বধু বেশে বড় ভাবির হাতটা শক্ত করে ধরে আছে ধারা। বাড়ির বাইরের উঠান থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছে। এরমধ্যে কেউ চিল চিৎকার করে বলল,
‘ আপনার মেয়ের যে হাতে আঙুল নেই তা আপনি আমাদের আগে জানাননি কেন? আপনারা আমাদের ঠকিয়েছেন! এমন মেয়ের সঙ্গে আমরা কিছুতেই আমাদের বাড়ির ছেলের বিয়ে দিতে পারিনা। এমন মেয়ের ছোঁয়ায় শুভ কাজও অশুভ হয়ে যায়।’
এমন চিল চিৎকার শুনে বিয়ে বাড়ির শোরগোল আরো বেড়ে গেল। ধারা ভাবি ধারার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে সান্তনার সুরে বলল,
‘ তুই একদম চিন্তা করিস না আব্বাজান আর চাচা মিলে কোন না কোন একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে।’
ধারার চোখ ছলছল করছে। সেতো এত ছোট বয়সে বিয়ের জন্য রাজি ছিল না। ক্লাস এইট এর ছাত্রী সে। মাত্র দু মাস বাকি জেএসসি পরীক্ষার। লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল সে। কিন্তু গ্রামের মেয়েদের যে ডানা মেলে উড়তে নেই। এ কথা ধারা ভুলেই গিয়েছিলো। তার পায়ে শিকল পড়াবার জন্য তোর-জোরে আয়োজন করছিল তার পরিবারের লোকজন। আচমকা একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনে, সপ্তাহখানেক পরে তার বিয়ে, এ কয়দিন আর স্কুলে যাবার প্রয়োজন নেই তার। যদি লেখাপড়া করার ইচ্ছে থাকে তাহলে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি থেকেই লেখাপড়া করতে হবে তাকে। এসব শুনে টু শব্দটিও করেননি ধারা। সে তার আব্বাজান কে ভীষণ ভালোবাসে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনো কোনো কাজ করেনি সে। ধারা তার আব্বাজানের ইচ্ছেতেই বধু সেজে বিয়ের আসরে আসে। কিন্তু বিয়ের আসরে যে এমন ঘটনা ঘটবে তা আঁচ করতে পারেনি ধারা। ধারা ওর ভাবি জোনাকিরে দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ ভাবি আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাবে?’
জোনাকি কি বলবো ভেবে পায়না। বাইরে যে শোরগোল বেড়েই চলেছে। শাশুড়ি কে যে ডেকে নেবে তার ও সুযোগ নেই। শ্বাশুড়ি আম্মা এবং চাচি মিলে দাদি আম্মা কে সামলাচ্ছেন। ধারা তার খুব প্রিয় পাত্রী। ধারার কষ্ট তিনি কখনোই সইতে পারেন না। বরযাত্রী এমন যুক্তিহীন কথা শুনে তিনি ভেঙে পড়েন। জোনাকি ধারার দিকে তাকিয়ে ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আব্বাজান সামলে নেবেন, চিন্তা করিস না।”
ধারা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরে উপস্থিত সবার দৃষ্টি ধারার উপর। জোনাকি তাড়াতাড়ি করে ধারার হাত ধরে বলল,
‘ এত উতলা হোস নে ধারা।’
ঘরে উপস্থিত প্রতিবেশীরা ধারার নামে নিন্দে মন্দ বলা শুরু করে দেয়। ধারা এক নজর তাদের দিকে তাকিয়ে জোনাকির দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল,
‘ ভাবি তুমি বলছো উতলা হোস নে! বাইরে একঘর লোকের সামনে আমার ভাই বাপ-চাচারা অপমানিত হচ্ছে। সেখানে আমি বউ সেজে বসে থাকতে পারিনা।’
ধারা আর না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। ধারার পিছন পিছন জোনাকি ভাবিও খুব দ্রুত আসছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ির বাইরের পরিস্থিতি দেখে পা থেমে যায় ধারার। জোনাকি ধারা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধারার পিছন থেকে উঁকি দিয়ে বাড়ির উঠোনে তাকায়। ধারার আব্বাজান মাথা নিচু করে একটা চেয়ারে বসে আছে। চাচা আর ধারার বড় ভাই বরের বাবা কে বোঝানোর চেষ্টা করছে। ধারার ছোট ভাই অভি বরের হাত ধরে কাকুতি-মিনতি করছে। ধারা দুই পায়ে এগিয়ে যায় ওর ছোট ভাইয়া কি বলছে শোনার জন্য।
‘ মতিন ভাইয়া আপনার মতো শিক্ষিত ছেলের মুখে এমন কথা শোভা পায় না। মানছি আমার বোনের হাতে সমস্যা আছে। আপনারাতো কয়েকবার এসে ওকে দেখে গেছেন। তাহলে বিয়ের আসরে এমন কথার কী কোনো মানে হয়? আপনারা আপনাদের মত বলে দিলেন যে বিয়ে হবে না। একবার আমাদের কথা চিন্তা করলেন না!’
