অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৪১|
বেলী তৃষ্ণার কাপড় ধুচ্ছে। পুকুর পারে। তৃষ্ণা হাফ প্যান্ট, হাতা কাটা গেঞ্জি, পায়ে স্লিপার পরে, হাতে তাওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে। সে মনোযোগ দিয়ে বেলীর কাপড় ধোয়া দেখছে। পুকুর পারের ওপর পাশ থেকে বেশ কিছু যুবতী এবং মহিলারা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিছু মহিলা তো চেঁচিয়ে জিজ্ঞেসও করলো,
–” কিরে বেলী, এইডা তোর জামাইডা নাকি? ”
বেলী শুধু লজ্জায় হালকা হাসলো। এবং আবার কাপড় ধুতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কাপড় ধুয়ে সেগুলো উঠানে ফ্রেস যায়গায় শোঁকাতে দিল। তারপর তৃষ্ণাকে বলল,
–” চলুন খাবেন। ”
তৃষ্ণা ভদ্র লোকের মতো বেলীর সাথে চলল। ঘরে প্রবেশ করতেই, খুশি তৃষ্ণা থেকে তাওয়াল নিল,
–” ভেজা এটা। শোঁকাতে দিতে হবে। তুমি যাও বাবা বেলীর সাথে। খাবার দিবে। আমি এখনই আসছি। ”
তারপর বেলীকে ইঙ্গিত করে বলল,
–” সারাদিন কিছু খাসনি। এখন একসাথে খেয়ে নে। ”
–” হ্যাঁ, হ্যাঁ খাব। ”
অগ্যত বেলী তৃষ্ণাকে নিয়ে চলল। দেখা গেলো তৃষ্ণার বড়বড় পায়ের ধাপে তার জুতো আঁটকে যাচ্ছে। তার জন্য বেলী এক দৌঁড় লাগাল। ভাত বাড়তে গিয়ে বেলী পড়লো বিপদে। তৃষ্ণা সমানে তার দিক এক ধ্যানে তাকিয়ে। হঠাৎ সে তৃষ্ণার আওয়াজ পেল,
–” কাপড় ধোয়া, কাপড় শোঁকাতে দেওয়া। ভাত খেতে দেওয়া৷ একদম নতুন বউ দেখাচ্ছে। ”
বলতে বলতে তৃষ্ণা দাঁড়ালো। তারপর বেলীকে সামনাসামনি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
–” তুই জানিস, আরও তিন-চার বছর আগে আমি এগুলোর স্বপ্ন দেখতাম। খাবার বেড়ে দিচ্ছিস, কাপড় ধুচ্ছিস। আমার অপেক্ষায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস। আর দেখ, আজ স্বপ্নগুলো বাস্তবতায়। একদম আমার সামনে ঘটছে। আমার বেলী বড় হয়েছে। সে এখন আমায় ভালবাসে, আমার জন্য কাঁদে-হাসে, আমার চিন্তা করে, সবচেয়ে বড় সে আমার অপেক্ষা করে। আমি কতটা ভাগ্যবান তাই না? ”
বেলীর কি হলো সে কেঁদে ফেলল। হু হু করে কাঁদতে সে তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। তৃষ্ণা হাসছে। সে হাসতে হাসতে বেলীর চুলে হাত বোলাচ্ছে। তারপর শক্ত করে বেলীর কপালে চুমু খেয়ে নিল।
–” বাচ্চাদের মতো এখনও কাঁদতে হয়?খাসনি কেন? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলি?”
–” না। ”
তৃষ্ণা হাসলো,
–” আচ্ছা? বোস। ”
বেলী বসলো। এবং তৃষ্ণার জন্য খাবার বেড়ে, নিজের জন্যও খাবার বাড়লো। এই লোকের চক্করে তার খাওয়াও হয়নি। দেখা গেলো বেলী দ্রুত খাচ্ছে আর ওপর পাশে তৃষ্ণা ধীরে ধীরে। খুশির জামাই আদর মনে হচ্ছে এক্সট্রা। সে একটু পরপর এসে জিজ্ঞেস করছে।
–” কিছু লাগবে বাবা? আরেকটু তরকারি?”
