#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৫|
দুপুরের কাঠফাটা রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে ধারা। হাঁটার মাঝে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কয়েকবার নিজের কপালের ঘাম মুছে নিয়েছে ধারা। ভ্যান চালক ধারার গতি অনুসরণ করে তার পিছন পিছন ধীরেসুস্থে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। ভ্যানচালক সেও গরমের দৌলতে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। তার গায়ের গামছা দিয়ে বারকয়েক ঘাম মুছেছে তিনি। ধারা আরও মিনিট তিনেক হাঁটার পরে পা থামায়। ধারা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে, ইশারায় রাস্তার পাশের বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এই বাড়িটা শাহেদা দাদিদের। আমি এখন যাই, শাহেদা দাদি আমাকে দেখলে আর ছাড়তে চাইবে না।’
ভদ্রমহিলা মৃদু স্বরে বলল,
‘ সে কী কথা, তুমি কষ্ট করে আমাদের এতদূর পৌঁছে দিলে। আর তুমি এখনি চলে যাবে! না না তা হয় না তুমি চলো আমাদের সাথে!’
ধারা তাড়াতাড়ি করে বলল,
‘ না না আমি এখন যেতে পারবো না। খুব দেরি হয়ে গেছে। আম্মা হয়তো চিন্তা করছে আমার জন্য। আমি আসি এখন।’
ভদ্রমহিলা হালকা হেসে বলল,
‘ তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমার বাড়ি এখান থেকে কতদূর?’
ধারা ধীর গলায় বলল,
‘ এখান থেকে ছয়টায় বাড়ি পরেই আমাদের বাড়ি। আমি আসি এখন। দেরি হয়ে যাচ্ছে যে আমার। ভালো থাকবেন আপনারা।’
এই কথাটুকু বলেন ধারা আর দাঁড়ায় না। ব্যস্ত পায়ে হাটতে শুরু করে। চোখের পলকে আঁকাবাঁকা পথে হারিয়ে যায় ধারা। ওদের কথার মাঝে ছেলেটা ভ্যান চালকের টাকা পরিশোধ করে। ভদ্রমহিলা তার পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ চল বাবু। বাড়ির ভেতরে।’
ছেলেটা মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে তার সাথে যায়।
ধারা দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে আজ তার। সূর্যমামা ডোবার আগে ধারার আব্বাজান আর আম্মা ধারার ভাবির বাড়িতে যাবে। ভাবির বাবাকে দেখতে। ধারার ও যাওয়ার ইচ্ছে আছে কিন্তু শরীরের ক্লান্তির জন্য আর যাওয়া হচ্ছে না। ধারা এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু ঘুম আর বেশিক্ষণ সইলোনা ধারার চোখে। ফোনের জোরালো শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে ধারা। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে ধারার। ইচ্ছে করছে এই প্রাণহীন ফোনটাকে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলতে। একটুও দয়া মায়া নেই ফোনটার মাঝে। কোথায় বেচারী একটু ঘুমিয়েছে সবে তাকে ঘুমানোর সুযোগ করে দিবে তা না করে আরো শব্দ করে তাঁর ঘুম ভাঙ্গাতে। বিড়বিড় করতে করতে বিছানা থেকে উঠে পড়ার টেবিলের কাছে যায় ধারা। জান্নাত ফোন করেছে। এক তো আর সাধে জাহান্নামের শয়তান বলে ডাকে না ধারা। সব সময় শুধু শয়তানি আর শয়তানি। বিগড়ে যাওয়ার মেজাজে ফোনে রিসিভ করে ধারা। কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে ধারা। ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠায় হয়ে জান্নাত বলল,
‘ জানু জানু জানু আমি কাল বিকেলে গ্রামে আসছি।’
ধারার ঠোঁটে হাসি ফোটে। তা প্রকাশ না করে বলল,
‘ এইটুকু কথা বলার জন্য তুই আমার কাঁচা ঘুম টা ভেঙ্গে দিয়েছিস?’
জান্নাত না জানার ভান করে বলল,
‘ তুই ঘুমিয়ে ছিলে বুঝি।’
ধারা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ না ফুটবল খেলছিলাম। খেলবি?’
জান্নাত হাসি আটকে রেখে বলল,
‘ না রে আমি তো ফুটবল খেলতে পারি না। ক্রিকেট হলে না হয় ভেবে দেখতাম।’
ধারা রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ তুই আমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে এখন আবার ফাজলামি করছিস?’
জান্নাত মৃদু স্বরে বলল,
‘ আরে না না, আমার কি আর সেই যোগ্যতা আছে আপনার মত মহা মুরুব্বীর সাথে ফাইজলামি করার! একবার চিন্তা করে দেখুন কোথায় আপনি আর কোথায় আমি! আমি একটা নির্বোধ শিশু!’
