই না লাগছে। শরীর ঝিনঝিন করে উঠছে। হালকা বাতাসের সাথে বৃষ্টির পানি উড়ে উড়ে চোখ-মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। শরীর ভালোলাগায় এলিয়ে যাচ্ছে। ইশ, আজই কেন বৃষ্টিকে এতো সুন্দর হতে হলো? আজ যে বৃষ্টির কাছে যেতে বড্ড ভয় হচ্ছে বেলীর। এইযে, মনেমনে সে বিশ্বযুদ্ধ জয়ের মনোবল তৈরি করছে। কিন্তু,পরক্ষণেই মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে কারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চোখে ভাসতেই। অদ্ভুত অস্বস্তিতে বেলী অসহায় হয়ে পড়ছে। এমন কেন মনে হয়? যতক্ষণ তার সাথে থাকে মনে হয়, বেলীর শরীরের রক্ত গুলো অপরিসীম ভাবে দ্রুততম গতির রেশ ধরেছে। মন বারবার কাঁপতেই থাকে। গলা বারবার শুঁকিয়ে যায়। এইসব অনুভূতি গুলো যে বেলীকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। অনুভূতি সজ্জ করতে না পাড়ায় যে তার চোখ ঝাপসে হয়ে আসে। এগুলো সে কীভাবে বলবে?
প্রবল বৃষ্টির মাঝেও বেলী অস্পষ্ট ভাবে দেখছে সে দাঁড়িয়ে। এবং তার চাহনি বেলী। এভাবে কেন তাকায়? এইযে এই তাকানোতে বেলীর মনের সব মনোবল যে গুঁড়িয়ে গেলো? সেটা তো মনোবল ভাঙানো ব্যাক্তি জানল না। সে তো জানলোই না যে বেলীকে সে অদ্ভুত জালে একা ফেলে দিয়েছে। যেখানে বেলী জালের ছোঁয়া সজ্জই করতে পারছে না।
গাড়ি হতে বেশ কিছুদূর দাঁড়িয়ে বেলী। এখন আর তৃষ্ণা তাড়া লাগাই নি তাঁকে। অদ্ভুত ভাবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। টুপটুপ পানিতে সে ভিজে যাচ্ছে। সদা উঁচু হয়ে থাকা চুলগুলো চোখের পাপড়ি ডেকে দিচ্ছে। শার্ট চপচপ ভাবে শরীরে মিশে আছে। কি লম্বাই না দেখাচ্ছে লোকটাকে। ভাবতেই বেলী হেসে ফেলল। বেলীর হঠাৎ হাসিতে তৃষ্ণা কেমন আরও ঝিম মেরে গেলো। বেলী ধীরে এগোতে লাগলো। প্রতিটি এগোনো ধাপে জেনো বেলীকে জানান দিচ্ছে ‘ সামনে ভয়ংকর কিছু ‘। যার জন্য সামনে পা বাড়তেই চাচ্ছে না! শরীরের সব শক্তি দিয়ে বাড়াতে হচ্ছে। চোখে চোখ মিলানো-টা আজ বড্ড কষ্টদায়ক হয়ে উঠছে। তৃষ্ণা বরাবর আসতেই বেলীর কেমন শীত লাগতে শুরু করলো। স্বাশ নিতেও ভয় হচ্ছে। হঠাৎ, তার ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেতেই বেলী কেমন নেতিয়ে গেলো। মনের দ্বিধা কাটিয়ে তাকাল মাথা উঁচু করে। সে অদ্ভুত ভাবে বেলীর চুলের দিক তাকিয়ে। ধীরে চুলগুলো বেলীর কানে গুঁজে দিল। গালে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতে লাগলো। এখানে যে বেলীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সেটা তো জানলোই না। শরীরে রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বুকের মাঝে তীব্র ঝর বয়ে যাচ্ছে। সেগুলো তো লোকটা জানলো না। বেলী সরে যেতে গিয়েও সরলো না। বরং এগিয়ে গেলো দু’ধাপ। একদম তৃষ্ণার কাছাকাছি। ঝর যদি এমন মধুময় তাহলে সেই ঝরে বেলী ডুবতে রাজি। হাজার বার রাজি।
বেলীর কাঁপা-কাঁপি পায়ে এগিয়ে আসার পদক্ষেপ গুলো বেশ তাঁক লাগানোর ছিলো। তৃষ্ণা প্রায় থম মেরে রইলো। পরক্ষণেই বেলীর দু’গাল চেপে কপালে গভীর ভাবে চুমু খেয়ে বসলো। তারপর বেলীর মাথায় থুঁতনি গুঁজে বেলীকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো। আয়েশে তার চোখ বুঁজে এলো। এটা তার বেলীর প্রথম আগানোর পথ। আচ্ছা, বেলীকে ভালোবাসা শিখতে পেরেছে? সেকি বুঝতে পারছে অনুভূতি গুলো। তৃষ্ণা যে-ই অনুভূতিতে প্রতিরাত মাতাল হয়ে যায়। শরীর ঝিম মেরে থাকে। সব শেষ মনে হয়ে যায়। পৃথিবী থেমে যায়। শুধু সে ছটফট করতে থাকে একান্ত। এই অনুভূতি গুলোর সাথে কী বেলী পরিচয় হতে পেরেছে?