তৃষ্ণা শান্ত কন্ঠে বলল,
–” লাগবে না। আপনি খুব হার্ড ওয়ার্ক করেছেন আজ। এখন বরং গিয়ে রেস্ট নিন। বেলী আছে তো। ”
খুশি মনে হলো খুশিতে কেঁদে দিবে। সে বেলীকে বারবার বলে গেলো,
–” তরকারি দিস ঠিক ভাবে। ”
তৃষ্ণার কথা মতো ঠিকই খুশি বিশ্রাম নিতে চলে গেলো। খুশি যেতেই বাবলু আসলো। সে গিফট পেয়ে বেশ খুশি। নেচে-কুঁদে বারবার বেলীকে দেখাচ্ছে তো খুশিকে।
সন্ধ্যা’তেই চলে যেতে হয় তৃষ্ণাকে। সে পড়ন্ত কাপড় পরেই দ্রুত হাওলাদার বাড়ি ত্যাগ করে। বেলী হন্তদন্ত হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। অভিও বেরোতে বেরোতে জানাল, জয়া হার্ট-অ্যাটার্ক করেছে। হাওলাদার বাড়ির সবাই যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু অভি না করলো। বলল,
–” ঢাকা’য় পাঠানো হয়েছে। ”
বিমান অভির সাথে বেরোলো। বেলীও যেতে চাইছিল। কিন্তু অভির কথায় থেকে গেল। চিন্তায় বেলীর রাতে এক ফোঁটা ঘুমও হলোনা। সে অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তায় সারারাত জেগে। ফোলা লাল চোখ নিয়ে বেলী কল লাগালো বিমানকে। বিমান ও ফোন ধরছে না। তারপর সে আবিদকে কল লাগালো। আবিদের ফোন স্যুইচডওফ বলছে।
কোনো প্রকার ইনফরমেশন না পেয়ে, বেলী প্রায় চিন্তায় আধমরা। সকালে আনন্দ এসে জানাল,
–” অবস্থা বেশি ভালো না। ক্রিটিকাল সিচুয়েশনে। এখনও আইসিইউ তে। ”
বেলী পড়লো আরও চিন্তায়। সারাদিন অপেক্ষার পর আবারও কল করলো বিমানকে। এবার বিমান কল রিসিভ করে,
–” আপু? ”
–‘ হ্যাঁ বেলী? ”
–” এখন কেমন অবস্থা? ”
–” আলহামদুলিল্লাহ। দুশ্চিন্তা কেটেছে। কিন্তু কিছুদিনের জন্য তাকে হসপিটাইজড করা হয়েছে। ”
–” আলহামদুলিল্লাহ। ”
বেলী দাঁত কামড়ে। তার বারবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে তৃষ্ণার কথা। কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করতে হলো না। বিমান নিজেই বলল,
–“তৃষ্ণাকে হসপিটাল থেকে সরানো যায়নি। সেই কাল থেকে একই ভাবে বসে। না খাচ্ছে, না ঘুমাচ্ছে। ”
বেলী তীব্র কষ্ট আটকে বলল,
–” কথা বলা যাবে? ”
–” মনে হচ্ছে না। তৃষ্ণা একদম মূর্তির মতো বসে। সে তার আম্মুর সাথে কথা বলে নিক। তাহলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন হবে। ”
–” উম আচ্ছা। ”
ফোন কেটে বেলী বসে রইলো। সেদিনও তৃষ্ণার সাথে বেলীর কথা হলোনা। এতো মানুষ যাওয়া যাবেনা দেখে শুধু আনন্দ গেলো ঢাকা। বেলী অনেকবার বলল,
–” বাবা আমি যাব। ”
আনন্দের জবাব,