ধারা জান্নাতের কোথায় তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
‘ তুই নির্বোধ শিশু? চাচা চাচি ঠিক সময় তোকে বিয়ে দিলে তো এতদিনে হয়তো আমি খালামণি হয়েছে যেতাম।’
জান্নাত মুখ বাঁকা করে বলল,
‘ বলছে আপনাকে। যাইহোক শুনুন বাবার অফিসে একটা দরকারি কাজ পড়ে গেছে। মা বাবাকে একা ছাড়বে না তাই আমরাও কাল ফিরে আসছি। কখন এসে বুঝাবো কে খালামণি হবে আর কে মা?’
এইটুকু কথা বলে জান্নাত ফোন কেটে দেয়। ধারা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসে। বেশ মজা পেয়েছে সে জান্নাত কে খেপিয়ে দিয়ে। তার কাঁচা ঘুম ভাঙানোর শাস্তি স্বরূপ জান্নাত কে বেশ জব্দ করতে পেরেছে সে। ধারা ঠোঁটে হাসি নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়। এখন আর তার ঘুম আসবে না। শুধু শুধু শুয়ে থাকে সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয়না। ধীর পায়ে গিয়ে ধারা দাদি আম্মার ঘরের সামনে দাঁড়ায়। প্রথমেই চোখ যায় টেবিলের উপরে রাখা আচারের বৈয়ম এর দিকে। দুপুরবেলা কড়া রোদের সময় এগুলো উঠোনের রোদে দেওয়া ছিল। তখন শরীরের ক্লান্তির জন্য সেদিকে খেয়াল করতে পারিনি। কিন্তু এখন যে খুব লোভ হচ্ছে এগুলো খাওয়ার জন্য। উঁকি দিয়ে দেখে ধারা, দাদি আম্মা ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পা টিপে ঘরের ভিতরে ঢুকে। ডান-বাম একনজর তাকিয়ে পা টিপে পা টিপে টেবিলের কাছে যায়। তিন-চার রকমের আচারের বৈয়াম। কোনটা রেখে কোনটা নিবে ভাবতে শুরু করে ধারা। দাদি আম্মা হাতের আচার মানেইতো অমৃত। না আর বেশি ভাবা যাবে না। দাদি আম্মা একবার ঘুম থেকে উঠে পড়লে আর আচার খাওয়া হবে না ওর। সবার প্রথমে থাকা চালতার আচারের বৈয়াম হাতে তুলে দেয়। এক নজর তাঁকালো ঘুমন্ত দাদি আম্মার দিকে। আহ কি শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে। এদিকে যে তার স্বাদের চালতার আচার ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে সেদিকে তো আর কোন হুশ নেই। আগের বারের মত পা টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ধারা। উঠানের মাঝে এসে দাঁড়ায়। ডান হাতে আচারের বৈয়াম ধরে বাম হাত টা বুকে রেখে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ধারা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে পরিবেশ ঠান্ডা। ধারা আচারের বৈয়াম হাতে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে চলে যায় পুকুর পাড়ে।
ধারা ঠোঁট চেপে হাসছে। দাদি আম্মা সেই কখন থেকে তার চালতার আচারের বৈয়াম খুঁজে যাচ্ছে। কখনো এই ঘর তো কখনও সেই ঘর। কিন্তু তা কী আর খুঁজে পাবে দাদি আম্মা! সে আচার তো কখন শেষ হয়ে গেছে। পুকুর পাড়ে যে বাচ্চাগুলো খেলছিল তাদের নিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলেছে আচার। দাদি আম্মা প্রথমে বুঝতে পেরেছে আচারের বৈয়াম ধারা সরিয়েছে। কিন্তু ওর ঠোঁটে হাসি দেখে মিথ্যে বৈয়ম খোঁজার অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি। ধারা সামনে এসে হতাশার সুরে বলল,
‘ এত করে খুঁজলাম কোথায় পেলাম না বৈয়ম টা। মনে হয় গেছো বিড়ালের বৈয়ম টা নিয়ে গেছে।’
ধারা রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি কখনো গেছো বিড়াল দেখেছো? আর সত্য অনুসন্ধান না করে কাউকে কিছু বলা ঠিক নয়। এ কথা জানো না তুমি।’
দাদি আম্মা মৃদু স্বরে বলল,
‘ দেখছি তো। আমাদের বাড়িতে একটা আছে। একদিন সময় করে তোকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।’
ধারা ওর দাদি আম্মার কথা বুঝতে পেরে মুখ বেঁকিয়ে চলে যায় ওখান থেকে। দাদি আম্মা তা দেখে হেসে দেয়।
চলবে….