#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-৩২|
ঘুমিয়ে রয়েছে ইভান। ঘুমের ঘোরে ও সে তার প্রিয়সি কে জাপটে জড়িয়ে ধরে আছে। রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে স্পষ্ট ভাবে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ইভানের চোখের ঘুম এসে হানা দিয়েছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বেশিক্ষণ সে আর তার প্রিয়সির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনি। ঘুমিয়ে পড়েছে ইভান। সারা রাত রুমের মধ্যে লাইট জ্বলছে। ইভান জ্বালিয়ে রাখছে লাইট। লাইট জালানো ছাড়া চাঁদনী রাতে আবছা অন্ধকারে সে তো তাঁর প্রিয়সির মুখ দেখতে পাবে না। কত দিকেই না খেয়াল তার। কতই না পাগলামি করেছে রাতভর জেগে। তার প্রিয়সি কে নিয়ে দিশেহারা ছিল রাতভর। রাত কাটিয়ে দিয়েছে তার প্রিয়সি কে দেখতে দেখতে। কিন্তু তার প্রিয়সি? আদৌ কী খবর জানেন? উঁহু, জানে না! তার প্রিয়সি যে সারা রাত নিষ্ঠুরের মত তার বুকে ঘুমিয়ে রাত পার করেছে।
ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায় ধারা। ঘুমের ঘোরে কানে তীব্রভাবে কিছুর শব্দ আসছে। ধুক! ধুক! নিবু নিবু চোখে বোঝার চেষ্টা করে ধারা। তবে এটুকু বুঝতে পারছে, তার মাথার নিচে শক্ত কিছু আছে, সেখানে সে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর সেই শক্ত জিনিসটার ভিতর দিয়ে ধুক! ধুক! শব্দ করছে। শুধু তাই নয় শক্ত জিনিসটা তার মাথা টা নিয়ে বারবার উঠা নামা করছে। এবার ধারা বেশ ভয় পায়। ভয়ে চোখ মুখ খিচে লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে। ডান হাত বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। নিজেকে শান্ত করে পিট পিটিয়ে চোখ খুলে তাকায়। তীব্র বিস্ময় চিহ্ন ধারার চোখে। তার সামনে, তার বিছানায় এক অচেনা যুবক শুয়ে আছে। তাহলে কি ধারা এতক্ষণ তার বুকে ঘুমিয়ে ছিল? না, না অসম্ভব, তা কী করে হয়। তাহলে, ঐ ধুক! ধুক! শব্দটা কীসের ছিল। নিশ্চয়ই এই যুবকের হৃদয় কম্পনের শব্দ। সারা রাত এক অচেনা যুবকের সাথে ছিল ধারা ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ধারার। অচেনা? অচেনা হতে যাবে কেনো? কাল রাতে না ওর বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে? তাহলে কি এই সেই ছেলে যার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে! হ্যাঁ এই সেই ছেলে, ওর বিয়ে করা বর। এই ছেলে যদি ওর বর না হতো তাহলে ওকে এমন জাপটে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর প্রশ্নেই উঠতো না। শুকনো গলায় ঢোক গিলে ছেলেটার দিকে তাকায়। কী সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে দেখো না। যেন পৃথিবীর সব মায়া তার মুখে ঢেলে দিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে উপর পড়ে আছে। ধারা লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠায় ইভানের গায়ের উপর থেকে লেপ খানিকটা সরে গেছে। তাতে তার গায়ে সাদা রঙের গেঞ্জি টা দেখা যাচ্ছে। কী নিদারুণ সুন্দর দেখতে তাঁকে। চোখ, গাল, নাক, কপাল, চুল, ঠোঁট সব কিছুই ভয়ঙ্কর রকম সুন্দর দেখতে। ইশ! ঠোঁট দুটো কী অসম্ভব লাল। ছেলেদের ঠোঁট কী এমন লাল হয়? ধারা সারা রাত একে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিল। ভেবেই লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে ধারা। না জানি তার এই বেহায়াপনার জন্য এই ছেলেটা তাকে কি না কি ভেবে বসে আছে। তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠতে যায় ধারা। কিন্তু মুহূর্তে বিধিবিড়ম্বনা পড়তে হয় তাকে। শাড়ির আঁচলটা এই ছেলেটার পিঠের নিচে পড়ে আছে। করুন চোখে শাড়ির আঁচলটা দিকে তাকায়। আঁচলটা কে তার সাথে এখন এমন বিরোধীতা করতে হলো। ধারা তার শাড়ির আঁচলটা কে মনে মনে বকাবকি করতে করতে ইভানের পিঠের নিচ থেকে খুব সাবধানে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে উঠে পড়ে। উফ, কী ভয়ানক পরিস্থিতি। আর একটু হলে সে দম বন্ধ হয়ে মরেই যেতো সে। সে কী কখনো এত কাছে কোনো ছেলের গেছে। উঁহু, কখনো না। বিছানা থেকে উঠে ঘরের পূর্ব দিকের জানালা খুলে ধারা। মুহূর্তেই ভোরের আলো এসে ঘরে ঢুকে। লাইটটা এখনো জ্বলছে। ধারা খাটের ওপাশ ঘুরে গিয়ে লাইট টা অফ করে। খাটের ওপাশে পড়ার টেবিলের চেয়ারে সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি রাখা। ওর ঘরে পাঞ্জাবি! তাহলে এই ছেলেটার ই হবে পাঞ্জাবি টা। ধারার ভাবনা ছেদ হয়। দরজায় করো কড়া নাড়ার শব্দে। ধারা এক নজর বিছানার দিকে তাকায়। কী সুন্দর বাচ্চাদের মত আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। ধারা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। জোনাকি দাঁড়িয়ে আছে। জোনাকি ধারা কে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে। ধারা তার দিকে তাকায়, ঠোঁটে তার দুষ্টুমির হাসি। জোনাকি ধারার হাত ধরে বলল,
‘ শাড়ি সামলে রাখতে শিখ। এখন আমার সামনে না পড়ে অন্য কারো সামনে পড়লে এখন তো লজ্জায় পড়তে হতো তোকে।’
জোনাকি কথা কিছু বুঝতে না পেরে ধারা অবাক চোখে তাকায়, তা দেখে জোনাকি আবারো বলল,
‘ বুঝতে পারছি না তাই তো, শাড়ির দিকে তাকা তাহলে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারবি!’