বেলী কেঁপে উঠছে। তা-ও সে মিনমিন গলায় বলল,
— আপনার তো অল্পতে ঠান্ডা লেগে যায়। এভাবে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবেনা।
তৃষ্ণা বেলীকে ছাড়লো,
— তোকে কে বলল? নাকি এখনই জাসুসি শুরু করেছিস?
— জাসুসি কেন করব। আন্টি বলেছিল।
— আন্টি কী? আম্মু বলবি।
বেলী কেমন কেঁপে উঠলো।
— আর ঠান্ডা লাগলে লাগবে।
— লাগলে লাগবে মানে। চলুন গাড়িতে।
বেলী বলতে বলতে তৃষ্ণার হাত টানতে লাগলো। কিন্তু, তৃষ্ণা একচুল পরিমাণ ও নড়ল না। উল্টো বেলীকে এক টানে সামনে আনল,
— একটা চুমু খা। তাহলে বৃষ্টিতে দাঁড়াব না।
বেলী চুপসে গেলো, ছোট্ট আওয়াজে বলল,
— সদা এমন করেন আপনি।
তৃষ্ণা যেমন শুনেও শুনলো না। ঠাঁই একই পরিস্থিতি-তে দাঁড়িয়ে। কঠিন চাহনি দিয়ে বেলীকে ভস্ম করে দিচ্ছে। বেলী সজ্জ করতে না পেরে তেড়ে বলল,
— আপনি এভাবে তাকানো বন্ধ করুন।
— কীভাবে?
— এইযে যেভাবে তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আমায় গিলে নিবেন।
— আহ,
বেলী বড়সড় চোখ করে তাকাল। তৃষ্ণা হালকা আওয়াজে বলল,
— গিলতে দিবি?
বেলী বুঝতে পারলো নাকি না সে জানেই না। অযথা বলল,
— ছিঃ!
তৃষ্ণা হালকা হাসলো,
— ছিঃ কেন? তুই অন্যকিছু ভাবছিস?
বেলী মুখ বন্ধ করে ফেলল। কথা বললে বলতেই থাকতে হবে। এদিকে বৃষ্টি কমছে না। বরং বাড়ছে। অগ্যত বেলী বলল,
— চোখ বন্ধ করুন৷
লক্ষি ছেলের মতো তৃষ্ণা সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। এবং ঠোঁটের হাসিটা কিছুটা বড় হয়ে গেলো। বেলী কিছুক্ষণ সেই হাসি-হাসি মুখটার দিক তাকিয়ে থাকলো। লোকটা আসলেই ভয়ংকর সুন্দর। তৃষ্ণার মুখের দিক তাকিয়ে ঢোক গিলল সে। তারপর কাঁপাকাঁপা হাতে তৃষ্ণার ডান হাত নিজের হাতে নিলো। চোখ বুঝে থাকা তৃষ্ণার হাসিটা আরও বড় হয়ে উঠলো। লজ্জায় কাঁচুমাচু করা বেলী দ্রুত, তৃষ্ণার উল্টো হাতে চুমু খেয়ে সরে দাঁড়ালো। তৃষ্ণা কিছুক্ষণ ঠাঁই হয়ে রইল । চোখ বুঝে থাকা অবস্থায় হালকা হেসে বলল,
— চোখ খুলব নাকি আরও কোথাও দিবি?
লজ্জায় লাল থাকা বেলী এবার নীল হয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণা চোখ খুলে নিজের হাতের দিক তাকিয়ে। তারপর বেলীর দিক তাকিয়ে থেকে যেখানে বেলীর ঠোঁটের ছোঁয়া ছিলো সেখানে নিজের ঠোঁট বসালো। তারপর কেমন নেশাধরা কন্ঠে বলল,
— ঠোঁট চুমু খেলে না কাজে দিতো।
বেলী আঁড়চোখে তাকিয়ে, গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো।
ভেজা চুল উঁচু করতে করতে তৃষ্ণা নিজেও গাড়িতে গিয়ে বসল। বেলীর দিক থম মেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— আহ, এতো কষ্ট কেন করছি আমি ? তুলে নিয়ে বিয়েটা করে নিলেই হয়। বিয়েটা করে তারপর সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকলেও সমস্যা নেই। সকাল, দুপুর, রাত যখন অস্থির হব একদম…
বেলী কান চেপে ধরলো।
— আপনার অসভ্য কথা বার্তা বন্ধ করবেন।
— মেইন পার্ট মিস করে গেলি।
তৃষ্ণা গাড়ি স্টার্ট করলো। এবং ধীর আওয়াজে গান ধরলো,
— এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে, কেমন হতো তুমি বলোতো।
বেলী অবাক করে দিয়ে বলল,
— কেমন হতো?
