অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৬
নিরিবিলি প্রাকৃতির ঠান্ডা আবহাওয়া। গাড়ির চলন্ত গতিতে ঠান্ডাটা বেশিই লাগছে। গাছগুলো নিমিষেই পিছনে হারিয়ে যাচ্ছে! ঠান্ডা হাওয়ায় আশপাশ নিশ্চুপ! শুধু স্তব্দ হয়ে আছে বেলী। বেলীর শরীরের পশম গুলোও দাঁড়িয়ে আছে! নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! বুক ধুকপুক করছে! হাত-পা ঝিমিয়ে আছে! চোখ গুলো বড়সড় হয়ে আছে। ! হঠাৎ, কি হলো তার সাথে মাথায় ঢুকছে না! ঘাড়ের বাম সাইডের রগের তিলটা হাত দিয়ে হাত চেপে রেখেছে! নিশ্বাস নিচ্ছে না দেখে, তৃষ্ণা গাড়ি থামালো,
— শ্বাস নে!
বেলী তৃষ্ণার দিক আঁড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত শ্বাস নিলো আর ফেলল! ঢোক গিলল লম্বা করে!
এখনো বেলীর হাত ঘাড়ে চেপে! সে আশেপাশে তাকাচ্ছে! তার হালকা মনে আছে! সে বলেছিলো…
— মিস করেছি!
আর দ্রুত গাড়ি থেমে গেলো! তৎক্ষণাৎ ঘাড়ের রগে গভীর ঠোঁটের স্পর্শ পেলো! এবং সেটা এতো দ্রুত ছিলো যে, বেলি এখনো বুঝছে না, ইমাজিনেশন ছিলো নাকি রিয়ালিটি! শরীর যে কাঁপছে সেটাও স্পষ্ট বোঝার মতো! হালকা ভেজা ভেজা উষ্ণতা এখনো ঘাড়ে ছুঁয়ে আছে! গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো! বেলি এখনো ঘোরের মাঝে আছে ! চোখ বন্ধ করতেই, তার সেই অনুভব আবার শরীরে ছুঁয়ে দিচ্ছে!
— মিস করেছিকি..?
বেলীর জবাব না পেয়ে তৃষ্ণা আবার বলে..
— জিজ্ঞেস করেছি কিছু ?
বেলী কাঁপা কাঁপা গলায় হালকা আওয়াজে বলল..
— গ…গলা কাঁ..কাঁপছে!
— কেনো?
— আ..আপ..আপনি,
তৃষ্ণা ভ্রু-উঁচু করে সামনে তাকিয়ে বলে..
— হ্যাঁ, আমি?
–বাড়ি যা..যাব আমি! গাড়ি ঘুরান!
মনে হলো গাড়ি আরেকটু দ্রুত ছুটতে লাগলো ! যেটার মানে ছিলো
‘ যেতে দেবে না ‘!
— প্লিজ, বাড়ি যাব আমি!
তৃষ্ণার জবাব না পেয়ে অসহায় হয়ে পড়লো বেলী।
এতোক্ষণ ভয়ে থাকলেও, এখন অন্য অনুভুতিতে বেলী ! শরীর কেঁপে উঠছে ভাবতেই, কিছুক্ষণ আগে তৃষ্ণার ঠোঁট ছিলো তার ঘাড়ে! এখনো তার হাত ঘাড়ে চেপে, মনে হচ্ছে, ঠোঁটের ছোঁয়া ঘাড়ে মিশে আছে! বারবার আঁড়চোখে তাকাচ্ছে তৃষ্ণার দিক, যিনি আপাতত ঠোঁটের নিচের অংশ দাঁত দিয়ে চেপে, কিছু একটা হয়তো ভাবছে!
গাড়ি বাগান বাড়ির রাস্তায় প্রবেশ করতেই, বেলী লাফিয়ে উঠলো! এটা তো চেয়ারম্যানদের বাগান বাড়ি! তার মানে তৃষ্ণাদের! আর এখানে নাকি, গেইটে দারোয়ান, বাগান পরিষ্কার রাখার মালি, বাড়ি পরিষ্কার রাখার বুয়া ছাড়া কেউ আসে না! এখানে কেনো এনেছে?