–” তাদের মানুষ দিয়ে হাসপাতাল ভর্তি। আরও নিলে কেমন দেখাবে? ”
বেলী আর কিছু বলল না। চিন্তায় সে নিজের ঘরে বসে রইলো। পাক্কা চারদিন বেলীর ভালো ঘুম হলো না। তার চোখের নিচ কালোয় পরিনত। খুশি প্রায় জোর করেই খাবার খাওয়াচ্ছে কয়দিন যাবত বেলীকে। এর মাঝে আবিদ ইনফরমেশন দিয়েছে যে, জয়া পুরোপুরি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত। বাড়িতে নিয়ে আসবে পরশু।
আনন্দকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। ঢাকা থেকে ফিরে সে ভালভাবে কথা বলছে না। খাবার খেতে বসে খুশি জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
–” হয়েছে কি? ”
আনন্দ কিছুক্ষণ সংকচ করলো। অগ্যত বলেই ফেলল,
–” তারা চাচ্ছেন বেলীকে কিছুদিনের মাঝে উঠিয়ে নিতে। ভাবী সুস্থ হয়েছে কিন্তু তার দুর্বলতা থেকে যাবে। যেহেতু হার্ট-অ্যাটার্ক। আগের মতো আর দৌঁড়াদৌঁড়ি বা অতিরিক্ত চিন্ত করতে পারবেন না। তাই, সে চাচ্ছে বেলীকে তুলে নিতে। ”
খুশি চুপ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ,
–” তুমি কি জবাব দিলে? ”
–” তিনি যেভাবে বললেন আমি না করতে পারিনি। ”
–” ও এখনও ছোট। পড়াশোনার কি হবে? ওখানে গেলে কি আর পড়াশোনা হবে? ”
–” আমি জানি। কিন্তু ওদের বিয়েটা হয়ে আছে। আর তৃষ্ণা সে অবশ্যই বেলীর সবকিছু নিয়ে খুব চিন্তা করে। এই কয় বছর আমার থেকে বেশি, ওই বেলীর হেফাজত করেছে তাইনা? আস্থা আছে, ও নিশ্চয়ই বেলীর খেয়াল রাখবে। ওর পড়াশোনার ও। ”
–” হুঁ। ”
খুশি নিজেও অমত করতে পারলো না। বিয়েটা হয়ে আছে। এটা তো অস্বীকার করার মতো না। এখন যেহেতু বেলীর শ্বশুর বাড়ি উঠাতে চাচ্ছে। তারা কিভাবে না করবে? তাও আবার এমন কঠিন অবস্থায়?
বেলী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবা-মায়ের কথপোকথন শুনে সে স্তব্ধ। কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে এলো। তার গলা শুঁকিয়ে আসছে। বুক ধরফর করছে। অদ্ভুত অনুভূতিতে বেলী জানালার সামনে বসে রইলো।
তৃষ্ণার কল এলো রাত আটটার দিক। বেলী ফোন নিয়েই বসেছিল। কল আসতেই রিসিভ করে ফেলল। সে তৃষ্ণার ক্লান্ত কন্ঠের স্বর শুনতে পেলো,
–” বেলী? ”
–” হুঁ। ”
–” বাড়ির পেছনে আয়। ”
বেলী কল কেঁটে দিল। দ্রুত ওড়না নিয়ে দরজার সামনে এসে থেমে গেল। খুশি দাঁড়িয়ে,
–” কোথায় যাচ্ছিস? ”
–” তৃষ্ণা ভাইয়া আসছে। ”
খুশি হাসলো,
–“তৃষ্ণা ভাইয়া? আজ বাদে কাল তুলে নিবে। এখনও ভাইয়া? বোকা মেয়ে। ”
বেলী মাথা নিচু করে রইলো। খুশি বলল,
