#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-২৭|
মাথায় এক হাত সমান ঘোমটা দিয়ে মিতা বেগমের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে ধারা। ধারার চেয়ারের পিছনে জোনাকি আর ধারার চাচি জান দাঁড়িয়ে আছে। মিতা বেগম ধারার আব্বাজানের সাথে কথা বলার ফাঁকে ধারা কে খতিয়ে দেখছে। শেষ বিকেলে রোদের আলোতে ধারার চোখের পাপড়িতে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি জ্বলজ্বল করছে। এ বিষয়ে অন্য কারো চোখে না পড়লেও মিতা বেগমের চোখে পড়েছে। আর ইভান সে তো ধারা কে দেখে দিশেহারা। তার শীতল চোখ দুটো অবস্থান করছে ধারা উপর। ধারা যদি একবার মাথা তুলে তাকাতো তাহলে দেখতে পেতে তার চোখ দুটো দেখার জন্য কেউ একজন ব্যাকুল হয় তাকিয়ে আছে। কিন্তু ধারা যে মাথা তুলে তাকাবে না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছে। এ বিষয়ে তার যখন মত নেওয়া হয়নি তাহলে ছেলের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে পছন্দ-অপছন্দ করার কোনো মানেই হয় না। মিতা বেগম কী জেনো ভেবে ধারার আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ভাইজান আমার কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।’
ধারার আব্বাজান ছোট করে বলল,
‘ হ্যাঁ, বলুন কী বলবেন আপনি?’
মিতা বেগম মৃদু স্বরে বলল,
‘ ভাইজান আপনার মেয়েকে আমার অনেক আগেই পছন্দ হয়েছে এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ধারা মা খুব মিষ্টি একটা মেয়ে, আমি চাই ধারা কে আমার ছেলের বউ করে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে। এবং আমি চাই আমার ছোট ছেলে ইভান এবং ধারা মায়ের বিয়েটা আজ সম্পন্ন করতে। এ বিষয়ে আপনার কী মতামত ভাইজান?’
মিতা বেগমের কথা শুনে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালো সবাই তার দিকে। আজ দেখতে এসেই বিয়ে? বিয়ের কথা শুনে ধারা ওর হাত শক্ত করে মুঠো করে নেয়। মাথা তুলে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও ওর আব্বাজান এর কথা ভেবে আবার চুপ হয়ে যায় ধারা। মিতা বেগম তাদের অবস্থা বুঝতে পেরে আবারো বলল,
‘ আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি আমার ছেলে বলে বলছি না, আমার ছোট ছেলে ইভানের মত ছেলে পাও বর্তমান সমাজের দুষ্কর।’
রুমি ধারার আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আঙ্কেল আপনি চিন্তা করবেন না ইভান সত্যি খুব ভালো ছেলে। আম্মু যখন আজ ওদের বিয়ের কথা বলছে নিশ্চয়ই ওদের ভালোর কথা কিছু ভেবেই আম্মু বলছে।’
কেউ কিছু বলার আগেই ধারার দাদি আম্মা বলল,
‘ আরে তোমরা এত চিন্তা করছো কেন বিয়ে হবে। দরকার পরলে আজ এক্ষুনি হবে।’
ধারার দাদি আম্মা কথা শুনে ধারার আব্বাজান তার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,
‘ আম্মা কী বলছো এসব তুমি? ধারা আমার একমাত্র মেয়ে, ওর বিয়ে আমি কখনো এভাবে দিতে চাই না। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী ধুমধাম করে ওর বিয়ে দেবো আমি। কিন্তু এইভাবে না।’
কথার মাঝে সম্রাট মিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আন্টি ইভান তো এখনো লেখাপড়া শেষ করেনি, ইভান লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াক তারপরে না হয় এই বিষয়ে কথা বলা যাবে।’
লাবিদ মৃদু স্বরে সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ইভান বর্তমানে পার্টটাইম জব করে যে টাকা উপার্জন করে তা বাংলাদেশ বেসরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপার্জন করে না। তাছাড়া আমাদের বিজনেসের প্রতিমাসের একটা লাভের অংশ ইভানের একাউন্টে চলে যায়। আর ইভান যদি একবার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যায় তখন আমরা দুই ভাই ছয় মাসে যে টাকা উপার্জন করবো তা হয়তো ইভান এক মাসে উপার্জন করবে।’
সবার কথা শুনে মিতা বেগম ধারার আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি শুধু বলেছি ওদের বিয়েটা আজ হয়ে যাক। কিন্তু আমি একবারও বলিনি ধারা কে আমি আমার ছেলের বউ বানিয়ে আজকেই আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। শুধু নাম মাত্র ওদের বিয়েটা হয়ে থাকবে। ধারা নিজের মতন লেখাপড়া করবে আর ইভান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করবে। তারপরে আমি শুভ একটা দিন দেখে ধারা কে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব পাকাপাকি ভাবে আমার ছেলের বউ করে। এবার বাকিটা আপনারাই ভেবে দেখুন। আপনার আমার কথায় রাজি আছেন কি না?’