গেইটে বুড়ো বয়সী একজন দাদু টুলে বসে! চ্যাকচ্যাক সাদা রঙের লুঙ্গি, খুঁচিয়ে পড়ে আছে! ভাড়ি বড় হাতার একটি ছাই কালারের গেঞ্জি! হাতে বেশ বড়, চিকন লাঠি! মুখের সাদা দাড়ি গুলো চারপাশে লাল হয়ে আছে, পান চিবানোর কারণে! তৃষ্ণাকে দেখেই, সে বড় এক হাসি দিতে দিতে দরজা খুলে দিলো!
— পিচ্চি কেডা গো সাথে?
— বউ না।
বেলী বড়সড় চোখ করে তাকালো তৃষ্ণার দিক। দাদু আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
— ছোট প্রেমিকা?
এইবার তৃষ্ণা জবাব দিলো না। তাই প্রেমিকা ভেবে দাদু আবার বলল,
— ভালোভাবে খাওয়াবা। তাহলে সেই মানাবে। কি চিকন। কিরে মাইয়া খাস না?
তৃষ্ণা ইশারায় কিছু বলল ! দাদুটাও বেশ মাথা দুলালো! গাড়ি সাইড করে নেমে গেলো সে ! সেই দাদু আবার বলল,
— তা ঘুরতে গেলে সুন্দর যায়গায় না যাবা। ইহানে কি দেখাবা? নাকি রুম্যান্স করবা?
বেলী হা করে রইলো। তৃষ্ণা বলল,
— বুড়ো এতো বুঝতে কে বলেছে।
দাদু চোখ-মুখ উল্টিয়ে ফেলল! দুষ্টুমি হেসে বলল..
— এখনো ১০-১২ টা মেয়ে লাইন ধরে আছে! চুটকি দিলেই প্রেম!
— কল করবো নাকি দাদি কে?
— আরে না! ভাত দিবে না, আমায় বাড়িতে!
কথাটা বলেই দাদু হো, হো করে হেসে উঠলো! মাথা দুলাতে, দুলাতে গেইটের বাহিরে চলে গেলো! তৃষ্ণাকে আসতে দেখে বেলী সিটে, আরো ঘেষে বসলো! তার কিছুই ভালো লাগছে না!
— নামছিস না যে?
— আ..আমি বাড়ি যাব! নামবো না!
— কোলে নিবো?
তৃষ্ণার হাত তার দিক এগোতেই…
— নামছি তো!
দ্রুত নেমে গেলো বেলী!
এ-ই বাগান বাড়িতে বেলীর প্রথম পা রাখা! এভাবে মাঝে মাঝে অনেক কেই, নাকি ঘুরতে দেওয়া হয় এখানে! পার্মিশান নিতে হয় , নাহলে ঢুকা যাবে না! বলতেই হচ্ছে ‘ বাগান বাড়ি ‘, নামের মতো সুন্দর! চারপাশে ফুলের ছিটেফোঁটা অনেক! ঘাসে সাইড করে রাস্তা দেওয়া! বাড়িটার আশেপাশে লম্বা দুটো গাছ! পিছনে আরো গাছগাছালী! আর বেশ যায়গা নিয়ে বানানো হয়েছে! খোলামেলা প্রচুর অবশিষ্ট যায়গা! মন শান্ত করার মতো! ভাবনার মাঝে কখন তৃষ্ণা তার সামনে খেয়ালই করে নি বেলী ! দু’পা পিছনে নিতেই গাড়ির সাথে লেগে যায়! বেলীকে দু’পাশে হাত দিয়ে গাড়ির সাথে আঁটকে ফেলল তৃষ্ণা!
— এখন বল তোর সমস্যা কি? [ বেলীর চোখ নিচে! ] আমার দিক তাকিয়ে জবাব সে!
বেলী তাও আশেপাশে তাকিয়ে জবাব দিলো..
— আমা..র কি সমস্যা?
— প্রশ্ন করেছি সুন্দর ভাবে উত্তর দিবি! স্মার্টন্যাস দেখাতে আসলে খবর আছে! [ বেলির গাল চেপে ধরে নিজের দিক, মুখ উঁচু করে ধরে, ] তোকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম?
বেলীর চোখ তৃষ্ণার বুকের দিক! কিছু না বলায় তৃষ্ণা ধমক দিয়ে উঠে..
— আরেকবার বলতে হলে থাপ্পড় খাবি! [ বেলি মাথা ‘ হ্যাঁ ‘ বোধক দুলায়! ] ইউজ ইওর ওয়ার্ডস বেলী!
— হ…হ্যাঁ !
বেলীর দিক আরেকটু এগিয়ে ছুঁই-ছুঁই হয়ে দাঁড়িয়ে..