— আমাদের কিছু বাচ্চা হতো।
বেলী আহত গলায় বলল,
— আপনার সাথে কথা নেই।
তৃষ্ণা হাসতে শুরু করলো। আর বেলী মুখ গোমড়া করে জানালা দিয়ে তাকালো। কি সুন্দর লাগছে। গাছগুলো প্রবল বৃষ্টির ছোঁয়ায় তাজা হয়ে উঠছে। হালকা বাতাস কী মনোরম পরিবেশ।
— কাঁচ-টা নামিয়ে দিননা।
তৃষ্ণা নামিয়ে দিলো অল্প কিছুটা। বাতাসের সাথে বৃষ্টি উড়ে আসছে। বেলী আপনমনে তাকিয়ে। কী ভালোই না লাগছে। কী সুন্দর। কী স্বচ্ছলতা। কী আবেদনময়ী।
কিছুটা রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছাতেই বাসে গড়া টঙ দেখা গেলো। বৃষ্টির কারণে আবছা একটু হুট খুলে দেওয়া। দোকানের ভিতর কিছু মানুষজন বসে সেটাও দেখা যাচ্ছে। তৃষ্ণা গাড়িটা থামালো,
— চা খাবি?
— এখন?
— বস, আমি নিয়ে আসি।
— না না, আপনি অনেকক্ষণ ধরে ভিজে। অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
তৃষ্ণা কানে নিলো না। সে চলল টঙের দিক। বেলী গাড়িটা দেখতে লাগলো। স্লো আওয়াজে সফট মিউজিক চলছে। ড্রিম্লাইট আলো। বাহিরে বৃষ্টি। হালকা বাতাস। উফ,
তৃষ্ণা ফিরল মিনিট খানিক পর। এসেই বসল এবং বেলীর হাতে চায়ের কাপ একটি ধরিয়ে দিলো। তৃষ্ণা খাচ্ছে আর নাক চুলকাচ্ছে। তার বৃষ্টিতে ভিজলেই নাক চুলকায়। এবং ঘন্টাখানেকের মাঝে গভীর এক ঠান্ডা লাগবে। যেখানে নাক একদম লাল থাকবে টানা চার-পাঁচ দিন। যার জন্য জয়া ছেলেকে একদম বৃষ্টিতে ভিজতে দিতেন না। যদি বাহিরে বৃষ্টি পড়তো আর তৃষ্ণা বাড়ির না থাকতো, তাহলে সেদিন সে তৃষ্ণাকে কসম দিয়ে ঝাঝরা বানিয়ে ফেলত ফোনে। অগ্যত তৃষ্ণা বৃষ্টিতে ভিজতে পারতো না। আজ তার সেলফোন বন্ধ। নাহলে এতক্ষণে জয়ার দশটা কল তো থাকতোই। বেলী আঁড়চোখে তাকাচ্ছে তৃষ্ণার দিক। চুল ঝাড়া দিয়ে তৃষ্ণা বেলীর দিক ফিরল।
— এমন আঁড়চোখে তাকানোর সভাব কবে যাবে?
বেলী শুনেও না শোনার মতো করে চা খেতে লাগলো। তৃষ্ণার আওয়াজ আবার পাওয়া গেলো,
— জানিস তো, মেয়েরা কিন্তু আমায় রেড-হ্যান্ড সিগনাল দেয়। একদম সামনাসামনি।
— তো যান। ধরলো কে।
— যাবো?
— আপনি জানেন ।
— থাক, তোর একটু খানি মনটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
অ্যান্ড আই ডোন্ট ওয়ান্ট দিস। বিক্যজ আই লাভ ইউ না।
বেলী চা-তে মাত্র এক চুমুক দিয়েছিল। তৃষ্ণার কথা শুনে কেশে উঠলো। মিনমিন গলায় বলল,
— খাচ্ছিলাম আমি।
চা খেয়ে কাপ দিয়ে এসে গাড়ি চলল আবার।
চলবে,
নাবিলা ইষ্ক