মতিন মিন মিন করে বলল,
‘ তোমার কথা মানলাম কিন্তু শরীরের অঙ্গে সমস্যা আছে এমন কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
অভি গোল গোল চোখ করে তাকায় মতিনের দিকে। এতক্ষণ যেন কোন নির্বোধ গাধা কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে ও। এত কিছু বোঝানোর পরও সেই একই কথাই আটকে আছে। অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তোমাকে এতক্ষণ ভাইয়া বলে সম্মোধন করেছি! কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে আমি এতক্ষণ ভুল করেছি। সে যাই হোক, আমার মতে তোমাকে বোঝানোর চেয়ে একটা ছাগল পুসা বুদ্ধিমানের কাজ। অন্তত ছাগলটা তোমার মত এতটা নির্বোধ হবে না।’
মতিন অভির দিকে চোখ গরম করে তাকায়। সাহস পায় কিভাবে এই ছেলের ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলার। কি যোগ্যতা আছে ও? গ্ৰামে কত নামডাক ওর, সবাই এক নামে চিনে ওদের পরিবারকে। সেখানে এই ছেলে কী না ওকে ‘ ছাগলের’ সঙ্গে তুলনা করেছে। মতিন খেঁক খেঁক করে বলল,
‘ তুমি কিন্তু তোমার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো অভি। এমন চললে কিন্তু আমি ভুলে যাবো…
মতিনের কথা শেষ হবার আগেই ধারা ওদের অনেকটা কাছে এসে বলল,
‘ ছোট ভাইয়া। তুই এখানে দাঁড়িয়ে শুধু শুধু কথা বলে সময় নষ্ট করছিস কেন?’
অভি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। বধু বেশে বোনটাকে যেন কোন হুর পরী লাগছে। এতক্ষণ তো বিয়ে বাড়ির ঝামেলার জন্য বোনটাকে দেখার সুযোগ হয়নি। বড্ড ভালোবাসে অভি ওর বোনকে। কিন্তু তা কখনো বোনের সামনে স্বীকার করে না অভি। বাড়িতে এই দুইজনের সম্পর্ক অনেকটা সাপ বেজির মতো। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলোনা। অভির ভাবনার সমাপ্তি ঘটে ধারার হাতের মৃদু ধাক্কায়। ধারা অভির হাত ধরে বলল,
‘ ভাইয়া চল এখান থেকে।’
অভি একনজর মতিনের দিকে তাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে তাকায়। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে এই মতিন নামক ছেলেটাকে। আবার কিছু ভেবে থেমে যায়। মেরুদণ্ডহীন প্রাণী সঙ্গে কথা বলার কোন মানে হয়না। অভি ধারার সামনে দাঁড়িয়ে ওদের ভাবি কে বলল,
‘ ভাবি তুমি ধারা নিয়ে বাড়ির ভিতরে যাও। আমরা এদিক সামলে নিবো।’
জোনাকি কিছু বলার আগে ধারা দূরত্ব বলল,
‘ কোথাও যাব না আমি এখন, আমি এখন আব্বাজানের কাছে যাবো।’
এইটুকু বলে ধারা ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ওর আব্বা জানেন চেয়ারের পাশে। ধারার চাচাজান মুখ কালো করে তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ধারা ছোট শ্বাস ফেলে বলল,
‘ আব্বাজান।’
রফিক দুলাল মাথা তুলে তাকায়। পাশে না তাকালেও বুঝতে পারে কণ্ঠ শুনে, এটা যে তার আদরের মেয়ে। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পাশে। ইয়া আল্লাহ কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। মেয়েটাকে এমন সাজে দেখার জন্যই তো চোখ জোড়া ব্যাকুল হয়েছিল তার। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পায়। তাকিয়ে দেখে ছোট ভাই শফিক। চোখের ইশারায় তাকে চোখের পানি মুছতে বলছে। শফিকের ইশারা বুঝে চোখে হাত দেয় রফিক দুলাল। চোখে পানি কখন পড়তে শুরু করেছে বুঝতে পারেননি তিনি। দ্রুত চোখ মুছে নেয় তিনি। চেহারা থেকে ওঠেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে আলত গলায় বলল,
‘ আম্মাজান আপনি এখানে?’