— আসিস নি কেনো?
— র..রান্না করছিলাম!
— রান্না করতেও জানিস.? আচ্ছা! যতোদিন ডেকেছি রান্না
করছিলি?
বেলী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়! একবার হ্যাঁ মাথা দুলায়, আরেকবার না! আঁড়চোখে তৃষ্ণার রাগী চেহারা দেখে, ভয় পেয়ে যায়! ফিসফিসানো আওয়াজে বলল..
–আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন!
— যখন শিলাকে বলেছিলি ‘ যাবনা কি করবে করতে বল গিয়ে ‘ তখন ভয় করেনি?
— উঁহু! আমি তো বলেছিলাম শুধু যাবনা! কি শাকচুন্নি মেয়েটা! মিথ্যে, মিথ্যে বলল!
— কেনো বলেছিলি?
বেলী একটু চুপ থাকে..
— এভাবেই..
–ঠিকঠাক উত্তর দে।
— আপনি..[ চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে! ] যাওয়ার সময় আমা..আমায় কিছু বলেছিলেন? যেদিন গেলেন সেই স..সকালে তো দেখা হয়েছিলো, তখনও তো ব..বলেন নি! অথচ, শ..শি..শিলাকে বলে গেলেন! তাহলে আপনি ডাকলে আমায় কেনো যে..যেতে হবে! আর আমায় কেনো ডাকবেন? শিলাকে ডাকেন!
এইবার তৃষ্ণা কিছুক্ষণ থমকে রইল। অস্ফুটে স্বরে হেসে উঠলো,
— আচ্ছা, আমি বলে যায় নি, তাই আসিস নি? অভিমান করেছিস.?
বেলী মাথা দুলালো! আবার মাথা নাড়ালো!
— বলে গেলে কি হতো?
— তাহলে কি আমি আপনায় খুঁজতাম?
কথাটা বলে বেলী দ্রুত মুখে দাত দিয়ে দিলো! বাঁকা হেসে বেলীর মুখের দিক এগিয়ে..
— কেনো খুঁজেছিলি.?
— আমি বাড়ি যাব!
— চুপচাপ সোজা হয়ে দাঁড়া !
তৃষ্ণার হাতটি বেলির ঘাড়ে ছুঁয়ে দিতেই, বেলি কেঁপে উঠলো! ছোটছোট চোখ করে, তৃষ্ণার দিক তাকালো! কিন্তু, তৃষ্ণার নজর তখনও বেলির ঘাড়ের তিলটির দিক! মুখ এগিয়ে নিতেই বেলী সরতে চায়! তৃষ্ণা তার হাত দুটো দিয়ে বেলির দু’হাত ধরে রাখে! তৃষ্ণার চুল আর খোচাখোচা দাড়ি গুলো বেলির থুতনির নিচে ছুঁয়ে দিচ্ছে! ঘাড়ে উষ্ণ নিশ্বাস পেতেই, বেলী চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে! তৃষ্ণার ঠোঁটের ঠান্ডা ছোঁয়া লাগতেই, বেলির নিশ্বাস আঁটকে যায়! নিজের হাতে থাকা তৃষ্ণার হাত শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেপে ধরে! শব্দ করে ছোট চুমু খায় তৃষ্ণা ! বেলী নড়ার চেষ্টা করলে, ঠোঁট দুটো আরো গভীর ভাবে স্পর্শ করে! তিলটির আশেপাশে আরো কিছু চুমু খায় ! বড় এক নিশ্বাস টেনে নেয় ! ঘাড়ে ঠোঁট ছুইয়েই হালকা আওয়াজে বলল…
— পাগল করে দিবি আমায়!
কথাটা বলেই তৃষ্ণা দ্রুত সেখান থেকে চলে যাচ্ছে ! এখনো নিশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে বেলি! জমিন কাঁপছে নাকি, বেলি নিজে কাঁপছে?
বাগান বাড়ির ভিতরটা আরো সুন্দর ! খুবি সৌখিনতা নিয়ে সাজানো! আলাদাভাবে রুম ডেকোরেশন করা! প্রত্যেকটি রুমের আলাদা সৌন্দর্য!
গেইটে থাকা দাদু নাস্তা এনে, টেবিলে সাজাচ্ছে!