জোনাকির কথা শুনে ধারা শাড়ির দিকে তাকিয়ে। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে ধারার। শাড়ির আঁচল ঠিক থাকলেও শাড়ির কুচিগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ধারা তাড়াতাড়ি করে কুচিগুলো মুঠো করে নেয় হাতে। তা দেখে জোনাকি মৃদু হাসে। জোনাকির হাসি দেখে ধার লজ্জার আর মাথা তুলে তাকায় নি। জোনাকি হাসি থামিয়ে ঘরে উঁকি দিয়ে ধারা কে বলল,
‘ তোর বর টা কোথায়? ওহ, এখনো ঘুমাচ্ছে যে? কাল সারা রাত ঘুমোয় নি না কী?’
ধারা উত্তর দেয় না। এখনো মাথা নিচু করে এক হাতে কুচিগুলো ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জোনাকি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ কথা বলছিস না যে?’
ধারা মাথা নিচু রাখা অবস্থায় বলল,
‘ কী বলবো?’
জোনাকি হাসে! হেসে বলল,
‘ থাক, তোকে আর কিছু বলতে হবে না। গোসলখানায় গরম পানি রাখা আছে। এখন ঝটপট গিয়ে গোসল করে নে।’
ধারা মুখ তুলে তাকায়, ভাবি বলে কী, এই কনকনে শীতের সকালে তাকে গোসল করতে হবে? মাথাটা ঠিক আছে তো ভাবির? ধারা ওর ভাবির দিকে তাকিয়ে মোলায়েম বলল,
‘ কি বলছ ভাবি তুমি? এই কনকনে শীতের সকালে গোসল করব। তার থেকে বরং আমি না হয় একটু বেলা করে গোসল করে নেব।’
জোনাকি ধারার কথা শুনে মুচকি হাসে। মুচকি হাসি ঠোঁটে বজায় রেখে বলল,
‘ উঁহু, আজ বেলা করে গোসল করার দরকার নেই। আজকে বাড়িতে অনেক মেহমান আসবে তাই সময় পাবি না। এখনি সকাল সকাল গোসল করে নে।’
ধারা জোনাকির কথার আগামাথা কিছু না বুঝে মাথা ধীরে মাথা দুলালো। জোনাকি হেসে বলল,
‘ দ্রুত যা।’
এটুকু বলে জোনাকি আর দাঁড়ায় না দ্রুত পা বাড়ায় উঠানের দিকে।
শীতের সকালে গোসল করে আরেক ঝামেলা সম্মুখীন ধারা। এখন তাকে আবার শাড়ি পড়তে হবে। নির্দেশ দিয়েছেন তার আম্মা। সেই নির্দেশ অনুযায়ী জোনাকি ধারা কে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে নতুন শাড়ি পরিয়ে দেয়। টকটকে গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ানো হয়ে গেলে জোনাকি ধারা কে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগে। ধারার চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলল,
‘ মাশাল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে দেখতে তোকে ধারা। ইভান তো আজ তোর উপর থেকে চোখ ফিরাতে পারবে না। তা আমি হলফ করে বলতে পারি।’
ধারা আলতো আবার চোখে জোনাকির দিকে তাকায়। ইভান কে জানার জন্য! আর কেনই বা সে তার উপর থেকে চোখ ফিরাতে পারবে না। সে কি জানে না ধারা যে বিবাহিত? ধারা কৌতুহলী গলায় বলল,
‘ ইভান কে?’
ধারার প্রশ্ন শুনে জোনাকি হতবাক চোখে তাকায়। পরক্ষণে শব্দ করে হাসতে শুরু করে। ধারা জোনাকির দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বলল,
‘ আমি কি এমন জানতে চেয়েছি যার জন্য পাগলের মত এমন হাসছো কেনো?’
জোনাকি হাসি থামানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ আমি হাসছি তার কারণ আছে রে গাঁধী। তুই হয়তো পৃথিবীতে প্রথম বউ যে কিনা তার বাসর রাতের পরেও বরের নাম জানে না।’
এইটুকু বলে জোনাকি আবার হাসতে শুরু করে। ধারা এখন বেশ বুঝে গেছে তার ওমন সুন্দর দেখতে বর টার নাম ‘ইভান’। জোনাকি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে জোনাকি বলল,
‘ বেলা কত হলো সেদিন খেয়াল আছে, যা এবার গিয়ে ইভান কে ঘুম থেকে তুল। একটু পরে তো বাড়িতে মেহমান এর আনাগোনা শুরু হয়ে যাবে।’
এইটুকু বলতে না বলতেই ধারার চাচি জান জোনাকি কে ডাক দেয়। জোনাকি ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ যা তাড়াতাড়ি গিয়ে ইভান কে ঘুম থেকে তুল।’
এইটুকু বলে জোনাকি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ধারা একা একা বিড় বিড় করে বলল,
‘ ইভান!’
চলবে….