ধারা খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,
‘ আব্বাজান আমি এই বিয়ে করব না। তুমি…
আর একটা অক্ষর উচ্চারণ করার আগেই ধারার চোখ জোড়া তীব্রভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ধারা। রফিক দুলাল এগিয়ে এসে মেয়ে কে ধরার আগে ধারা তার আব্বাজানের পাঞ্জাবি খামছে ধরে নেতিয়ে পড়ে তার আব্বাজানের বুকে।
পড়ন্ত বিকেল বেলা, মিতা বেগম তার রুমের বেলকনি বসে তার পছন্দের একটা উপন্যাস পড়ছে। শরৎচন্দ্রের লেখা গৃহদাহ। অসম্ভব রকম সুন্দর উপন্যাসটা। যতবার পড়েন উপন্যাসটার মিতা বেগমের কখনো অনীহা আসেনা উপন্যাসটার প্রতি তার। তিন চার পৃষ্ঠা পড়ার পরে বেলকুনিতে কেউ হুড়মুড়িয়ে ঢুকে। মিতা বেগম উপন্যাসের পাতা উল্টিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ কিছু বলবি সালমা?’
সালমা তিন-চারবার জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে হাতে থাকা ফোনটা মিতা বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
‘ আপা বাবু আবার ভিডিও ছাড়ছে।’
মিতা বেগম উপন্যাসের পৃষ্ঠা ভাঁজ করে রেখে সালমার চোখ মুখের দিকে তাকায়। প্রতিবারের মত খুশিতে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। মিতা বেগম হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে ভিডিওটা দেখে বলল,
‘ আমার জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আসবি?’
সালমা মুখ গোমরা করে বলল,
‘ আপা বাবু এত কষ্ট করে ভিডিও বানায়। আপনি কোনদিন ওর ভিডিওর প্রশংসা করলেন না।’
মিতা বেগম সালমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
‘ চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দিতে ভুলিস না কিন্তু!’
এইটুকু বলে মিতা বেগম আবার উপন্যাসের পৃষ্ঠায় মন দেয়। সালমা অসহায় দৃষ্টিতে মিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলল,
‘ আপার মুখ থেকে প্রশংসা বের করার মত আর কষ্টের কাজ বোধহয় এই পৃথিবীতে নেই।’
সালমা একা একা বিড়বিড় করতে করতে বেলকনি থেকে চলে যায়। মিতা বেগম বই রেখে সালমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। মিতা বেগমের তিন ছেলে। বড় দুই ছেলের বিয়ে দিয়েছে কয়েক বছর হলো। দুজনেই আলাদা থাকে। মিতা বেগম অবশ্য এতে আপত্তি করেনি। তার মতে সবারই ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকতে পারে। তাই তিনি ছেলে কিংবা ছেলের বউকে জোর করে আটকে রাখেন নি। ছোট ছেলে জুনায়েদ ইভান। তাকে নিয়েই মিতা বেগমের যত স্বপ্ন। ইভান ইতালিতে থাকে। বর্তমানে ইভান ইউনিভার্সিটি অফ ট্রেন্টো (University of Trento)
ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছে। ইভান হলো মিতা বেগমের বাবু। ইভান সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন ভিডিও আপলোড করলে সালমা নিয়ম করে তাকে দেখাবে। তার মুখ থেকে প্রশংসা শোনার অপেক্ষায় বসে থাকবে। কিন্তু মিতা বেগমের বক্তব্য সব প্রশংসা মুখে করতে নেই কিছু প্রশংসা আচরণের মধ্যে বুঝে নিতে হয়। মিতা বেগম এখন দিন গুনছে কবে তার ছোট ছেলের লেখাপড়া শেষ করবে আর কবে তিনি তার ছোট ছেলের জন্য নিজের পছন্দ অনুযায়ী বৌমা নিয়ে আসবেন এই বাড়িতে।
চলবে….
#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#Writer_Sarjin_Islam [ সারজীন ]
#Part:1