–” আচ্ছা, যা। আর হ্যাঁ ঘরে নিয়ে আসিস। ”
–” হুঁ! ”
তৃষ্ণা আজ দাঁড়িয়ে না। বরং গাড়ির ভেতরে। বেলী সামনে যেতেই, পেছনের দরজা খুলে দিল ভেতর থেকে। ভিতরে বসে বেলী চুপ হয়ে রইলো। তৃষ্ণা হেলান দিয়ে চোখ বুঝে। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। বেলীর ইচ্ছে করলো তৃষ্ণার চুলগুলো ধরতে। নিজেকে আজ আর সংযত করলো না। ধীরে সে তৃষ্ণার হাতে হাত রাখলো। তৃষ্ণা তখনই চোখ খুলে বেলীর দিক তাকাল গভীর ভাবে। এবং পরক্ষণেই ঘুরে বেলীর কোলে মাথা রেখে, শুয়ে পড়লো গুটিসুটি মেরে। বেলীও ধীরে ধীরে তৃষ্ণার চুলে হাত বোলাতে লাগলো। কপালে স্লাইডও করছে। দেখা গেলো তৃষ্ণা ঘুমিয়ে পরতে পরতে বিরবির করলো,
–” আই মিসড ইউ বেলী। ”
বেলী এক পলকে তৃষ্ণার ক্লান্ত চেহরার দিক তাকিয়ে। ক্লান্ত চেহরায় ও লোকটাকে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। বেলী ধীরে তৃষ্ণার মুখে হাত ছোঁয়ালো। তারপর আবারও কপালে স্লাইড করতে লাগলো।
একই ভাবে বসে থাকতে থাকতে পা শক্ত হয়ে গেছে বেলীর। সে তিন ঘন্টা যাবত বসে। তৃষ্ণা এখনও মাথা রেখে ঘুমিয়ে। বেলীর একদম ইচ্ছে করছেনা তৃষ্ণাকে জাগাতে। আবার পা’ও আর সাথ দিচ্ছে না। বড্ড যন্ত্রনা করছে। এর মাঝে আবার তৃষ্ণার ফোন বেজেই যাচ্ছে। অতিমাত্রায় বাজছে। বেলী কয়েকবার নড়েচড়ে বসলো। তারপর তৃষ্ণার পকেট হতে, ফোন’টা ধীরে বের করে ফেলল। ফোন করছে আবিদ। বেলী রিসিভ করে ‘ হ্যাঁ ভাইয়া ‘ বলার আগেই থেমে গেলো। ওপর পাশ থেকে জয়ার কন্ঠ।
–” আব্বা? ”
বেলী ভয়ে চুপ হয়ে আছে। ওপর পাশে জয়া হয়তো বুঝতে পেরেছে,
–” বেলী? ”
–” আসসালামু আলাইকুম আন্টি, এখন কেমন আছেন? ”
–” আলহামদুলিল্লাহ আম্মু, সুস্থ অনেকটা। এখনও আন্টি? আমিতো এখন তোমার আম্মু। তাই না? ”
বেলী চুপ। জয়া আবারও বলল,
–” তৃষ কোথায়? ”
বেলীর ইনিয়েবিনিয়ে জবাব,
–” উমম ঘুমাচ্ছে। ”
–” তোমাদের বাড়িতে তো নাহলে। হয়তো গাড়িতে তাই না? ”
বেলী লজ্জায় লাল।
–” হ্যাঁ। ”
জয়া ছোট শ্বাস ফেলল।
–” আমার উপর এখনও রেগে। কিছুদিন যাবত খাচ্ছেও না ঘুমাচ্ছেও না। কসম দিয়ে যে খাওয়াবো তার ও উপায় নেই। ও উঠলে একটু কষ্ট করে, খাওয়া’তে পারবে? ”
–” আচ্ছা। ”
–” আমি আবিদকে দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছি, হুঁ?”
বেলী বলতেও পারলো না যে দরকার নেই। তাদের বাড়িতে রান্না আছে। তার আগেই জয়া কল কেঁটে দিয়েছে। কল কেঁটে বেলী আবারও তৃষ্ণাকে দেখতে লাগলো।
চলবে
নাবিলা ইষ্ক