ছোট-ছোট বাটি গুলো কি সুন্দর দেখতে! বাড়িটার সব সুন্দর বলতে হচ্ছে ! তৃষ্ণা সোফায় বসে মোবাইল টিপাচ্ছে! বেলি তৃষ্ণার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে! তার শরীরের কাঁপা-কাঁপি এখনও যায় নি! তৃষ্ণার দিক চোখ যেতেই, কেমন জেনো লাগছে তার! তাই চাইতেও তাকাচ্ছে না!
— কি গো পিচ্চি মনি, তুমি কি নিবা নাস্তায়? দাদু ভাই তো ভাজি-পরোটা খায়!
— আমি কিছু খাবো না দাদু!
দাদু খাবার বেরে চলে গেলো! তৃষ্ণা মোবাইল নিয়েই টেবিলে চেয়ার টেনে বসলো! বেলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ভ্রু-উঁচু করলো! বেলি দুলতে দুলতে তৃষ্ণার থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো..
— খাইয়ে দে!
— জ্বি.?
— খাইয়ে দিতে বললাম!
— আপনার হাত আছে না?
মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে বেলির দিক ফিরলো.!
— কি বললি?
— খাওয়াচ্ছি তো!
— গুড গার্ল। পাশের চেয়ারে বস!
— বসে কিভাবে? আপনার মাথা দেখেছেন কোথায়? বসে কি হাত যাবে?
— যাক, বুদ্ধি আছে তাহলে!
খাওয়াতে গিয়ে বেলী পড়লো আরেক বিপদে। আঙুল গুলো তৃষ্ণার ঠোঁটে চেপে থাকবেই। কামড় ও দিয়েছে, তা যে ইচ্ছে করে, সেটাও বুঝেছে বেলি! ঠোঁট ও পুছিয়ে দিতে হয়েছে! ঠোঁটে টাচ করতে গিয়ে, বেলী যে কি রকমের কেঁপেছে, তা ধারণার বাহিরে! তখন তৃষ্ণার চাহনিটাও ছিলো নেশাময়! অদ্ভুত ছিলো, ভয়ংকর অদ্ভুত!
খিদে লাগায় বেলিও তাড়াহুড়ো করে নুডলসের বাটি শেষ করে দিলো! ভাজা ডিমটা মুখে পুরে, তৃষ্ণার পিছু বাহিরে দৌঁড় দিলো! তৃষ্ণার পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়লো! গেইটে বসে থাকা দাদুকে সালাম দিলো! হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো ! দাদুও বেশ আওয়াজ করে বলল…
— আবার এসো!
বেলি মাথা দুলালো! সমস্যা হলো যখন গাড়ি সোজা যেতে শুরু করলো! তাদের বাড়ির রাস্তা তো পিছনে!
— আপনি তো উল্টো রাস্তায় যাচ্ছেন! বাড়ির রাস্তা তো..
— তুই আজ বাড়ি যাবি না!
বেলি খু, খু কেশে উঠলো! ভুল শুনেছে নিশ্চই!
— কিছু বললেন.?
তৃষ্ণা উত্তর দিলো না! বাঁকা হেসে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত!
— আল্লাহ! বাবা-মা চিন্তা করবে! আমায় মাড়বে! আপনি..শুনুন না! [ তৃষ্ণা নিজ মনে গাড়ি চালাচ্ছে ] কোথায় যাচ্ছি?
— তোর শশুর বাড়ি!
মুখ ওফ করে বেলি চুপচাপ পাশে তাকিয়ে! দুপুরের আজান অনেকক্ষণ আগে দিয়েছে! তৃষ্ণার হাতের ঘড়িতে দেখেছে ২ টা বেজে যাচ্ছে! এখনো গাড়ি চলছে! কোথায় যাচ্ছে এ-ই লোক? এটাতো কামারখালির রাস্তা! মাথায় এখনো তৃষ্ণার ঠোঁটের স্পর্শ ভাসছে! কেমন অনুভূতি ছিলো প্রকাশ করা অসম্ভব! নিজেকে ছাড়াতে ইচ্ছে করছিলো, তেমনি আবার তার সাথে লেগে থাকতে! অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি ছিলো! শরীর কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো!
কামারখালির দোকান গুলো রেখে গাড়ি যাচ্ছে! এখন আর জিজ্ঞেস করার সাহস নেই বেলির ! একটু আগে যে ধমক দিয়েছে! ধাক্কা দিয়ে নাকি ফেলে দেবে! খবিস, টবিস একটা!
চলবে…..
নাবিলা ইষ্ক