ধারার আব্বাজান কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে বলল,
‘ আপনারা বসুন আমরা একটু আমাদের মধ্যে আলোচনা করে নেই। আর বৌমা তুমি আমার ধারা আম্মাজান কে ওর ঘরে নিয়ে যাও।’
জোনাকি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ধারা কে গিয়ে ধীরে সুস্থে চেয়ার থেকে তুলে ধীর পায়ে ধারার ঘরের দিকে নিয়ে যায়।
ধারার আব্বাজান মুখ গম্ভীর করে তার ঘরে বসে আছে। তিনি এখন এই মুহূর্তে কি সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। ধারা তার একমাত্র অতি আদরের মেয়ে। আর সেই মেয়ের জীবনের বিষয় তো আর হুট হাট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এই মুহূর্তে কি সিদ্ধান্ত নিবেন সেটা ভেবেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে ধারার আব্বাজান। ধারার আব্বাজানের এমন অস্থিরতা দেখে ধারার দাদি আম্মা বলল,
‘ আমি বলছি এত ভাবতে হবে না তোকে। তুই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যায়। এমন ছেলে তার উপর এত সুন্দর পরিবার আর কখনো নাও পেতে পারিস। তাই বলছি এই সুযোগ হাতছাড়া করিস না। আমার নাতনি সেখানে রাজরানী হয়ে থাকবে। আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনা। মিতার মত মেয়ে হয় না। অত বড় বাড়ির বউ হয়েও ওর ভিতরে কোন অহংকার দেমাগ নেই।’
ধারার আব্বাজান কিছু বলে না। চুপ করে কিছু ভাবতে থাকে। সম্রাট এগিয়ে এসে ওর আব্বাজানের পাশে বসে বলল,
‘ আব্বাজান তুমি তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নিও না। ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। ধারা শুধু তোমার মেয়ে নয়, এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে ও। তোমার এই সিদ্ধান্তে এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে জীবন জড়িয়ে আছে। তাই বলছি যে সিদ্ধান্ত নিবে হাজারবার ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে।’
ধারার চাচা জান মৃদু স্বরে বলল,
‘ ভাইজান আমি কিন্তু আম্মার সাথে এক মত। এমন ছেলে আমরা ধারার জন্য হয়তো ভবিষ্যতে নাও পেতে পারি। তাছাড়া ছেলের মা তো বলেছে ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে ঘটা করে অনুষ্ঠান করে ধারা কে তাদের বাড়ির বউ হিসেবে পাকাপাকি ভাবে নিয়ে যাবে। এখন বাকিটা তুমি ভেবে দেখো তুমি কি করবে? তুমি বাড়ির কর্তা, তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে।’
ইভান যখন থেকে ওর আম্মুর মুখে বিয়ের কথা শুনেছে তখন থেকে ওর ভিতর অস্থিরতা কাজ করছে। তার প্রিয় মানুষটিকে নিজের করে পাবার আকাঙ্ক্ষার। তীব্র আকাঙ্ক্ষা মনের জেঁকে বসেছে। মনে হচ্ছে ইভান খুশিতে দিশেহারা হয়ে যাবে। প্রচন্ড খুশি তে ইভান কি করবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কেমন অস্থির লাগছে ইভানের। এখন খুব করে তার ইচ্ছে করছে ধারার চোখ দুটো দেখতে। তার চোখ দুটো কি এখন লজ্জাবতী আকার ধারণ করেছে না কি রুদ্রাণী। ইভানের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে সেই দৃশ্য। কিন্তু নিষ্ঠুর ধারা যে ওর সেই ইচ্ছে পূরণ হতে দেবে না। সেই প্রথম থেকে উঠে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একদম মাথা নুইয়ে রেখেছে। ইভানের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বড় ভাইয়ারা, ভাবি, আম্মু, তার উপরে ধারার পরিবারের লোকজনের সামনে তো আরো লাজ লজ্জা ফেলে গিয়ে বলতে পারছে না, ‘ এই মেয়ে তুমি এত নিষ্ঠুর কেনো? সেই প্রথম দিন থেকে তুমি আমার দিকে এক নজরও তাকাওনি। আমি সেই কবে থেকে তোমার চোখের গভীরতা মাপার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছি। তুমি কী কখনো আমাকে বুঝবে না মেয়ে?’
চলবে….